আলোকিত মানুষ
আল্লামা মুফতি মুহাম্মদ ইদ্রিস রেজভী (ম.) বলেন-
একজন সামাজিক মানুষ বেঁচে থাকে অন্যের প্রতি সুন্দর আচরণের মাধ্যমে
মননশীল মানুষেরই সমাজ বিপ্লবের সিপাহসালার। ভাঙ্গাগড়ার স্বপ্ন দেখা প্রতিভাবানদের দ্বারাই সম্ভব। আবহমান কাল থেকে জন্মগত গহীন লোকেরাই সমাজ সভ্যতার উত্থান পতন ঘটিয়েছেন। বর্তমান উত্তরাধুনিক যুগের মুসরিম প্রজন্ম পাশ্চাত্য ধর্ম, দর্শন ও প্রযুক্তি কাছে পদানত। ইসলাম যেন দিন দিন কুলুষিত হচ্ছে। তাই আমরা নিয়মিত মুখোমুখি হচ্ছি আলোকিত মানুষদের।
গত ২১ মে ও ২৫ মে ২০০২ সালে দু’বার করে মুখোমুখি হয়েছি খ্যাতিমান ইসলামী ব্যক্তিত্ব, ওস্তাজুল ওলামা আল্লামা মুফতি ইদ্রিছ রেজভী (ম.) এর। খ্যাতিমান পাত্য এই মহান মানুষটি বলেন ত্যাগের কথা, গুণের কথা, শান্তির কথা, সর্বোপরি মানুষের মনের কথা। এই কথোপকথনের অংশ বিশেষ আমাদের বিপুল সংখ্যক পাঠকের জন্য পত্রস্থ করা হল -সম্পাদক।
….ইসলামী ও তাকওয়াপূর্ণ আচরণের অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ বিষয়ের একটি হলো মানুষের জন্য সাথে বাস করা এবং মানুষের দুঃখ কষ্টে শরিক হওয়া। কথিত বেঁচে থাকে এবং একজন সামাজিক মানুষ বেঁচে থাকে অন্যের প্রতি সুন্দর আচরণের মাধ্যমে’। এখানে আরেকটি সৎ গুণ আছে যাতে খুব জোর দেয়া হয়েছে তা হলো আত্মীয়তা বাঁধন অটুট রাখা। এ বিসয়ে প্রিয় নবী (দ.) বলেছেন ‘কেউ যদি চায় যে, তার রিজিক বহুগুণ বৃদ্ধি পাক এবং তার মৃত্যু বিলম্বিত হোক, তাহলে সে যেন আত্মীয়তার বন্ধন বজায় রাখে।
এখানে নবীজী (দ.) মানুষকে আপন করার সর্বোচ্চ গুরুত্ব দিয়েছেন। এ ধরনের বন্ধন এ পৃথিবীতে অনেক কল্যাণ এনে দেয়। আজকালকার সমাজে সে সৎগুণের কদর কমে গেছে। অনেকে নিকট আত্মীয়কে বাদ দিয়ে নিজের মনগড়া বিশ্লেষণে এগিয়ে যায়। তাতে বরকত কমে গেছে। হিংসা বেড়ে গেছে। আল্লাহর শোকরানা নেই। তৃপ্তিতে মজা নেই।
আমরা একজনকে দেখিয়ে অন্যকে দান করি। আপনজনকে বাদ দিয়ে স্বার্থ সিদ্ধির মানুষকে সেবা করি। আমি বলব দূর থেকেও বিভিন্নভাবে আত্মীয়তার বন্ধন বজায় রাখা যায়। যদি সৎ মনোভাব থাকে।
…ইসলামী রাষ্ট্রের অপর একটি বৈশিষ্ট হচ্ছে ইসলামী নেতৃত্ব। ইসলামী সমাজের জন্য যে বৈশিষ্ট্য ও মান নির্ধারণ করা হয় অন্য কোন সমাজে তা দেখা যায় না।
