মো.তাজুল ইসলাম রাজু

পৃথিবীতে অগণিত মানব সন্তানের মধ্যে এমন কিছু মানুষ থাকেন যাঁরা নিজেদের কর্ম প্রচেষ্টা, সাধনা, চরিত্র, মানবতা, মহানুভবতা, ত্যাগ কল্যাণময়তার মাধ্যমে স্রষ্টার সৃষ্টির একটি বিশিষ্ট স্থান অধিকার করতে সক্ষম হন। তাঁদের সৎ ও সৃজনশীল কর্মকান্ডে মহান স্রষ্টা এমন এক স্থানে নিয়ে যায় যা আলোকে আলোকময়। তারাঁ এমন এক মর্যাদাশীল আসনে সমাসীন হন যা নক্ষত্র খচিত গগনের পূর্ণিমার চন্দ্রতুল্য। এরূপ ব্যক্তিদের জীবন ও কর্ম মানব সমাজের জন্য অনুকরনিয় ও অনুস্মরণীয় আলোক বর্তিকা স্বরূপ। তাঁদের শিক্ষা-দীক্ষায় ভবিষ্যৎ প্রজন্ম আলোকিত হয়, মর্যাদা সম্পন্ন হয়। এমন একজন ব্যক্তিত্ব সম্পন্ন আলেম, আমাদের প্রাচীণ বোয়ালখালী’র কালের জ্ঞানতাপস হজরত মাওলানা কাজী আবদুল মজিদ শাহ রহমতুল্লাহ আলাইহে’র জীবন কর্ম নিয়ে কিছু আলোকপাত করা হলো-

