হজরত গাউসুল আযম মাইজভান্ডারী শাহসুফি সৈয়দ আহমদ উল্লাহ (ক.) এবং কুতুবুল আকতাব হযরত শেখ অছিয়র রহমান আল ফারুকী (ক.) অভিন্ন আধ্যাত্মিক অবয়বে অভিন্ন আধ্যাত্মিক সত্ত্বা
– মোঃ মাহবুব উল আলম

এক.
হযরত মাহবুবে রব্বানী খাজা নিজামউদ্দিন আউলিয়া (রঃ) ৬৯০ হিজরী সনের ২০ শে জমাদিউল আউয়াল তাঁর বক্তৃতা মজলিশে বলেন, “মাওলার নূর ও রহস্যের জন্য অদম্য আশা-আকাংখা থাকা উচিত, যাতে বন্ধুর রহস্য তাঁর ভিতরে স্থান করে নিতে পারে।… এ পথে এমন হতে হয় যে, শত শত রহস্যের নদী পান করলেও তাঁর আকাংখা পূরণ না হয় অর্থাৎ ‘হাল মিম্ মজিদ’ [রাহাতুল মুহিব্বীন]

হযরত মাহবুবে রব্বানী বর্ণিত এ আকাংখা ও তৃষ্ণার সাক্ষাৎ মিলে হযরত গাউসুল আযম মাইজভান্ডারী শাহসুফী সৈয়দ আহমদ উল্লাহ (কঃ) এর প্রথম খলিফা বা আধ্যাত্মিক উত্তরাধিকারী কুতুবুল আকতাব হযরত মাওলানা শাহসুফী শেখ অছিয়র রহমান আল-ফারুকী (কঃ) এর মধ্যে। হযরত গাউসুল আযম মাইজভান্ডারী (কঃ) বর্ণনাতীত কঠোর জ্ঞান সাধনা ও অধ্যাত্ম সাধনার মাধ্যমে মারিফাতের যে উচ্চ মকাম হাসিল করেছিলেন, তা বিস্ময়কর। একাডেমিক শিক্ষায় মেধা ও একাগ্রতার বলে তিনি যেমন সর্বদা শীর্ষস্থান দখল করতে সক্ষম হয়েছিলেন, তেমনি আধ্যাত্মিক জগতের অন্তহীন শিক্ষার ভূবনেও তিনি ছিলেন নিরলস কঠোর পরিশ্রমী সাধক। আধ্যাত্মিক জগতের পথ বড়ই কঠিন ও কষ্ট সাধ্য। মেধা ও পরিশ্রমযুক্ত একাগ্রসাধনা ব্যতীত এ লক্ষ্য অর্জন সম্ভব হয় না।

হজরত গাউসুলআযম মাইজভান্ডারী (কঃ) এই পথে কঠিন ও দুর্গম অভিযাত্রার কথা মনে রেখেই তাঁর খলিফা নির্বাচন করতেন। এখানে উল্লেখ করা অপ্রসাঙ্গিক হবেনা যে, তাঁর ফয়েজ প্রাপ্ত সকল খলিফা একাডেমিক শিক্ষা জগতে যেমন ছিলেন অত্যন্ত কৃতী ও মেধাবী, তেমনি অধ্যাত্ম সাধনার পথে সকল প্রকার কষ্ট-যাতনা-সংযম, সাধনা-ধৈর্য ও পরিশ্রমের আগুনে পোড়া খাঁটি সোনাও। মেধাবী, সংযমী পরীক্ষিত আগ্রহী ব্যক্তিদেরকেই তিনি তাঁর অধ্যাত্ম উত্তরাধিকারী মনোনীত করেছিলেন। উপযুক্ততাই ছিল তাঁর কাছে আধ্যাত্মিক উত্তরাধিকারী নির্বাচনের প্রধান মাপকাঠি, আত্মীয়তা কিংবা পারিবারিক নৈকট্য কিম্বা অন্য কোন বিষয় নয়। আধ্যাত্মিক সম্পদ এমন এক মূল্যবান সম্পদ, যা বৈষয়িক সম্পদের মতো যেনতেন ভাবে হস্তান্তর করা যায় না।

॥ ২ ॥

হযরত শেখ অছিয়র রহমান আল-ফারুকী চরণদ্বীপি (কঃ) সম্পর্কে হযরত গাউসুল আযম মাইজভান্ডারীর (কঃ) সর্বজন জ্ঞাত একাধিক উক্তির মধ্যে নিহিত তাঁকে (চরণদ্বীপি) তদীয় প্রথম আধ্যাত্মিক উত্তরাধিকারী নির্বাচনের যৌক্তিকতা। হজরত গাউসুল আযম মাইজভান্ডারীর (কঃ) কাছে গিয়েছিলেন মাওলানা শাহ চরণদ্বীপির জ্যেষ্ঠ ভ্রাতা হযরত শাহ ছুফী আলীমউল্লাহ। তিনি গিয়েছিলেন তাঁর কনিষ্ঠ ভ্রাতা হযরত শাহসুফি শেখ অছিয়র রহমান আল-ফারুকীর (রঃ) কঠোর রেয়াজত ও জজবাতি অবস্থা সন্দর্শনে ব্যাকুল ও উদ্বিগ্ন হয়ে। রিয়াজত ও সাধনার মাত্রা কী পরিমাণ কঠোর হলে অগ্রজ উৎকণ্ঠিত হয়ে পড়তে পারেন, তার প্রমাণ এ তথ্যে বিধৃত। উদ্বিগ্ন ভ্রাতার আকুলতার জবাবে হযরত গাউসুল আযম মাইজভান্ডারী (কঃ) বলেন, “মিঞা! আমার এই ছেলেটি আমার বাগানের গোলে গোলাব’ তৌহিদ পতাকাধারী রহমানিয়া শানে বিরাজমান। তাঁর প্রেম-পিয়াসা এতো প্রবল হয়েছে যে, তাঁকে সোরাহী সোরাহী শারাব পান করাচ্ছি। তবুও তৃপ্তি হয়না। শারাবের পাত্র শুদ্ধ খেতে চায়। আপনি আমার ছেলেটির জন্য চিন্তা করবেন না।”

