‘ফানা ফিল্লাহর পথে’
আত্মার শতভাগ পরিশুদ্ধি ছাড়া কোনো সাধনায় শতভাগ লক্ষ্য অর্জন সম্ভব হয় না। তাই সাধনায় প্রবৃত্ত হওয়ার আগে আত্মার পরিশুদ্ধি হওয়া আবশ্যক। আর আত্মশুদ্ধির কৌশল গুলাে জানা না থাকলে আত্ম যথাযথ পরিশুদ্ধি কঠিন হয়ে পড়ে। দুনিয়ায় যারা লক্ষ্য অনুযায়ী স্রষ্টার দর্শন লাভ করে জগৎখ্যাত হয়েছেন তারা সকলেই আত্মাকে পরিশুদ্ধ করেছেন কঠোর সাধনা বলে। পৃথিবীতে যারা আউলিয়ে কামেল হিসেবে খ্যাত হয়েছেন তাদের নেপথ্যে সাফল্য ইতিহাস পর্যালােচনা করলে এই বাস্তবতার সাক্ষাত পাওয়া যায়। মােটকথা আত্মশুদ্ধি ছাড়া সিদ্ধি লাভ অসম্ভব। যার কারণে লক্ষ্যর্জন করতে চাইলে প্রয়ােজনীয় কৌশল চর্চার মাধ্যমে আত্মাকে পরিশুদ্ধ করুতে হয়। এ বিষয়ে রচিত কৌশলগ্রন্থ গুলাের মধ্যে অন্যতম হচ্ছে ‘ফানা ফিল্লাহর পথে’। সফল আধ্যাত্মিক সাধক শাহসূফি হযরত মৌলভী আবুল খায়ের নক্শবন্ধি (রাহ:) রচিত গ্রন্থটি এ বিষয়ে একটি প্রামাণ্য নির্ভরযােগ্য গ্রন্থ হিসেবে সমজদার-সুধী সমাজে সমাদৃত হয়েছে।
‘ফানা ফিল্লাহর পথে’ গ্রন্থটির প্রণেতা শাহসূফী আবুল খায়ের (রাহ:) ছিলেন আল্লাহর স্বরূপে বিলীন একজন আধ্যাত্মিক সাধক । তিনি আত্ম বিলােপনের মাধ্যমে মহান আল্লাহর সান্নিধ্যে উপনীত হয়েছিলেন। তিনি পার্থিব জীবনের প্রতি নিরাসক্তির সাহায্যে মুক্তির পথ অনুসন্ধান করেন। তাঁর অনুসৃত এই পথই ‘ফানা ফিল্লাহর পথে’ হিসেবে চিহ্নিত। একমাত্র এই পথেই আল্লাহর স্বরূপে বিলীন হওয়া যায়। লাভ করা যায় জীবনের মূল লক্ষ্য। হযরত মৌলভী আবুল খায়ের (রাহ:) এর এই সাধনা পথ সকলের জন্য অনুসরণ ও অনুকরণীয় আদর্শ হয়ে আছে।
‘ফানা ফিল্লাহর পথে’ গ্রন্থটিতে জীবনের অর্থ আবিষ্কারের কথা এবং জীবনের গভীর জিজ্ঞাসার কথা আছে। এতে একজন সাধকের তন্ময়তা ও রহস্যের সন্ধান পাওয়া যায়। বইটিকে ৪টি অধ্যায়ে ভাগ করা হয়েছে। পর্বগুলাে হচ্ছে। । ১. কথামৃত পর্ব : হযরত আবুল খায়ের (রাহঃ) প্রশ্নোত্তর আকারে যে অমৃতবাণী লিখে গেছেন, তার সমষ্টিই কথামৃত পর্ব। এতে জীবনের বিভিন্ন জটিল প্রশ্নের জ্ঞানগর্ভ সমাধান রয়েছে। এই অধ্যায়ে চিত্তশুদ্ধির উপায়, মনস্থিরতার উপায়, জিতেন্দ্রীয় হওয়ার উপায়, রিপুজিৎ হওয়ার উপায়, সংসারের মায়ার বন্ধন হতে মুক্তি লাভের উপায়, সাধুর সংজ্ঞা, ধ্যান ও ভক্তি কাকে বলে, ব্যাকুলতা এবং এর বৈশিষ্ট্য, সাধুসঙ্গ, চিন্তাশীল তথা সগুরু আদিষ্ট মন, মহাপুরুষের সংজ্ঞা ও বৈশিষ্ট্য, মহাপুরুষের শিষ্য ও তার চারিত্রিক লক্ষণ, মৃত্যুর সংজ্ঞা ও মুক্তির সােপান, পরকাল, আত্ম – উন্নতি, আত্মজ্ঞান, সংসার, জাতিভেদ, ধর্ম-সংজ্ঞা , জন্ম রহস্য, বাক সংযম, আল্লাহ কি? ঐশী প্রেম কি, কবরের আজাব, বেহেস্ত-দোযকের ধারণা, জ্ঞানের সংজ্ঞা, জ্ঞানের প্রকার ভেদ ও জ্ঞান লাভের