কর্ণফুলির পূর্বপাড়ে মাজারের গেইট

ইতিহাস : হালদার মোহনাস্থ কর্ণফুলীর দক্ষিণ পূর্বসীমা ঘেষে বর্তমান কধুরখীল গ্রাম। এ গ্রাম চারটি অংশ পরিচিত। পশ্চিম কধুরখীল, মধ্যম কধুরখীল ও পূর্ব ও দক্ষিণ কধুরখীল। এ গ্রামের দক্ষিণে গোমদন্ডী পূর্বে আকুবদন্ডী, উত্তর পূর্বে চরণদ্বীপ ও পোপাদিয়া, উত্তর পশ্চিম “কাইচা” (কর্ণফুলী)। পূর্ব কধুরখীলে হিন্দুদের বসবাস বেশী। পশ্চিম ও মধ্য কধুরখীলে প্রায়ই মুসলমানদের বসতি।
জনবসতির সাথে সাথেই কাইচার কুল ঘেষে এ গ্রামে গড়ে উঠে চৌধুরী হাট নামে এক ঐতিহ্যবাহী হাট। নদীপথকে মাধ্যম করে এই হাট পরিণত হয় একটি গঞ্জে। দূর-দূরান্ত থেকে লোকজন বেচা কেনার জন্য ছুটে আসতো এ হাটে। বেচা কেনা হয় বিভিন্ন ফসলাদি। এ হাট কত প্রাচীন তা নির্দেশ করে তৎকালিন ফসলের মূল্য। ধান বিক্রয় হতো টাকায় ২৫-৩০ আড়ি।
পূরাতত্ত্ববীদগণের মতে চরণদ্বীপ খরণদ্বীপ কধুরখীল গ্রামসমূহ কর্ণফুলীর নদীর গর্ভে বিলীন ছিলো। পশ্চিমা থেকে আগত ইসলাম প্রচারক মহাত্মা সৈয়দ সাহেব এসে যে স্থানে সর্ব প্রথম পা (চরণ) রাখেন। সে স্থানে নাম করণ করা হয় চরণদ্বীপ। সেখান থেকে আসার পথে যে স্থানে তাঁর পায়ের খরম (জুতা মোবারক) পড়ে যায় এবং কালক্রমে সে স্থানে চর জেগে উঠে, সে স্থানে নাম করণ করা হয় খরণদ্বীপ। এ খরণদ্বীপ বর্ধিত হয়ে বর্তমান কধুরখীল এলাকার সৃষ্টি হয়। এ স্থানটি তখনো অনাবাদী ছিলো।
১৭৬৫ খ্রিস্টাব্দে/১১২৬ মঘি জরিপের সময় এ স্থানটি জরিপের প্রশ্ন উঠলে কধুরখীল নামে জরিপ হয়। প্রচলিত প্রবাদ আছে “কতদূরখিল” থেকে কধুরখীল নাম হয়। এতে এও শোনা যায় সেখানে মুসলমান নবাবগণ এ স্থানের নাম কধুরখীল দিয়েছিলেন। গৌড়াগত প্রখ্যাত হাতেম মোল্লা বাঁশখালীর রায়ছটা গ্রামে বাস করতেন। তাঁর পৌত্র নজর মোহাম্মদ খাঁন নবাব শায়েস্তা খাঁ থেকে চট্টগ্রামের নানা স্থানে জমিদারী প্রাপ্ত হন। জমিদারীর অংশ বিশেষ প্রাপ্ত হন বর্তমান কধুরখীল গ্রামে। জমিদার নজর মোহাম্মদ খাঁ ১৬৯৪ খ্রিস্টাব্দে মৃত্যুবরণ করলে তৎপুত্র মোহাম্মদ ফরিদ উদ্দিন জমিদারীর শাসন কার্য পরিচালনার সুবিধার্থে ১৬৯৫ খ্রিস্টাব্দে এ গ্রামে বসবাস শুরু করেন। জমিদারের প্রকাশ নাম হল “ফুল গাড়ী খাঁ” তিনি ১৭২০ সালে মৃত্যুবরণ করেন। তদপুত্র তাঁর অসাধারণ দক্ষতা ছিল। তিনি শুধু ভাষাবিদ ছিলেন তা নয়, তিনি একজন ন্যায় পরায়ণ ধার্মিক পরহেজগার ছিলেন। লোকে তাঁকে ফকির মুহাম্মদ বলে ডাকতেন। তিনি ও তাঁর প্রকৃত নাম ব্যবহার না করে ডাক নাম-ই ব্যবহার করতেন।
বাংলার নবাব মুর্শিদ কুলি খাঁ চট্টগ্রামের নানা স্থানে কাজী তথা বিচারক নিযুক্ত করেন। নবাব কর্তৃক কাজী নিযুক্ত হলেন ফকির মোহাম্মদ। ন্যায় বিচার ও কর্মদক্ষতার নৈপূণ্যতা দেখে নবাব তাকে খাঁ বাহাদুর উপাধীতে ভূষিত করেন। এই খাঁ বাহাদুর ফরিক মোহাম্মদ প্রায় ২৯ বৎসর কাজী পদে বিচার কার্যকরে ১৭৫৯ সালে ইন্তেকাল করেন। উল্লেখ্য ফারসী কাব্যের অনুলেখক ছিলেন তিনি। তাঁর অনুলিখিত “মধুমালতী” নামে একটি প্রাচীণ পান্ডুলিপি প্রখ্যাত পুঁথি সংগ্রাহক আবদুস সাত্তার চৌধুরী কাজী সাহেবের উত্তর পুরুষ মৌলভী কাজী ইলিয়াছ (এস/ও চ.বি) থেকে সংগ্রহ করেন। পরে সাত্তার সাহেব থেকে এটি জাতীয় অধ্যাপক সৈয়দ আলী আহসান উপন্যাস উপহার হিসেবে প্রাপ্ত হয়ে বিভিন্ন পত্র পত্রিকার লেখালেখি করেন। ১৯৭০ সালে এ পাণ্ডলিপির সাহায্যে আমীর হামজা বিরচিত “মধুমালতী” কাব্য খানি তাঁরই সম্পাদনায় প্রকাাশিত হয়। এটি বর্তমানে বিশ্ববিদ্যালয় পর্যায়ে বাংলা বিভাগের ছাত্র-ছাত্রীদের সহায়ক গ্রন্থ হিসেবে পাঠ্যভুক্ত রয়েছে। এই মহাজ্ঞানী মহাজনের এক উত্তম পুরুষ হলেন হযরত শাহ সুফী মাওলানা কাজী আবদুল মজিদ (রহ.) তিনি একজন কবি ও প্রাচীন পুঁথির অনুলেখক ছিলেন।
তার রচিত অপ্রকাশিত পাণ্ডলিপি থেকে নেয়া।
“তাঁর সুত কাজী শেখ মছউদ খান
সুচরিত গুণসুত ধার্মিক প্রধান।
তার তনয় অতি সভার ভাজন
কাজী মোহাম্মদ আলী ধার্মিক সুজন।
ধর্ম শিক্ষা বহু দীক্ষা করে সদা দান
ইসলাম প্রচারে তিনি অতি যতœবান।
তাহার তনয় আমি অম্বা জ্ঞাত অতি
আবদুল মজিদ নাম দীন হীন অতি।”
এই আলেম কবির দ্বারা অনুলিখিত কবি আলাওল বিরচিত ‘সপ্ত পয়কর” কাব্যের একটি পান্ডুলিপি পুঁথি-সংগ্রাহক, গবেষক ও লেখক মুহাম্মদ ইসহাক চৌধুরীর সংগ্রহে রয়েছে। তিনি ঐতিহাসিক হামিদুল্লাহ খাঁর সভা কবি ছিলেন। তিনি তাঁর কাব্য গুরু খাঁ সাহেবের আদেশে বিখ্যাত ইরানী কবি জামী বিরচিত “শিরি খোস” কাব্যের বাংলা অনুবাদ করে গেছেন।
“গুরুর আদেশ আর ঈশ্বর ভরসা।
রচিতে পুস্তক মনে করিলাম আশা।”

