নিদানের বন্ধু “রমেশ স্মারক-এক”
লায়ন ডা. বরুণ কুমার আচার্য বলাই
“মুরশিদ ও নিদানের বন্ধু এই দাসে কবুল করলানি” ‘মুক্তির দরবার’ বইতে ৩নং গান, ও
“নিদানের বন্ধু আমার গাওছুল আজম মাইজভাণ্ডারী” ‘ভাণ্ডারে মওলা’ বইতে ৪নং গান।
এই দুইটি বিখ্যাত গানের কলিতে ‘নিদানের বন্ধু’ শব্দটি এভাবেই উপস্থাপন করেছেন উপমহাদেশের কিংবদন্তি কবিয়াল ও মাইজভাণ্ডারের সাংস্কৃতিক দূত, লোককবি রমেশ শীল মাইজভাণ্ডারী। মাইজভাণ্ডারী দর্শনের সাথে তিনি সম্পৃক্ত হওয়াতে নামের সাথে মাইজভাণ্ডারী শব্দটি যুক্ত হয়ে যায় গৌরবের সাথে।
মূলত রমেশের যে লেখনি তাতে দরবারী গানই বহুল প্রচার রয়েছে দেশের নগর-গঞ্জ-গ্রামে। সেই মাইজভাণ্ডারী গানের মাধ্যমে রমেশ বেঁচে আছেন ভাণ্ডারী ভক্ত অনুরক্তদের মাঝে।
গত ৬ এপ্রিল ২০১৭ ছিল তাঁর মৃত্যুর ৫০ বছর। এই ৫০ সংখ্যাকে স্মরণীয় করে রাখতে রমেশের পারিবারিক সংগঠন ‘রমেশ ভাণ্ডার’ থেকে প্রকাশ করা হয়েছে ‘নিদানের বন্ধু’ নামে ‘রমেশ স্মারকÑএক’ গ্রন্থটি। বইটি সম্পাদনা করেছেন মো. তাজুল ইসলাম রাজু। প্রকাশ করেছেন ‘রমেশ ভাণ্ডারের’ সমন্বয়ক আল সিরাজ ভাণ্ডারী। মূল্য রাখা হয়েছে ৫০ (পঞ্চাশ) টাকা। বইটি উৎসর্গ করেছেন জাতীয় ও আন্তর্জাতিক পরিমণ্ডলে মানবতাবাদী লোককবি কবিয়াল রমেশ শীল স্মরণে যে সব খ্যাতিমান লেখক রমেশের সৃষ্টিকর্ম নিয়ে লেখালেখি করেছেন তাঁদের প্রতি। প্রকাশকাল ৬ এপ্রিল ২০১৭।
সম্পাদকীয় কলামে মো. তাজুল ইসলাম রাজু লিখেছেন, যৌবনের তরঙ্গ-উচ্ছলতা, লাবণ্যের মায়া মন্ত্রে স্থির অ-চঞ্চলকে বন্দি করে রেখে মনের শিখরে, ললাটে, অধরে সিক্ত দেহের রেখায়-রেখায়, ঝলকে-ঝলকে বাংলার সংস্কৃতিকে লালন-সৃজন করে নিখিল বাতাস আর অনন্ত আকাশকে সর্বাঙ্গে চুম্বিয়ে কঠিন জীবনের ঝংকারিত নিদারুণ করুণ মূর্ছনায় জীবন কাটানোর এক উদাহরণ কিংবদন্তি ও লোককবি কবিয়াল রমেশ শীল।
সামাজিক-সাংস্কৃতিক-আধ্যাত্মিক জাগরণের ক্ষেত্রে রমেশ শীলের ভূমিকা এমনই গুরুত্বপূর্ণ ছিল যা শিল্পী, সাধক, ভাবুক-চিন্তকদের বিশেষভাবে দৃষ্টি আকর্ষিত হয়েছিল। ফলে জীবিতকালেই তিনি হয়ে উঠেছিলেন এক অনুপম আদর্শের প্রতীক। প্রগতিশীল আদর্শে সকল প্রকার বৈষম্য রোধ করে অসাম্প্রদায়িক শোষণহীন সমাজ প্রতিষ্ঠায় এ যেন সফল চেষ্টা।
বইটি শুরুতে জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের কাছে রমেশের লেখা একটি চিঠি ছাপানো হয়েছে। চিঠির পরবর্তীতে রমেশের নারী প্রসঙ্গে একটি লেখা দিয়ে জাতীয় লোককবির স্বীকৃতি ও মর্যাদা দাবি করা হয়েছে।
গ্রন্থটিতে বাণী দিয়েছে গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশের সরকারের সংস্কৃতি মন্ত্রী আসাদুজ্জামান নূর এমপি, চট্টগ্রাম-৪ আসনের এমপি সৈয়দ নজিবুল বশর মাইজভাণ্ডারী ও চট্টগ্রাম-৮ আসনের এমপি মঈন উদ্দিন খান বাদল।
