বিজয় শংকর চৌধুরী

প্রধান শিক্ষক চট্টগ্রাম জেলার বােয়ালখালী উপজেলাধীন পশ্চিম শাকপুরা গ্রামের ধনাঢ্য ব্যক্তি প্রয়াত সারদা প্রসাদ চৌধুরী ও তাঁর সহধর্মিনী স্বৰ্গতা হিমাংশুবালা। চৌধুরীর প্রথম পুত্র শ্রী নীরদ বরণ চৌধুরী জন্মগ্রহণ করেন পশ্চিম শাকপুরা দেওয়ানজী বাড়ীতে ১৯১৩ সালে। প্রাথমিক শিক্ষা শুরু হয় পশ্চিম শাকপুরা প্রাথমিক বিদ্যালয়ে। মাধ্যমিক বিদ্যালয় এর পাঠ শুরু করেন পূর্বশাকপুরা পিসিমার বাড়ী (শ্ৰীচিন্ময় ঘােষ এর বাড়ী) তে থেকে শাকপুরা হাই স্কুলে। এরপর চট্টগ্রাম কলেজ থেকে আই, এ এবং বি, এ পাশ করেন। ঢাকা ট্রেনিং কলেজ থেকে বি.টি পাশ করেন।

শাকপুরা শ্রী অরবিন্দ বিদ্যাপীঠের প্রধান ফটক

এই প্রয়াত কৃতি পুরুষ ১৯৩১ ইংরেজী সালে প্রবেশিকা, ১৯৩৩ সালে আই, এ ১৯৩৫ সালে বি, এ এবং পরবর্তীতে বি, টি ডিগ্রী লাভ করেন। শিক্ষা জীবন সমাপ্তির পর থেকেই সমাজ সংস্কারের মত গুরু দায়িত্ব স্বেচ্ছায় নিজ কাঁধে তুলে নিয়েছিলেন তিনি। হাজারাে বাধা বিপত্তি, ঘাত প্রতিঘাতের মধ্য দিয়েই এই চেতনা ও প্রেরণাকে বাস্তবায়নের দৃঢ় প্রত্যয় নিয়ে এগিয়ে গিয়েছিলেন জীবনের শেষদিন পর্যন্ত। ত্যাগের উজ্জ্বল মহিমা ও আদর্শের প্রতি আনুগত্যতা প্রকাশের ফলশ্রুতি হিসাবে তিনি ব্রহ্মচর্য জীবনকে বেছে নিয়ে চিরকুমার ছিলেন। এই ধরণের সংযমী নিষ্ঠাবান জীবন সমাজ জীবনে সত্যিই বিরল-যা অনাগতদের সামনে যুগ যুগ ধরে উজ্জ্বল উদাহরণ হয়ে থাকবে।

সরকারী শিক্ষা দপ্তরে পদস্থ কর্মকর্তা, বিভিন্ন সময়ে বিভিন্ন শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে শিক্ষকতা ইত্যাদি সমাজ উন্নয়নমূলক কর্মকাণ্ডের মধ্য দিয়েই তার কর্মময় জীবনের পরিসমাপ্তি ঘটে। শ্রীঅরবিন্দ উচ্চ বালিকা বিদ্যাপীঠ প্রতিষ্ঠা ছাড়াও তিনি শ্রীঅরবিন্দ সরকারী প্রাথমিক বিদ্যালয়েরও প্রতিষ্ঠাতা ছিলেন। তাছাড়া পশ্চিম শাকপুরা সাধারণ পাঠাগার (পূর্বের নাম পশ্চিম শাকপুরা জিন্নাহ্ পাঠাগার)-এর জন্য জমিও তিনি দান করেছিলেন। শাকপুরা হাই স্কুলে পড়ার সময় তিনি প্রথমে শ্রীঅরবিন্দ সম্পর্কে কিছু লেখাপড়া করেন। শাকপুরা শ্রীঅরবিন্দ মাতৃমন্দির এর প্রতিষ্ঠাতা মােহিনী মােহন দত্ত এর বাড়ীতে গিয়ে শ্রীঅরবিন্দ এবং শ্রীমা সম্পর্কে জানেন।