হুজুরের হস্তলিখিত পাণ্ডুলিপি

তিনি বংশীয় বর্ণনায় ‘কধুরখীল’ নামক দীর্ঘ ২০২ লাইনের ছন্দ আকারে একটি কবিতা রচনা করেন পাশাপাশি একইভাবে ‘স্তুতি’, ‘হযরতের গুণকীর্ত্তন’, ‘খান বাহাদুর মৌলভী হামিদুল্লাহ খাঁন’ ও ‘ইসলামাবাদ’ নামে দীর্ঘ লম্বা ঐতিহাসিক কবিতা (পুঁথি আদলে) রচনা করেন।
তাঁর জীবনকাল ১৮৫১-১৯১৬ সাল। এ বিখ্যাত কাজী বংশে এক মহিলা কবির জন্ম হয়। তাঁর নাম জমিরুন্নেসা। এই মহিলা ১৮৯০ সালে একটি কাব্য রচনা করেন। এটির নাম ‘মনিওল বেদাদ’। অর্থাৎ শরীয়ত সম্মত নয়, এমন আচার আচরণ মুসলমানদের অনেকেই ধর্মীয় অনুশাসন হিসেবে বিশ্বাস করেন। এ কাব্যে সে সবই বর্ণিত হয়েছে।
এ নবাবিস্কৃত কাব্যের পুঁথি সংগ্রাহক আবদুস সাত্তার চৌধুরী। তিনি উক্ত মহিলা কবির অনুলিখিত (ক) কবিরাজ বিষয়ক (খ) কবি শাহীদুল্লা বিরচিত ‘তালিব নামা’ আরো দু’খানা পাণ্ডলিপি সংগ্রহ করেন। উল্লেখ্য চট্টগ্রাম মুসলিম সমাজে তিনিই প্রথম মুসলিম কবি। তাঁর এ কাব্যখানি জাতীয় জাদুঘরে স্থান পেয়ে সংরক্ষিত আছে।
জমিরুন্নেসা একজন কবি ছিলেন শুধু তাই নয়। তিনি ছিলেন একজন স্কুল শিক্ষিকা। এ শতকের শুরুতে সরকারি শিক্ষিকা হিসেবে মাসে পাঁচ টাকা মাইনে পেতেন। সম্ভবত তৎকালে তিনি ছিলেন একমাত্র মুসলিম শিক্ষিকা সমগ্র চট্টগ্রামে।

জন্ম বৃন্তান্ত: বাংলার রাজধানী গৌড় হতে এসে বাংলার ইতিহাসে প্রখ্যাত প্রশাসক উজীরে আজম মোর্শেদকুলী খানের বংশধরের একটি অংশ চট্টগ্রামের বাঁশখালীতে হিজরত করে বসতি স্থাপন করেন। এই বংশ হতে হজরত শাহ্ মোহাম্মদ ফকির কাজী (রহঃ) পবিত্র কোরআন-হাদীস এবং আধ্যাত্মিক জ্ঞান গরিমার কারণে তাঁকে ইফতেখার উদ্দিন মোহাম্মদ বখতিয়ার খল্জীর আমলে বোয়ালখালী ও পটিয়া থানা এলাকার বিচারক (কাজী) এর পদে আসীন হয়ে পশ্চিম কধুরখীল এসে বসবাস শুরু করেন। তাঁরই অধস্থন ৬ষ্ঠ পুরুষ মহান অলি হজরত শাহ্ কাজী মোহাম্মদ আলীর (রহঃ) ঔরশে ১৮৫১ ইসায়ী সালে কালের জ্ঞানতাপস হজরত মাওলানা শাহ্ কাজী আবদুল মজিদ ইসলামাবাদী (রহ) জন্মগ্রহণ করেন।

