দেশের তরুণ ও নিভৃতচারী ভাস্কর ডি.কে. দাশ (মামুন)। দীর্ঘ ত্রিশ বছর ধরে একটানা কাজ করে একশত কীর্তিমান বাঙালীর প্রতিকৃতি ভাস্কর্যের উপর একটি সিরিজ ওয়ার্ক কার্যক্রমের শেষ পর্যায়ে রয়েছেন। দেশের প্রতীতযশা, স্বনামধন্যের ও প্রিয়জনদের প্রতিকৃতি ভাস্কর্য নির্মাণ করে এর প্রদর্শনী করাই তাঁর কার্যক্রমের মূল উদ্দেশ্য। তরুণ এই ভাস্কর দেশের ৯৪ জনের প্রতিকৃতি নির্মাণের কাজ এর মধ্যে প্রায় শেষ করেছেন। তৎমধ্যে বোয়ালখালীর কীর্তিমান বাঙালী রয়েছেন এমন ৫জন ব্যক্তির প্রতিকৃতি নির্মাণ প্রায় শেষ। তৎমধ্যে একুশে পদক প্রাপ্ত বাদন শিল্পী বিনয় বাঁশী জলদাশ এর সমাধি প্রাঙ্গণে ৬ফুট উচ্চতার পূর্ণাঙ্গ ভাস্কর্য নির্মাণ, যা দক্ষিণ চট্টগ্রামে প্রথম ওভার লাইফ সাইজ প্রতিকৃতি ভাস্কর্য। ২০০৭ সালে আঞ্চলিক গানের রানী শেফালী ঘোষ এর পৈত্রিক বাড়ীতে সমাধি প্রাঙ্গণে স্থাপিত, ২০১৩ সালে সাহিত্যিক রমা চৌধুরী, ২০০৯ সালে বিপ্লবী বিনোদ বিহারী চৌধুরী, ২০০৭ সালে আন্তজাতিক ব্যক্তিত্ব ডা. বিবি চৌধুরীর ভাস্কর্য নির্মাণ করেছেন। এছাড়া বোয়ালখালী ইতিহাস ঐতিহ্যে আঁকড় আরো ১০জনের ভাস্কর্য নির্মাণে এক বিশাল কর্মযজ্ঞ গ্রহণ করা হয়েছে। তিনি কথা বলেছেন আলোকিত বোয়ালখালী’র সম্পাদক মো. তাজুল ইসলাম রাজু’র সাথে। তারই কথোপকথনের চৌম্বক অংশটুকু পাঠকের উদ্দেশ্যে নিবেদন করা হলো।

প্রফেসর ভাষ্কর  সৈয়দ আবদুল্লাহ খালিদ এর সাথে ভাষ্কর ডি কে দাশ মামুন ও আলোকিত বোয়ালখালীর সম্পাদক মো. তাজুল ইসলাম রাজু

আ.বো.: আপনার ছেলেবেলা নিয়ে বলুন।
ভাস্কর মামুন : জ্যৈষ্ঠের খরতাপে চৌচির ফসল শূন্য মাঠে প্রথম বৃষ্টিতে ভেজা মাটির গন্ধ শুকে নেবার সুযোগ, আষাঢ়ের প্রবল বৃষ্টিতে কলার ভেলায় বাগমারা চর পর্যন্ত ভেসে যাবার আনন্দ, মাঘের শীতে সারারাত জেগে পালা কীর্তন কিংবা যাত্রা নাটক দেখার আনন্দের পাশাপাশি উদোম উঠোনে মাদুর চাটাই পেতে বিদ্যাভ্যাাসের পর মা’র হাতের অমৃত রান্না খেয়ে ঘুমিয়ে কাটানোর মত অমূল্য টুকরো টুকরো বিশাল এক স্মৃতির পুঁথির মালা আমার শৈশব। যা আমাকে আমৃত্যু কাছে টানবে। সেই শিশুকাল মায়াবী এক মনলোভা ইন্দ্রজল।

খাগড়াছড়িতে বঙ্গবন্ধুর ভাস্কর্য
জাতীয় চার নেতা (খাগড়াছড়ি)