উপায়, ‘আমি’ সম্পর্কে দার্শনিক বিশ্লেষণ, ত্রিতাপ সম্পর্কে ধারণা, আগাম-বর্তমান সঞ্চিত কর্মফল বিশ্লেষণ, সংসারকে কবিগান ভবসাগর কেন বনে থাকেন, মায়া কাকে বলে, জন্মান্তর বাদ, ত্রিবেনী ও ত্রিধারা সম্পর্কে দার্শনিক ধারণা, শাস্ত্ৰ-দীক্ষা ও পাপ পূণ্য সম্পর্কে নিজস্ব দৃষ্টিভঙ্গির যৌক্তিক বিশ্লেষণ, ইবাদতের সময় ও স্থান সম্বন্ধে বিভিন্ন জটিল প্রশ্নের উত্তর, স্বপ্নের ধারণা ব্যাখ্যা, কাল ও পঞ্চকোষের ব্যাখ্যা, শয়তান এবং যমদূত নিয়ে নানা জটিল জিজ্ঞাসার দার্শনিক দৃষ্টিতে জবাব, দ্বীন সম্পর্কে ধারণা, দরবেশ ও আউলিয়া কেরাম গণের সাধনা, নামাজ রােজা হজ্ব যাকাত, শরীয়ত মারেফাত প্রভৃতি বিষয়ে নানা অন্তর্জিজ্ঞাসার দর্শন সিদ্ধ জবাব রয়েছে।
গ্রন্থটির দ্বিতীয়পর্ব হচ্ছে বাণী পর্ব এই অধ্যায়ে ২৭৮টি নির্দেশনামূলক বাণী রয়েছে। যেমন- ১. কূজন হতে নির্জনতা ভাল, নির্জনতা হইতে সজন অতি উত্তম। ২. সর্বজাতি ও সর্বজীবকে মিত্র ভাবনায় বিশ্বপ্রেম সৃষ্টি হয়। সেই প্রেমই নিষ্কাম প্রেম। ৩. জন্ম-জীবন-মৃত্যুর কারণ অনুসন্ধানী ব্যক্তিই জিজ্ঞাসু ভক্ত। জিজ্ঞাসু ভক্তই কালে জ্ঞানী হয়। ৪. কর্মই ধর্ম, আত্মকর্ম ব্যতীত প্রকৃত ধর্মের অনুসন্ধান পাওয়া যায় না। ৫. যাবতীয় ধর্মের মধ্যে মানবতাই প্রধান। ৬. সাধক আল্লাহর সংগে যােগ হইয়া যে আনন্দ লাভ করে তাহার কণামাত্রও ভুবনে নাই। তাহা অবর্ণনীয়। ছালেক বা সাধক ব্যতীত অন্য কেহ জানেনা, বুঝে না, দেখেও না। ৭. সমাজনীতি ও শাস্ত্রনীতির সম্পূর্ণ অধীন ব্যক্তির জ্ঞান লাভ করা সুকঠিন। কেননা জ্ঞানী হতে হইলে স্বাধীন বিবেক লইয়া চিন্তাশীল ও কারণদশী হইতে হয়। মুক্তির সহিত সত্যের মাধ্যমে জ্ঞানের সৃষ্টি হয়। ৮. অসীমকে ধারণা করা যায়না। ফোজের সসীম বৰ্জুক লইয়া সাধন করত : অসীমে লয় হইতে হয়। সেটা চূড়ান্ত মুক্তি । ৯. ধ্যান ছাড়া জ্ঞান হয় না। জ্ঞান ছাড়া মুক্তি নেই। ১০. জ্ঞান আগে শাস্ত্র পরে। জ্ঞান হইতে শাস্ত্রের সৃষ্টি। শাস্ত্র হইতে জ্ঞানের মূল্য অনেক বেশি। সুতরাং বিশুদ্ধ জ্ঞান লাভই মানুষের কাম্য। জ্ঞানী সংগ করিয়া জ্ঞানীর ইঙ্গিত অনুযায়ী মারফতের সাধন করিলেই বিশুদ্ধ জ্ঞান হয়, নচেৎ নয়। ১১. পুকুরের জল ও সাগরের জল মিশিলে সাগর জল ও পুকুরের জল আর পৃথক করা যায় না, একাকার হয়ে যায়। তদ্রুপ জীবের জীবাত্মা সাধন দ্বারা ধ্যান যােগে অসীম পরমাত্মার সহিত মিশিয়া গেলে, তখন জীবাত্মা এবং পরমাত্মা পৃথক থাকে না। একাকার হইয়া যায়। ইহার নাম ফানাফিল্লাহ। ১২. চিন্ত াশীল ও বিচারক প্রকৃত সাধকের জন্যে বিধি নিষেধের বিচার নাই। তাহার সাধন পথের অনুকূল বা সুবিধার জন্যে যাহা যাহা করিবার আবশ্যক, নির্বিচারে তাহা গ্রহণ করিয়া যাইবেন।