শিক্ষা ও সাধনা: ছোটবেলা থেকে নীরব গাম্ভীর্য্য প্রকৃতি ও ধ্যান মনস্ক স্বভাবের ছিলেন। দুনিয়ার প্রতি ছিলেন বিরূপ ভাবাপন্ন। প্রাথমিক পর্যায়ের শিক্ষা-দীক্ষা স্বীয় পিতার নিকট হতে শুরু করেন। তথা থেকেই তাঁর জ্ঞান গরিমার খুশবু বিকশিত হতে থাকে। উচ্চতর জ্ঞান লাভের জন্য কলকাতা আলীয়া মাদ্রাসায় ভর্তি হয়ে ১৮৭২ ইং সালে কৃতিত্বের সাথে ‘মমতাজুল মোহাদ্দেসীন’ খেতাব নিয়ে দেশে ফিরে এসে চট্টগ্রামের মোহসেনিয়া মাদ্রসায় ১৮৭৭ ইং সালে প্রধান শিক্ষকের পদ অলংকৃত করেন। ইন্তেকালের আগ পর্যন্ত এই মাদ্রাসায় শিক্ষকতায় নিয়োজিত ছিলেন। এর আগে শিক্ষা সমাপ্তির পর ১৮৭২ থেকে ১৮৭৭ সাল পর্যন্ত প্রায় ৫ বৎসর যাবত হজরত সুফি ফতেহ আলী ওয়াইসী (রহঃ) সান্নিধ্যে থাকেন এবং আধ্যাত্মিক জগতে উচ্চমার্গে আরোহণ করার পর খেলাফত প্রাপ্ত হন।
হজরত সুফি ফতেহ আলী (রহঃ) কে রসুলনামা বলা হয়, কেননা তিনি প্রত্যক্ষভাবে হজরত রসুলে মকবুল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামকে দেখতে পেতেন। তাঁর পীর ছিলেন বালাকোটের গাজীয়ে আজম হজরত সুফি নুর মোহাম্মদ নিজামপুরী (রহঃ)।