আ.বো.: শিল্পকলায় লেখাপড়া কি জীবনের পরিকল্পনা ছিল ?
ভাস্কর মামুন : না, শিল্পকলায় পড়তে আসাটা আমার জীবনে মেঘ না চাইতে বৃষ্টির মত। বিজ্ঞানের ছাত্র ছিলাম। পড়তে গিয়েছিলাম বিজ্ঞান নিয়ে এগ্রিকালচার ইউনিভার্সিটিতে। এখন মনে হয় ঠিক জায়গাতেই আমি ফিরে এসেছি, ঘরের ছেলে ঘরে ফেরার মত। শিল্পকলা চর্চা জীবনে বিচ্ছিন্ন ভাবে চলতে গিয়ে খুব করে ভাললাগার মত কোন সুপরিকল্পনায় সেঁঠে যাওয়ার মত।

বাংলাদেশের ২য় শাপলা ভাস্কর্য খাগড়াছড়িতে শাপলা চত্বর

আ.বো. : প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষা কোথায় কখন থেকে ?
ভাস্কর মামুন : ছবি আঁকার লোভটা আমার শৈশব থেকে। পটুয়া আর মৃৎশিল্পীদের ক্যারিশমা দেখে তাদের এক একজনকে আমার বিশাল বিশাল স্রষ্ঠা মনে হত। হঠাৎ একদিন সরকারি চারুকলা কলেজে প্রদর্শনী দেখেতে গিয়ে মনটা কেমন প্রচন্ডভাবে দুলে যায়। তারপর চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ে চারুকলা অনার্সে ভর্তি পরীক্ষায় অংশ নিই। মজার বিষয় বিশ্ববিদ্যালয়ে বিজ্ঞান অনুষদের ভর্তি পরীক্ষায়ও মেরীট লিস্টে ভর্তির সুযোগ অর্জন করি। আমি দু’টি বিষয়ের ভর্তির যোগ্যতা অর্জন করে এক সংকটের মুখোমুখি হয়ে যাই। কি পড়ব, বিজ্ঞান না কলা? অবশেষে ফাইন আর্টসেই ভর্তি। ওখান থেকেই অনার্স ও মাস্টার্স করি। ভাষ্কর্যই ছিল আমার সাবজেক্ট। পরে এম.ফিল অর্জন ও পিএইচডি। এর জন্য চবি মাননীয় উপাচার্য অধ্যাপক ড. শিরীণ আখতার, অধ্যাপক ড. মাহবুবুল হক, অধ্যাপক ড. মহিবুল আজিজ স্যারের কাছে আমি কৃতজ্ঞ। অনেকটা স্বপ্নের মতো করে ছাত্রত্ব পেয়ে গেলাম ভাষ্কর সৈয়দ আবদুল্লাহ খালেদ স্যার কে। যিনি উজাড় করে শিখিয়েছেন। তবে পেইন্টিং, গ্রাফিক্স ও নাটকের চর্চাও করেছি। ইউনিভার্সিটি থেকে বেরিয়ে পশ্চিমবঙ্গের বয়োবৃদ্ধ ভাস্কর সুষ্ময় চ্যাটার্জীর সাথে বেশ কিছুদিন কাজ করেছি কলকাতা, দিল্লি, নেপালের কাটমান্ডুতে । একাডেমিক ভাষ্কর্য চর্চার বাইরে সুষ্ময়দার সান্নিধ্য আমার অর্জনে একটা মাত্রা এনে দিয়েছে। তবে ছাত্র জীবনে অত্যন্ত উদারভাবে অর্জন করেছি আমার শ্রদ্ধেয় স্যার দেশ বরেণ্য খ্যাতিমান চিত্রশিল্পী শ্রদ্ধেয় মূর্তজা বশির, অধ্যাপক মনসুর-উল করিম, অধ্যাপক আনসার আলী, অধ্যাপক আবুল মনসুর, অধ্যাপক মিজানুর রহিম, অধ্যাপক ঢালী আল-মামুন, অধ্যাপক অলক রায়, অধ্যাপক নাসিম বানু প্রমুখ শ্রদ্ধেয় স্যারদের কাছে।

চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের শহীদ মিনার ( প্রফেসর খালিদ স্যারের সাথে প্রধান সহেযাগী হিসেবে দায়িত্ব পালন করেছি )