হযরত গাউসুল আযম মাইজভান্ডারীর (কঃ) এই উক্তির মধ্যে দুটো সত্য প্রকাশ পেয়েছে। একটা হচ্ছে, হযরত শেখ অছিয়র রহমান আল-ফারুকীর (রঃ) রূহানী তৃষ্ণার প্রচণ্ডতা ও ব্যাপকতা। অপরটা হচ্ছে, আধ্যাত্মিক অনুসারীকে ‘সন্তানবৎ’ জ্ঞান করা। এই উপযুক্ত সন্তানরাই আধ্যাত্মিক উত্তরাধিকার লাভে ধন্য হন।

হজরত গাউসুল আযম মাইজভান্ডারী (কঃ) আরো বলেন, (চান্দগাঁও নিবাসী মৌলভী ওবায়দুল হক শাহকে) “আমি তাঁকে (হজরত শেখ অছিয়র রহমান শাহকে) হযরত আবু বকর ছিদ্দিকের (রঃ) আসনে পেয়েছি। আল্লাহতায়ালা তাঁকে হযরত আলীর (রঃ) গুপ্ত জ্ঞান দান করেছেন। আমি তাঁকে আমার চিন্তাধারার সূক্ষ্ম তত্ত্ব জ্ঞান খনির দ্বারস্বরূপ পেয়েছি। তিনি আমার অলদ। আমি তাঁর ওয়ালেদ।”

হযরত গাউসুল আযম মাইজভান্ডারীর (কঃ) এই পবিত্র উক্তির মধ্যে হযরত শেখ অছিয়র রহমান আল ফারুকী চরণদ্বীপির (রঃ) আধ্যাত্মিক মর্যাদা ও অবস্থানের সম্যক পরিচয় বিধৃত।

॥ ৩ ॥
নিজের প্রতি হযরত গাউসুল আযম মাইজভান্ডারীর (কঃ) এই দৃষ্টিভঙ্গীর স্বীকৃতি রয়েছে হযরত শেখ অছিয়র রহমান আল ফারুকীর (কঃ) এক প্রকাশ্য উক্তির মধ্যে। মাওলানা শাহসুফী শেখ আবুল বশর ফারুকীর (রঃ) এক প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, “বৎস! তোমাকে একটি কথা বলছি, তা মনোযোগ সহকারে শুনে রাখ। আমি এবং আমার পীর হযরত গাউসুল আযম মাইজভান্ডারী (কঃ) আমরা উভয়ে এক আত্মা বিশিষ্ট, ভিন্ন নই। তিনি ভিন্ন আমি নই, আবার আমি ভিন্ন তিনি নন। তাঁর আকার প্রকার অঙ্গাঅবয়বের সাথেও আমি এক রং বিশিষ্ট হয়েছি। আমি আমাকে তাঁর মধ্যে বিলীন করে দিয়েছি। তাঁর চিন্তাধারার গোপন রহস্যের ধারক-বাহক হয়েছি এবং তাঁর চিন্তাধারাকে ফলপ্রসূ করে তুলেছি। তাঁকে গাউসুল আযম রূপে সর্বপ্রথম আমি জেনেছি এবং তা সর্বত্র ব্যক্ত করেছি। আমি তাঁকে আব্বাজান বলে ডেকেছি। তিনি আমাকে তাঁর অলদ বা সন্তান বলে স্বীকৃতি দান করেছেন।…..”

হযরত গাউসুল আযম মাইজভান্ডারী (কঃ) এবং হযরত শেখ অছিয়র রহমান আল-ফারুকী (রঃ)- এর পারস্পরিক সম্পর্ক ও অবস্থান যেন হযরত আমীর খসরু (রঃ) সেই বিখ্যাত উক্তিরই ফলিত রূপ:

মানতু শুদম তু মান শুদি
মানতন শুদম তু জা শুদি,
তাকছ না গোয়েদ বাদ আজ-ই
মান দিগরম তু দিগরী।

অর্থাৎ আমি তুমি হলাম, তুমি আমি হলে, আমি দেহ এবং তুমি প্রাণ। এরপর যেন কেউ বলতে না পারে যে, আমি একজন আর তুমি পৃথক আর একজন। বাস্তব তথ্যে প্রমাণিত হয় যে, হযরত গাউসুল আযম মাইজভান্ডারী শাহসুফী সৈয়দ আহমদ উল্লাহ (কঃ) এবং কুতুবুল আকতাব হযরত মাওলানা শাহসুফী শেখ অছিয়র রহমান আল ফারুকী (রঃ) অভিন্ন আধ্যাত্মিক অবয়বে অভিন্ন আধ্যাত্মিক সত্তা।

লেখক: সাংবাদিক, সাবেক সহ সম্পাদক, দৈনিক আজাদী, মাসিক আলোকধারা।

মৌলানায়ে আকদছ শাহ চরণদ্বীপি (ক.) কেবলার জীবনী শরীফ থেকে সংগৃহিত

লিংক https://play.google.com/store/apps/developer?id=Senani+International

Print Friendly, PDF & Email

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here