ইরানের ভাষায়- সৌদি রাজতন্ত্র এজিদের বংশধর। রাজতন্ত্রের প্রতিষ্ঠাতা আবদুল আজিজ ইবনে সওদ। এর শাসন কায়েম করেন আবদুল ওহাব নজদী। তারা ‘সিরাজতুর মুস্তাকিম’ এর কথা বলে নিজেদের প্রতিষ্ঠা করছে ভিন্ন পথে। আসল পথের সন্ধান না দিয়ে ভিন্ন পথের অবলম্বনে তারা বিশ্বকে নিয়ন্ত্রণ করার চেষ্টা করছে।
…আজকের দুনিয়ায় প্রায় সকল দেশেই সরকার পরিচালিত হয় এমন সব মানুষের দ্বারা, যারা সৎ গুণের অধিকারী বাস সততার অনুসারী নয়। এরা সেই সব লোক যারা সরকারি অর্থের অপব্যবহার করে এবং জনগণের জান, মাল ও ইজ্জত নিয়ে ছিনিমিনি খেলে। এর কারণ হলো এসব লোক সরকার পরিচালনার জন্য আল্লাহ কর্তৃক মনোনীত হয়। এ কারণে তারা খোদীয় বিধান অনুসারে দেশ পরিচালনা করেনা। নবী রাসুল গণের অবর্তমানে মা’সুম ইমাম ও আউলিয়াগণ হচ্ছেন আল্লাহ কর্তৃক মনোনীত নেতা ও শাসক। ইসলামী রাষ্ট্রের ধর্মীয় কর্তৃত্ব থাকবে এমন ব্যক্তির নিজস্ব নিয়ন্ত্রণে যিনি কখনই শয়তানী প্রবণতা বা প্রবৃত্তির কামনা-বাসনা দ্বারা পরিচারিত হয় না।
ইসলাম যে ধরনের ধার্মিকতাকে গুরুত্বপূর্ণ বলে বিবেচনা করে, তার জন্য ব্যক্তিকে অপরাধ, দুর্নীতি, আত্মকেন্দ্রিকতা, স্বার্থ পরতা ও ক্ষমতা লিন্সার বিরুদ্ধে সর্বাত্মক জেহাদে লিপ্ত থাকতে হয়।
পবিত্র কোরআনে পাকে বলা হয়েছে। এমন ব্যক্তির হাতে যদি ক্ষমতা চলে যায়, যে নিজের খেয়ালখুশী মতো চলতে থাকে এবং নিজের ক্ষমতা মর্যাদা ও প্রবণতা ছাড়া অন্য কিছু বুঝতে চায় না, তাহলে পৃথিবী ঘৃণা, শত্র“তা, যুদ্ধবিগ্রহ ও খুন খারীতে ভরে যায়। তাকওয়া অর্জন করেনি এমন ব্যক্তিকে ইসলাম কখনোই নেতৃত্বের জন্য বাছাই করে না। বর্তমান সময়ে ইলেক্টনিক্স মিডিয়াগুলো ইসলামের নাম ভাঙিয়ে দখল করে অনৈসলামিক কার্যক্রম চালাচ্ছে। তাই এখন পাশ্চাত্যের ঐতিহ্যকে রক্ষা করতে ‘সিরাতুল মুসলাকিম’ এর সঠিক পথের অনুসারীদের আরো তৎপর হতে হবে।
…আগে ছিল ইমাম ভিত্তিক সমাজ এখন হচ্ছে পীর ভিত্তিক সমাজ। সে কারণে সমাজে বৈষম্যের সৃষ্টি হয়েছে। ইমামগণ ছিলেন স্বতন্ত্র মনোভাবের, পীরগণ হচ্ছেন ব্যক্তিগত মনোভোবের। তাই এর প্রভাব এখন মাদ্রাসা শিক্ষার পর্যায়েও চলে এসেছে। কোন কোন মাদ্রাসা পীরের আকিদা ব্যবহার করতে গিয়ে শিক্ষাদানের বৈষম্য সৃষ্টি