আ.বো. : প্রতিকৃতি ভাস্কর্য নির্মাণ ও প্রদর্শনীর অনুপ্রেরণা পেলেন কোথা হতে?
ভাস্কর মামুন : মিশরীয় শিল্পকলায় ফারাওদের মমি সংরক্ষণ কর্মকান্ড আমার কাছে যুগান্তকারী মনে হয়েছে। পিড়ামিডের সংরক্ষিত শত শত প্রয়াত মিশরীয়দের মমি সংরক্ষণের মধ্য দিয়ে পূর্ব পুরুষদের স্মৃতি সংরক্ষণ ও তাদের প্রতি শ্রদ্ধা প্রদর্শন সত্যি অপূর্ব। আমার ধারণা, আমাদের জাতীয় যাদুঘরে বিখ্যাত সকল ব্যক্তিবর্গের প্রতিকৃতি সংরক্ষণ করলে এদেশের মহৎপ্রাণরা তাদের কীর্তিগাঁথা নিয়ে সর্ব সাধারণের কাছে স্মরণীয় হয়ে পরিচিতি লাভ করতে থাকবেন। প্রতিকৃতি ভাস্কর্যের মাধ্যমে অনাদিকাল বন্দিত হবেন তাঁদের কর্ম ও ব্যক্তিত্ব।
এরপর বেশ সময় পেরিয়ে যায়। একটি বেসরকারি বি.এড. কলেজের উপাধ্যক্ষ ও একটি বেসরকারী বিশ্ববিদ্যালয়ের কোর্স কোর্ডিনেটর-এর দায়িত্ব পালন করি। উদ্যোগটি নিতে আরো দেরি করে ফেলি। পরবর্তীতে অনেকেই এ বিষয়ে আমাকে অনুপ্রেরণা যুগিয়েছেন। এই জন্যে তাঁদের সকলের কাছে আমি সত্যি ঋণী। আর পেছন ফিরে তাকাইনি। সিরিজ ওয়ার্কের প্রথম কাজটি শুরু করি। এই সিরিজ ওয়ার্কের প্রথম ব্যক্তিত্ব আজাদীর তৎকালীন সম্পাদক শ্রদ্ধেয় মরহুম অধ্যাপক মোহাম্মদ খালেদ। সেই যে শুরু করেছি এখনো কাজ করছি নিয়মিত।

সাহিত্যিক রমা চৌধুরীর ভাস্কর্য নির্মাণ কালে

আ.বো.: আপনার সিরিজ প্রতিকৃতি ভাস্কর্য প্রদর্শনী সম্পর্কে বলুন?
ভাস্কর মামুন : ছাত্রাবস্থায় এই পরিকল্পনাটি আমার মাথায় আসে। তখন থেকেই ভাবতাম দেশের বরেণ্য ব্যক্তিদের প্রতিকৃতি দিয়ে একটি প্রদর্শনী করার। কিন্তু সাধকে সাধ্যে গড়ানো যে বড় দুঃসাধ্য তা কাজে হাত দিয়ে বুঝতে পারি। কেননা আমাদের দেশে পৃষ্ঠপোষকতার যথেষ্ট অভাব। আমি সিরিজের জন্য ১০ বছর ধরে কাজ করছি এবং সর্ব প্রথম চট্টগ্রামকেই নিয়ে কাজ শুরু করি। এটা আমার শহর। এই কাজে নিশ্চয়ই একটা সহভাগীতাপূর্ণ পরিবেশ পাব ভেবেছিলাম। আমার অভিজ্ঞতা কিন্তু মিটে কড়ায়পূর্ণ। এই চট্টগ্রামে বহু গুনী ব্যক্তির জন্ম, তাঁদের সবার প্রতিকৃতি নির্মাণ আমার একার পক্ষে সম্ভব নয়। ঐ যে বললাম সময় আর পৃষ্ঠপোষকতার অভাব। আবার অনেকের প্রতিকৃতি নির্মাণের ক্ষেত্রে পারিবারিক অসম্মতির কারণেও অনেক বিখ্যাত ব্যক্তির কাজ করা সম্ভব হয়নি। বাহিরের দিক থেকে আমরা উদার হলেও শত বছরের কুসংস্কার হতে আজও আমরা মুক্ত হতে পারিনি। বিষয়টি বেশ পরিস্কার হল আমার কাছে।

