সালমা বিনতে শফিক

কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে ইতিহাসে এমএ-র সনদ নিয়ে ১৯৬০ সালে বোয়ালখালীর কানুনগোপাড়ায় নিজভূমে ফিরে আসেন এক তরুণ, যখন তাঁর আত্মীয় পরিজনদের বেশীরভাগ মাতৃভূমি ছেড়ে পাড়ি জমাচ্ছিল পশ্চিমে। সেই সময়ের অতি সাধারণ বিষয়- পূর্ব ছেড়ে পশ্চিম অভিমুখে ছোটা। কারণ, পূর্বে তখন আশা ও নিরাপত্তার অভাব। সিরিল রেডক্লিফের পেন্সিলে আঁকা ভৌগোলিক সীমানা পূর্ব বাংলার সনাতন ধর্মাবলম্বীদের নিজভূমে পরবাসীতে পরিণত করে। পূর্ব পুরুষের শত বছরের পুরনো ঘর, ভিটে- মাটি সব ছেড়ে পাড়ি দেয় অনেকে অচিন এক দেশে। একইভাবে পশ্চিম থেকে সংখ্যালঘু মুসলমানরা ছুটে আসে পূর্বে। কানুনগোপাড়ার সেই তরুণ সেই দলে ভিড়েননি, সেই স্রোতে ভেসে যাননি। কোন ভয় তাঁকে টলাতে পারেনি, কোন বড় স্বপ্ন তাঁকে ছুটিয়ে নিতে পারেনি সেই আনন্দ নগরীতে। তিনি এই মাটির সন্তান। নাম তাঁর সুনীতি ভূষণ কানুনগো। চিরন্তন সঙ্গী তাঁর বই। আর কাগজ, কলম।
১ ফেব্রুয়ারি, ১৯৩৬। পুলিনবিহারী ও সুচারুপ্রভা কানুনগোর ঘরে জন্মগ্রহণ করেন সুনীতি। চট্টগ্রামের বোয়ালখালী উপজেলার কানুনগোপাড়া গ্রামেই কাটে তাঁর শৈশব ও কৈশোর। উচ্চশিক্ষার উদ্দেশ্যে কলকাতা গমন করেন কিশোর বয়সে। খুব বড় কোনো স্বপ্ন দেখেননি তিনি কোনদিন। কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়াশোনার পাট চুকিয়ে নিজ গ্রামে ফিরে গিয়ে থিতু হন নিজ গাঁয়ে, পিতৃপুরুষের ভিটায়। স্থানীয় মহাবিদ্যালয়ে (আশুতোষ কলেজ) যোগ দেন শিক্ষক হিসেবে। পিতৃব্য প্রখ্যাত ঐতিহাসিক, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অবসরপ্রাপ্ত অধ্যাপক কালিকারঞ্জন কানুনগোর নির্দেশনা ও আশীর্বাদ পেয়েছিলেন ডাকযোগে, পত্রমারফত। শিশুর মতো অনুসন্ধিৎসা আর থুকিডাইসের মতো বিশ্লেষণ করার ক্ষমতা নিয়ে চারপাশের জগত থেকে লেখার উপাদান খুঁজে নেওয়ার আদেশ দিয়েছিলেন তাঁকে ১৯৬২ সালে। জ্যাঠামনির কথা মাথায় তুলে নিয়ে পথ চলা শুরু করেন সুনীতি ভূষণ কানুনগো। পড়ার নেশায় চলে যান বড় গ্রন্থাগারে, ঢাকা শহরে।
লন্ডন থেকে দ্বিতীয় পিএইচডি শেষ করে সদ্য দেশে ফিরেছেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ইতিহাস বিভাগের রিডার ড. আবদুল করিম। তাঁর চোখ এড়ায় না তরুণ পাঠক গবেষক সুনীতির গতিবিধি- ‘সাহস তো কম না আপনার, কানুনগো পাড়ার মানুষ এসে কাজ করছেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের কেন্দ্রীয় গ্রন্থাগারে!’ তরুণ সুনীতিকে পাকড়াও করে নিয়ে যান ডঃ করিম। শিক্ষক বানিয়ে দেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের। এ-যেন মেঘ না চাইতে জল। দিনরাত পড়েন। পাঠদানের সময় হলে পড়ান। ঘর-সংসার হয়নি তখনও। পাকিস্তান জাতীয় পরিষদের সদস্যদের থাকার জন্য ফুলবাগানে ঘেরা সরকারি বাসভবনে তাঁর থাকার ব্যবস্থা হয়। প্রতিবেলা খাবার আসে জগন্নাথ হলের হেঁসেল থেকে। রীতিমত রাজকীয় কায়দায় জীবনযাপন। বলা বাহুল্য সব ব্যবস্থা করে দিয়েছিলেন ঐ একজনই, ড. করিম। ড. করিম নিজেও বোধ করি এতো আয়েশি ও বনেদি হালে সময় পার করেননি।