করছে। এতে শিক্ষার্থীরা ইসলামের সঠিক রূপরেখা থেকে বঞ্চিত হচ্ছে বলে আমি মনে করি। মসজিদ ভিত্তিক সমাজ ব্যবস্থায় পূর্বেকার সময় যে সামাজিক নিয়ন্ত্রণ ছিল, বর্তমানে কোরআন হাদিস এর বাংলা অনুবাদের কারণে অনেক বাংলা ও ইংরেজী শিক্ষিত ব্যক্তিগণ মোল্লাদের কাছ থেকে দূরত্ব সৃষ্টি করেছে। এতে আমি মনে করি তাঁরা যদি কোরান হাদিসের ন্যূনতম জ্ঞান লা যদিও করছে তবে সমাজের বৈষম্যতার দূর হচ্ছে না। ইসলামী কানুন অনুযায়ী মসজিদ ভিত্তিক সমাজ ব্যবস্থাই কাম্য হওয়া উচিত। এতে ধর্মপ্রাণদের খোদাভীরুতা বাড়বে এবং সমাজের অসংগতি চলে যাবে। এটা আমার বিশ্বাস।
…আল্লামা গাজী শেরে বাংলা (রহ) আমার শিক্ষক। তাঁর সানিধ্যে এসে আমি জীবনকে আলোকিত করার সুযোগ পেয়েছে। তাঁর সাথে পটিয়াই ৫৩/৫৪ সালে ওহাবী সুন্নী মোনাজেরায় আমার সরব উপস্থিতি এখনো চেতনা বাড়ায়।
…ওহাবী আকিদায় আমরা বিশ্বাসী নয়। তাদের ‘খাতেফ’ কিতাবে আছে ‘আল্লাহ মিথ্যা কথা বলতে পারে’, ‘হেফজুল ইমান ও তাহাজিরুন নাস’ কিতাবে আছে ‘রাসুলের জ্ঞান থেকে শয়তানের জ্ঞান বেশী’। তাই আল্লামা গাজী শেরে বাংলা (রহ.) তাদের বিরুদ্ধাচরণ করতে গিয়ে বলেছেন তাদের সাথে আত্মীয় সম্পর্ক, তাদের সাথে উঠাবসা-চলাফেরা কলে মাযহাবের আকিদা সঠিক থাকবে না। এদের সাথে আমাদের মাদ্রাসার শিক্ষাও মিল নেই। এরা কখনো খারেজী, কখনো ওহাবা, কখনো কওমী মাদাসা নাম দিয়ে থাকে। খারেজী অর্থ শেষ। এটা বাদদিয়ে দিল কওমী শব্দটি।
কোরআনের ভাষায় কওমীল কাফেরিন কওমীল মুসলেমিন, কওমীল মুনাফেকিন, কওমীল জালেমীন। তারা কোন কওমের নামে মাদ্রাসা চালান সেটা আমরা বুঝি না। জানতেও চেষ্টা করিনা। কারণ তাদের আকিদার সাথে আমাদের আকিদার অনেক তফাৎ।
…বচন আছে-উত্তরে শেরে বাংলা, দক্ষিণে ফখরে বাংলা, পূর্বে মাওলানা রাহাতউল্লাহ, পশ্চিমে সুফি আহসান উল্লাহ। এরাই হলেন চট্টগ্রামের সুন্নীদের স্তম্ভ। এদের কারণে আজও ঠিকে আছে রাসূলের সঠিক আদর্শের পতাকাধারী সুন্নী নেতৃবৃন্দ।
…শবেবরাতে টিভির অনুষ্ঠানে বলেছেন রুটি কি জন্য, সিন্নি-হালুয়া কি জন্য। যুগযুগান্তর ধরে মাযহাবে অনুসারী হয়ে যে সংস্কৃতি মুসলিম সমাজে রেওয়াজ হয়ে এসেছে, আজ সে সব বিষয়ে নিয়ে বিরুদ্ধাচরণ হচ্ছে। সংসদে বিলপাশ হচ্ছে। সে জন্য সুন্নী মতাদর্শ ভিক্তিক একজন নেতৃত্ব অবশ্যই প্রয়োজন। এজন্য সুন্নীয়ত ভিত্তিক সমাজ গঠনে একজন নেতাকে নির্বাচন করে সংবাদ পাঠাতে পারলে অন্তত তাদের প্রশ্ন প্রস্তাবে একটি ‘না’ শব্দ যুক্ত হবে। তাই রাজনীতিতে অংশ নিচ্ছি।