বি. টি পাশ করার পর তিনি কিছুদিন কুতুবদিয়া হাইস্কুলে শিক্ষকতা করেন। কুতুবদিয়া দ্বীপে তাঁর পিতার অনেক জায়গা জমি ছিল। ঐ সময়ের দিকে তিনি পণ্ডিচেরী “শ্রীঅরবিন্দ আশ্রম”-এ চলে যান। তখন অবিভক্ত ভারত। আশ্রমে তিনি থেকে যেতে চেয়েছিলেন কিন্তু কিছুদিন থাকার পর নীরদবাবুর “মা” হিমাংশু বালা শ্রীঅরবিন্দ আশ্রমের “শ্রীমায়ের নিকট চিঠি লিখেন, ‘আমার ছেলে গ্রামে “শ্রীঅরবিন্দ” এর জন্য যদি কিছু করতে চায় তা করতে সাহায্য করব।’ তখন পণ্ডিচেরী শ্রীঅরবিন্দ আশ্রমে যেতে হলে শ্রীমায়ের অনুমতি নিয়ে যেতে হত। তখন নীরদ’কে শ্রীমা বললেন- তুমি গ্রামে চলে যাও। তােমার মা তােমার জন্য কান্নাকাটি করছে।

গ্রামে এসে ১৯৪৩ ইংরেজী সালে “শ্রীঅরবিন্দ বিদ্যাপীঠ” প্রতিষ্ঠা করেন। তিনি ছিলেন চিরকুমার। ১৯৪৯-৫০ ইং সালে পটিয়া গুরু ট্রেনিং স্কুলে শিক্ষকতা করেন (প্রাথমিক শিক্ষকদের ট্রেনিং সেন্টার)। ১৯৫১ সালে “হাতিয়ায়” সাব-ইন্সপেক্টার হিসাবে শিক্ষা ডিপার্টমেন্টে যােগ দেন। এরপর বেলুনিয়া বদলী হন। সর্বশেষ বৃহত্তর পার্বত্য চট্টগ্রাম জেলার সাব ইন্সপেক্টর হিসাবে যােগ দিয়ে অনেক বছর চাকুরী শেষে। ঐ জেলা থেকে ১৯৬৩ ইংরেজী সনে অবসর গ্রহণ করেন। সরকারী চাকুরী হতে অবসর গ্রহণের পর তিনি পশ্চিম শাকপুরা হাজী আজগর আলী হাই স্কুলের প্রতিষ্ঠাতা প্রধান শিক্ষক হিসাবে যােগ দেন। ১৯৭১ সালের স্বাধীনতা যুদ্ধের সময় রাজাকারদের অত্যাচারে বাড়ীতে থাকতে না পেরে তিনি ভারতে চলে যান। ভারতে রিফিউজী ক্যাম্পে থাকাকালীন “হরিনা” ক্যাম্পে রিফিউজীদের স্কুল পড়ুয়া সন্তানদের নিয়ে তিনি একটি স্কুল খােলেন। সে স্কুলে তাঁর ছােট বােন বনবীথি চৌধুরী, (এই বিদ্যাপীঠের প্রাক্তন প্রধান শিক্ষিকা) চন্দনা চৌধুরী এবং তার ভাইয়ের স্ত্রী মালতী চৌধুরীও শিক্ষকতা করেন। বাংলাদেশ স্বাধীন হওয়ার পর নিজ গ্রামে বাড়ীতে চলে আসেন। কিছুদিন পর হতে চট্টগ্রাম শহরের নিজ বাড়ী নন্দনকাননে বসবাস করতে থাকেন। ১৯৮৮ সালের ১৩ জুলাই বুধবার সকালে ঘুম থেকে উঠে প্রতিদিনের মত সকালে স্নান করে চণ্ডী পাঠ শেষে দৈনিক খবরের কাগজ পড়ার সময় হঠাৎ ৭-৩০ মিনিটে হৃদযন্ত্রের ক্রিয়া বন্ধ হয়ে ইহধাম ত্যাগ করেন।

Print Friendly, PDF & Email

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here