সান্নিধ্যে থাকা কৃতি ছাত্র: তাঁর কৃতি ছাত্রদের মধ্যে উপমহাদেশের খ্যাতনামা ওলামায়ে কেরামগণের তালিকাও বিশেষভাবে উল্লেখযোগ্য- তৎমধ্যে উপমহাদেশের ২য় বৃহত্তম দ্বীনি মাদ্রাসা হাটহাজারী মঈনুল ইসলাম জামেয়ার প্রতিষ্ঠাতা হজরত মাওলানা হাবীবুল্লাহ (রহঃ) প্রকাশ বড় মাওলানা, জীরি মাদ্রাসার প্রতিষ্ঠাতা হজরত মাওলানা আহমদ হোসেন (রহঃ), পটিয়া আল জামেয়ার প্রতিষ্ঠাতা হজরত মুফতি শাহ আজীজুল হক (রহঃ) এর আব্বাজান হজরত মাওলানা নুর মােহাম্মদ (রহঃ), গারাঙ্গীয়ার জামেয়ার প্রতিষ্ঠাতা হজরত মাওলানা আবদুল মজিদ (রহঃ) প্রকাশ বড় হুজুর , সাতকানিয়ার চুরামনি হজরত মাওলানা শাহ্ আহমদুর রহমান প্রকাশ চুরামনির শাহ্ (রহঃ), বাঁশখালী নিবাসী চট্টগ্রামের দারুল উলুম আলিয়া মাদ্রাসার সাবেক প্রধান মোহাদ্দেস হজরত মাওলানা শাহ্ ফজলুর রহমান (রহঃ), বোয়ালখালী নিবাসী হজরত মাওলানা আবদুল্লাহিল কাফী ও হজরত মাওলানা আবদুল্লাহিল বাকী (রহঃ), বোয়ালখালী থানার প্রখ্যাত ওয়াহেদিয়া মাদ্রাসার হজরত মাওলানা আবদুল ওয়াহেদ (রহঃ)। বোয়ালখালীর কধুরখীল নিবাসী বিশ্বনন্দিত ঐতিহ্যবাহী মিশরের আল আযহার বিশ্ববিদ্যালয়ের ‘মমতাজুল মোহাদ্দেসীন’ খেতাবপ্রাপ্ত এবং মদীনা শরীফের মাদ্রাসায় প্রায় ৬/৭ বৎসর হাদিসের শিক্ষাদানে রত ছিলেন হাম্বলী মাজহাবপন্থী হজরত মাওলানা শাহ আবদুল কাদির মাদানী ইসলামাবাদী (রহঃ), সাতকানিয়ার চুনতীর প্রসিদ্ধ হাকিমিয়া মাদ্রাসার প্রতিষ্ঠাতা হজরত মাওলানা শাহ্ নজির আহমদ (রহঃ) তাঁর খেলাফত প্রাপ্ত হন। এছাড়া চট্টগ্রাম বায়তুশ শরফের পীর হজরত মাওলানা মীর মোহাম্মদ আখতার হোসেন (রহঃ) এর আব্বাজান হজরত মাওলানা মীর আনোয়ার হোসেন (রহঃ) (ফাজেলে দেওবন্দ)। তিনিও একজন বিশিষ্ট শাগরেদ ছিলেন। বাংলাদেশের অন্যান্য জেলার বিশিষ্ট হাক্কানী ও রব্বানী ওলামায়ে কেরামগণ রয়েছেন, যাঁরা বিভিন্ন দ্বীনি মাদ্রাসা এবং খান্কার মাধ্যমে একাধারে দ্বীনের খেদমত এবং প্রচার প্রসারে জীবন অতিবাহিত করেছেন।
এছাড়াও বাংলাদেশের তথা বৃহত্তর চট্টগ্রাম বিভাগীয় অঞ্চলের বিভিন্ন প্রখ্যাত দ্বীনি মাদ্রাসার প্রতিষ্ঠাতা, অধ্যক্ষ ও মোহাদ্দেসবৃন্দ এবং সুপ্রসিদ্ধ দ্বীনি মাদরাসা ও খানকার পীর মাশায়েখে কেরামগণ তাঁরই নিকট যাহেরী ও বাতেনী এলমে উচ্চতর মার্গে উপনীত হন। বিশেষ করে ইলমে-লাদুন্নীর মাধ্যমে ফয়েজ প্রাপ্ত হন। তাই তিনি (হজরত মাওলানা শাহ্ কাজী আবদুল মজিদ ইসলামাবাদী (রহঃ)) “আল্ ওস্তাদুল উলামা ” নামে খ্যাতি লাভ করেন।

আল্লামা গাজী শেরে বাংলা রচিত ‌দিওয়ান-ই আযীয’ গ্রন্থের পৃষ্ঠা
আল্লামা গাজী শেরে বাংলা রচিত ‌দিওয়ান-ই আযীয’ গ্রন্থের পৃষ্ঠা