…বর্তমানে যে রাজনীতি পরিবেশ, সেটি রাজার জন্য নীতি, আমাদের রাজনীতি হচ্ছে নীতির জন্য রাজা। রাসূলের (স) আদর্শ ও তেমন ছিল। মাযহাবের মতে মিল আছে তাই নীতির রাজার জন্য ইসলামী রাজনীতির সাহায়তা করি।
তবে বর্তমান সময়ে দেখা যায় ‘ইছাপীর, মুছাপীর, সবচেয়ে বড়ো পয়সাপীর’ সে নীতিতে আমরা পরাজয় বরণ করছি। গতানুগতিক ইসলামী আকিদা ভিত্তিক সংগঠক তৈরি করলে সব কুসংঙ্গতা দূরে হয়ে যাবে।
…বর্তমান সরকার উন্নয়নের জোয়ারের ভেসে নিচ্ছে বলে বুলি আউরাচ্ছে। উন্নয়ন কই, চোখে তো দেখিনি। কর্ণফুলীর দু’পাড়াইতো ভাঙছে। এক পাড়ে কাজ হচ্ছে অন্য পাড়ে হচ্ছে। তাতো দেখোর মতো নয়। কানুনগোড়া রোডে দু’টো গাড়ি ক্রস করতে পারে না। ভান্ডালজুড়িতে রাতে চলাফেরা করা যায় না। সেগুলো হয়েছে সেগুলো নিয়মতান্ত্রিক উন্নয়ন। নেই কোন ভাল চিকিৎসা, নেই ভালো যোগাযোগ ব্যবস্থা। কালুরঘাট ব্রীজ নির্মাণ করবে করবে বলেইতো করলো না। তারা উন্নয়ন করলো কোথায়?
…ছাত্রজীবনে ফটিকছড়ির ওবাইদুল আকবর, মাওলানা নুরুল ইসলাম বোয়ালী, মৌলানা ফোরকান, মৌলানা ইসমাইল প্রমুখ এবং পেশাগত জীবনে খরদ্বীপের আলহাজ্ব মাওলানা আবদুল হক, চন্দনাইশের আল্লামা আবদুল হামিদ ফখরে বাংলা পটিয়ার আবদুল করিম সাহিত্য বিশারদ, শাহচান্দ আউলিয়ার মাদ্রাসার প্রতিষ্ঠাতা আল্লামা নুরুল হকের সান্নিধ্য আমার জীবনে স্মৃতি ভাস্বর। তাদের কথাবার্তা, আচার আচরণ আমার জীবনকে আরো বণাঢ্য করেছে এবং তরাহ্নিত করেছে।
…ভবিষ্যৎ প্রজন্মের জন্য আমার পরামর্শ সত্যিকারের আহলে সুন্নত ওয়াল জামাতের পতাকাতলে যথাসাধ্য থাকার চেষ্টার করতে হবে। প্রিয় নবীর (স) আদর্শের দামার ধরতে আহলে সুন্নত ওয়াল জামাতের বিকল্প নেই।
সাক্ষাতকারটি নিয়েছেন-মো. তাজুল ইসলাম রাজু। সাথে ছিলেন এম. জসিম উদ্দিন, আল সিরাজ ভাণ্ডারী, এস.এম গিয়াস উদ্দিন, এস.এম মোদ্দাচ্ছের।
অধ্যক্ষ আল্লামা মুফতি শাহ্ মুহাম্মদ ইদ্রীছ রজভী বড় হুজুর কেবলা
অধ্যক্ষ আল্লামা মুফতি শাহ্ মুহাম্মদ ইদ্রীছ রজভী বড় হুজুর কেবলার ওফাত বরণ