সংগ্রাহক : মো. তাজুল ইসলাম রাজু :
প্রকাশ: ২৪ মে ২০১৯
মাইজভাণ্ডারী সূফীবাদের ইতিহাস পর্যালোচনায় দেখা যায়, এর প্রাগ্রসর বক্তব্য ও কর্মযজ্ঞসমূহ ক্ষেত্রবিশেষে স্থবিরজনদের সমালোচনার সম্মুখীন যেমন হয়েছে, সেইসাথে সমাজজীবনের শ্রেষ্ঠতম প্রতিনিধি, স্বনামধন্য বিশিষ্ট ব্যক্তি ব্যক্তিত্বদের সপ্রশংস দৃষ্টি আকর্ষণেও সমর্থ হয়েছিল তাৎপর্যপূর্ণভাবে। এর মধ্যে ধর্মীয় পরিমণ্ডলে মাওলানা আমিনুল হক ফরহাদাবাদী ও আজিজুল হক শেরে বাংলা, রাজনৈতিক অঙ্গনে শেরে বাংলা এ কে ফজলুল হক ও শেখ মুজিবুর রহমান, সাহিত্যাঙ্গনে কবি সুফিয়া কামাল ও পল্লীকবি জসীম উদ্দীন, গবেষণা ও মেধা মননের জগতে মুহম্মদ মনসুর উদ্দীন, ডক্টর এনামুল হক ও সাহিত্যিক আবুল ফজলের নাম সবিশেষ উল্লেখযোগ্য। এইরূপ ৬৩ জন বিশিষ্ট ব্যক্তিত্বের অভিমত পূর্ণাঙ্গ তথ্যসূত্র সহকারে নিম্নে সন্নিবেশিত করা হোলঃ
১. “হযরত শাহ আহমদউল্লাহ কাদেরী, যিনি ভু-খন্ডের পূর্বাঞ্চলে বিকশিত কুতুবুল আখতাব; তিনি মাইজভান্ডার সিংহাসনে গাউছুল আজম নামধারী বাদশাহ। রাসুল (সঃ) এর নিকট শ্রেষ্ঠ বেলায়তের দুটি তাজ বা সন্মানের প্রতীক ছিল। এর একটি জিলান নগরের বাদশা হযরত শায়খ সৈয়দ আবদুল কাদের জিলানী (কঃ) এর মস্তক মোবারকে প্রতিষ্ঠিত, যে কারণে সমস্ত আউলিয়াদের গর্দানে তাঁর পা মোবারক প্রতিষ্ঠিত, অর্থাৎ সমস্ত আউলিয়া তাঁর আনুগত্য স্বীকারে বাধ্য। অপর তাজটি নিশ্চিতভাবে হযরত শাহ আহমদউল্লাহ (কঃ) এর মস্তক মোবরকে প্রতিষ্ঠিত। যেই কারণে তিনি পূর্বাঞ্চলের গাউছুল আজম বলে খ্যাত। সেই কারণে তাঁর রওজা মোবারক মানব-দানবের জন্য খোদায়ী বরকত হাসেলের উৎসে পরিণত হয়েছে।”
-আজিজুল হক শেরে বাংলা আলকাদেরী
[তৎকালীন র্পূব পাকিস্তানের আহলে সুন্নত ওয়াল জামাতের আমির, চট্টগ্রামের হাটহাজারী থানার মাওলানা আজিজুল হক আলকাদেরীর [প্রকাশঃ শেরে বাংলা] ফার্সি ভাষার লিখিত ‘দিওয়ানে আজিজ’ গ্রন্থে ‘নজরে আকিদত’ এর ভাবানুবাদ। উদ্ধৃতঃ বেলায়তে মোতলাকা, পৃ. ৪৭]
২. “মানবপ্রেম, সামাজিক কল্যাণ ও আত্মিক সমৃদ্ধিতে মাইজভান্ডার দরবার শরীফ আমাদের দেশে অনন্য ভূমিকা পালন করে আসছে। এদেশে ইসলামের মহানবাণী প্রচারে মাইজভান্ডার দরবার শরীফের অবদান তাই অনস্বীকার্য।”
-আবদুর রহমান বিশ্বাস
[প্রাক্তন রাষ্ট্রপতি, গনপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশ সরকার, উৎসধারা, পূর্বোক্ত]
৩. “সকল অশুভ শক্তির বিনাশ ও বিশ্বব্যাপী সাম্য, মৈত্রী, ভ্রাতৃত্ব ও ইনসাফের অমিয়ধারা একমাত্র নির্মোহ, নৈর্ব্যক্তিক ও প্রেমময় আধ্যাত্মিকতাই দিতে পারে- যা মাইজভান্ডারী দর্শনে বিধৃত হয়েছে। মানবের দায়িত্ব, নৈতিকতা ও মহাত্মতা সৃষ্টিতে এই দর্শনের অবদান অপরিসীম।”
-আবদুর রাজ্জাক
[রাজনীতিবিদ, প্রাক্তন মন্ত্রী-পানি সম্পদ মন্ত্রণালয়, গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশ সরকার, আলোকধারা, মাইজভান্ডার গাউছিয়া হক মনজিলের মাসিক মুখপত্র, ১৯৯৭]
৪. “মহাপ্রভুর আসন রবি উদিত হয়েছে, মানবাকারে খোদার গোপন রহস্য প্রকাশ পেয়েছে। ত্রিভূবন ছিল যাঁর আগমনের অপেক্ষায়, আজ সেই আশার ফুলরাজ প্রস্ফুটিত হয়েছে। যাঁকে নিয়ে নবীবর আহমদ মোস্তফা (দঃ) গৌরব করতেন, আজ সেই গৌরব, সূফীদের সারতত্বখনি জগতে আবির্ভূত হয়েছেন। …..হযরত মোহাম্মদ মোস্তফা আহমদ মোস্তাফা (দঃ) নবীদের মধ্যে সর্বশেষ নবী এবং রেসালতপ্রাপ্ত নবীদের বাদশা ছিলেন। সেরূপ হযরত গাউছুল আজম শাহসুফি সৈয়দ মাওলানা আহমদউল্লাহ (কঃ) বেলায়তে মোকাইয়াদা যুগের পরিণতিকারী। তিনি আউলিয়াদের বাদশা এবং দোজাহানের গাউসুল আজম বা পরিত্রাণকর্তা।”
-আবদুল গনি কাঞ্চনপুরি (রহঃ)
[মওলানা আবদুল গনি কাঞ্চনপুরী (রহঃ), তত্ত্বজ্ঞানী আলেম ও কামেল অলি-আল্লাহ। সমকালীন আলেমগণ তাঁকে বাহারুল উলুম বা “জ্ঞানসাগর” বলে অভিষিক্ত করেছিলেন। তিনি গাউছুল আজম মাইজভান্ডারীর উচ্চমার্গীয় আধ্যাত্মিক মাহাত্ম্য প্রকাশ করে উল্লেখযোগ্যসংখ্যক মূল্যবান গ্রন্থ রচনা করেছিলেন। এর মধ্যে সবিশেষ উল্লেখযোগ্য “আয়নায়ে বারী” [আল্লাহর দর্পণ] গ্রন্থের পৃ. – ১৪০, ১৫১]
৫. “মাইজভান্ডারী মতবাদি ধর্ম-সাধনার প্রধান নীতি হলো গীতিবাদ্য সহযোগে নৃত্য করা। তাকে হালকা জজবা বা জেকের বলা হয়। মাইজভান্ডারি গানে আল্লাহ রসুল ও তাঁদের পীরের প্রশংসাই মুখ্য।”
-আবদুল হক চৌধুরী
[চট্টলবিশারদ, চট্টগ্রামের সমাজ ও সংস্কৃতির রূপরেখা, বাংলা একাডেমী-ঢাকা ১৯৮৮, পৃ. ৬১৮]
৬. “মাইজভান্ডার চট্টগ্রাম জেলার ফটিফছড়ি থানার এক অজপাড়া-গাঁ, বাংলাদেশের অগন্য গ্রামের নগন্য একটি গ্রাম মাত্র। আজ কিন্তু একে নগন্য বলার কোনো উপায় নেই; কিছুতেই অভিহিত করা যাবেনা অজপাড়া-গাঁ বলেও। পৃথিবীর মানচিত্রে মাইজভান্ডার আজ নিজের স্থান নিজেই করে নিয়েছে। এ নাম আজ ছড়িয়ে পড়েছে দিগ দিগন্তে। বিশেষকরে পাক ভারতে এই নাম আজ ধ্বনিত-প্রতিধ্বনিত; লক্ষ ভক্তের কন্ঠে আজ এই নাম উচ্চারিত সশ্রদ্ধচিত্তে। এই মাইজভান্ডার শরিফের মধ্যমণি মরহুম সৈয়দ আহমদ উল্লাহ শাহ আর মরহুম সৈয়দ গোলামুর রহমান শাহ। আধ্যাত্মিক সাধনায় এঁরা ছিলেন সিদ্ধপুরুষ, কামেল অলিআল্লাহ্। এঁদের আধ্যাত্মিক সাধনার মহিমায় কালক্রমে মাইজভান্ডারকে উন্নীত করেছে মাইজভান্ডার শরীফে। এখানে এসে হাজার হাজার ভক্ত নিজেদের আধ্যাত্মিক ক্ষুধা আর তৃষ্ণা নিবারণ করে থাকে প্রায় শত বৎসর ধরে। নর নারী জাতি-ধর্ম নির্বিশেষে মাইজভান্ডার আজ অগন্য ভক্তের মিলনকেন্দ্র, এক মহাতীর্থভূমি। ইসলামে মারাফত বা আধ্যাত্মিক সাধনার বহু তরিকা রয়েছে। মাইজভান্ডার শরীফে যে তরিকা অনুসৃত হয় তার মূলকথা প্রেম ও ভক্তি। তাই কোনোরকম জাতি ধর্ম কী মাযহাবের ভেদাভেদ নেই এখানে। এখানে যাঁরা আসেন তাঁরা সবাই প্রেম ভক্তি পথের পথিক; সবাই এক ও সবাই সমান। মাইজভান্ডার প্রেম ও ভক্তিমার্গের এক অপূর্ব সমন্বয়ক্ষেত্র।”
-আবুল ফজল
[সাহিত্যিক ও বুদ্ধিজীবী, সাবেক উপাচার্য-চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয় এবং বাংলাদেশ সরকারের প্রাক্তন শিক্ষা উপদেষ্টা। সূত্রঃ মাইজভান্ডার দরবার শরীফ থেকে প্রকাশিত শাহজাদা সৈয়দ বদরুদ্দোজা প্রণীত হযরত বাবাভান্ডারী গ্রন্থের ভূমিকা]
৭. “You are lucky. You have come from the birth place of Gausul Azam Hazrat Ahmadullah Maizbhandari”