সেই দিনগুলি ছিল কানুনগোর জীবনের শ্রেষ্ঠ সময়। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে পাঠদানের পাশাপাশি ড. করিমের তত্ত্‌বাবধানে ও সাহচর্যে পিএইচডি অভিসন্দর্ভ রচনার কাজ চলছিল। ইতোমধ্যে চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠার বিশাল কর্মযজ্ঞে জড়িয়ে পড়েন ড. করিম। ১৯৬৬ সালে ইতিহাস বিভাগ তথা চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রতিষ্ঠালগ্নে প্রিয় শিষ্য কানুনগোকে নিয়ে আসেন সঙ্গে করে। বিশ্ববিদ্যালয়, এবং বিভাগের পাশাপাশি জাদুঘর প্রতিষ্ঠায়ও তিনি কাজ করে যাচ্ছিলেন দিনরাত। এতো ব্যস্ততার মাঝেও ভুলে থাকেননি শিষ্যের কথা। গুরু-শিষ্যের যৌথ খাটুনিতে একদিন শেষ হয় বহু প্রতিক্ষার সেই গ্রন্থ, A History of the Muslim rule in Chittagong। ড. করিমের হাতে গড়া যেমন প্রথম পিএইচডি, তেমনি চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠার পরও প্রথম পিএইচডি এই অভিসন্দর্ভ। প্রাণ দিয়েই কাজ করেছিলেন দুজনে। এই গ্রন্থ রচনায় কোনো অর্থের লেনদেন হয়নি। এই প্রসঙ্গে কানুনগো স্বয়ং বলেছেন, ‘গবেষণা কর্মের জন্য আমি কোনো বৃত্তি বা আর্থিক সাহায্য পাইনি, আর তত্ত্ববাবধায়ক হিসেবে প্রফেসর করিম কোনো পারিশ্রমিক পাননি, কিংবা কর্তৃপক্ষের নিকট দাবি করেননি।’ এমন নিঃস্বার্থ গবেষণার নজির আরও আছে কি না জানা যায় না।
ডিগ্রি তো হলো। এবার কাজ মিলবে কি করে? এবারও এগিয়ে এলেন ড. করিম। সদ্য প্রতিষ্ঠিত চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের ইতিহাস বিভাগেই নিজের সহকর্মী হিসেবে নিয়ে নেন ড. কানুনগোকে। ডিগ্রি হলো, অন্ন সংস্থানের সুব্যবস্থাও হল। এরপর পড়া আর পড়ানো। আর লেখা। চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের ইতিহাস বিভাগে পড়িয়েছেন ১৯৯৯ সালে অবসরে যাবার আগ পর্যন্ত। খণ্ডকালীন শিক্ষক হিসেবে পড়িয়েছেন লোক প্রশাসন ও রাজনীতি বিজ্ঞান বিভাগে। সেই আশুতোষ কলেজ থেকে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়, এরপর চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়। কর্মজীবনে পড়িয়েছেন শত শত শিক্ষার্থীকে। গ্রন্থাগারকে ঘর, আর ঘরকে পাঠশালা বানিয়ে কাটিয়ে দিয়েছেন এক জীবন। নিজের ভাগ্যকেই বিশ্বাস হয় না মাঝেমধ্যে।
