মুফতি আবদুল হালীম

আল্লাহ রাব্বুল আলামিন মানুষের অনুভূতি জাগানোর জন্য পৃথিবীর সবকিছু বিপরীতমুখী করে সৃষ্টি করেছেন। শীত-গ্রীষ্ম, জান্নাত-জাহান্নাম, রাত-দিন, দুনিয়া-আখেরাত, আকাশ-জমিন, নারী-পুরুষ, জীবন-মরণ, ধনী-গরিব, হাসি-কান্না, আনন্দ-পেরেশানি, সুখ-দুঃখ, সুস্থতা-অসুস্থতা, আকর্ষণ-বিকর্ষণ_ সবই বিপরীতমুখী। পবিত্র কোরআনে এরশাদ হয়েছে, ‘সবকিছু আমি সৃষ্টি করেছি জোড়ায় জোড়ায়, হয়তো বা তোমরা উপদেশ গ্রহণ করবে।’ (সূরা জারিয়াত : ৪৯)।

কারণ কোনো কিছুর বিপরীত ছাড়া তার মান নির্ণয়, মূল্যায়ন ও কদর করা সম্ভব হয় না। পৃথিবীর সব পাথর যদি মণিমাণিক্য হতো তবে মণিমাণিক্য মূল্যহীন হয়ে যেত। সব রাত্রি শবেকদর হলে শবেকদর কদরহীন হয়ে পড়ত। কেউ সে রাতে ইবাদত-বন্দেগির জন্য আলাদা কোনো প্রস্তুতি নিত না। অতএব শীত-গ্রীষ্ম, ঠা-া-গরম মহান আল্লাহর অমোঘ নেয়ামত। রাতের পরে দিন আসছে, দিনের পরে রাত। শীতের পর গ্রীষ্ম, গ্রীষ্মের পর শীত। ‘শীতকালে রাতের কিছু অংশ দিনে প্রবিষ্ট হয়ে রাত ক্রমান্বয়ে ছোট হয়, দিন হয় বড়। তখন তাপমাত্রা বেড়ে যায়। আবার গ্রীষ্মে দিনের কিয়দাংশ রাতের অাঁধারে ঢুকে পড়ে। ফলে দিন ছোট হয়ে তাপমাত্রা কমতে থাকে।’ (সূরা লুকমান : ২৯)।

দিনের আলোয় আমরা জীবিকা তালাশ করি। রাতের নিদ্রায় ক্লান্ত দেহটা শক্তি সঞ্চার করে চাঙ্গা হয়ে যায়। অথচ কেউ কেউ অকৃতজ্ঞের মতো মনে করে এসব পালাবদল স্রেফ প্রাকৃতিক। এতে স্রষ্টার কোনো হাত নেই। অথচ খোদার এ কুদরতি পালাবদল যদি না থাকত আমরা অনুভূতিশক্তিই হারিয়ে ফেলতাম। এরশাদ হয়েছে, ‘নিশ্চয় আসমান-জমিনের সৃষ্টি এবং রাত-দিনের আবর্তনে নিদর্শন রয়েছে বোধসম্পন্ন লোকদের জন্য।’ (সূরা আলে ইমরান : ১৯০)।

শীতের মৌসুমে তাপমাত্রার নিম্নগতি, কনকনে শীত ও শৈত্যপ্রবাহ এবং গ্রীষ্মে তাপমাত্রার প্রচ-তা, ভ্যাপসা গরম ও তাপপ্রবাহ আসলে কোত্থেকে আসছে হাদিস শরিফে সুস্পষ্ট বলা হয়েছে। যাতে মানুষ তাদের ঈমান-আকিদা মজবুত রাখতে পারে। হজরত আবু হুরায়রা (রা.) বলেন, নবী করিম (সা.) বলেছেন, ‘সূর্যতাপ প্রচ- হলে জোহরের নামাজ কিছুটা শীতল আবহাওয়ায় বিলম্ব করে পড়ো। কেননা গ্রীষ্মের খরতাপ জাহান্নামের তাপপ্রবাহের কারণে হয়ে থাকে। দোজখ তার প্রভুর দরবারে অনুযোগ করল, হে আমার প্রতিপালক, অসহ্য তাপমাত্রার কারণে তো আমার এক অংশ অন্য অংশকে খেয়ে ফেলল। দয়াময় প্রভু তাকে দুইবার শ্বাস-প্রশ্বাসের অনুমতি দিলেন। গ্রীষ্মকালে একবার শ্বাস নিঃসরণ ও শীতকালে একবার শ্বাস গ্রহণ। ফলে গ্রীষ্মকালে তার শ্বাস ছাড়ার কারণে তোমরা প্রচ- উত্তাপ-উষ্ণতা অনুভব করো এবং শীতকালে তার নিঃশ্বাসের সঙ্গে লু হাওয়া টেনে নেয়ার কারণে কনকনে শীত অনুভব করো।’ (বোখারি : ৫১২; মুসলিম : ৬১৭)।

