জনাব মৌলানায়ে আকদছ শাহ চরণদ্বীপি (ক.) কেবলার পৌত্র শাহজাদা শেখ আবু মছহুদ মহিউদ্দিন আহমদ ফারুকী তাঁহার ‘প্রেমের সওগাত’ গ্রন্থে লিখিয়াছেন-
‘চরণদ্বীপ দরবার শরীফ’ (কবিতা)

– চয়ন করেছি ফুল স্বর্গীয় কাননে
নানারঙ্গে সুসজ্জিত আশ্চর্য দর্শনে।
সবুজ শোভায় ভরা প্রাকৃতিক শোভনা
বীথি তলে (ভূমন্ডলে) বিরাজিত স্বর্গের নমুনা।
শ্যামলা শোভনা দ্বীপ নিকুঞ্জ কাননী
প্রেমাসক্তা প্রেমাশ্রু সিক্তা কাজল নয়নী।
সবুজ বসনা রাণী (দ্বীপ) রত্ন প্রসু ললনা
তব পূণ্য ফলে জন্ম লভিল মৌলানা।
আনন্দে গাহিল বুলবুল বৃক্ষ ডালে
অপ্সরী কিন্নরী ঝলসে আকাশ কোলে।
সজীব হইল দ্বীপ গৌরব কানন
হাঁসিছে প্রকৃতি, আজি লভিয়ে চরণ।
আম, জাম, কাঁঠাল ও সুপারি বাগান
মাঝে মাঝে ধান্য ক্ষেত্র জুড়ায় নয়ন।
চারিদিকে নদীখাল মধ্যে এই দ্বীপ
ধনধান্যে পুষ্প ভরা নাম চরণদ্বীপ।

র- রহস্যে নিগূঢ় তব মহিলা অতুল
ফুটিয়াছে তব বক্ষে তৌহিদেরী ফুল।
সে ফুলেতে লিখা আছে ইসলামের মূল
‘লা এলাহা ইল্লাল্লাহু মোহাম্মদ রসূল।’
সে ফুলের সুবাস পেয়ে মত্ত অলিকুল
ঝাঁকে ঝাঁকে উড়ে পড়ে আশেক বুলবুল।

ন- (ণ) নয়ন সাফল্য হয় দর্শনে তোমার
চারিদিকে নদী খাল অপূর্ব বাহার।
স্বচ্ছ সলিল প্রবাহিত কর্ণফুলী নদী
স্নিগ্ধ পবিত্র সুপেয় (সলিল) চলে নিরবধি।

দ্বী- দ্বীন মনি (দিনমনি) উদয় যবে পূরব গগনে
টলমল পরিমল আশ্চর্য দর্শনে।
দেখিতে সুন্দর অতি সারিবদ্ধ পাহাড়
কেয়াম কউদে রত বিশ্বের দরবার।

প- পশ্চিম গগনে যবে দিনমনি চলে
অপূর্ব সুন্দর তোমায় দেখি কৌতুহলে।
ফলফুলে সুশোভিত গ্রাম চরণদ্বীপ
বর্ণিতে কি সাধ্য আছে দ্বীপের তারিফ।

দ- দয়াল বন্ধু কৃপাসিন্ধু নায়েব রসূল
মৌলানা শাহ্ চরণদ্বীপি মহিমা অতুল।
তোমারি জনমে ধন্য, ধন্য চরণদ্বীপ
চরণ পরশে তব হইল শরীফ।

র- রহিবে তোমার নাম এই নশ্বর ভবে
তপন বিমান দেশে যত দিন রবে।
পূর্ণমাসীর চন্দ্র যেমন নক্ষত্র বেষ্টিত
দ্বীপের তাপসগণ আছেন মণ্ডিত।

বা- বারিধারা রিমিঝিমি ঝড়ে বর্ষাদিনে
হুহু শব্দে মাতোয়ালা ছুটে নদীপানে।
দু’কুল প্লাবিয়া নদী চলে নিজ রঙ্গে
তোমার মহিমা গীতি গাহে প্রেম তরঙ্গে।

