কাজী আয়েশা ফারজানা

৯০ বছরে মুক্তকেশী বালিকা বিদ্যালয়

এক নিভৃত অঞ্চলের নাম ছিল চট্টগ্রামের বোয়ালখালীর কানুনগোপাড়া গ্রাম। ওই গ্রামের প্রত্যন্ত জনপদের একটি পরিবার ‘দত্ত পরিবার’। দত্ত পরিবারের সাধক পুরুষ রসিক চন্দ্র। তাঁর সহধর্মিণী মুক্তকেশী দেবী দত্ত।

তখন ব্রিটিশ শাসিত উপমহাদেশ। সুজলা, সুফলা, শস্য শ্যামলা এ বাংলা বিদেশি শাসকদের অত্যাচারে জর্জরিত। এমন এক দুঃসময়ে মুক্তকেশী দেবী জম্ম দেন এগারো পুত্র ও চার কন্যা সন্তানের। তাঁর এগারো পুত্রের সবাই উচ্চশিক্ষিত হয়ে বিশ্ববিদ্যালয়ের সর্বোচ্চ ডিগ্রি অর্জন করেন। এগারো পুত্র তাঁদের কীর্তির জন্য বিখ্যাত হয়েছিলেন রত্নরূপে। মুক্তকেশীর ১১ সন্তানের খ্যাতি ছিল একাদশ রত্ন হিসেবে। তাই তৎকালীন ব্রিটিশ সরকার সফল জননী মুক্তকেশী দত্তকে ’রত্নগর্ভা’ উপাধি দিয়েছিলেন।

কিন্তু রত্নগর্ভা মুক্তকেশীর চার কন্যা মনোরমা দত্ত, চিন্ময় দত্ত, স্নেহলতা দত্ত ও সরোজ দত্ত শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের অভাবে প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষায় শিক্ষিত হতে পারেননি। তাদের সময়ে এই গ্রামীণ জনপদে নারী শিক্ষা ছিল সোনার হরিণ। তাই মুক্তকেশীর মনে ছিল নীরব বেদনা। নারী শিক্ষার প্রসারের জন্য শিক্ষা প্রতিষ্ঠান গড়ে তোলার স্বপ্ন বুকে লালন করতে থাকেন তিনি।

একসময় তাঁর সন্তানরা রত্নগর্ভা মুক্তকেশীর স্বপ্নের বাস্তব রূপ দেন। মায়ের ইচ্ছার সম্মান জানিয়ে গ্রামে পিছিয়ে থাকা নারী শিক্ষাকে প্রাতিষ্ঠানিক স্বীকৃতি দিতে নিজেদের বসতভিটের পাশে সর্বপ্রথম নারী শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান গড়ে তোলেন। ১৯২৮ সালে মুক্তকেশীর বড় ছেলে রেবতী রমণ দত্ত মায়ের নামে প্রতিষ্ঠা করেন ‘মুক্তকেশী বালিকা বিদ্যালয়’। রেবতী রমণ দত্ত ছিলেন সে সময় ব্রিটিশ সরকারের ডেপুটি ম্যাজিস্ট্রেট।

সময়ের বিবর্তনে রত্নগর্ভা ও একাদশ রত্নের কথা নতুন প্রজন্ম ভুলে যেতে বসলেও তাঁদের প্রতিষ্ঠিত মুক্তকেশী বালিকা বিদ্যালয়টি আজ শতবর্ষের দ্বারপ্রান্তে। এখনো নারীশিক্ষার উজ্জ্বল আলোকবর্তিকা হয়ে দাঁড়িয়ে আছে বোয়ালখালীর কানুনগোপাড়া গ্রামে তথা সমগ্র চট্টগ্রাম অঞ্চলে।

এ ছাড়া রত্নগর্ভা মুক্তকেশীর ১১ সন্তান জীবনে প্রতিষ্ঠা পাওয়ার পর গ্রামে অশিক্ষার অন্ধকার দূর করতে গড়ে তোলেন একাধিক শিক্ষা প্রতিষ্ঠান। রেবতী রমণ দত্ত ভ্রাতৃবৃন্দের প্রতিষ্ঠিত কানুনগোপাড়া স্যার আশুতোষ সরকারি কলেজ (১৯৩৯), তাঁদের অপর এক ভাই উপমহাদশের প্রখ্যাত গণিতবিদ ড. বিভূতিভূষণ দত্তর নামে প্রতিষ্ঠা করেন একটি বালক উচ্চ বিদ্যালয় (১৯২৪)। শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানগুলো এ অঞ্চলের মানুষদের স্মরণ করিয়ে দেয় দত্ত পরিবারের অবদান।

উল্লেখ্য, ড. রেবতী রমণ দত্ত সরকারের একজন প্রশাসনিক কর্মকর্তা ডেপুটি ম্যাজিস্ট্রেট (বর্তমান জেলা প্রশাসক) হিসেবে ব্রিটিশ বাংলার বিভিন্ন স্থানে দায়িত্ব পালন করেছেন। তিনি যখন যেখানে দায়িত্ব পালন করেছেন সেসব এলাকার নারী শিক্ষার জন্য কাজ করেছেন। প্রতিষ্ঠা করেছেন বিভিন্ন বিদ্যালয়।