বিপ্লবী বিনোদ বিহারী চৌধুরীর বোঞ্জ ভাষ্কর্যটি কলকাতায় স্থাপিত হয়েছে

আ.বো. : সিরিজ করতে গিয়ে মনোটোনাস মনে হয় নি ?
ভাস্কর মামুন : না, একেবারেই না। আমার প্রতিটি প্রতিকৃতি নির্মাণের সময় মনে হয়েছে আলাদা আলাদা বিষয়ের উপরে কাজগুলো আমি করেছি। অধ্যাপক মোহাম্মদ খালেদ আর অধ্যাপক ডঃ জামাল নজরুল ইসলাম, কিংবা বিনোদ বিহারী চৌধুরী এই তিন জনই স্ব-মহিমায় আলাদা। তিন ব্যক্তির ব্যক্তিত্ব দিয়ে তিন ভাবে তাঁরা প্রতিভাত। তাই তিন ব্যক্তির তিন চেতনা নির্মাণে আমার শিল্প বোধ ভিন্ন ভিন্ন ভাবে কাজ করেছে। আমার কাছে কোন দু’টি কাজই একই মনে হয়নি। আমার কাছে একজন ব্যক্তি আলাদা আলাদা বিষয় এবং প্রতিটি প্রতিকৃতি ভিন্ন ভিন্ন বিষয়ের উপর নির্মিত আলাদা আলাদা শিল্পকর্ম।

মাইকেল মধুসুদন দত্ত ( সাগরদাড়ি )

আ.বো.: সর্বমোট ক’টি প্রতিকৃতি নির্মাণের পরিকল্পনা আছে আপনার? পাশাপাশি অন্য কোন কাজ করছেন?
ভাস্কর মামুন : আমার তো ইচ্ছে অনেকগুলো কাজ করি। কিন্তু সময় ও সাধ্য অত্যন্ত সীমিত। প্রায় ১০ বছর কাজ করেছি। এই দীর্ঘ সময়ে মাত্র ৯৪টির মতো কাজ শেষ করতে পেরেছি। রিলিফ ভাষ্কর্যে কিছু প্রতিকৃতি করেছি। কিছু ল্যান্ডস্ক্যাপ করার ইচ্ছে আছে। লে-আউট গুলো গুছিয়ে নিচ্ছি। প্রদর্শনীর পর কাজগুলো শুরু করব। একরকম টায়ার্ড হয়ে গেছি। অন্যকোন মাধ্যমে কাজ করতে মন চায়, প্রদর্শনীর পর ম্যুরাল ও পেইন্টিংও করব ফাঁকে ফাঁকে।

দৈনিক আজাদীর সম্পাদক অধ্যাপক মোহাম্মদ খালেদ

আ.বো. : প্রদর্শনীর আয়োজন নিয়ে আপনার মানসিক তৃপ্তি ও প্রস্তুতি কতটুকু?
ভাস্কর মামুন : বলতে গেলে “এ যাত্রা নাইতে গিয়ে মাথা না চুবিয়ে কুলে উঠার মত হল”। এই চট্টগ্রামে অনেক খ্যাতিমান মানুষ জন্মেছেন। কেউ গত হয়েছেন কেউবা এখনো জীবিত। অনেকেরই কাজ আমার করা সম্ভব হয়নি। একটি তালিকা করা হয়েছে। এতে ২০০ জনেরও অধিক ব্যক্তির নাম রয়েছে। আমি আবারো স্বীকার করছি আমার একার পক্ষে সকল কাজ শেষ করা সম্ভব নয়, তাই এ বিষয়ে একাধিক শিল্পীর সম্পৃক্ততা এবং কোন সহায়তাকারী ব্যক্তি/প্রতিষ্ঠানকে সার্বিক সহায়তা দিতে পাশে দাঁড়াতে হবে। এই বিশাল কাজগুলো স্পন্সর ছাড়া প্রায় অসম্ভব। আমি অত্যন্ত কষ্ট করে অপ্রতুল সময়, পরিসর ও সহায়তায় কাজগুলো করে চলেছি। সরকার চাইলে এই উদ্যোগটি নিতে পারে এবং জাতীয় যাদুঘরে একটি সেলে প্রতিকৃতিগুলো রাখতে পারেন। আমার উদ্যোগটি বিশাল হলেও সাধ্যে কুলোতে পারিনি বলে এই প্রদর্শনীতে পূর্ণতৃপ্তি পাচ্ছিনে। যদি কোন দিন অনেকগুলো প্রতিকৃতি নির্মাণের মধ্য দিয়ে জাতীয়ভাবে একটি প্রদর্শনীর উদ্যোগের বাস্তবায়ন দেখি তবে পরিতৃপ্ত হব। সেদিনের প্রতীক্ষায় থাকলাম।