‘দিওয়ান-ই আযীয’ গ্রন্থ হতে : হযরত মাওলানা আবদুল মজীদ শাহ (রহ.) এ শানে ক্বছিদা- লিখেছেন ইমামে আহলে সুন্নাত সৈয়দ মুহাম্মদ আযীযুল হক শেরে বাংলা আল্-ক্বাদেরী (রহঃ)। তাঁর রচিত ‘দিওয়ান-ই আযীয’ গ্রন্থের ২২৩ হতে ২২৫ পৃষ্ঠা পর্যন্ত শব্দ চয়নগুলো এখানে উল্লেখ করা হল-
“দর মদহে পে-শ্ওয়া-য়ে- আ-লেমাঁ- মুক্বতাদা-য়ে ফা-যেলা-. উসতা-যুল ওলামা-, বাদরুল ফুযালা- তা-জুল কুমালা-, মুরশিদে যামা-, মাশহু-রে দাওরাঁ-, মা’দিনে কাশ্ফ ও কারা-মা-ত, মাম্বা’এ ফয়ু-যা-ত, সা-হেবে কামা-লা-ত, হযরত মাওলা-না- আবদুল মাজী-দ্ সা-হেব বা শিন্দায়ে কদুরখীল, বোয়ালখালী, চট্টগ্রাম। আলায়হি রাহমাতু রাব্বিহিল বা-রী-।”
অর্থাৎ- আলিমকুলের শিরমণি, গুণীদের আদর্শ, আলিমগণের ওস্তাদ, গুণীজনদের পূর্ণিমা চাঁন, কামিলগণের মুকুট, যুগের পথপ্রদর্শক, যুগপ্রসিদ্ধ ব্যক্তিত্ব, কাশ্ফ ও কারামতের খনি, ফায়্ছ-বরকতের প্রস্রবণ, কামালাতের ধারক, চট্টগ্রামের বোয়ালখালীর কধুরখীল নিবাসী হযরত মাওলানা আবদুল মজীদ সাহেব এর প্রশংসায়। তাঁর উপর মহান স্রষ্টা ও রবের রহমত বর্ষিত হোক-
“আয্ বরা-য়ে- মাওলা-না- ‘আবদুল মাজী-দ্ বা-সফা-
মারহাবা- সদ মারহাবা- সদ মারহাবা- মারহাবা।”
অর্থাৎ- শত স্বাগতম, শত মুবারকবাদ, শত ধন্যবাদ, স্বাগতম-
পরিশুদ্ধ আত্মা বিশিষ্ট মাওলানা আবদুল মজীদকে।

“সদ হাযা-রাঁ- ‘আ-লেমা: শা-গিরদে আঁ- ফখরে যামা-
বুদ মুদাররিস মাদ্রাসাহ-ই মুহসিনিয়া বে-গুমা-”
অর্থাৎ- নিঃসন্দেহে তিনি মাদ্রাসা-ই মুহসিনিয়ার শিক্ষক ছিলেন
শত-সহস্র আলিম ওই যুগগৌবের ছাত্র।

“শুদ কামা-লা-তাশ বে-রূ- আয্ হদ্দে তাহরী-র ও বয়াঁ-
সা-হেবে কাশ্ফ ও কারা-মাত বু-দ হাম পী-রে মগা-”
অর্থাৎ- তিনি ছিলেন কাশফ ও কারামত সম্পন্ন; আরো ছিলেন কামিল পীর
তাঁর বুযুর্গীসমূহ লিখন ও বর্ণনার সীমা অতিক্রম করেছে।

“মরদুমাঁ- পুর ফয়্য বা-শব্দ দা-ইমান আয্ যা-তে উ-
দর কধুরখী-লাস্ত দা-নী- রওযায়ে পুরনু-রে উ-”
অর্থাৎ- সবসময় বহু মানুষ তাঁর বরকতময় সত্তা থেকে ফয়েজপ্রাপ্ত হয়।
ওই (বোয়ালখালীর) কধুরখীলে তাঁর নূরানী রওযা শরীফ অবস্থিত।

“ইস্তাজিব ইয়া- রব ত্বোফায়লে সরওয়ারে পয়গম্বরাঁ-
তুরবাতাশ রা- বা-গে জান্নাত সা-য আয় রব্বে জাহাঁ-”
হে বিশ্বপ্রতিপালক! তাঁর মাযার শরীফকে জান্নাতের বাগানে পরিণত করুন
হে মহান রব! নবীকুল সর্দারের ওসীলায় এ দোআ ক্ববুল করুন।

মুনকেরা-নে আউলিয়া-রা সায়ফে বোররা-বে-গুমাঁ-
না-মে না-যেন গরতু খা-হী ‘শে-রে বাঙ্গা-লাহ্ বেদাঁ-
তুমি যদি এর রচয়িতার নাম জানতে চাও, তবে জানো, তিনি হলেন ‘শেরে বাংলা।”
নিঃসন্দেহে ওলীগণের অস্বীকারকারীদের জন্য তিনি শানিত তরবারি।