র- রবির কিরণ যেন তিমির বিনাশে
পীরে মোরশেদ হাদী তোমার প্রকাশে।
তোমার ফয়েজ কণা লভি জ্ঞানীগণ
প্রেম মদে মত্ত হইল যত সাধুগণ।
তুমি আমার প্রাণের রবি নয়ন মনি
জ্ঞানের সাগর তুমি অলি শিরোমনি।

শ- শরিয়ত, তরিকত, হাকিকত মূল
মা’রফতের সার দর্পণ মহিমা অতুল।
বিংশ শতাব্দীর মোজাদ্দেদ জমান
হযরত মৌলানা শাহ অছিয়র রহমান।
তব স্নেহ কোলে যতনে লভিলে মৌলানা
অনন্ত গৌরব দ্বীপ নাহি তব তুলনা।

রী- রীদওয়ানের স্বর্গোদ্যান সমতুল
ভূস্বর্গ কাশ্মীর সম গৌরব অতুল।
বোগদাদ, আজমীর যে গুণে শরীফ
সে গুণে গুণান্বিত চরণদ্বীপ শরীফ।

ফ- ফরিয়াদ করি প্রভু! দীনহীন ‘খুশী’
সুখ ও শান্তিতে রাখ এই দ্বীপ বাসী।
সরল ও সহজ পথে চালাও সবারে
তোমার হাবিব বিশ্ব নবীর খাতেরে।
তব অলিগণের প্রতি রাখ সুমতি
জানাই তাঁদের প্রতি ভক্তি শ্রদ্ধা নতি।

বাস্তবিকই হযরত মৌলানা শাহ চরণদ্বীপি (ক.) এর জন্মকল্যাণেই যেন দেশখানা সুধন্য এবং গৌরবান্বিত। অনুমিত হয়, তাঁহার ন্যায় মর্মবাদী যুগ প্রবর্তক হাদি অলিউল্লাহর আবির্ভাবে এবং তাহার চরণস্পর্শে দেশখানা ধন্য ও পবিত্রতা লাভ করিবে বলিয়াই অন্তর্যামী আল্লাহ তা’আলা তাঁহার আবির্ভাবের বহুকাল পূর্বেই যেন গ্রামটির চরণদ্বীপ নামকরণ করিয়া রাখিয়াছেন। ষোড়শ শতাব্দীতে এই চরণদ্বীপ গ্রামে আগত তাপস প্রবর শাহসুফি আলাউদ্দিন ফকির, শাহসুফি জামাল উদ্দিন ফকির (প্রকাশ জঙ্গলী পীর) এবং পার্শ্ববর্তী সৈয়দপুর গ্রামে শাহসুফি সৈয়দ মারুফ (রা.), শাহসুফি সৈয়দ কুতুব (রা.) প্রভৃতি শ্রেষ্ঠতম অলি দরবেশগণের সাধনা ক্ষেত্র খানকা চিল্লাহ ছিল, তাঁহারা সকলে যেন মৌলানায়ে আকদছ শাহ চরণদ্বীপি (ক.) এর শুভাগমন প্রতীক্ষায় ধরার বুকে আত্মগোপন করিয়া রহিয়াছেন। আজ যেন তাঁহার শুভাগমনে সকলেই জাগরিত হইয়া আনন্দ উৎসবে মাতিয়াছেন। মৌলানায় আকদছ শাহ চরণদ্বীপি (ক.) এর বংশের আদি পুরুষগণ মদিনার অধিবাসী (শেখ ফারুকী) হযরত ওমর ফারুক (রা.) এর বংশজাত। মুসলিম রাজত্বকালে তাঁহারা দিল্লীতে আগমন করেন। সেখান থেকে ঘটনাক্রমে বাংলার রাজধানী গৌড় নগরে আসিয়া বসতি স্থাপন করেন। তাঁহারা মদিনা হইতে আগত মদনী বংশানুক্রমে গৌড়াধিপতির অধীনে সুবেদার পদে উন্নীত ছিলেন। ষোড়শ শতাব্দীর মধ্যভাগে যখন মোগল মারির যুদ্ধে পাঠান রাজত্ব বাংলাতে ধ্বংসপ্রাপ্ত হয় এবং গৌড়নগর ভীষণ মহামারিতে জনশূন্য হইয়া পড়ে ও পরবর্তী সময় নদীর ভাঙ্গনে নগর পর্যন্ত বিলুপ্ত হইয়া যায়, সেই সময় গৌড়ের হতাবিশিষ্ট আমীর ফকির সমস্ত অধিবাসীই বিপর্যস্ত ভাবে দিকবিদিকে যাইয়া বসতি স্থাপন করেন। ১৫৭৫ সনে এই বংশের জনৈক পুরুষ শাহ শেখ মোহাম্মদ আলী নবী ফারুকী গৌড়ী সাতকানিয়া থানার মরফলা গ্রামে বসতি স্থাপন করেন। তৎপর তাঁহার দুই পুত্র শেখ মোহাম্মদ কুতুব উদ্দীন ফারুকী ও শেখ মোহাম্মদ আবদুল মোনাফ ফারুকী বোয়ালখালী থানার অন্তর্গত কর্ণফুলী নদীর দক্ষিণ তীরে চরণদ্বীপ গ্রামে আসিয়া বসতি স্থাপন করেন। শেখ মোহাম্মদ আবদুল মোনাফ ফারুকীর দুই পুত্রের মধ্যে শেখ মোহাম্মদ আফজল উদ্দিন ফারুকী সমধিক প্রসিদ্ধ ছিলেন। তাঁহার একমাত্র পুত্র মোহাম্মদ সফিউদ্দিন ফারুকী। তাঁহার দুই পুত্রের মধ্যে শেখ মোহাম্মদ মাজম ওরফে মাগন আলী মরহুম এই মহা সৌভাগ্যশালী পূণ্যবান পুরুষই মাওলানা আকদছ শাহ চরণদ্বীপি (ক.) ছাহেব কেবলার পিতা-