একুশে পদক প্রাপ্ত শেফালী ঘোষের নির্মিত ভাষ্কর্যের সাথে মামুন

আ.বো. : যাদের কাজ শেষ করলেন?
ভাস্কর মামুন : যে প্রতিকৃতি ভাস্কর্য গুলোর নির্মাণ কাজ আমি শেষ করেছি তাদের মধ্যে রয়েছে- জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবর রহমান, শহীদ সৈয়দ নজরুল ইসলাম, শহীদ তাজউদ্দিন আহমদ, শহীদ এম. মনসুর আলী, শহীদ এ.এইচ.এম কামরুজ্জামান, যুদ্ধকালীন সমরনায়ক এম.এ.জি. ওসমানী, সেক্টর কমান্ডার আবদুর রব, এ.কে. খন্দকার, মেজর জিয়াউর রহমান, কে.এম. সফিউল্লাহ, মেঃ খালেদ মোশাররফ, মেঃ রফিকুল ইসলাম, মেঃ সি.আর.দত্ত, মীর শওকত আলী, কাজী নুরুজ্জামান, আবু ওসমান চৌধুরী, কাজেম আলী মাষ্টার, শহীদ নূতন চন্দ্র সিংহ, বিনয় বাঁশী জলদাশ, অধ্যাপক মোহাম্মদ খালেদ, মরহুম আতাউর রহমান খান কায়সার, বাদশা মিয়া চৌধুরী, বিজ্ঞানী ড. জামাল নজরুল ইসলাম, বিপ্লবী বিনোদ বিহারী চৌধুরী, ড. অনুপম সেন, বীর মুক্তিযোদ্ধা ওসমান সরোয়ার, ভাষা সৈনিক কবি মাহবুব উল আলম চৌধুরী, ভাষা সৈনিক কাজী গোলাম মাহবুব, ডাঃ রবিউল হোসেন, অধ্যাপক অর্ধেন্দু বিকাশ রুদ্র, অধ্যাপক জহুরুল ইসলাম, মানবেন্দ্র লারমা, হরিপ্রসন্ন পাল, মিয়া মোঃ ফারুকী, ভাষা সৈনিক শফি উদ্দিন আহমদ, অধ্যক্ষ নিলুফার জহুর, বিশপ যোয়াকিম রোজারিও, ওস্তাদ মোহন লাল দাশ, ওস্তাদ ক্যাপ্টেন আজিজুল ইসলাম, শেফালী ঘোষ, রমা চৌধুরী, ডা. বিবি চৌধুরী, আবদুল গফুর হালী প্রমুখ উল্লেখযোগ্য।

খ্যাতমান ভৌত বিজ্ঞানী প্রফেসর ড. জামাল নজরুল ইসলাম

আ.বো. : কি কি মাধ্যমে ভাস্কর্যগুলো তৈরি করেছেন?
ভাস্কর মামুন : আমরা ক্লেতে সচরাচর ক্লাস ওয়ার্কগুলো করতাম। মাঝে মাঝে কাঠ, সিমেন্ট, মোম, মেটালেও করেছি। আমার প্রদর্শনীর কাজগুলো (পোট্রেষ্টগুলো) মূলত: ক্লে, সিমেন্ট, ষ্টোন, প্লাস্টার অব প্যারিস প্রভৃতি দিয়ে করেছি। এসব কাজগুলো আমার এক্সপেরিমেন্টাল ওয়ার্ক। আমার এই প্রদর্শনীর বেশীর ভাগ কাজ শেষে স্টোনে কাষ্টিং করা।

