চট্টগ্রামের সফল নারী উদ্যেক্তা গৃহিনী মনোয়ারা বেগম

প্রকাশ- ১৮/০১/২০২১

মো. তাজুল ইসলাম রাজু
সমাজে কতগুলো নারী আছে, যারা নিজের মেধা মনন ও শ্রম দিয়ে সমাজ ও জাতীর কল্যাণ কাজ করে গেছেন এবং যাচ্ছেন। হাটি হাটি পা পা করে এগিয়ে গেছেন স্ব-সমাজের কল্যাণে। পুষ্টিহীনদের পুষ্টির চাহিদা মেটাতে সমাজের হত দরিদ্রদের অন্নের চাহিদা মেটাতে, নিরলস শ্রম করে গ্রামীণ জনপদে গো-খামার করে সাফল্যেও দ্বারপ্রান্তে উঠে এসেছেন চট্টগ্রাম বোয়ালখালীর থানাস্থ শ্রীপুর গ্রামের এক পথিকৃত, মহিয়ষী গৃহিনী। যার নাম মনোয়ারা বেগম। শূন্য থেকে আজ সফল উদ্যেক্তা, গড়ে তুলেছেন, গো-পালন থেকে আদর্শ একটি ডেইরি ফার্ম। এলাকায় যেটি আদর্শ ‘পিউর ডেইরী ফার্ম’ নামে পরিচিত। এলাকায় ৪৫ বছর বযসি এ মমতাময়ী মহিয়ষী মনোয়ারা বেগমকে একজন কর্মচঞ্চল, পরিশ্রমী আদর্শ গৃহিনী হিসাবে নয় শুধু একজন উদীয়মান উদ্যাক্তা হিসাবে খ্যাতি রয়েছে। গ্রামীণ জনপদে এ মহিয়সী মনোয়ারা বেগম, শখের ইচ্ছা শক্তি থেকে এখন সাফল্যের দ্বারপ্রান্তে। গল্পে গল্পে কথা হয় এ প্রতিবেদকের সাথে, তার ছন্দময়ী কথা-
ছোট বেলায় পাঠ্য বইয়ে পড়তাম- আমাদের গোলভরা ধান আছে, পুকুর ভরা মাছ আছে, গোয়াল ভরা গরু আছে। বাপ দাদারা চাষী ছিল। মৌসুমে ধানে মৌ মৌ গন্ধে মনমুগ্ধকর কৈশোর কাটে গ্রামীণ মেটোপথে। পুকুরের বড়-ছোট মাছের স্বাদ এখনো জীবের ডগায় আছে। জীবনের ছোটবেলাকার অন্যরকম এক অনুভতি কথা এমনি ভাবে প্রকাশ করলেন বোয়ালখালীর শ্রীপুর গ্রামের ‘পিউর ডেইরী ফার্মের স্বত্তাধীকারী ও উদ্যেক্তা ৪৫ বছর বয়সী মমতাময়ী মনোয়ারা বেগম। পেশায় একজন সুগৃহিনী। স্বামী মোহাম্মদ ইউনুস। তিনি একজন সরকারী কর্মকর্তা। এক ছেলে দুইমেয়ে তাদের সংসারে। ছেলে মেয়েরা বড় হয়ে গেছে। তারা স্ব স্ব ভাবে লেখা পড়া করে উচ্চতর ডিগ্রি নেয়ার পথে। তার অভিপ্রায় বাস্তবায়ন করতে গিয়ে ২০১৬ সালে ছোট করে একটি উদ্যেগ নিলেন। গ্রামের শিশুরা প্রোটিনের চাহিদা মেটাতে গরুর তরল দুধের ব্যাপক অভাব। তার মনে চাপে শিশুরা যদি ছোটকালে প্রোটিনের চাহিদা মেটাতে না পারে তাহলে জাতি গঠনে এ শিশুরা পিছিয়ে পড়বে। জাতির স্বার্থে তিনি সিদ্ধান্ত নিলেন একটি দুগ্ধ খামার প্রতিষ্ঠা করবেন।