গ্রন্থটিতে মাইজভাণ্ডারী দরবার শরীফের আঙিনার গাউছিয়া আহমদিয়া মঞ্জিল, গাউছিয়া রহমান মঞ্জিল, গাউছিয়া হক মঞ্জিল থেকে বাণী প্রদান করে মাইজভাণ্ডারী প্রচার ও প্রকাশে রমেশের ভূমিকা অনন্য অবদান হিসেবে চিহ্নিত করা হয়েছে। আর বিভিন্ন দরবার, জনপ্রশাসনের ব্যক্তিবর্গ, শিক্ষাবিদ, জনপ্রতিনিধি অভিমত প্রকাশ রমেশ ভক্তদের আরো জানার জন্য আগ্রহান্বিত করেছে। রমেশ পুত্র পুলিশ বিহারী শীল লিখলেন, আমাদের পারিবারিক সংগঠন ‘রমেশ ভাণ্ডার’। স্মৃতিচারণ করেছেন আলহাজ মো. সিরাজুল মোস্তফা, ওপার বাংলার লেখক সুভাষ মুখোপাধ্যায়ের রমেশের উপর ‘সাক্ষাৎকার’, জয়তি বন্দ্যোপাধ্যায়ের লেখনি, লোক গবেষক সৈয়দ মোহাম্মদ সাহেব এর কালজয়ী লেখা ‘কারাগারে রমেশের জন্মদিন’ পালনের ইতিবৃত্ত, ড. সেলিম জাহাঙ্গীরের রমেশের মাইজভাণ্ডারী গানে শব্দ ত্র“টি অক্ষর ব্যঞ্জনার একটি অনবদ্য বিশ্লেষণ, বাংলার রুমিখ্যাত সৈয়দ আহমদুল হক রমেশের গানের সাথে উর্দু, ফার্সি কিতাবের অপূর্ব সম্মিলনীরও যুগসূত্র, শিশু সাহিত্যিক অরুণ শীলের রমেশের একুশে পদক প্রাপ্তির প্রাসঙ্গিক ভাবনা, অধ্যাপক এ ওয়াই এম জাফর বাংলার লোকায়ত জীবন ও মরমী ধারায় রমেশ শীল, মোহাম্মদ ইউনুসের রমেশ শীলের গৌরবে আমাদের সুনাম বাড়বে আর এস এম মঞ্জুর আলম, মুহাম্মদ নাজিম উদ্দিন, আল সিরাজ ভাণ্ডারী, মো. হুমায়ুন কবিরের লেখনিগুলো রমেশ ভক্ত ও লোকসাহিত্যের জ্ঞান পিপাসুদের একটি চেতনাধ্যায় হয়েছে বলে আমার ধারণা।
গ্রন্থটিতে নাসির উদ্দীন হায়দারের রমেশ অনুষ্ঠানকে নিয়ে প্রতিবেদনের প্রাঞ্জল ভাষা আর লায়ন ডা. বরুণ কুমার আচার্যের গ্রন্থ সমালোচনা ‘রমেশ শীল ঃ মাইজভাণ্ডারী গান সমগ্র’ বইটি নিয়ে চমৎকার উপস্থাপনা ও বাহুল্য পাঠক মনে মাইজভাণ্ডার দরবার, তরিকা তথা দর্শনকে আরো সহজভাবে মহান সৃষ্টিকর্তার নৈকট্য হাসিলের অপূর্ব দিক-নির্দেশনা পাবে।
বইটিতে প্রকাশিত আরো একটি উল্লেখযোগ্য নিবন্ধ হলো ‘মাইজভাণ্ডারী তাপসমালা-৮’ মাসিক আলোক ধারা’র নিয়মিত প্রকাশনায় রমেশ শীলের দেহত্যাগ সম্পর্কিত ঐতিহাসিক তথ্য নিয়ে একটি নিবন্ধ পাঠকদের রমেশের সম্পর্কে আরো বিজ্ঞতা অর্জনের সহায়ক হবে।
একটি ঝড়ো হাওয়ায় পাল তোলা নৌকার মধ্যে স্কেচ করা রমেশের মায়াবী চেহারায় ঝকঝকে একটি প্রচ্ছদে ‘নিদানের বন্ধু’ প্রকাশনাটি যে কোনো বোদ্ধা পাঠকের দৃষ্টি আকির্ষত হবে নিঃসন্দেহে। বইটি পাওয়া যাবে অভিজাত বুক স্টল ও রমেশ ভাণ্ডার, পূর্ব গোমদন্ডী, বোয়ালখালীতে। ‘রমেশ স্মারক-এক’ এ বইটি পাঠক নন্দিত হোক এবং খ্যাতিমান লেখকের লেখনি পড়ে রমেশ বেঁচে থাকুক সুন্দর মনের ও সৃজনশীল পাঠকের অন্তরে-অন্তরে।
লেখক : বিশিষ্ট মরমী গবেষক ও প্রাবন্ধিক
Print Friendly, PDF & Email

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here