– আল আজহার বিশ্ববিদ্যালয়ের রেক্টর
[বাংলাদেশ থেকে আগত ব্যারিষ্টার আলহাজ্ব বজলুস সাত্তারকে উদ্দেশ্য করে মিসরের আল আজহার বিশ্ববিদ্যালয়ের রেক্টরের মন্তব্য। সূত্রঃ শাহানাশাহ জিয়াউল হক মাইজভান্ডারী ও ব্যক্তিত্ব, সম্পাদক-মাহবুব-উল-আলম, গাউছিয়া হক মনজিল, মাইজভান্ডার দরবার শরীফ চট্টগ্রাম, পৃ. ৪১]
৮. “শেরে বাংলা এ. কে. ফজলুল হক সাহেব প্রথম ওকালতি পাশ করে মাইজভান্ডার দরবার শরীফ গিয়ে হযরত আকদাসের [গাউছুল আজম মাইজভান্ডারী] খেদমতে হাজির হন এবং উন্নতির জন্য দোয়া প্রার্থনা করেন। তিনি একদিন এক জনসভায় বলেন, “গাউছুলআজম মাইজভান্ডারি (কঃ) ও বাবাভান্ডারির সুনজর যহ দিন আমার উপর বর্তমান থাকবে ততদিন কোনো শক্তিই আমার মাথা নত করতে পারবেনা এবং আমার জয় সুনিশ্চিত। আমি তাঁদের সুনজর কামনা করি।”
-শেরে বাংলা এ.কে. ফজলুল হক
[গাউছুল আজম মাইজভান্ডারীর জীবনী ও কেরামত, মাইজভান্ডার দরবার শরীফ, ফটিকছড়ি, চট্টগ্রাম, পৃ. ৯২]
৯. “আধ্যাত্মিক পরিমণ্ডলে মাইজভান্ডার শরীফ একটি প্রত্যয়দীপ্ত নাম। এই পাকদরবার খোদার অনুগ্রহ প্রত্যাশী ধর্মপ্রাণ মানুষের ভরসার ঠিকানা। …..অনেকের কাছে হয়তো অজানা যে, ১৯৭৫’র সেই কালো রাতে জাতির জনকের নৃশংস হত্যাকান্ডের পর এই পীর সাহেবই দরবার শরিফে সর্বপ্রথম একটি দৃষ্টি আকর্ষণীয় বড়ো মাপের কালো পতাকা উত্তোলন করেন, যা ১৫ই আগষ্ট’৭৫ থেকে একটানা চল্লিশ দিন টাঙ্গানো ছিল। আমি মনে করি, জাতীয় শোকদিবসের এটাই ছিল সূচনাপর্ব- সর্বপ্রথম উদ্যোগ। ধনী – নির্ধন, উচ্চ-নীচ সকলে এই দরবারে সমান। এটি এই দরবারের বৈশিষ্ট্য যা সাম্যবাদের প্রকৃষ্ট উদাহরণ। সমস্যাবিক্ষুদ্ধ বর্তমান সমাজব্যবস্থায় মাইজভান্ডার দরবার যে সমাধানের পথ-নির্দেশ দিচ্ছে তা অনস্বীকার্য।
মাইজভান্ডারী গান ভক্ত হৃদয়ের ঐশীপ্রেম-সিক্ত ভাবের প্রকাশ। এ গানের প্রতিটি ছত্রে খোদা ভীরুতা, আউলিয়া দরবেশের ভক্তি সযত্নে উপস্থাপিত। শ্রোতাকে এই গান সহজেই অনুপ্রাণিত করে খোদায়ীপ্রেম ও প্রেরণার সন্ধান দিতে পারে।”
-এম. এ. মান্নান
[প্রাক্তন মন্ত্রী-শ্রম ও জনশক্তি মন্ত্রাণালয়, গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশ সরকার, আলোকধারা, পূর্বোক্ত ও মরমী; মাইজভান্ডার মরমী গোষ্ঠীর বিশেষ প্রকাশনা]
১০. “কোরআন ও রাসুলে পাক (সঃ) এর জীবনের আলোকে সর্বধর্মের সহাবস্থান বহাল রেখে মানবতার মুক্তিরপথ দেখাতে গাউছিয়তের কর্তৃত্বধারার মহান সাধকপুরুষ হযরত শাহসুফি সৈয়দ আহমদ উল্লাহ মাইজভান্ডারী (কঃ) হতে শুরু করে বিশ্বঅলি শাহানশাহ জিয়াউল হক মাইজভান্ডারী (কঃ) যে দর্শন ঘোষণা করেছেন তা বিশ্ববাসীর উষ্ণ স্বীকৃতি পাওয়ার দাবিদার বলে আমি মনেপ্রাণে বিশ্বস করি। সমস্তবিশ্বে এই দর্শনের ব্যাপক প্রচার- প্রকাশ ও প্রসার হওয়া একান্ত প্রয়োজন।”
-এমাজউদ্দিন আহমদ
[অধ্যাপক এমাজউদ্দীন আহমদ, বিশেষ প্রকাশনা, সম্পাদকঃ মিয়া নজরুল ইসলাম; ঢাকা ২২ মার্চ ১৯৯৫, পৃ. ১০৪]
১১. “আধ্যাত্মিক ভাবধারায় রচিত মাইজভান্ডারী গানগুলো লোক সঙ্গীতের সখা। বিংশ শতকের গোড়ার দিকে মাইজভান্ডার পীরের আধ্যাত্মিক সাধনার তাৎপর্য ব্যাখা করে মাইজভান্ডারী গানের উদ্ভব হয়। মাইজভান্ডারের গান মূলত আধ্যাত্মিক হলেও এতে সমাজচেতনা অনুপস্থিত নয়। প্রতীক ও রূপকের ভাষায় সমাজের সমালোচনা ও প্রকাশ প্রায়। আমার মনে হয়, এই কারণে মাইজভান্ডরের গান বাংলার সংস্কৃতি জগতে স্থায়ী আসন লাভ করবে।”
-ডক্টর ওয়াকিল আহমদ
[উপাচার্য, জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয়, প্রবন্ধঃ মাইজভান্ডারের গান প্রসঙ্গে, ঋষিজ শিল্পীগোষ্ঠীর অষ্টম প্রতিষ্ঠা বার্ষিকীর স্মরণিকা। সম্পাদকঃ আলতাফ আলী হাসু, ঢাকা ১৯৮৪, পৃ. ৩৯]
১২. “মাইজভান্ডারী দর্শনের মানবতা, সর্বজনীনতা এবং ধর্মসাম্যমূলক মতবাদ অসাম্প্রদায়িক সমাজ গঠনে বিরাট ভূমিকা রাখতে পারে, কারণ এই দর্শনের মূল কথাই হলো মানুষে মানুষে ভ্রাতৃত্ববোধ। মাইজভান্ডারী (কঃ) আবির্ভাবের পর থেকে বিশ্বঅলি শাহানশাহ হযরত জিয়াউল হক মাইজভান্ডারী (কঃ) পর্যন্ত সকল সাধক পুরুষই এই কথাটি ব্যক্ত করেছেন বিভিন্নভাবে। সমন্বয়ধর্মী, মানবতাবাদী এই দর্শন মানব সভ্যতার বিকাশে অনন্য ভূমিকা পালন করে চলেছে।”
-ডক্টর কামাল হোসেন
[আইনজীবি ও রাজনীতিবিদ, সভাপতি, গনফোরাম, মাইজভান্ডার শরীফ, পূর্বোক্ত, পৃ.১০৩]
১৩. “হযরত শাহ মাওলানা আহমদুল্লাহ সাহেবের মাজার নাজিরহাট রেলষ্টেশন থেকে তিন মাইল দূরে অবস্থিত। তিনি একজন কামেলপীর ছিলেন। তাঁর অনেক কেরামতির কথা জানা যায়। কোনো লোক শাহ সাহেবের নিকট গেলে সে যে উদ্দেশ্যে গিয়েছে তিনি তা তৎক্ষণাৎ বলে দিতে পারতেন।”
-ডক্টর গোলাম সাকলায়েন
[অধ্যাপক, বাংলা বিভাগ, রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়। বাংলাদেশের সুফি সাধক, ইসলামিক ফাউন্ডেশন, ঢাকা, তৃ-স ১৯৮২, পৃ. ৯২-৯৩]
১৪. “হযরত শাহ আহমদ উল্লাহ! ছয়শত বৎসরের মধ্যে এ রূপ অলি আল্লাহ্ পৃথিবীতে আসেননি।”
-শাহ সূফী ছফিউল্লাহ
[কলিকাতা আলীয়া মাদ্রাসার প্রাক্তন মোদার্রেস, কুতুবে জামান। বেলায়তে মোতলাকা, পৃ.৪৩]
১৫. “শাহজালাল পীরের মতোই মাইজভান্ডারের সুপ্রসিদ্ধ পীর হযরত আহমদউল্লাহ সাহেবের জীবনের প্রকৃত মহিমা জানা যায়না। …. তাঁহার জীবনের অনেক গুরুত্বপূর্ণ ঘটনা আড়ালে পড়িয়াছে। …এই পীর সাহেবের জীবনে যে অনেক ত্যাগ, অনেক সাধনা, সহৃদয় প্রবণতা ছিল তাহা কল্পনা করিতে পারি।”
– পল্লী কবি জসীমউদ্দীন
[জসীমউদদীন, মুর্শীদা গান, বাংলা একাডেমী ঢাকা, ১৯৭৭, পৃ. ৬০]
১৬. “দ্বন্দ্ব-সংঘাত বিক্ষুদ্ধ সময়ে ধর্মীয় ও নৈতিকতার উন্নয়নই শুধুমাত্র বিশ্ববাসীকে শান্তি ও ইনসাফের পথ দেখাতে পারে। এই ক্ষেত্রে মাইজভান্ডারী দর্শন বিশ্ব মানবের সুপ্ত মানবতাকে জাগিয়ে তুলতে বিশেষ সহায়ক ভূমিকা রাখতে সক্ষম হবে বলে আমার বিশ্বাস।”
– ব্রাদার জার্লাথ ডি. সুজা
[পরিচালক, বাংলাদেশ ইন্টার রিলিজিয়াস কাউন্সিল ফর পিস এন্ড জাষ্টিস। মাইজভান্ডার শরিফ, পৃ. ১০৫]
১৭. “মাইজভান্ডারী গানের মধ্যে প্রোথিত মাইজভান্ডারী দর্শন, ধর্ম-বর্ণনির্বিশেষে মানবতার জয়গান গেয়ে বিগত শতাধিক বছর ধরে যে ঐতিহ্য সৃষ্টি করেছে তা সকলকে গভীরভাবে অনুপ্রাণিত করে। সমকালীন সময়ের হিংসাবিদ্বেষের মাঝখানে মাইজভান্ডারী দর্শন বিভেদ আর অনৈক্যকে অতিক্রম করে সমন্বয় আর শান্তির ললিতবাণী প্রচারে সক্ষম হবে বলে আমার দৃঢ় বিশ্বাস।”