পঁচিশ বছরের শিক্ষক জীবন এবং অবসর জীবন মিলিয়ে বই লিখেছেন ত্রিশটির বেশী, আর গবেষণা প্রবন্ধ দশেরও অধিক। প্রাচীন, মধ্য ও আধুনিক যুগের বাংলার রাজনৈতিক ও শাসনতান্ত্রিক ইতিহাস, বিপ্লব ও বিপ্লবীদের ইতিকথা, ধর্মতত্ত্ব ও দর্শনের জটিল সব বিষয়কে অত্যন্ত সাবলীল ভঙ্গিতে ব্যক্ত করেছেন বাংলা ও ইংরেজি দু’মাধ্যমেই। পাশাপাশি টিঊডোর, স্টুয়ার্ট ও হ্যানোভার রাজা রানী, ইংল্যান্ডের সাংবিধানিক অগ্রগতি ও গতিশীলতার গল্প বলেছেন তিনি সরল বাংলায়। ইংরেজি সাহিত্যের শিক্ষার্থীরা ইংরেজ জাতির ইতিহাসটা সহজে মাথায় ঢুকানোর জন্য এই বইয়ের আশ্রয় নেয়। অনেকে পাঠ্য বইয়ের মতো সঙ্গে রাখে। কাঁপা কাঁপা হাতে আজও লিখে চলছেন। দিন কাটে এখনও তাঁর বইয়ের পাহাড়ের পাশে। গ্রন্থাগারে যাওয়া হয় না আজকাল। শরীর সায় দেয় না। ঘর তাই এখন তাঁর গ্রন্থাগার। গৃহই দেবালয়।
সেই গৃহে একা তিনি। এই জগত সংসারে তিনি বড়ই একা। কারও পথ চেয়ে দিন গোনেন না। তাঁর অপেক্ষায়ও থাকে না কেউ। অর্ধশত বছরের জীবনসঙ্গিনী লীনা কানুনগো চলে যাবার পর গত হয়েছে প্রায় ছ’বছর। গিন্নির ব্যবহার্য সবকিছুতে ধুলোর পাহাড়। দেয়ালে ছবি হয়ে বসে সবই দেখতে পান তিনি। অন্য দেয়ালে ছবি হয়ে আছে কিশোর পুত্র, যে কোনদিন যুবক হবে না। চৌদ্দতে থেমে গেছে তাঁর জীবন ঘড়ি, কর্কট রোগের সঙ্গে যুদ্ধ করে। মায়ের পাশে ছোট পুত্র। বড় ভায়ের চেয়ে বড় এখন; ঘর বেঁধেছে সাত সমুদ্র তের নদীর পাড়ি দিয়ে আমেরিকান মুলুকে।
দেয়ালের তিনটি স্থিরচিত্র আর এক ঘর বই-ই এখন কানুনগো’র বড় আপন, একান্ত সঙ্গদাতা। না, আরও আছে কিছু পোকামাকড়। মা মাকড়সা ঘর বানিয়ে বংশ বিস্তার করে নির্বিবাদে। ছারপোকা, তেলাপোকারা সংসার পাতে নিশ্চিন্তে। পরিচ্ছন্নতা অভিযানের নামে কেউ ঘাঁটায় না ওদের। যে গৃহকর্মীটি দুপুরের আগে এসে রাঁধাবাড়া করে দিয়ে যায় সে-ও না। সবমিলিয়ে ঘণ্টা দুই অবস্থান করে সেই গৃহকর্মী। ঠুকঠাক টুংটাং শেষে ফিরে গেলে পাঁচ কামরার এই ঘরে নেমে আসে কবরের নিস্তব্ধতা। পরের দিন দুপুর পর্যন্ত বিশ কি বাইশটি ঘণ্টা এই ঘরে কথা বলে যায় একজনই, তাঁর কলম। হাতটা ধরে এলে আপনমনে বিড়বিড় করেন। কথা বলেন দেয়ালের ছবিদের সঙ্গে। এই ছবির মানুষরা একসময় তাঁর অস্তিত্বের অংশ ছিল।
নিজ গাঁয়ে হাসপাতাল বানানোর কাজে হাত দিয়েছিলেন শেষ উপার্জন দিয়ে, শেষ করা হয়নি। এই শহরে নিজের একটা ঘর নেই তাঁর। ভাড়া বাড়িতে জীবনযাপন করেছেন সরকারি মহাবিদ্যালয়ের শিক্ষক সহধর্মিণী আর পুত্রদের সঙ্গে নিয়ে। সবাই একে একে ছেড়ে চলে গেলেও ওদের স্মৃতি আর ছবি নিয়ে পড়ে আছেন সেই ঘরে।
কথা বলার মতো কেউ আজ নেই সুনীতি ভূষণ কানুনগোর। স্বল্পভাষী মানুষ ছিলেন চিরটাকাল। খুব বেশি বন্ধু বানাতে পারেননি জীবনে। গুণগ্রাহী নেই বললে চলে। পুরনো সহকর্মীরাও তেমন একটা আসে না। ছাত্র আসে দুএকজন কালেভদ্রে। যাওয়ার কোনো জায়গা নেই তাঁর। আত্মীয় পরিজন সব দেশ ছেড়েছে একে একে। ঘরের বাইরে যাবার মতো গায়ের জোর, পায়ের শক্তি কিছুই আর অবশিষ্ট নেই।