জনাব মৌলানায়ে আকদছ (ক.) এর শজরায়ে নছবী হযরত ওমর ফারুক (রা.) পর্যন্ত আরবী ভাষায় লিখিত ছিল। তাহা মাননীয় জনাব শাহজাদা মৌলানা শেখ আবুল বশর ফারুকী ছাহেবের নিকট আমি স্বচক্ষে দেখিয়াছি কিন্তু তাহাদের পুরানো অনেক দলিলপত্রের সঙ্গে এলোমেলো হইয়া যাওয়ায় তাহা আবশ্যক সময় খুঁজিয়া পাওয়া গেল না। এই জন্যই সংক্ষেপে বংশ পরিচয় লিখা হইল। মৌলানা আকদছ (ক.) এর পিতা অতিশয় ধর্মভীরু পরহেজগার এবং আদর্শবান পুরুষ ছিলেন। তদীয় সহধর্মিনী মোছাম্মৎ জয়নাব বিবি সতী সাধ্বী আদর্শ রমণী ছিলেন। এই পুত চরিত্রা রমণীই জনাব মৌলানা আকদছ শাহ চরণদ্বীপি (ক.) ছাহেব কেবলার পূণ্যবতী জননী। তিনি অত্যন্ত পতিপরায়ণা সতীসাধ্বী রমণী রত্না ছিলেন। নামায, রোযা, আদব কায়দার সহিত পতি সেবা ইত্যাদিই তাঁহার জীবনের নিত্যদিনের কর্মস্বরূপ ছিল। জরুরত ভিন্ন এবাদত বন্দেগীর জন্য ভুলেও কোনদিন আলস্য অনুভব করেন নাই।

মৌলানায়ে আকদছ শাহ চরণদ্বীপি (ক.) কেবলার জীবনী শরীফ থেকে সংগৃহিত

Print Friendly, PDF & Email

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here