– ডি. পি. বড়ুয়া
[সাংবাদিক, প্রাক্তন ব্যবস্থাপনা পরিচালক ও প্রধান সম্পাদক –বাসস, মাইজভান্ডার শরিফ, ১০৫]
১৮. “ইসলাম ধর্মের চিরন্তন বাণী ও শাশ্বতরূপকে সর্বসাধারণের কাছে অবিকৃতভাবে তুলে ধরবার ক্ষেত্রে পবিত্র সুফিসাধকেরা যুগ যুগ ধরে ঐতিহাসিক গুরুদায়িত্ব পালন করে এসেছেন। তাঁরা পরিবর্তিত পরিস্থিতির প্রেক্ষাপটে স্থান-কাল-পাত্র ভেদে প্রয়োজনে নতুন আঙ্গিকে নবরূপে ধর্মের সর্বজনীন বাণীকে জনসমক্ষে তুলে ধরার কাজটি করেছেন নিরবচ্ছিন্নভাবে। মাইজভান্ডার দরবার শরিফের অন্যতম মহান সাধক শাহনাশাহ হযরত সৈয়দ জিয়াউল হক মাইজভান্ডারি (কঃ) তাঁর স্বীয় জীবনাচরণ ও পবিত্র চারিত্রিক মহিমায় জাগতিক জীবনকে সুন্দর ও মঙ্গলময় করার প্রেরণা দিয়ে গেছেন।”
– জাতীয় অধ্যাপক ডাঃ নুরুল ইসলাম
[জাতীয় অধ্যাপক ও চিকিৎসা বিজ্ঞানী, প্রতিষ্ঠাতা উপাচার্য, চট্টগ্রাম বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয় – ইউ.এস.টি.সি, মাইজভান্ডার শরিফ, পূর্বোক্ত, পৃ.১০৩]
১৯. গাউছুলআজম মাইজভান্ডারীর উছিলায় সাবরেজিষ্ট্রারি পরীক্ষায় প্রথমস্থান অধিকারী খানবাহাদুর ফজলুল কাদেরের একন্ত স্মৃতিচারনঃ “গাউছুলআজম মাইজভান্ডারীর মেহেরবানী নিয়ে পরীক্ষায় অবতীর্ণ হলাম। অনেক লোকই পরীক্ষা দিলেন। পরীক্ষার প্রশ্নগুলো নতুন হলে ও আমার নিকট পুরাতন মনে হলো। কে যেন আমার অন্তরে বসে উহার উত্তর যোগাচ্ছিলেন, আমি পুলকিত মনে লিখতে লাগলাম। পরীক্ষার ফল প্রকাশিত হলো, আমিই হলাম প্রথম, আমার চাকুরি হয়ে গেল, কয়েক বছরের মধ্যে আমি ইন্সপেক্টর পদে বরিত হই।”
– খানবাহাদুর ফজলুল কাদের
[খানবাহাদুর ফজলুল কাদের, চট্টগ্রামের চন্দনপুরাস্থ এমদাদ আলী দারোগার পুত্র। গাউছুল আজম মাইজভান্ডারীর জীবনী ও কেরামত, পৃ.৯২]
২০. “মাইজভান্ডারী দর্শনের প্রবর্তক হযরত গাউছুল আজম শাহসুফি সৈয়দ আহমদউল্লাহ মাইজভান্ডারীর আবির্ভাবের পর থেকে বিশ্বঅলি শাহনশাহ সৈয়দ জিয়াউল হক মাইজভান্ডরী (কঃ) পর্যন্ত মাইজভান্ডারী সুফিসাধকগণ জাগতিক জীবনকে সুন্দর ও সত্যে দীক্ষিত করে গেছেন।”
– বজলুর রহমান ভঁইয়া
[প্রাক্তন পরিচালক, বাংলাদেশ লোক ও কারুশিল্প ফাউন্ডেশন- নারায়নগঞ্জ। মাইজভান্ডার শরিফ, পুর্বোক্ত ভূমিকাংশ]
২১. “১৯১৮ সনে একবার আমার আব্বার সাথে মাইজভান্ডার শরীফ সফরের ঘটনা মনে পড়ে। হযরত বাবাভান্ডারী কেবলার হুজরা শরীফের সামনে আমার আব্বার সাথে দাঁড়িয়ে বাবাজানের দিকে তাকিয়ে দেখলাম তাঁর হাতে পানি ঢালা হচ্ছিল। ৬৫ বৎসর পূর্বে দেখা সেই শান্ত, সৌম্য, সুন্দর চেহারা আজও আমার মনে আছে। ….১৯৮৪ সনে হজ্ব করতে গিয়ে একদা হেরেম শরীফের কাছাকাছি কোনো কোনো হোটেলে অবাঞ্চিত কাজকর্মের খবর শুনে বিষন্ন ও জিজ্ঞাসু মনে শুয়ে পড়ি। স্বপ্নে কে যেন আমাকে বললেন- “কেন মাইজভান্ডার শরিফ যাওনা” হযরত সৈয়দ জিয়াউল হক নামটি ও উচ্চারণ করলেন। তখন আমার স্মৃতিতে আব্বার সাথে বাবাজানকেবলার জেয়ারত, হযরতকেবলার প্রতি [গাউছুলআজম মাইজভান্ডারি] আল আজহারের রেক্টরের ভক্তি শ্রদ্ধা প্রদর্শনের কথা মনে পড়ল।”
-ব্যারিস্টার বজলুস সাত্তার
[আলহাজ্ব ব্যারিস্টার বজলুস সাত্তারের একান্ত স্মৃতিচারণ। শাহানশাহ জিয়াউল হক মাইজভান্ডারীঃ ব্যক্তি ও ব্যক্তিত্ব, পৃ.৪২]
২২. “মাইজভান্ডার দরবার জাতি-ধর্ম-বর্ণ ও গোত্রের ঊর্ধ্বে থেকে মানব কল্যাণের মহান ব্রতে নিয়োজিত রয়েছে। মানুষের সেবা ও আল্লাহর এবাদত বন্দেগীতে ব্যাপৃত এই দরবার শরিফ। মানবপ্রেম, সামাজিক কল্যাণ ও আত্মীক সমৃদ্ধি অর্জনের ক্ষেত্রে মাইজভান্ডার দরবার শরিফের ভুমিকা আজ সর্বজনস্বীকৃত। এই উপমহাদেশে আধ্যাত্মিক জগতে নতুন ধারার প্রবর্তক, মাইজভান্ডার দরবার শরীফের মহান আধ্যাত্মিক সাধক হযরত মাওলানা সৈয়দ জিয়াউল হক মাইজভান্ডারী (কঃ) দীর্ঘ ছয় দশক ধরে কঠোর-কঠিন সংযম সাধনার মধ্যদিয়ে অগণিত মানুষকে সত্য ও ন্যায়ের পথের সন্ধান দিয়ে গিয়েছেন। তিনি তাঁর স্বীয় জীবনাচরণ ও পবিত্র চারিত্রিক মহিমায় জাগতিক জীবনকে ও সুন্দর ও মঙ্গলময় করার প্রেরণা দিয়েছেন।“
– বেগম খালেদা জিয়া
[চেয়ারপারসন, বাংলাদেশ জাতীয়তাবাদী দল। মাইজভান্ডার শরিফ, পৃ. ১০৯]
২৩. “মাওলানা সাহেবের [মাওলানা সৈয়দ আহমদউল্লাহ মাইজভান্ডারী] বাড়িতে প্রবেশ করিলাম। ….বিভিন্ন প্রশ্নের উত্তর দিয়া বলিলাম বাবা দোয়া চাই। এই কথাতে হাত উঠাইয়া দোয়া করিলেন। …..ফকির সাহেবের অনেক অলৌকিক শক্তি ছিল। কথিত আছে যে, তিনি প্রতি শুক্রবার মক্কা শরীফে নামাজ পড়িতেন।”
– মহর্ষি মনোমোহন দত্ত
[সুকুমার বিশ্বাস, মনোমোহন দত্ত, বাংলা একাডেমী, ঢাকা, ১৯৯২, পৃ.২৯]
২৪. মাওলানা অলি আহমদ নিজামপুরী ছিলেন একজন দেওবন্দপাশ সুপ্রসিদ্ধ আলেম ও কামেল পীরে তরিকত। তিনি হযরত গাউছুল আজম মাইজভান্ডারীর উপর অগাধ ভক্তি ও বিশ্বাস রাখতেন। শেখ মোছলেহ উদ্দিন নামে তাঁর এক ভক্ত মাইজভান্ডারীর মাঘ মাসের (১৯৫১) ওরশকালীন রীতিনীতি সম্পর্কে বিরূপ মন্তব্যের পরিপ্রেক্ষিতে তিনি বলেন-“মাটির উপর নাচ গান করলে কী হবে? মাটির নীচে উত্তম জিনিসই আছে। হযরত মাওলানা শাহসুফি আহমদউল্লাহ (কঃ) চট্টগ্রামের একজন সর্বশ্রেষ্ঠ বুজুর্গ ও আলেম ছিলেন। তাঁর এন্তেকালের পর মাযার শরীফে কী হচ্ছে উহার জন্যে তিনি দায়ী নহেন।“
– মাওলানা অলি আহমদ নিজামপুরী
[গাউছুল আজম মাইজভান্ডারীর জীবনী ও কেরামত, পৃ. ২১৬]
২৫. চট্টগ্রামের ঐতিহ্যবাহী আন্দরকিল্লাহ জামে মসজিদের প্রাক্তন ইমাম, চট্টগ্রাম দারুল উলুম মাদ্রাসার প্রাক্তন মোদার্রেস; মোহাদ্দেস, মাওলানা ছফিরুর রহমান হাশেমী সাহেবের জামাতা হেজাজী সাহেব চট্টগ্রামের মাওলানা আব্দুল হক মরিয়মনগরীকে “মাইজভান্ডারী” বলে ঠাট্টা করায় মাওলানা ছাফরুর রহমান সাহেব তদীয় জামাতার উপর অসন্তুষ্ট হয়ে তিরস্কার করে বলেন- “মাইজভান্ডার দরবার সম্বেন্ধে ভবিষ্যতে কিছু বলবেনা। কারণ উক্ত দরবারের শান মান খুব বড়, যা সকলের বোধগম্য হবেনা।”
– মাওলানা ছফিরুর রহমান হাশেমী
[বেলায়তে মোতলাকা, পূর্বোক্ত, পৃ.৫৩]
২৬. “মাইজভান্ডার দরবার শরীফ মহান অলি-আল্লাহর দরবার। বিপন্ন মানবতাকে রক্ষা করার জন্য এই দরবার কাজ করে চলেছে প্রতিনিয়ত। জাতি- ধর্মের কোনো ভেদাভেদ নেই এখানে। প্রত্যেক ধর্ম- বর্ণ – শ্রেণী- গোত্রের মানুষ এই দরবারে গিয়ে শান্তি পায়। এই দৃষ্টিতে মাইজভান্ডার দারবার শরিফ শান্তির মহাকেন্দ্র।“