শুরু করেন নতুন করে ৩টি গাভী নিয়ে। পরিচিত গো-খামারীদের সঙ্গে আলাপ-আলোচনা, প্রাণী চিকিৎসকদের সাথে মতামত, পরামর্শ ও প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নিয়ে এগিয়ে গেলেন তিনি। স্থান নির্ণয়, গাভী ক্রয়, লোক নিয়োগ সবটিতে স্বামীর সহযোগীতা চাইলেন। স্বামী তাতে সহযোগীতার হাত বাড়িয়ে দিলেন এবং সাহস দিলেন। গৃহিনী মনোয়ার বেগম ১৬০০বর্গফটের একটি সেড তৈরি তথায় ২লক্ষ টাকায় উন্নত জাতের ফিজিশিয়ন ও অষ্ট্রেলিয়ান ৩টি গরু কিনতে ৩ লক্ষ টাকা দিয়ে সাহস যোগান তার স্বামী মোহাম্মদ ইউনুছ। যেমন গাভীগুলোর পরিচর্যা আর খাবারের ব্যবস্থা করা এবং রোগ-বালাইয়ে চিকিৎসকের ধারস্থ হওয়া কিছুতে আর বেগ পেতে হয়নি। যেখানে সহযোগীতা চেয়েছি তা কেবল সময়ের সঙ্গেই পেয়েছি স্বামীকে। তৃতীয় বছরে গাভীর সংখ্যা দাড়ায় ১০টি। এ গাভী থেকে ১০টি বাছুর জন্মে। পুরুষ বাছুরগুলো কোরবানী ঈদের সময় বিক্রি করা হয়, মেয়ে বাছুরগুলো গাভীর সাথে যোগ করা হয় ফলে গাভীর সংখ্যা বেড়ে এখন ২০টিতে উন্নিত হয়েছে।

এক সময় আমি গোয়াল থেকে বাচ্চাদের জন্য দুধ সংগ্রহ করতাম। এগুলো দুধ না পানি তা সাদা রঙ এর কারনে শুধু খেলে বুঝা যায়। ফলে দুধের মানের ব্যাপারে আমি খুব সচেতন ছিলাম। শুরুতে আমার খামারে দুধের উৎপাদন ছিল প্রতিদিন ৬০-৭০ লিটার। আল্লাহর রহমতে এখন প্রায় ১৬০-১৮০ লিটার দুধ উৎপাদন হচ্ছে। মাসে ১৫ টনের মতো দুধ উৎপাদিত হয়। লাভের টাকা দিয়ে খামারের এ ব্যাপ্তি। আল্লাহর কাছে বড় শোকরিয়া।

মনোয়ারার বেগমের স্বামী সরকারী কর্মকর্তা মোহাম্মদ ইউনুছ এ প্রতিবেদকের সাথে আলাপকালে বলেন- সাহস, ইচ্ছা এবং আগ্রহ থাকলে মানুষ যে সবকিছু করতে পারে তার একটি জ্বলন্ত প্রমান আমার স্ত্রীর এই প্রতিষ্ঠান। প্রথমে আমার দুর্সাধ্য মনে হয়েছিল। লোকশানের জন্য প্রস্তুত ছিলাম। কিন্তু না আল্লাহর অপার মহিমায় খুব ভাল হয়েছে। গ্রামের বাড়ীতে এধরনের একটি প্রতিষ্ঠান টিকে থাকলে সকলের জন্য একটি মঙ্গলবার্তা। সাধারণ খেটে খাওয়া মানুষ থেকে শুরু করে স্বচ্ছল পরিবারের সবার প্রেটিন চাহিদা মেটাচ্ছে তাতে আমার খুবই আনন্দ লাগছে।

উল্লেখ্য যে ‘পিউর ডেইরী ফার্ম’ খানা ২০১৬ সালে প্রাণী সম্পদ অধিদপ্তর থেকে সরকারী অনুমোদন নেয়া হয়েছে যার নং জেপ্রাদ/চট্ট/সিসি-১৩১৩।

‘পিউর ডেইরী ফাম’ এর উদ্যেক্তা মনোয়ারা বেগম জানান, এই খামারে বর্তমানে যে ৩জন পরিচর্যাকারী কাজ করছেন এদের মোট বেতন ৩৮ হাজার টাকা বেতন প্রদান করা হয়। বলতে গেলে আধুনিকতার সকল ছোঁয়া দিয়েই তার খামারটি তৈরি করা হয়েছে।

সমস্যা সম্পর্কে মনোয়ারা বলেন, আমার ইচ্ছা আরো ব্যাপক ভাবে এ খামারের উৎপাদন বৃদ্ধি করা। কিন্তু জায়গাতো নিজের না। অন্যেও জায়গা লীজ নিয়েছি। মেয়াদ শেষ হলে আবার রিনিউ করতে হবে। এখানে অর্থের প্রয়োজন আছে। সরকারী প্রনোদনা থাকলে হয়তো সম্ভব হবে। আর প্রান্তিক জনপদে দুধ সংরক্ষণের জন্য পর্যাপ্ত চিলিং প্ল্যান্ট নেই। অবশ্যই আমাদের এখনো সেটি প্রয়োজন পড়ছেনা। কারণ আমাদের খামারের দিনের উৎপাদিত সব দুধ দিনেই বিক্রি হয়ে যায়।