আরেকটি হাদিস হজরত আবু জর (রা.) বর্ণনা করেন, একবার গ্রীষ্মকালে নবীজি (সা.) এর মুয়াজ্জিন হজরত বেলাল (রা.) দুপুরবেলা আজান দিলেন। নবীজি (সা.) তাকে দুইবার বললেন, ‘আবহাওয়া কিছুটা শীতল হলে আজান দিয়ো। কেননা গ্রীষ্মের খরতাপ জাহান্নামের তাপপ্রবাহের কারণে হয়ে থাকে। অতএব পরিবেশ ঠা-া হলে নামাজ পড়ো।’ এরপর থেকে জমিনের ওপর রাখা বস্তুর ছায়া দেখে আমরা নামাজ পড়তাম। (বোখারি : ৫১১, মুসলিম : ৬১৬)।

এ কারণেই গ্রীষ্মকালে আবহাওয়া কিছুটা শীতল হলে জোহরের নামাজ পড়া মুসতাহাব। (হেদায়া : ৪০)।

অতএব ঈমানদারের জন্য প্রমাণিত হয়ে গেল গ্রীষ্মের খরতাপ জাহান্নামের উত্তাপ। সূর্যতাপের উৎস অগি্নময় নরক। পবিত্র কোরআনে দোজখের পাঁচটি নাম ও তিনটি স্তরের কথা বর্ণনা করা হয়েছে। যার সবই অগি্নগর্ভ এবং একটির তুলনায় অন্যটি তীব্র থেকে তীব্রতর উত্তপ্ত। ‘নার, জাহান্নাম, জাহিম, সাকার, সায়ির এবং গঈ, হাবিয়া ও হুতামা।’ এগুলোর কোনোটাই শীতল ও সহনীয় নয়। বরং এগুলোর বৈশিষ্ট্য হলো, ‘বিষাক্ত তপ্তবাষ্প, গরমপানি, আগ্নেয়গিরির ধূম্রকুঞ্জের ছায়া, অশীতল, অসদয়, অসহ্যকর।’ (সূরা ওয়াকিয়া : ৪২-৪৪)।

দোজখের তপ্তশ্বাস সূর্যকিরণের আকারে পৃথিবীর যেখানে যখন যত বেশি নিঃসরণ হয় সেখানে তত বেশি গ্রীষ্মের তাপমাত্রা বেড়ে যায়। তাপপ্রবাহ চলতে থাকে। আর যে অঞ্চল থেকে যত বেশি তাপমাত্রা জাহান্নাম টেনে নেয় সেখানে তত বেশি শীত ও শৈতপ্রবাহ বয়ে যায়। আবার যে দেশের তাপমাত্রা সে দেশের বাসিন্দাদের সার্বিক ব্যবস্থাপনার অনুকূল তাদের জন্য তা স্বাভাবিক। অনুকূল কোনো কিছুই আজাব নয়, বরং রহমত। প্রতিকূলই আজাব। মানবদেহের স্বাভাবিক তাপমাত্রা ৯৪ থেকে ৯৮.৪ ডিগ্রি ফারেনহাইট। যখনই কারও তাপমাত্রা স্বাভাবিকের কমবেশি হয় তখনই তা সর্দিজ্বরে পরিণত হয়।

Print Friendly, PDF & Email

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here