– ডক্টর মাওলানা জামাল উদ্দীন কাদেরী
[প্রাক্তন অধ্যাপক, নাজুয়া বিশ্ববিদ্যালয়, ভারত। মাসিক আলোকধারা, সেপ্টেম্বর ১৯৯৭]
২৭. গাউছুলআজম মাইজভান্ডারির ওফাতের পর চট্টগ্রামের মোহছেনিয়া মাদ্রাসার প্রাক্তন সুপারিনডেন্ট, কলিকাতা নিবাসী মাওলানা জুলফিকার আলীর ফার্সী ভাষায় লিখিত প্রশংসাবাণীর ভাবানুবাদ-“গাউছে মাইজভান্ডারের নিঃশ্বাসের বরকতে পূর্বদেশবাসীরা আল্লাহপন্থী ও ছাহেবে হাল জজবার অধিকারী হন। তাঁর মাজারপাকের বরকতে বুজুর্গানের এই দেশীয় কবরের মধ্যে জালালী ও রওনক [উজ্বলতা] এনে দিয়েছে। সর্দারে আউলিয়া হযরত আহমদউল্লাহর ছিফত বা উপাধি গাউছুল আজম।“
– মাওলানা জুলফিকার আলী
[বেলায়তে মোতলাকা, পূর্বোক্ত, পৃ. ৪০। উল্লেখ্য, এটি মূল ফার্সি ভাষার পাথরে খোদিত করে গাউছুল আজম মাইজভান্ডারীর রওজা মোবারকের মেহরাবে সংযুক্ত করা হয়েছিল]
২৮. “বঙ্গদেশে আসিয়া মাইজভান্ডারী সম্বন্ধে বহু বিরূপ আলোচনা শুনিয়াছি। কিন্তু আমরা স্বচক্ষে যাহা দেখিলাম, তাহাতে বুঝিতে পারিলাম মাইজভান্ডার সবকিছু।“
– Mr. MACKENJEE
[ভূতপূর্ব ডিষ্ট্রিক ম্যাজিষ্ট্রেট, বেলায়তে মোতায়ে মোতলাকা, পূর্বোক্ত, ভূমিকাংশ]
২৯. আধ্যাত্মিক পরিমণ্ডলে মানবতার জয়গানে মুখরিত, ধর্ম-সাম্যের বক্তব্য নিয়ে হিন্দু-মুসলমান-বৌদ্ধ-খ্রিষ্টান সকল ধর্মের অপূর্ব মিলনকেন্দ্র হিসেবে বিগত শতাধিক বছর ধরে মাইভান্ডার দরবার শরীফ এক অনন্য সমন্বয়ধর্মী ঐতিহ্যের সৃষ্টি করেছে। মানবপ্রেম, সামাজিক কল্যাণ ও আত্মিক সমৃদ্ধি অর্জনের ক্ষেত্রে মাইজভান্ডার দরবার শরীফ এর ভূমিকা সর্বজনস্বীকৃত।
– মিজানুর রহমান চৌধুরী
[রাজনীতিবিদ, প্রাক্তন প্রধানমন্ত্রী, গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশ সরকার। মাইজভান্ডার শরীফ, পৃ. ১০৩]
৩০. “মাইজভান্ডারের দরগাহে ‘হালকা’ ও ‘সামা’ প্রায় সবসময়, বিশেষত বার্ষিক মেলার (উরস) সময় মহাসমারোহ সহকারে অনুষ্ঠিত হয়। হালকা বৃত্তাকার নর্তন মাওলানা রূমী প্রবর্তিত মৌলবি সম্প্রদায়ের বৈশিষ্ট্য। আর ‘সামা’ বা সঙ্গীত সাহায্যে মহিমাকীর্তন চিশতিয়া খান্দানের বৈশিষ্ট্য। মাইজভান্ডারে নানাস্থানের বাউল ফকির ও মেলার সময় একতারা দোতারা হাতে ভীড় জমায়।“
– ডক্টর মুহম্মদ এনামুল হক
[শিক্ষাবীদ ও গবেষক, প্রথম পরিচালক, বাংলা একাডেমী, ঢাকা। জীবনবাতি, সম্পাদক ঃ সৈয়দ সহিদুল হক, মাইজভান্ডার দরবার শরীফ, চট্টগ্রাম, ১৯৮২, পৃ. ২৫-২৬]
৩১. “চট্টগ্রাম জেলার মাইজভান্ডার মারফতি ফকিরদের একটি প্রধান কেন্দ্র। মাইজভান্ডার নামক একটি গ্রামে এই মারফতি দায়েরার প্রতিষ্ঠাতা একজন সুফি ও আলেম ছিলেন। তাঁহার দরবারে সর্বদা আল্লাহর জিকির হইত। সঙ্গে সঙ্গে তাল-লয় যন্ত্র সহকারে গান বাজনাও হইত।”
– মুহম্মদ মনসুর উদ্দীন
[স্বনামধন্য ফোকলোর সংগ্রাহক ও গবেষক। হারামণি, ৭ম খন্ড বাংলা একাডেমী, ঢাকা দ্বি-স, ১৯৭৮, পৃ.৫২-৫৩]
৩২. “এ উপমহাদেশে অধ্যাত্ম জগতের পরিমন্ডলে মাইজভান্ডারী দর্শন যে অবদান রেখেছে তার সুম্পষ্ট স্বাক্ষর মানব কল্যাণ তথা জীবনপ্রবাহের বাঁকে বাঁকে দেদীপ্যমান।“
– বিচারপতি মোঃ আবদুর রউফ
[বিচারপতি, আপিলবিভাগ, বাংলাদেশ সুপ্রিমকোর্ট। আলোকধারা, ১৯৯৭]
৩৩. “মানব কল্যাণের জন্য মাইজভান্ডারী দর্শনের শান্তির ললিতধারা বয়ে চলবে অনন্তকাল ধরে।“
– ডঃ মোঃ তৌহিদুল আনোয়ার
[অধ্যাপক, সাংবাদিকতা বিভাগ, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়, প্রাক্তন মহাপরিচালক বাংলাদেশ প্রেস ইন্সটিটিউট। মাইজভান্ডার শরিফ, পৃ.১০৫]
৩৪. “ভূখন্ড ও ভাষাগত জাতীয়তার নিরিখেও মাইজভান্ডার দরবার শরীফের একটি বৈশিষ্ট্য আছে। বিশ্বের শ্রেষ্ঠতম মানব মহানবী হযরত মোহাম্মদ মোস্তফা (সঃ) প্রচারিত ইসলাম ধর্মের মর্মবাণীকে হযরত গাউছুল আজম মাইজভান্ডারী (কঃ) তাঁর স্বদেশ বাংলাদেশ ও তাঁর স্বজাতি বাঙালি জাতির সামগ্রিক পরিবেশের সাথে খাপ খাইয়ে সময়োপযোগী পথ নির্দেশ দিয়ে গেছেন। ইসলামের অন্যতম সামাজিক মর্মবাণী বিচারসাম্যকে তিনি মাইজভান্ডারী তরিকার সামাজিক মূলনীতি হিসেবে গ্রহণ করেছেন। সূক্ষতার চূড়ান্ত বিশ্লেষণে কেবল মানুষ নয়, সকল সৃষ্টজীবই বিচারসাম্যের এই নীতিতে মহাজগতের বর্তমান অস্তিত্বকে টিকিয়ে রেখেছে।“
– মোঃ মাহবুব- উল-আলম
[সাংবাদিক, সিনিয়র সহ-সম্পাদক, দৈনিক আজাদী, চট্টগ্রাম। সম্পাদকঃ আলোকধারা। মাইজভান্ডার শরীফ পৃ. ১০৯]
৩৫. “চট্টগ্রামের মাইজভান্ডার শরীফ অতি পরিচিত একটি নাম। ধর্ম-বর্ণ নির্বিশেষে মানুষকে ভালোবাসার যে কথা মাইজভান্ডারে দেখি, তা সকল ধর্মের মূলকথা। মাইজভান্ডার দরবার শরীফের আধ্যাত্মিক পুরুষকে জানার ক্ষেত্রে আল্লাহর-রসুলের পথে চলার ক্ষেত্রে অনুপ্রাণিত করুক এটি আমার একান্ত কামনা।“
– মোহাম্মদ হারুন- উর- রশিদ
[অধ্যাপক, ইংরেজি বিভাগ, জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়; প্রাক্তন মহাপরিচালক, বাংলা একাডেমী মাইজভান্ডার শরীফ, পৃ. ১০৪]
৩৬. “বিগত শতাধিক বছর ধরে মাইজভান্ডার নামটি বিভিন্ন কারণে অতিপরিচিত একটি নাম। আধ্যাত্মিকতার পাশপাশি এর আর একটি বিশেষত্ব মাইজভান্ডারী সঙ্গীতধারা। মাইজভান্ডারী তরিকাকে কেন্দ্র করে মাইজভান্ডারী সঙ্গীতের যে ধারা তা আমাদের সঙ্গীত জগতকে করেছে সমৃদ্ধ।“
– মোবারক হোসেন খান
[সঙ্গীত বিশেষজ্ঞ, ওস্তাদ আলাউদ্দীন খাঁ ঘরানার সদস্য। প্রাক্তন মহাপরিচালক, শিল্পকলা একাডেমী। মাইজভান্ডার শরীফ, পৃ. ১০৪]
৩৭. “মাইজভান্ডারী গানের মরমে যাঁরা প্রবেশ করেছেন তাঁরাই জানেন, এই গান এবাদতের সাথে সম্পর্কিত। মাওলানা জালালউদ্দীন রূমী আজ থেকে সাতশো বছর আগে কোনিয়াতে যে সামা গানের মধ্যে নিজেকে সমর্পিত করতেন, আমাদের মাইজভান্ডার শরিফের গান সেই সামারই অংশ। দেহ- মন পবিত্র করে সুরের ফেনিল ঢেউয়ে নিজেকে সমর্পিত করে সেই পরমাত্মাকে অন্বেষণ, এ বড়ই আনন্দের সন্তরণ।“
– মোস্তাফা জামান আব্বাসী
[কন্ঠশিল্পী ও লোকসঙ্গীত বিশেষজ্ঞ। “মরমী” ৯৭]
৩৮. “I am extremely happy to have been aguest in the home of the religious leader [Maizbhandar Sharif] and to view the activities of a great festival as is taking place.”