আর্ন্তজাতিক ব্যক্তিত্ব ডা. বিবি চৌধুরীর ভাস্কর্য নির্মাণকালে। পাশে চৌধুরীর কন্যা ময়নার ভাস্কর্য যা আমেরিকাতে সংরক্ষণ করা হয়েছে।

আ.বো. : দেশ ও দেশের বাইরে আপনার প্রিয় ভাস্কর আছেন কেউ?
ভাস্কর মামুন : অবশ্যই আছেন। দেশে রয়েছেন আমার শ্রদ্ধেয় স্যার ভাস্কর সৈয়দ আবদুল্লা খালিদ, ভাস্কর হামিদুজ্জামান, ভাস্কর অলক রায়, ভাস্কর নিতুন কুন্ডু, ভাস্কর নভেরা আহমেদ প্রমুখ। আর দেশের বাইরে ভাস্কর হেনরি ম্যুর, ভাস্কর মাইকেল এঞ্জেলো, ভাস্কর রাম কিংকর আমার প্রিয় ভাস্কর। তাঁদের প্রত্যেককে আমার কাছে এক একজন স্বতন্ত্র স্রষ্টা বলে মনে হয়।

একুশে পদক প্রাপ্ত বিনয় বাঁশী জলদাশের ভাষ্কর্য নির্মাণকালে

আ.বো.: শিল্পীদের জীবনে শিল্পচর্চায় অনুপ্রেরণা অত্যাবশ্যক। সেই ক্ষেত্রে আপনার কাছের মানুষগুলোর প্রেরণা/ অনুপ্রেরণার কথা বলুন?
ভাস্কর মামুন : আমার মা, বাবা না চাইলে এ বিষয়ে আমার পড়া-শোনাই সম্ভব হতো না। সম্ভব হতো না নতুন একটা পৃথিবীকে জানার। তাঁরা নিরন্তর আমার প্রেরণার আঁধার। পারিবারিক পরিমন্ডল, শিক্ষক, বন্ধু-বান্ধব, শুভানুধ্যায়ী সবার কাছ থেকে এ বিষয়ে পেয়েছি উদার এক দৃষ্টি ভঙ্গি, সহযোগীতা যা আমার শিল্প চর্চার পথকে করে করেছে সুগম।

কাজেম আলী মাষ্টার

আ.বো. : শিল্পী হিসেবে আপনার স্বাধিকারের কথা বলুন?
ভাস্কর মামুন : শিল্পীরা চেতনায় স্বাধীন। যে শিল্পী পরাধীনতার শেকল পড়ে আছে তার মধ্যে শিল্পসত্ত্বা মরা গাঙের মত স্রোতহীন। আমি চাই এদেশে শিল্পীদের শিল্প চর্চায় সরকারি সুযোগ সুবিধা বৃদ্ধি করা হোক। প্রতি জেলায় একটি করে সরকারি আর্ট গ্যালারী ও প্রতিটি বিভাগে অন্ততঃ একটি করে সরকারি ফাইন আর্টস কলেজ প্রতিষ্ঠার পাশাপাশি প্রতিটি বিশ্ববিদ্যালয়ে আলাদা বিভাগ চালু করে এ বিষয়ে উচ্চ শিক্ষার পথ প্রশস্ত করা হোক। শিল্প চর্চা ছাড়া একটি জাতি প্রাণহীন, বিনোদনহীন নিথর জড়বৎ। আর শিল্পীর স্বাধিকার বলতে আরো কিছু কথা আমি বলতে চাই। একজন চারুশিল্পী শিল্পকলায় সর্বোচ্চ এম.এ. ডিগ্রী নিয়ে উচ্চ শিক্ষা অর্জন করেন। অথচ, বাংলাদেশ পাবলিক সার্ভিস কমিশনে (বি.সি.এস.) এদের বিষয় ভিত্তিক নিয়োগের কোন স্কোপ নেই। সম্প্রতি তা করা হলেও অপ্রতুল। বাংলাদেশে অনেক ক্ষেত্র আছে যেখানে এই বিষয়ে পাশ করা ছাত্র-ছাত্রীদের রিক্রুট করা যেতে পারে। সংস্কৃতি মন্ত্রণালয় থেকে শুরু করে প্রতিটি থানা পর্যায়ের শিক্ষা কার্যক্রমে, যাদুঘর, শিল্পকলা একাডেমী, সকল কলেজ, বিশ্ববিদ্যালয় সহ প্রতিটি স্থানে সমমর্যাদায় চারুশিল্পীগণ তাদের চর্চা ও প্রতিভা রাষ্ট্রীয় কর্মকান্ডকে সৌকর্যমন্ডিত, মহিমান্বিত করে তুলতে অগ্রণী ভূমিকা রাখতে পারে। প্রসংগত উল্লেখ্য বাংলাদেশের বেশ কিছু খ্যাতিমান চিত্রকর ও ভাস্কর বিশ্বজোড়া গৌরব, এ জাতির জন্য এনে দিয়েছে। যেহেতু বিষয়টির লেখা-পড়া একটু ব্যতিক্রম। এর জন্য সেই ভাবেই পরীক্ষার আয়োজন করা যেতে পারে। সাধারণ পদ্ধতিতে পরীক্ষা দিয়ে অনেক ছাত্র-ছাত্রী শেষমেষ হতাশ হয়ে পড়েছে (বিষয় ভিত্তিক কোটা না থাকায়) এমন নজির প্রচুর। কলেজ পর্যায়ে (অন্ততঃ শুরুটা করা যেতে পারে) একাদশ শ্রেণীতে নন্দন তত্ত্ব ও শিল্প চর্চার উপর একটি বিষয় রাখা যেতে পারে। বিশ্বের সকল উন্নত শিক্ষা ব্যবস্থায় শিল্প চর্চা শ্রেণী কার্যক্রমে অত্যাবশ্যক। কেননা শিল্পচর্চা প্রতিটি মানুষকে পরিশীলিত করে তোলে।