তৃতীয় অধ্যায়ে সন্নিবেশিত হয়েছে ফানা ফিল্লাহ পর্ব। এতে বদনে জিসমানী, বদনে বাদী, আলমে মাহছুছাত, আলমে মা’কুলাত, ফানাফিল্লাহ প্রভৃতি বিষয়ে দার্শনিক আলােচনা উপস্থাপিত হয়েছে। এই অধ্যায়ে ফানা ফিল্লাহর পথ নির্দেশনা হয়েছে অতি প্রাঞ্জল ভাষায়। তাঁর নির্দেশনা অনুসরণে কেউ সাধনা করলে সিদ্ধি লাভ কঠিন হবে না।
উক্তি পর্বে হযরত আবুল খায়ের (রাহ:) এর গুরুত্বপূর্ণ উক্তিগুলাের সন্নিবেশ ঘটানাে হয়েছে। যেমন – ১. যেবা ধরে জ্ঞানীর পাশ, তবে হয় আমি নাশ। ২. ভক্তি আছে যার, মুক্তি মিলে তার। ৩. সংসার ধর্ম পালন কর, সত্য গুরুর চরণ ধর। ৪. যে। নিবে আত্ম তত্ত্ব, লাভ করিবে অমরত্ব। ৫. ভাব যত জ্ঞান তত, একভাব অবিরত। ৬. জ্যোতি ছাড়া নাই মতি, সত্য ছাড়া নাই গতি। ৭. হিংসা, নিন্দা, লজ্জা, ভয়, চার থাকিতে সাধন নয়। ৮. জ্ঞান মিলে ধ্যানে, ধ্যান কর নির্জনে। ৯. ডুব না দিলে হৃদয় তলে, জ্ঞানের মানিক নাই মিলে। ১০. যেই পথে যেবা যায়, সবাই এক কেন্দ্র পায়। এভাবে অন্তমিল দিয়ে ছন্দে ছন্দে মােট ৬২৩টি উক্তি পাঠকের কাছে উপস্থাপন করা হয়েছে। আকারে ছােট হলেও এসব উক্তিতে রয়েছে বিশাল তত্ত্বজ্ঞানের এক বিশাল ভাণ্ডার। সৎ ও মুক্তি অন্বেষণকারী ব্যক্তিবর্গ এসব উক্তি থেকে খুঁজে পেতে পারেন এক অনন্য পথ নির্দেশনা।
‘অগ্নিশিখা ১ম ও ২য় খন্ড’
শাহসূফি হযরত আবুল খায়ের (রাহ:) ঐশী প্রেমের উপরে ভিত্তিশীল অনেক গীতিকবিতাও রচনা করেছেন। তাঁর গানের গাঁথুনি গভীর প্রকাশ ছিল এবং তাঁর রচিত প্রচলিত লােক সংগীতে নিজে সুরারােপ করে ছিলেন। আবার অনেক গানের সুর মােহনীয় আশ্রয় নিয়ে ছিলেন উচ্চাঙ্গ সংগীতের। যা গানের সংকলনে, সুর নির্দেশে এর উল্লেখ পাওয়া যায়। মাত্রাভিত, অক্ষরভিত ও সুরারােপিত ছন্দের তিন তালে। ভাটিয়ালী, বিচ্ছেদ বা কাউয়ালি এবং গজল ছন্দ বেঁধেছেন অনেক সংগীতে। বিভিন্ন রাগ -রাগিনীর উপর ভিত্তি করে রচিত এসব গানেও রয়েছে জীবনও জগতের গভীর জিজ্ঞাসা। এসব গীতিকবিতা নিঃসন্দেহে সন্ধিৎসু চিন্তাশীলদের নানা রহস্যময় প্রশ্নের জবাব পেতে সাহায্য করবে। একই সঙ্গে ফানাফিল্লাহর পথে গ্রন্থ ও দু’টি গীতিকবিতা গুলাে মানব চিন্তাকে শাণিত, পরিশীলিত ও গভীরতা দানে এক অনুপম পথ নির্দেশনা দেবে।
সংগত কারণে বােদ্ধা পাঠকরাই এই অমূল্য গ্রন্থ তিনটিকে সমাদর করবেন এবং তত্ত্বজ্ঞান আস্বাদন করে নিজের জ্ঞান পিপাসা নিবারণের চেষ্টা চালাবেন এমনটি আশা করা যায়। আলোচিত বইগুলো বাজারে পাওয়া না গেলেও বােয়ালখালীর খায়ের মঞ্জিল দরবার শরীফে পাওয়া যাবে।
লেখক- মো. তাজুল ইসলাম রাজু, সম্পাদক-আলোকিত বোয়ালখালী,
ছবি সহযোগিতায় শিল্পী– মোজাহের
আরো পড়ুনঃ
আধ্যাত্মিক মহাপুরুষ শাহসুফি মাওলানা আবুল খায়ের নক্সবন্দি (রহ.)
হযরতুলহাজ্ব শাহসুফি মৌলানা এম. কে ঈছা আহমেদ নকশবন্দি (রহ) ১৯তম ওরশ শরিফে শ্রদ্ধাঞ্জলী