– Robert W. Fawler
[J.C.A. Agriculture Advisor. বেলায়তে মোতলাকা]
৩৯. “মাইজভান্ডারী সাধনা যেমনি ইসলামের সৌন্দর্য ও ভিত্তিকে গণমুখী করেছে, তেমনি বাঙালি সংস্কৃতির ধারায় সংযোজিত করেছে একটি স্বতন্ত্র সাংগীতিক উজ্জীবনের। সঙ্গীতের মাধ্যমে মহান আল্লাহ ও পীরের স্বরণ মাইজভান্ডারী ধারার একটি উল্লেখযোগ্য শিল্পময়তা- যা বাঙালি সংস্কৃতিকে দিয়েছে নতুন মাত্রা।“
– শেখ হাসিনা
[রাজনীতিবিদ, সভাপতি, বাংলাদেশ আওয়ামীলীগ; প্রধানমন্ত্রী, গনপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশ সরকার। মাইজভান্ডার শরীফ, পূর্বোক্ত, পৃ. ১০২]
৪০. “যাঁরা যথার্থ ধার্মিক, সত্যপথ-সন্ধানী তাঁরা ইসলামের উদার, সার্বজনীন মতবাদকে অবলম্বন করে ইসলামের মর্যাদা রক্ষা করে আজ ও দৃপ্তবাণী প্রচার করে যাচ্ছেন। আধ্যাত্মিক ও বর্তমান জগতের গতিশীল প্রবাহে সামঞ্জস্য বজায় রেখ প্রকৃত ইসলাম প্রচারে বহু দিনের ঐতিহ্যবাহী মাইজভান্ডার দরবার এই ঔদার্য, সত্যনিষ্ঠ, সুন্দর মহৎ সাধনায় এই পৃথিবী মানবতার জয়গানে ইসলামের সত্য আলোকে উদ্ভাসিত সমাজ সুসংবদ্ধ হয়ে মানবজীবনকে শান্তিময় পথ প্রদর্শন করে সাম্যে, ঐক্যে, সেবায় মহীয়ান হয়ে থাকবে।“
– সুফিয়া কামাল
[কবি, নারীনেত্রী ও সমাজকর্মী । মাইজভান্ডার শরীফ, পূর্বোক্ত, পৃ.১০৫]
৪১. “মাইজভান্ডারী তরিকার প্রবর্তক হযরত শাহ আহমদউল্লাহ চট্টগ্রাম শহর থেকে ২৬ মাইল দূরবর্তী ফটিকছড়ি থানার মাইজভান্ডার গ্রামে জন্মগ্রহণ করেন। তিনি গভীর পান্ডিত্যের অধিকারী ও একজন প্রখ্যাত সুফি ছিলেন। প্রতিবছর ১০ই মাস তাঁর হাজার হাজার মুরিদ এখানে সমবেত হয়ে ওরস উদযাপন করে। তাঁর ওফাতের পর তাঁর ভ্রতুষ্পুত্র শাহ গোলামুর রহমান তাঁর জামাতের নেতৃত্ব গ্রহণ করেন। তিনিও সুফি হিসেবে পিতৃব্যের ন্যায় খ্যাতি অর্জন করেন। তিনি সুফিবাদের মৌলবিয়া তরিকাকে পুনরুজ্জীবিত করেন। এক বিশেষ ধরনের বাদ্য ও নৃত্য তাঁদের ঐশী ধ্যানপদ্ধতির অপরিহার্য অঙ্গ বলে বিবেচিত হয়।“
– সৈয়দ মর্তুজা আলী
[ইসলামিক একাডেমী পত্রিকা, ৩য় বর্ষ ১ম সংখ্যা, পৃ. ৯২]
৪২. “কুশাসন, অবিচার, অবহেলায় যখন ভুমন্ডেলের এ অংশ অন্ধকারে নিপতিত ছিল তখন বিভিন্ন সময়ের ব্যবধানে অনেক অলিআল্লাহর আবির্ভাব ঘটেছে এই উপমহাদেশে — সমাজসংস্কারক হিসেবে। এই নিরিখে হযরত শাহজালাল (রঃ), হযরত শাহপরান (রঃ), হযরত শরফুদ্দিন চিশতি (রঃ), শাহআলী বোগদাদী (রাঃ) , শাহ মখদুম (রঃ) , খানজাহান আলী (রঃ) এর নাম বিশেষভাবে উল্লেখযোগ্য। মাইজভান্ডারের সাধক-পুরুষ সৈয়দ জিয়াউল হক (কঃ) সারাজীবন নিজেকে মানবকল্যাণে উৎসর্গ করে যে মহান আদর্শ রেখে গেছেন, তা অনুকরণীয় এক বিরল দৃষ্টান্ত।“
– হুমায়ন রশীদ চৌধুরী
[স্পিকার, বাংলাদেশ জাতীয় সংসদ। আলোকধারা-৯৭]
৪৩. “মাইজভান্ডার দরবার শরীফ এক অফুরন্ত আলোর ভান্ডার। হিন্দু-মুসলিম-বৌদ্ধ-খ্রিষ্টান সকলের মুক্তির পথ এখানে চির উন্মুক্ত। এ কারণে মাইজভান্ডারী তরিকার আবেদন সার্বজনীন ও সুদূরপ্রসারী।“
– ড. মুহাম্মদ আবদুল মান্নান চৌধুরী
[অধ্যাপক, অর্থনীতি বিভাগ, চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়, উৎসধারা]
৪৪. “ধর্মীয়- শিক্ষা বিস্তারের মাধ্যমে মানবিক গুণাবলীর বিকাশ ঘটিয়ে সমাজে শান্তি ও শৃঙ্খলা বজায় রাখতে আধ্যাত্মিক যুগ-পুরুষদের অবদান শ্রদ্ধার সঙ্গে স্মরনীয়। এই ধারায় বিগত শতাধিক বছর ধরে আমাদের দেশে ধর্মীয় অঙ্গনে মাইজভান্ডার শরীফ এক তাৎপর্যপূর্ণ বিশাল প্রতিষ্ঠানে পরিণত হয়েছে।“
– আবদুল্লাহ আল নোমান
[সাবেক মন্ত্রী, মৎস ও পশু সম্পদ মন্ত্রণালয়। করুণাধারা, পূর্বোক্ত]
৪৫. “মাইজভান্ডার দরবার শরীফের হযরত মাওলানা শাহসুফি সৈয়দ আহমদউল্লাহ সাধনার যে পদ্ধতিটি উদ্ভাবন করেছিলেন তাঁর কতিপয় প্রণিধানযোগ্য বৈশিষ্ঠ্য অবশ্যই রয়েছে। তিনি মানবমুক্তির এমন একটা পন্থা উদ্ভাবন করেছেন যেখানে ধর্মে-ধর্মে, সম্প্রদায়ে-সম্প্রদায়ে বিরোধ এবং সংঘাতের বদলে অন্তর্নিহীত ঐক্যের প্রশ্নটিই অগ্রাধিকার লাভ করেছে।“
– আহমদ ছফা
[সাহিত্যক। ১৭.৪.৯৫ বাংলা একাডেমী- ঢাকার সেমিনারে প্রঠিত মূল প্রবন্ধ]
৪৬. “বাংলায় অধ্যাত্ম- চর্চা ও সঙ্গীতের ইতিহাসে মাইজভান্ডারী সঙ্গীত এক অপূর্ব সংযোজন। এ গানগুলো অসাম্প্রদায়িক চেতনায় ও অনন্য শিল্পগুণে গুণান্বিত।“
– ড. মোহাম্মদ মনিরুজ্জমান
[অধ্যাপক বাংলা বিভাগ, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়। ১৭.৪.৯৫ বাংলা]
৪৭. “মাইজভান্ডারী গান বাংলার লোক সঙ্গীতের সমৃদ্ধ একটি ধারা। এর সঙ্গে গোটা পরিবেশ- পরিস্থিতিসহ এই সঙ্গীতকে শুধুমাত্র বাংলাদেশে নয়; বহির্বিশ্বেও তুলে ধরার ব্যাপারে আামরা একটা উদ্যোগ গহণ করেছি। মাইজভান্ডারী গানে মাধুর্যতা আছে, তন্ময়তা আছে, গভীরতা আছে; এর পাশাপাশি লৌকিক গানের যে সৌন্দর্য তাও আছে, এতদসঙ্গে সাধন তত্ত্বও আছে। সর্বোপরি এর মধ্যে লোকজধর্ম ও সনাতন ধর্মের একটা সম্পর্ক আছে। তার চেয়েও বড় কথা, বিভিন্ন সম্প্রদায় এই সঙ্গীত অত্যন্ত মনোযোগ দিয়ে হৃদয়ঙ্গম করে। তারা শুধুমাত্র বুদ্ধি-বিবেচনা, চিন্তা ও মস্তিস্ক দিয়ে নয়; অন্তর থেকে গভীর শ্রদ্ধার সঙ্গে এ গান শ্রবণ করে, এর সাথে একাত্ম হয়ে যায়। বলাবাহুল্য, এ গানে এ ধরনের স্বতন্ত্র বৈশিষ্ট্য, এর দার্শনিকতা ও ধর্মীয় তন্ময়তা শ্রোতাদের আকর্ষণ ও আবিষ্ট করে। এ গানের সাথে রয়েছে জনজীবনের ক্রমসম্প্রসারমান একটি সম্পর্ক।‘
– ডক্টর লাউরি হারবিলাহত্তি
[প্রফেসর, ফোকলোর বিভাগ, হেলসিংকি বিশ্ববিদ্যালয়, ফিনল্যান্ড। হেলসিংকিতে অনুষ্ঠিত ( জুলাই’ ৯৭) আন্তর্জাতিক ফোকলোর সম্মেলনে উপস্থাপিত প্রতিবেদন]
৪৮. “সঙ্গীত সম্পর্কে, বিশেষত লোকসঙ্গীত সম্পর্কে শেষ কথা বলা যায়না। সঙ্গীতের একটা ঘরানা যখন নির্দিষ্ট হয়ে যায়, তখন তার ব্যাখ্যা বিশ্লেষণ দেওয়া যতটা সহজ, লোকসঙ্গীত সম্পর্কে ব্যাখ্যা বিশ্লেষণ দেওয়া ঠিক তেমনিভাবে কঠিন।…সমন্বয়বাদী এক সমৃদ্ধ সঙ্গীত ধারার নাম মাইজভান্ডারী গান। এখন চট্টগ্রাম গেলে যে কোনো এলাকায় মাইজভান্ডারী গান ব্যাপকভাবে শুনা যায়। বর্তমানে রেডিও-টেলিভিশনে ও এটি স্থান পেয়েছে। মধ্যপ্রাচ্যের দরবেশ নৃত্যের সাথে মাইজভান্ডারী গানের একটা সাদৃশ্য আমরা খুঁজে পাই। সুফি, বৈষ্ণব, শাস্ত্রীয়, বাউল, ভাটিয়ালি সব মিলে একটা নতুনধারা, একটা নতুন সত্তা, একটা নতুন চরিত্র আমরা লক্ষ্য করি। সে জন্যই ETHNO-MUSICOLOGYটা বিশেষ করে দরকার। এর মাধ্যমে নানাভাবে এর সুর, গায়ন পদ্ধতি, এর ইতিহাস সব কিছু ভেঙে ভেঙে এর থেকে এর মৌলিক যে চরিত্র তা খুঁজে বের করা যায়।“