চট্টগ্রাম শহর থেকে প্রায় ২২ কিলোমিটার উপজেলা সদর থেকে প্রায় ৮ কিলোমিটার দূরে বোয়ালখালী উপজেলার পূর্ব সীমায় আমুচিয়া ইউনিয়নের কানুনগোপাড়ার প্রত্যন্ত গ্রামে মুক্তকেশী বিদ্যালয়ের অবস্থান। দুপাশে ধান ক্ষেত, চলাচলের ইটের রাস্তা। কিছু দূর যেতে যেতে বেশ কয়েকটি বড় দিঘি। চারপাশে শান্ত পরিবেশ। রয়েছে শতবর্ষী বৃক্ষ। এর মধ্যে চোখে পড়বে ‘মুক্তকেশী বালিকা বিদ্যালয়’ লেখা হলুদ ও ছাই রঙের ভবন।

বিদ্যালয়ের ভেতরে ঢোকতে চোখে পড়বে মুক্তকেশী সরকারি প্রাথমিক ও উচ্চ বিদ্যালয়ের চারটি ভবন। তার মধ্যে একটি দ্বিতল ও তিনটি একতলা। রয়েছে ছোট্ট মাঠ।

একসময় মাটির গুদাম ঘরের কয়েকটি কক্ষ নিয়ে যাত্রা শুরু হওয়া এ বিদ্যালয় এখন কংক্রিটের ভবনে রূপান্তরিত হয়েছে। নিরুপমা চক্রবর্তী নামের প্রধান শিক্ষিকা দিয়ে শুরু হয় এ বিদ্যালয়ের প্রথম পাঠদান। ১৯৪৬ সালে প্রথম এ বিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীরা এসএসসিতে অংশ নেয়।

এ বিদ্যালয়ের ৪ একর ৫১ শতক জায়গা রয়েছে। তার মধ্যে ৯০ শতকে রয়েছে বিদ্যালয় ভবন। রয়েছে মাল্টিমিডিয়া কম্পিউটার ল্যাব ও বিভিন্ন দুর্লভ বই সমৃদ্ধ লাইব্রেরি, ভাষাগার। বিদ্যালয়ে এসএসসিতে পাসের হার ৮২ শতাংশ।

শুধু পড়ালেখায় নয় খেলাধুলা ও সংস্কৃতি চর্চায়ও এগিয়ে এ বিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীরা।

বিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীরা জানায়, বিদ্যালয়ের ভেতরে পড়ালেখার পরিবেশ ভালো। কিন্তু যোগাযোগ ব্যবস্থা অনুন্নত হওয়ায় দূর-দূরান্ত থেকে আসতে তাদের কষ্ট হয়। অনেকে সাইকেল চালিয়ে দুর্গম পথ পাড়ি দিয়ে বিদ্যালয়ে পড়তে আসে। তাই যোগাযোগ ব্যবস্থা আরো উন্নত করতে সরকারের সুদৃষ্টি কামনা করেছেন এখানকার নারী শিক্ষার্থীরা। সেই সঙ্গে ইভটিজিং ও বাল্যবিয়ে রোধে আরো বেশি সচেতনতা বাড়াতে প্রশাসনের প্রতি অনুরোধ জানান। এছাড়ও গেট ও সীমানা প্রাচীর না থাকায় অরক্ষিত রয়েছে বিদ্যালয়টি।

আমুচিয়া ইউনিয়নের চেয়ারম্যান বিদ্যালয় পরিচালনা কমিটির সভাপতি কাজল কুমার দে বলেন, ১৯৮৮ সাল থেকে তিনি জনপ্রতিনিধির দায়িত্ব পালন করে আসছেন। তার কন্যাসন্তান এ শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে পড়ালেখা করার সুবাদে তিনি এ বিদ্যালয় পরিচালনা কমিটির সঙ্গে সংযুক্ত হন। নারী শিক্ষার প্রসারের জন্য দেশের অনগ্রসর এলাকা চট্টগ্রামের বোয়ালখালীর কানুনগোপাড়া গ্রামে প্রতিষ্ঠিত হয় প্রথম বালিকা বিদ্যালয়। অজপাড়াগাঁয়ে এ শিক্ষা প্রতিষ্ঠান প্রতিষ্ঠার পেছনে রয়েছে এক মায়ের বেদনার ইতিহাস। ১৯২৮ সালে প্রতিষ্ঠিত এই বালিকা বিদ্যালয়টি ছিল সমগ্র চট্টগ্রাম জেলার গ্রামীণ এলাকার নারী সমাজের উচ্চশিক্ষার সর্বপ্রথম শিক্ষা প্রতিষ্ঠান।

সেই ইতিহাসের সাক্ষী হয়ে আজো নারী শিক্ষায় অবদান রেখে চলেছে  এ বিদ্যালয়। এ বিদ্যালয়কে সাফল্যের উচ্চ শিখরে পৌঁছাতে তিনি সচেষ্ট রয়েছেন বলে জানান।

বিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষক নূপুর কান্তি চৌধুরী বলেন, ‘এ ঐতিহ্যবাহী বিদ্যালয় মায়ের প্রতি ভালোবাসার বিরল দৃষ্টান্ত। সাফল্যের পাশাপাশি ছোটখাটো কিছু সমস্যাও রয়েছে।’

এটিকে একটি মডেল বিদ্যালয় হিসেবে গড়ে তোলার স্বপ্ন লালন করেন তিনি।

Print Friendly, PDF & Email

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here