সভ্যতার যুগের কথা তুলে ধরে মনোয়ারা বেগম বলেন, শুরু থেকে পশু পালন ছিল মানুষের প্রধান পেশা। যুগে যুগে এই পেশার ধরণ বদলে গেছে। সারা পৃথিবীতে পশুর খামার ব্যবসা একটি অন্যতম উৎপাদনশীল এবং লাভজনক ব্যবসা।

নিউজিল্যান্ড, হল্যান্ড, ফিনল্যান্ড, নেদারল্যান্ড, অস্ট্রেলিয়াসহ ইউরোপ আফ্রিকার বিভিন্ন দেশে বৃহৎ আকারে শতভাগ বৈজ্ঞানিক ব্যবস্থাপনায় পশুর খামার পরিচালিত হয়। এসব খামারের সামগ্রিক ব্যবস্থাপনা, উৎপাদন, তাক লাগিয়ে দেবার মত। বর্তমানে আমাদেও দেশে বাণিজ্যিক আকারে বৈজ্ঞানিক পদ্ধতিতে খামার ব্যবসা শুরু হয়েছে এবং উদ্যোক্তা মোটা অংকের মুনাফা দেখতে শুরু করেছে।

ভৌগলিক অবস্থানের কারনে বাংলাদেশ পশুর খামার ব্যবসায় উন্নত দেশের তুলনায় অনেক পিছিয়ে। তবে সুনির্দিষ্ট পরিকল্পনা এবং বিনিয়োগ সম্ভব হলে আমাদের দেশের পশুর খামার লাভজনক করা সম্ভব। আমার কাছে মনে হয় সরকার, সমাজ এবং পরিবার থেকে এই পেশার আধুনিকীকরণের কোন উৎসাহ নেই। বিষয়টা যেন বিধির অমোঘ বিধান, পেশাটি শুধুমাত্র গ্রামের হত দরিদ্র বা অর্ধ শিক্ষিত বেকার তরুণদের জন্য। অবিলম্বে এই ধারণার পরিবর্তন প্রয়োজন। ভবিষ্যৎ দেশের অর্থনীতিতে কৃষি উদ্যোক্তা সামনের সারিতে থাকবে তা হলফ করে বলার প্রয়োজন নেই। বাংলাদেশ কৃষির জন্য অনেক সম্ভাবনাময় একটি দেশ।

দুগ্ধ খামার বর্তমানে একটি লাভজনক শিল্প। গাভীর খামার বেকারত্ব দূরীকরণ, দারিদ্র্যবিমোচন, আত্মকর্মসংস্থান সৃষ্টি ও দেশে দুধের চাহিদা পূরণে বিশাল ভূমিকা রাখছে। সরকারী তথ্য মতে- মানুষের শারীরিক বৃদ্ধি ও মানসিক বিকাশের জন্য দুধ ও মাংসের প্রয়োজনীয়তা অপরিহার্য। একজন প্রাপ্ত বয়স্ক ব্যক্তির জন্য দৈনিক ২৫০ মিলিলিটার দুধ ও ১২০ গ্রাম মাংসের প্রয়োজন। তার বিপরীতে আমরা পাচ্ছি ৫১ মিলিলিটার ও ২০ গ্রাম মাংস। দেশে জনসংখ্যা বৃদ্ধির সাথে সাথে দুধ ও মাংসের চাহিদাও বৃদ্ধি পাচ্ছে। দেশে দুধ ও মাংসের ব্যাপক চাহিদা পূরণ করতে হলে আরও অনেক গাভীর খামার স্থাপন করা প্রয়োজন।

একটি পারিবারিক গাভীর খামার স্থাপন করতে বেশি জমির প্রয়োজন হয় না। বাড়ির ভেতরেই একটি আধা-পাকা শেড তৈরি করলেই চলে। গাভীর খামার স্থাপনে তেমন কোনো ঝুঁকি নেই। প্রয়োজনে দেশি ঘাস সংগ্রহ করে খাওয়ালেও চলে। অল্প পুঁজি দিয়ে গাভীর খামার শুরু করা যেতে পারে। একটি পারিবারিক গাভীর খামার দেখভালো করার জন্য আলাদা শ্রমিকের প্রয়োজন হয় না। নিজের মেধা, মনন, ইচ্ছা শক্তি যতেষ্ট বলে মনে করি। সৎ ইচ্ছা ও প্রচেষ্টা থাকলে, সাফল্য অবশ্যই একদিন আসবেই।

Print Friendly, PDF & Email

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here