– শামসুজ্জামান খান
[মহাপরিচালক, জাতীয় যাদুঘর-ঢাকা। প্রাক্তন পরিচালক, গবেষণা সংকলন ও ফোকলোর বিভাগ, বাংলা একাডেমী ঢাকা। সোনরগাঁ ফাউন্ডেশনের [বাংলাদেশ লোক ও কারুশিল্প ফাউন্ডেশন] উদ্যোগে লোক কারুশিল্প মেলা ও লোকজ উৎসব ’ ৯৬ উপলক্ষে মাইজভান্ডারী গানের সেমিনারে বিশেষ অতিথির ভাষণ]
৪৯. “যুগে যুগে পৃথিবীতে অনেক মহাপুরুষের আবির্ভাব ঘটেছে। মানুষ যখন পাপে ও অজ্ঞানতায় অন্ধকারের দিকে ধাবিত হতে থাকে তখন পীর আউলিয়ারা মানুষকে সত্য ও সুন্দরের পথ দেখায়। মাইজভান্ডারী তরিকা হল দুঃখী মানুষকে আশার বাণী শুনানো, তাদের সাহায্য করা। এ কারণে মাইজভান্ডারী ভক্তকুলের তরিকা ও আদর্শকে আমাদের আরো বেশি করে গুরুত্ব দেওয়া প্রয়োজন।“
-ড. আশরাফ সিদ্দিকী
[স্বনামধন্য ফোকলোর বিশেষজ্ঞ, বুদ্ধিজীবী]
৫০. ‘মাইজভান্ডার’ শব্দটি উচ্চরিত হলে প্রথমেই ছোট বেলার স্মৃতিময়তা আমাকে আচ্ছন্ন করে। একেবারে আমার শিশুকালেরই কথা আমাকে টেনে নিয়ে যায় পেছনে; কেননা আমি আটবছর বয়সে আমার গ্রাম ছেড়েছিলাম, সেইসবুজ গ্রাম, যার নাম বক্তপুর-আমাদের প্রাণের মাইজভান্ডার থেকে যার দূরত্ব মাত্র দু’মাইল। আমার জেলাশহর চট্টগ্রামে কোনদিন বসবাস করিনি। সুতরাং আবশ্যিকভাবেই ‘মাইজভান্ডার’কে ঘিরে আমার স্মৃতিময়-কথকতা, আমার শিশুকালেরই আনন্দময় অনুভবের কথা। সেই গানের কলি “ঘুরি ঘুরি চাক্কা চলে মনভূবনের রেল গাড়ি। মাইজভান্ডারে যাইবানিরে, পাড় করাইবো ভান্ডারী।” এখনো কানে সুমধুর গীতলতায়া ধ্বনিত প্রতিধ্বনিত হয়। আমাদের মতো অনেক প্রাগ্রসর তরুণের একদা যৌবনের বোধন হয়েছিলো রমেশ শীলের গানের মাধ্যমে। আমরা আত্মচয়ন করেছিলাম এই মহৎ গীতিকারের ভাবনারাশিতে অবগাহণ করে। আশ্চর্য হয়ে লক্ষ করেছিলাম, মানবতাবাদী এই মহান গীতিকারও অবগাহন করেছিলেন মাইজভান্ডারের প্রেম-সাগরে।
মাইজভান্ডারে আরো এমনি অনেক কবি আছেন, যাঁরা মূলত সাধক। এঁরা মুর্শিদের পূজারী। বস্তুত এঁদের অনেকের স্কুলের পাঠ নেই; কিন্তু “যে ইশকুল মওলা খুইলাছে-” সেখানে “সিনায় সিনায়” যে পাঠ নেওয়া হয়, পাঠ দেয়া হয় তা আমাদের সাধারণ মানুষের চিন্তা ও ধর্তব্যের অতীত। যেমন “লাইন ছাড়া চলে না রেলগাড়ি” তেমনি মাইজভান্ডারের সাধক-কবিদের সঙ্গে অসংখ্য মানুষ মর্শিদ ছাড়া কী করে পরমাত্মার সঙ্গে মিলনে পারঙ্গম হবেন? আমার এতো বড়ো বয়সে এখনো এর কোন উত্তর পাইনা। কর্মজীবনের ফাঁকে এখনো ছুটে যাই আমার শিশুকালের মাইজভান্ডারে; যেখানে মানুষের মনের গহীনে লুকানো রয়েছে আত্মার- ভান্ডার।“
– ফারুক আলমগীর
[উপ-মহাপরিচালক [বার্তা], বাংলাদেশ টেলিভিশন, ঢাকা]
৫১. “মাইজভান্ডারী তরিকা হল স্রষ্টার সাধনা, ধৈর্য সত্যের পথে কাজ করা জ্ঞানী ও চরিত্রবান হওয়া এবং মানবতার ঐক্যের সাধনা করে সুন্দর-সমাজ গঠনে আত্মনিয়োগ করা। বাস্তবে মাইজভান্ডারী আদর্শ অনুসরণ করতে পারলে সবাই মিলে সুন্দর ও শান্তিপূর্ণসমাজ গঠন করতে পারব।“
-ব্যারিষ্টার মইনুল হোসেন
[সম্পাদক মন্ডলীর সভাপতি, দৈনিক ইত্তেফাক ও নিউ নেশান]
৫২. “ঊনবিংশ শতাব্দীর মাঝামাঝি সময় থেকে শাহ আহমদ উল্লাহ মাইজভান্ডারী তাঁর দর্শনের কথা জানিয়েছেন ভক্তদের কাছে। তাঁর চিন্তা- চেতনা বাংলাদেশের মানুষের মধ্য দিয়ে বিকশিত হচ্ছে বিগত শতাধিক বছর ধরে। এ দেশের আপামর জনগণ , বিশেষভাবে পল্লী অঞ্চলের মানুষের মনের গভীরে যে সুদূরপ্রসারী প্রভাব তিনি ফেলেছেন তা আমাদের দেশ তথা মানব সমাজের উদার মননশীলতার উন্নয়নের ক্ষেত্রে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে চলেছে। এটা আমাদের অমূল্য সম্পদ। তাই এই দর্শন চর্চা করতে হবে। এর লালন, প্রচার ও সংরক্ষণে জনগণকে এগিয়ে আসতে হবে। আমার একান্ত স্বীয় অভিব্যক্তি- আমি নিজেও মানবধর্ম চর্চার এই মহৎ কর্মের ধারায় নিজেকে নিবেদন করে রাখতে চাই।
যুগপৎ স্বতন্ত্র ভাষা ও স্বতন্ত্র ভূখন্ডের জন্যে অকাতরে জীবন বিসর্জন দেওয়ার দুর্লভ গৌরবে গৌরবান্বিত বাংলাদেশ একদিন মানবধর্ম চর্চার ক্ষেত্রে ও বিশ্বের ইতিহাসে আদর্শের প্রতীক হিসেবে সম্মানিত হবে, এটা আমার দৃঢ় বিশ্বাস। আর এটি ও অনস্বীকার্য, এই গৌরবগাঁথার নেপর্থে উল্লেখযোগ্য অবদান রাখতে সক্ষম হবে ‘মাইজভান্ডারী সংস্কৃতি’।“
– আজাদ রহমান
[সঙ্গীত পরিচালক, সঙ্গীত শিক্ষক, গীতিকার , লেখক, চলচ্চিত্র পরিচালক, মহা পরিচালক, বাংলাদেশ শিল্পকলা একাডেমী]
৫৩. ‘মাইজভান্ডার’ চট্টলার একটি প্রত্যন্ত পল্লী। এই নিভৃত দুর্গম পল্লী- জনপদের নামেই পরিচিতি পেয়েছে আমাদের দেশের এক বিশিষ্ট সঙ্গীতাশ্রয়ী অধ্যাত্মবাদী সম্প্রদায়। সুফিতত্ত্বের সঙ্গে দেশজ লৌকিক মরমী সাধনার মিলন ঘটেছে মাইজভান্ডারী তত্ত্ব ও দর্শনে। অসাম্প্রদায়িক চেতনা, মানব-মহিমার জয়কীর্তন, ধর্মীয় সমন্বয়বাদ, সর্বজনীন কল্যাণচেতনা, নিগূঢ় আধ্যাত্ম উপলদ্ধি, শাস্ত্রাচারের উপরে প্রেম-ভক্তির সাধনাকে স্থাপন লৌকিক বাংলার মরমী সাধনার এইসব বৈশিষ্ট্য মাইজভান্ডার সম্প্রদায়ের বিশ্বাস ও আচরণে প্রতিফলিত। সঙ্গীত এই সম্প্রদায়ের সাধনার এক প্রধান অবলম্বন। প্রায় শতাব্দী জুড়ে জাতধর্মনির্বিশেষে মানুষের অধ্যাত্ম- ক্ষুধা ও রস-তৃষ্ণা নিবারণ করে আসছে এই সঙ্গীত। কবিয়াল রমেশ শীলের মতো উদার অসাম্প্রদায়িক অসাধারণ লোক-ব্যক্তিত্বের যোগ মাইজভান্ডার-সঙ্গীতের ধারায় নির্মাণ করেছে একটি নতুন ‘ঘরানা’। মাইজভান্ডার সম্পর্কে ক্রমশ বিদেশীদের মনোযোগ ও আকৃষ্ট হচ্ছে। বিশিষ্ট লালন-গবেষক ডক্তর ব্যারল সলোমন একবার অন্তরঙ্গ আলাপচারিতার মুহুর্তে আমাকে কলেছিলেন, লালন-বিষয়ে তাঁর গবেষণা শেষ হলে তিনি মাইজভান্ডার সম্প্রদায় সম্পর্কে কাজ করতে আগ্রহী। তিনি মন্তব্য করেছিলেন, মাইজভান্ডার বাংলার লোকায়ত সাধনা ও সঙ্গীতের উত্তরাধিকারকেই বহন করে চলেছে এবং এই সম্প্রদায় অন্যান্য মরমী সম্প্রদায়ের সমানধর্মা।