হজরত মাওলানা শাহ্ কাজী আবদুল মাজিদ ইসলামাবাদী (রহ)-এর প্রায় লেখনি সংরক্ষণ ছিল তাঁরই ৪র্থপুত্র কাজী এ এম ইসহাক-এর কাছে। ইসহাক সাহেবের মৃত্যুর পর লেখনিগুলো তাঁরই ২য় পুত্র তৎকালীন বাংলাদেশ ব্যাংকের যুগ্ম পরিচালক একেএম রফিকুল ইসলামের নিকট হস্তগত হয়। এর মধ্যে উল্লেখযোগ্য হচ্ছে কাজী এ এম ইসহাক রচিত হজরত মাওলানা শাহ্ কাজী আবদুল মজিদ ইসলামাবাদী মরহুম মশহুর রহমতুল্লাহ আলাইহের সংক্ষিপ্ত জীবনালেখ্য। গ্রন্থটি ১৯৯৫ সালে প্রকাশ করার ইচ্ছা থাকলেও সময় ও সীমাবদ্ধতার কারনে সম্ভব হয়নি। বর্তমানে এ অপ্রকাশিত গ্রন্থটি একেএম রফিকুল ইসলামের ২য় পুত্র ব্যবসায়ী কাজী একেএম ইকরামের নিকট সংরক্ষিত আছে। এই গ্রন্থটিতে গৌড় নগর, শেখ মোহাম্মদ হাতেম মোল্লা, কর্ণফুলি নদীর ইতিহাস, কধুরখীলের ইতিবৃত্ত, খাঁ বাহাদুর শেখ মোহাম্মদ সাহ্ কাজী, উনবিংশ শতাব্দীর মধ্যভাগে কাজী বাড়ীর অবস্থিতি, সংক্ষিপ্ত কোষ্ঠীফলক ও বিস্তৃত বংশাবলী শিরোনামগুলো উল্লেখ আছে।

ওফাত দিবস: এই মহান জ্ঞানতাপস অসংখ্য ছাত্র, আত্মীয়-স্বজন ও গুণগ্রাহীদের শোক সাগরে ভাসিয়ে ১৯১৬ ইংরজী সনে ২০ নভেম্বর, ১৩২৩ বাংলা ৫ অগ্রহায়ণ, ১৩৩৫ হিজরিতে ২৩ মহররম মহান আল্লাহর সান্নিধ্যে গমন করেন।