আজকাল এক কি দুই বইয়ের লেখককে সম্বর্ধনা দেওয়া হয়, বইয়ের মোড়ক উন্মোচন করা হয় জাঁকজমকের সঙ্গে, গণমাধ্যমে ব্যাপক গুরুত্বের সঙ্গে ছাপানো হয় ছবিসহ খবর, রাতারাতি খ্যাতিমান হয়ে যান কত লেখক! অথচ ত্রিশের অধিক মৌলিক গ্রন্থের লেখক হয়েও বন্দনা জোটে না তাঁর। উদযাপিত হয় না তাঁর জন্মদিবস। বড় মঞ্চে ডাকা হয় না তাঁকে। জাতীয় পুরস্কার ওঠে না তাঁর হাতে। কেউ বলে না তাঁর কথা। বইঘরে কেউ আসেনা তাঁর বই কিনতে। বাজারে আজকাল পাওয়াও যায় না সেইসব মূল্যবান গ্রন্থ। কেজো মানুষদের সময় কোথায় ঐসব ইতিহাস খুলে দেখবার?
সফলতা বিচারের মাপকাঠি যদি হয় বাড়ি- গাড়ি, বিত্তবৈভব কানুনগো স্যারকে তাহলে সফল বলা যাবে না। সত্যি বলতে কি, সুখ কিংবা সাফল্যের পেছনে ছোটেননি তিনি। কোনো স্বপ্ন বা আশা নয়, নেশায় পেয়েছিল তাঁকে। নিঃসঙ্গ তিরাশিতেও ছাড়েনি সেই নেশা।
চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের ইতিহাস বিভাগের অবসরপ্রাপ্ত অধ্যাপক ড. সুনীতি ভূষণ কানুনগো এমন এক নিবেদিতপ্রাণ ইতিহাসবিদ যিনি আক্ষরিক অর্থেই কোন উত্তরসূরি তৈরি করতে পারেননি; না পরিবারে না কর্মক্ষেত্রে। চল্লিশ বছরের বেশি সময় যাদের পড়িয়ে গেলেন, তাদের কেউও কী তাঁর উত্তরাধিকার হতে পেরেছেন? কেউ কি আদৌ হতে চেয়েছেন তাঁর উত্তরাধিকার? কখনও তারকা শিক্ষক ছিলেন না তিনি। তাঁর সঙ্গে থাকলে মোক্ষলাভের সম্ভাবনা থাকে না। জাগতিক প্রাপ্তিলাভের পথও খোলা থাকে না। আমাদের মতো কেজো মানুষরা কেন যাবে তাঁর দুয়ারে? কেনইবা গুণগান করবে এই নিভৃতচারীর? তাই বলে তাঁর সব কীর্তি কি মুছে যাবে? না। তাঁকে বাঁচিয়ে রাখবে তাঁর কাজ; তাঁর রচিত অমূল্য গ্রন্থসম্ভার।
আসছে পয়লা ফেব্‌রুয়ারি চুরাশিতে পা দেবেন চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের ইতিহাস বিভাগের অবসরপ্রাপ্ত অধ্যাপক ড. সুনীতি ভূষণ কানুনগো। তিনি কেবল শিক্ষক আর গবেষকই নন, তিনি এক সাধক। শতায়ু হন প্রিয় শিক্ষাগুরু।

-দৈনিক আজাদীর সৌজন্যে

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের স্বপ্নদ্রষ্টা এবং কিছু কথা

শাকপুরা শ্রী অরবিন্দ বিদ্যাপীঠের প্রতিষ্ঠাতা শ্রী নীরদ বরণ চৌধুরী

বাংলার পল্লী গীতিকা সংগ্রাহক, কবি, প্রাবন্ধিক, নাট্যকার আশুতোষ চৌধুরী

আমার জীবন

স্মরণ: আহমদ ছফা-যে নক্ষত্রের মৃত্যু নেই,আলো ছড়িয়ে যায় অনন্ত কাল

ইতিহাস গবেষক অধ্যাপক সুনীতিভূষণ কানুনগো

স্বামী বিদ্যারণ্য বিভূতিভূষণ দত্ত একজন গাণিতিক ইতিহাসবেত্তা ও সন্ন্যাসী

Print Friendly, PDF & Email

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here