অবিশ্বাস ও সংশয়, সন্ত্রাস ও সংহারের ক্রান্তিলগ্নে মাইজভান্ডারের মতো মানবপ্রেমী, সম্প্রদায়-সম্প্রীতিকামী, উদার মানবিকবোধ উদ্বুদ্ধ সম্প্রদায়ের নিকট থেকে শুধু মুক্তি- মোক্ষের অধ্যাত্মপ্রাপ্তিই নয়- জীবনের স্বপক্ষে আনন্দ-কল্যাণের জাগতিক-প্রাপ্তিও হয়তো সম্ভব বলে আমাদের বিশ্বাস।“
– আবুল আহসান চৌধুরী
[লালন গবেষক, বাংলা বিভাগ, ইসলামী বিশ্ববিদ্যালয়, কুষ্টিয়া]
৫৪. “সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতি এবং অসাম্প্রদায়িক গণচেতনার প্ল্যাটফর্ম সৃষ্টিতে মাইজভান্ডার শত বছরের ইতিহাসে যে ঐতিহ্য সৃষ্টি করেছে তা সত্যিই প্রশংসনীয়। মাইজভান্ডারের আরেক উল্লেখযোগ্য বিশেষত্ব মাইজভান্ডারী গান। বাংলার লোক সঙ্গীতে এ গান তাৎপর্য্যপূর্ণ ভূমিকা রেখে চলেছে।“
– এ.কে.আজাদ চৌধুরী
[উপাচার্য, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়]
৫৫. “মাইকেল-রবীন্দ্রনাথ-নজরুল প্রমুখ বাংলা সাহিত্যের স্বনামধন্য লেখকের এক অপূর্ব সমাবেশ ঘটেছিল বিগত ঊনবিংশ শতাব্দীতে। বাংলা সাহিত্যের এই স্বর্ণযুগের পাশাপাশি বাংলার সূফী সাধনার ইতিহাসেও ঊনবিংশ শতাব্দী একটি উল্লেখযোগ স্থান দখল করে আছে। এই শতাব্দীতে সুফি সাধকদের চারণক্ষেত্র বাংলার পবিত্র মাটিতে আবির্ভাব ঘটেছিল দুই সুমহান সুফি সাধকের । (১) হযরত শাহসুফি খানবাহাদুর আহছানউল্লা (১৮৭৩-১৯৬৫) এবং (২) হযরত শাহ সুফি সৈয়দ আহমদ উল্লাহ মাইজভান্ডারী (১৮২৬-১৯০৬) । বিশুদ্ধ সুফিতত্ত্বের ধারায় আজীবন স্নাত এই দুই সুমহান সুফিসাধক স্ব স্ব মহিমায় বাংলার সুফিসাধনার ইতিহাসে অক্ষয় অমর হয়ে আছেন। বাংলাদেশের মাটিতে একটি স্বতন্ত্র তরিকার প্রবর্তকের ঐতিহাসিক গৌরব নিয়ে হযরত শাহ আহমদ উল্লাহ মাইজভান্ডারী বাংলার সুফি সাধনার ইতিহাসে ব্যতিক্রমধর্মী স্মরণযোগ্য নতুন মাত্রিকতার সংযোজন ঘটাতে সক্ষম হয়েছেন, যা তরিকার ইতিহাসেও স্বতন্ত্র গুরুত্ব বহন করে। মাইজভান্ডারী তরিকা এবং এই তরিকার সাধন- সঙ্গীত হিসেবে উদ্ভূত মাইজভান্ডারী গান বিষয়ে আধুনিক বিজ্ঞানসম্মত গবেষণা বাংলার সুফিতত্ত্বের ইতিহাসের পাশাপাশি আবহমান বাংলার লোকঐতিহ্য ও লোকসঙ্গীতে ইতিহাসের ধারায়ও নতুন দিগন্তের দ্বার উন্মোচণ করবে বলে আমার বিশ্বাস।“
– গোলাম মঈনউদ্দিন
[নির্বাহী পরিষদ সদস্য ও পরিচালক, ঢাকা আহছানিয়া মিশন, পরিচালক, বাংলা একাডেমী, ঢাকা]
৫৬. “আজ থেকে দীর্ঘ অর্ধশতাব্দীকালেরও আগের ঘটনা। আমার বাবা মোসলেহউদ্দীন আহমদ চৌধুরী তদীয় সদ্য বিবাহিতা স্ত্রী মেন্দিয়া খাতুনের সম্পূর্ণ অজান্তে তাঁর বিভিন্ন পদের আশি ভরি স্বর্ণালঙ্কারের সবগুলো একত্রিত করে গোলকপিন্ড বানিয়ে মাইজভান্ডার দরাবার শরীফে গিয়ে পীর সাহেবের পদমূলে তা নিবেদন করে সেখানেই অবস্থান করতে থাকেন। খবর পেয়ে নববধূ মেন্দিয়া খাতুন তীব্র ক্ষোভে ফেটে পড়ে পাল্কিযোগে কুমিল্লা থেকে দুর্গম পাহাড়ি পথের শতাধিক মাইল দূরত্বের মাইজভান্ডার শরিফ গিয়ে হাজির হন। কিন্তু আশ্চর্যজনক ঘটনা, দরবার শরীফ পৌছার পর তাঁর তীব্র ক্ষোভ পরম ভক্তিতে রূপান্তরিত হয়ে যায়। তিনি স্বেচ্ছায় মানসিক প্রশান্তি নিয়েই দরবারের আতিথ্য গ্রহণ করেন এবং দরবার শরীফে অবস্থান করতে থাকেন। অতপর মা নিজেও দরবারের ভক্তে পরিণত হন এবং পরম নিষ্ঠা ও গভীর মমতার সাথে আমৃত্যু (১৯৯৬) তা ধারণ লালন ও প্রতিপালন করেন। আমার মনে বড় ধরনের প্রশ্ন জাগে, কিসের মোহে, কোন অদৃশ্যশক্তির তীব্র আকর্ষণে বাবা নব পরিণীতা সুন্দরী বধুর মধুর সান্নিধ্য ত্যাগ করে তদীয় সমস্ত অলঙ্কার দরবার শরীফে নিবেদন করে সেখানেই অবস্থান করতে থাকলেন? আবার কোন পরশ পাথরের ছোঁয়ায় মার ক্ষোভ রূপান্তরিত হলো ভক্তিতে? মাইজভান্ডার দরবার শরীফের সেই আধ্যাত্মিক মহিমা-সংশ্লিষ্ট গভীর রহস্য আজ ও আমার বিস্ময়ের উদ্রক করে; আমাকে কোন সুদূরে টেনে নিয়ে যায় নিজের অজান্তে।“
– অধ্যাপিকা পান্না কায়সার
[সংসদ সদস্য, চেয়ারম্যান, কেন্দ্রীয় খেলাঘর আসর]
৫৭. “আমি যখন উচ্চ বিদ্যালয়ের নিম্ন শ্রেণীতে পড়ি তখন প্রথম মাইজভান্ডার মাজারে যাই। তখন প্রচন্ড শীত। আমি এবং আমার অগ্রজ তাহের দা দমদমা চাড়ালিয়া হাটের নিকটস্থ মামার বাড়িতে চলে গেলাম মাঘ মাসের ৫ কি ৯ তারিখ —-মাইজভান্ডার আমার ছোট বেলার তীর্থ। মনের আনন্দে তিন দিনের এই পরিভ্রমণ আমাদের সাংবাৎসরিক কর্মবিরতির ও আনন্দ বিনোদনের একটি উপায়। আমরা প্রতিবছর শীত এলে বাড়ির পুকুরে চারপাশে যে কয়েক ডজন খেজুর গাছ আছে, সেগুলো চাটাই করে রস আহরণের ব্যবস্থা করি। প্রতিবছর অন্তত আট দশটা খেজুর গাছের রস আমরা প্রায় মাস খানেক ধরে বিক্রি করি। যা অর্থ সঞ্চিত হয়, সেগুলো নিয়ে মাইজভান্ডারে যাই। মাইজভান্ডার ভক্তের কামনার কামধেনু। যে সব সিদ্ধ পুরুষের মাজার সেখানে আছে তাঁদের জীবনের বিভিন্ন উপাখ্যান বিবৃত হয়, পুনরাবৃত্ত হয়। এক বছর যে গল্প ভক্তরা শুনেছে, পরের বছর সে গল্প তারা পরবর্তী ভক্তদের শোনায়। ভক্তের এক অনিমেষ ফল্গুধারা বয়ে চলেছে মাইজভান্ডারে। আমরা মাইজভান্ডারের সাঙ্গীতিক অসাম্প্রদায়িকতার পরিচয় পাই রমেশ শীলের গানের মধ্যে। মাইজভান্ডার আর রমেশ শীল এই দুটোকে সাঙ্গীতিকভাবে বিচ্ছিন্ন করে দেখা যায় না। নদীয় বঙ্গের এক ভক্তিদর্শনের তীর্থ, মাইজভান্ডার ভক্তি দর্শনের আরেক তীর্থ। মাইজভান্ডার আমার শৈশবের তীর্থক্ষেত্র।“
– মনসুর মুসা
[প্রফেসর, ভাষাতত্ত্ব বিভাগ, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়, প্রাক্তন মহাপরিচালক, বাংলা একাডেমী]
৫৮. “মাইজভান্ডার দরবার শরীফে হযরত বাবাভান্ডারীর হস্ত মোবারকে পানি ঢালার সৌভাগ্য আমার হয়েছে। তাঁর দেহ অবয়ব! সে যেন দীপ্তিমান আলোকমালা। যেখানে থাকতেন পুরা ঘর আলো হয়ে যেত। মাওলানা শাহ সুফি সৈয়দ দেলাওর হোসাইন মাইজভান্ডারীকেও দেখেছি। নিজেকে বলতেন- “খাদেমুল ফোকরা” একইসাথে আলেমও ছিলেন ফকিরও ছিলেন। সবাইকে অত্যন্ত মেহমানদারি করতেন। এলম দুই প্রকার, এলমে দরাছত এবং এলমে ওরাছত। প্রথমটা একাডেমিক, দ্বিতীয়টা আধ্যাত্মিক। যাঁরা এলমে ওরাছতধারী তাঁরাই ওয়রেছুল আম্বিয়া। মাইজভান্ডার দরবার শরীফ এলমে ওরাছতের স্থান। শুধু একাডেমিক জ্ঞানের চর্চাকারী মৌলভি সাহেবরাই এর সমালোচনা করেন। প্রকৃত অর্থে, “যার যদ্দুর ওজন; মাইজভান্ডার দরবার শরীফকে সে তদ্দুরই দেখেছে”।
– মাওলানা মুফতি মোঃ মুসা মোজাদ্দেদী