১৯৫৪ সালে ওরশের একটি চিটি

পারিবারিক জীবন: হযরত মাওলানা আবদুল মজীদ শাহ (রহ.) পারিবারিক জীবনে দুই সংসার। প্রথম সংসারে ৬পুত্র ৩কন্যা আর দ্বিতীয় সংসারে ২পুত্র ৪কন্যা। মোট ৮পুত্র ও ৭কন্যা সকলেই ছিল বিনয়ী এবং সু-শিক্ষিত। প্রত্যেকে নিজ-নিজ গুণে সমাজের বিভিন্নস্তরে নানা ভাবে কল্যাণমূলক কাজ করেছেন। তৎমধ্যে-
১ম পুত্র মাওলানা শাহসুফি কাজী এ এম এম আবদুর রশীদ (১৮৮৪-১৯৬৬)। তিনি কধুরখীল ইউনাইটেড মুসলিম হাই স্কুলের ধর্মীয় শিক্ষক ছিলেন এবং স্থানিয় কাজী মসজিদের ইমামের দায়িত্ব পালন করেন। হুজুরের জীবদ্দশায় স্থানীয় পরহেজগার ব্যক্তি মাওলানা আবদুস চোবহান মাইজভাণ্ডারী’র কন্যার সাথে তাঁকে বিবাহ বন্ধনে আবদ্ধ করেন।
২য় পুত্র মাওলানা শাহসুফি কাজী এ টি এম এহায়া (১৮৬৬-১৯৫৬)। তিনি চট্টগ্রাম কলেজিয়েট স্কুলের ধর্মীয় শিক্ষক ছিলেন। তাঁকেও হুজুরের জীবদ্দশায় দরবারে হাওলাপুরির হযরত মাওলানা সৈয়দ আবদুল কুদ্দুস হাওলাপুরী (ক.) -এর বড় মেয়ে সৈয়দা আমাতুল মালেকের সাথে বিবাহ বন্ধনে আবদ্ধ করেন।
৩য় পুত্র মাওলানা শাহসুফি কাজী একেএম আবুল খায়ের (১৮৯০-১৯৬০)। তিনি সৌদি আরবে তেল কোম্পানি ‘আরামকো’তে কাজ করতেন।
৪র্থ পুত্র এ কেএম আবুল মোকারম (১৮৯২-১৮৯৩) তিনি অপ্রাপ্ত বয়সে মারা যান।
৫ম পুত্র মাওলানা শাহসুফি কাজী এ এম ইসহাক (১৮৯৩-১৯৬০)। চট্টগ্রাম জর্জকোর্টে পেস্কার ছিলেন।
৬ষ্ঠ পুত্র মাওলানা শাহসুফি কাজী এ এফ এম আবুল ফয়েজ (১৮৯৯-১৯৭৫)। তিনি ব্যবসায়ী ছিলেন।
৭ম পুত্র কাজী এ এস এম আবু ছউদ (১৯০৭-১৯৭৪) ও
৮ম পুত্র কাজী এ কে এম আবু ছাহাত (১৯০৮-১৯৭৯) দু’জনেই নিজস্ব ভূমিতে চাষাবাদ করে জীবন অতিবাহিত করেন।
৭কন্যারা হলেন ১) মাহমুদা খাতুন (১৮৮২-১৯১৪)। ২) আজিজা খাতুন (১৮৮৭-১৯৫৩)। ৩) ছায়েদা খাতুন (১৮৯৬-১৯৫৫)। ৪) রসিদা খাতুন (১৮৯২-অজ্ঞাত)। ৫) আছেফা খাতুন (১৯০৫-অজ্ঞাত)। ৬) রাজিয়া খাতুন (১৯১১-অজ্ঞাত)। ৭) ছুফিয়া খাতুন ওরফে আমেনা খাতুন (১৯১৪-অজ্ঞাত)।
শতবছর ধরে পরিবারের সদস্যগণ বংশপরম্পরায় তাঁদের পূর্বপুরুষের আদর্শ ও নীতির মধ্যে থেকে ত্বরিকত চর্চায় নিজেদের আত্মনিবেদিত করে রেখেছেন। পরিবারের পক্ষ হতে যথারীতি হুজুরের ওফাত দিবস ৫অগ্রাহায়ন মোতাবেক ২০নভেম্বর খ্যাতিমান পীর-বুজর্গ এবং ওলামায়ে কেরামগণের উপস্থিতিতে মহাসমারোহে দিনটি পালন করে থাকেন।
এ ছাড়া ১৯৯০ সাল থেকে এলাকাবাসীর উদ্যেগে হুজুরের স্মৃতির উদ্যেশে ওরশ এন্তেজামেয়া কমিটি গঠন করে দীর্ঘ ৩১বছর যাবৎ হুজুরের মাজার প্রাঙ্গনে মিলাদ মাহফিল আয়োজন করে আসছেন। এ কমিটির পক্ষ থেকে প্রতি বছর ২৮ফাল্গুন হুজুরের স্মরণে বিশাল মাহফিলের আঞ্জাম দিয়ে থাকেন। কমিটির উদ্যেগে ইতোমধ‌্যে অসহায় দুঃস্থদের আর্থিক সহায়তাসহ মাজারের উন্নয়নের কাজ করে থাকেন বলে জানান কমিটির সেক্রেটারী বীর মুক্তিযোদ্ধা আলহাজ্ব হারুন অর রশীদ ।

তথ্যসূত্র- পুঁথি সংগ্রাহক মুহম্মদ ইসহাক চৌধুরী, কাজী পরিবারের কাজী এ কে এম ফেরদৌস, কাজী এ কে এম ইকরাম, শাহ্ কাজী ইল্ য়াছ ছাদেকী ও কে.বি. এম আছিফ (মিল্টন) ও বীর মুক্তিযোদ্ধা আলহাজ্ব হারুন অর রশীদ ।

প্রাবন্ধিক- মো.তাজুল ইসলাম রাজু, সম্পাদক আলোকিত বোয়ালখালী

নোটঃ এ প্রবন্ধটি ইতিহাসের তথ্য উপাত্ত ভিত্তিক রচনা করা হয়েছে । এতে যদি বিজ্ঞ কারো কোনো মতামত বা প্রামাণ্য তথ্য থাকে তা আমাদের প্রেরণ করলে প্রবন্ধটি সংযোজন বিয়োজন করার ক্ষমতা রাখে- সম্পাদক।

Print Friendly, PDF & Email

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here