[প্রাক্তন শিক্ষক শাহচাঁন্দ আউলিয়া মাদ্রাসা, পটিয়া, চট্টগ্রাম। ইনি ওস্তাদুল ওলেমা হিসেবেই সর্বাধিক পরিচিত]
৫৯. “শাহানশাহ হযরত সৈয়দ জিয়াউল হক মাইজভান্ডারী (কঃ) বংশসূত্রে এবং নিজস্ব সাধনা বলে এমন একটা আত্মিক স্তরে উন্নীত হন, যে স্তরে তিনি সবসময় আল্লাহর ফানিয়তের মধ্যে ফানা বা বিলীন হয়ে ডুবন্ত থাকতেন। সে কারণে বাহ্যিক আচার- আচরণ দিয়ে তিনি বিচার্য নহেন। তিনি বুঝবার মানুষ নন, বাজবার মানুষ। তাঁর অন্তরের মধ্যে ঝংকার সৃষ্টি হতো। আমি বয়সে তাঁর বড়, কিন্তু তিনি বুজুর্গিতে বড়। তিনি খুব বড় বুজুর্গ। আল্লাহর কাছে মুনাজাত করি, এই সমস্ত অলি আল্লাহদের উসিলায় আল্লাহ আমাদেরকে মুক্তি দিন, জান্নাত দিন।“
– প্রিন্সিপ্যাল এ.এ. রেজাউল করিম চৌধুরী
[আক্ষরিক অর্থেই একজন সফল শিক্ষক ও অধ্যক্ষের প্রতিকৃতি অধ্যক্ষ এ. এ. রেজাউল করিম চৌধুরী। এ পর্যন্ত তেরটি ছাত্রবহুল কলেজের প্রতিষ্ঠাতা অধ্যক্ষ হিসেবে এক গৌরবময় নতুন ইতিহাস সৃষ্টি করেছেন। শাহনশাহ জিয়াউল হক মাইজভান্ডারীর সম্মনিত শিক্ষক হওয়ার গৌরবেও গৌরবান্বিত। সূত্রঃ মাসিক আলোকধরা, সম্পাদক, মাহবুব উল আলম, ৩য় বর্ষ ১০ম সংখ্যা, অক্টোবর ১৯৯৮]
৬০. “সুফি সাধক গভীর ধ্যানমগ্ন অবস্থায় পরম সত্তা উপলদ্ধি করে থাকেন। এভাবে সাধনার ক্ষেত্র হিসেবে চট্টগ্রাম অঞ্চলে গড়ে উঠে দরগাহসমূহ। এরই অন্যতম মাইজভান্ডার শরীফ। এখান থেকে ব্যুত্থিত হয়েছে সাধন সঙ্গীত। এ সকল সঙ্গীত এক অধ্যাত্ম অনুভূতির আবেশ সৃষ্টি করে গভীর ধ্যানে পরম সত্তায় মগ্ন হওয়ার সুযোগ বয়ে আনে। এ মাইজভান্ডারী গানগুলি প্রার্থনাসঙ্গীতে পরিণত হয়ে হৃদয়ের ভাষা সৃষ্টিকর্তার উদ্দেশ্যে ব্যক্ত হয়েছে এক বিশ্বজনীন আবেদনে ধর্ম-বর্ণের গন্ডি ছাড়িয়ে।“
– স্বামী অক্ষরানন্দ
[অধ্যক্ষ, রামকৃষ্ণ মিশন, ঢাকা। সূত্রঃ শাহানশাহ হযরত সৈয়দ জিয়াউল হক মাইজভান্ডারী (কঃ) বার্ষিক ওরশ উপলক্ষে বিশেষ ক্রোড়পত্র, ’ ৯৮। দৈনিক নতুন বাংলাদেশ, সম্পাদক ঃ আলহাজ্ব আফাজ উল্লাহ খান সর্দার , বান্দরবান পার্বত্য জেলা, ১০.১০.৯৮]
৬১. “সুফি- দরবেশদের জীবনদর্শনে তত্ত্ব ও তথ্যের চাইতে বাস্তবজীবনের জন্য প্রয়োজনীয় সর্বজনীন মূল্যবোধের প্রাধান্য থাকে। এই কারণেই জনসাধারণের উপর তাঁদের প্রভাব হয় সুদূরপ্রসারী। বাঙালি জাতির মন- মানসিকতা, মনন ও কৃষ্টি-সংস্কৃতির উপর সুফিদর্শনের প্রভাব সুস্পষ্ট। রবীন্দ্রনাথ বলেছেন “স্নেহ প্রেম দয়া ভক্তি কোমল করে প্রাণ।” এগুলোর সঠিক বিকাশ ও প্রকাশই প্রকৃত মানবতা। সৃষ্টিকর্তাতো একজনই আছেন। তাঁর উপর অকপট বিশ্বাসের গুণেই মানুষের মধ্যে এসব সার্বাজনীন মানবিক মূল্যবোধের উদয় হয়। সুপ্রাচীন, ঐতিহ্যবাহী মাইজভান্ডার দরবার শরীফ এদেশের আধ্যাত্মিকতা ও ধর্মীয় চেতনার অগ্রগতিতে যে অনন্য অবদান রেখেছে এবং আজো রেখে চলছে তা অত্যন্ত প্রশংসনীয়। দেশের বর্তমান রাজনৈতিক ও আর্থ-সামাজিক প্রেক্ষাপটে বিরোধ, সংঘাত, ভেদাভেদ, দলাদলি ও হানাহানির পরিবর্তে এরূপ মূল্যবোধের বাপক প্রসার ও বিস্তার ঘটিয়ে জাতি –ধর্ম -বর্ণ নির্বিশেষে সবার মিলন ও ভ্রাতৃত্ব গড়ে তোলা অত্যন্ত জরুরি বলে আমি মনে করি।
– মাইকেল রোজারিও
[আর্চ বিশপ, ঢাকা- বাংলাদেশ]
৬২. “সার্বজনীন সংহতি ও ঐক্যের তীর্থভূমি মাইজভান্ডার। মাইজভান্ডারী সাধকের আদর্শ শ্রেণী সম্প্রদায় নির্বিশেষে গণ-মানষের দৃষ্টিকে আকর্ষণ করতে সমর্থ হয়েছে। মোহমুক্তির সোপান হিসেবেও এর সুখ্যাতি রয়েছে। মাইজভান্ডারী সাধকের দর্শন বিশেষভাবে প্রতিধ্বনিত হয়েছে মাইজভান্ডারী গানে। মানুষের অনুভূতিকে জাগ্রত করার অত্যন্ত সহজ মাধ্যম। কারণ সুর-সংগত বিষয়াদি বিদ্বজ্জন ও অবিদ্বজ্জন সকলের কাছে অনায়াসে নান্দনিক হয়। এতে ভাষার সারল্য যোগ হলে তা আরো হৃদয়গ্রাহী হয় সর্বশ্রেণীর শ্রোতার কাছে, একান্ত হয়ে যায় শ্রোতার মানব চেতনার সাথে। উপযুক্ত বৈশিষ্ট্যের কারণে মাইজভান্ডারী গান চিরঞ্জীব হয়ে আছে। বর্তমানে জগৎ জীবনে সংঘাত সংশয়ের ধারাক্রম বিবর্তিত হচ্ছে। পারস্পরিক অবিশ্বাস, সম্পদ ও সত্তার বিকাশে মোহান্ধ চেতনা পর্যায়ক্রমে বাড়ছে, ঘাতক-ব্যাধির মত অন্তরালে থেকে গ্রাস করেছে স্বার্থ প্রত্যাশী মানুষের অন্তরকে। বাঙলার মাইজভান্ডারী তত্ত্ব ও এর গান এই ব্যাধির ধন্বন্তরি প্রতিষেধক স্বরূপ। তাই, এই মাইজভান্ডারী তত্ত্ব ও গানের বহুল গবেষণা ও বিকাশ গণ-মানুষের কল্যাণে বহুবিধ ভূমিকা রাখবে বলে আমাদের দৃঢ় বিশ্বাস।“
– শুদ্ধানন্দ মহাথের
[সভাপতি, বাংলাদেশ বৌদ্ধ কৃষ্টি প্রচার সংঘ, ধর্মরাজিক বৌদ্ধ বিহার, অতীশ দীপংকর সড়ক, ঢাকা]
৬৩. “মাইজভান্ডারী তরিকার আদর্শ ও দর্শনের অবস্থান শরিয়তি সীমানার বাইরে নয়। সত্যিকার অর্থে এটি একটি মানবতাবাদী দর্শন। সত্যসন্ধানী সকল মানুষ এই দর্শনের মাধ্যমে মুক্তির পথ খুঁজে পায়। মাইজভান্ডার দরবার শরীফ বিভিন্ন জাতিধর্মের মিলনকেন্দ্র হিসেবেও সুপরিচিত। এই সার্বজনীন মিলনকেন্দ্র হওয়ার পেছেনেও রয়েছে মাইজভান্ডারী দর্শনের সর্বজনীনতা।
প্রতিবছর রবিউল আউয়ার মাসের বিশ তারিখ যে বৃহৎ আকারের মিলাদুন্নবী (দঃ) মাহফিল অনুষ্ঠিত হয়, যাতে আমি একজন ওয়ায়েজ হিসেবে উপস্থত থাকি, উল্লেখযোগ্য মিলাদুন্নবী (দঃ) মাহফিলটি করা হয় হযরত দেলাওর হোসাইন মাইজভান্ডারীর নির্দেশে। তিনি ওফাতের পূর্বে তাঁর আওলাদের তদীয় সমাধিতে সৌধ নির্মাণ এবং ওরশ না করার অছিয়ত করে যান। যে কারণে তাঁর মাজার নির্মিত হয়নি এবং বার্ষিক ওরশও পালিত হয় না। তবে ওরশের পরিবর্তে মিলাদ মাহফিলের কথা বলেছিলেন। মিলাদ মাহফিলে দেশের খ্যাতিমান আলেমদের দাওয়াত করা হয়। তদীয়পুত্র শাহনশাহ সৈয়দ জিয়াউল হক মাইজভান্ডারী ছিলেন মজজুবে সালেক। তাঁদেরক বুঝা ও অধ্যয়ন করা সহজসাধ্য নয়। এক কথায়, গাউসুল আজম শাহ আহামদ উল্লাহ মাইজভান্ডারী (কঃ) প্রবর্তিত মাইজভান্ডারী দর্শন নিয়ে এখন ও অধ্যয়ন ও গবেষণার অনেক কিছুই বাকি আছে।“
– মাওলানা নুরুল ইসলাম হাশেমী
[আহলে সুন্নহ ওয়াল জামাতের নেতা। সমকালের চট্টগ্রামে যে কয়জন দ্বীনী আলেম খ্যাতির শীর্ষে অবস্থান করছেন তাঁদের অন্যতম মাওলানা নুরুল ইসলাম হাশেমী] [তথ্যসূত্রঃ গাউসুল আজম মাইজভাণ্ডারীর ওফাত শতবার্ষিকী (১৯০৬-২০০৬) ‘প্রসঙ্গ’; সম্পাদনাঃ সৈয়দ সহিদুল হক, ডক্টর সেলিম জাহাঙ্গীর]