কলকাতার  নন্দনে ভাস্কর্য শিল্পে অনন্য অবদানের জন্য ভাস্কর ডিকে দাশ মামুনকে “শিল্প ভারতী” উপাধি প্রদান করা হয়

আ.বো. : ভাস্কর্য চর্চায় অবদানের জন্য কোন এওয়ার্ড পেয়েছেন কি ?
ভাস্কর মামুন : ভাস্কর্য চর্চায় অবদানের জন্য কলকাতার শীর্ষ শিল্প ও সাহিত্য চর্চকারী সংগঠন ‘হ্যালো ক্যালকাটা’, ‘ভাইব্রেশন অব জয়’, ও ‘চর্চার আনন্দ’র যৌথ উদ্যোগে শিল্প চর্চায় অবদানের জন্য সম্মানসূচক এওয়ার্ড প্রদান করেছিলো। সম্প্রতি কলকাতার রবীন্দ্র সনদের নন্দনে অবনীন্দ্রনাথ সভাঘরে আনুষ্ঠানিকভাবে এ সম্মাননা প্রদান করা হয়। বিজ্ঞানী ড. অরুপ মিত্রের সভাপতিত্বে অনুষ্ঠিত এওয়ার্ড প্রদান অনুষ্ঠানে অতিথি ছিলেন সাহিত্যিক শিবানী সংহ, আচার্য দীনেশ চন্দ্র সেন রিসার্চ সোসাইটির সাধারণ সম্পাদক অধ্যাপক দেবকন্যা সেন, শিক্ষাবিদ ড. গৌতম মুখাজী, মালদার ভূমিপুত্র কবি ও ইতিহাসবিদ আব্দুস সামাদ, নবদিগন্তের সুনীতা মুখার্জি, মহাকাশ বিজ্ঞানী অসীম আচার্য চৌধুরী, চলচ্চিত্রকার অজয় আগরওয়াল, শিল্পী আয়ুষ আগরওয়াল প্রমুখ। অনুষ্ঠানটির সঞ্চালক ছিলেন সংগঠক আশিষ বসাক।

পটিয়ার ভাটিখাইন ইউনিয়ন পরিষদ চত্বরে নির্মিত হয়েছে মুক্তিযুদ্ধের ভাস্কর্য ‘বিজয় বাংলা’

আ.বো. : উল্লেখযোগ্য একটি ভাস্কর্য নির্মাণের কথা বলুন ?
ভাস্কর মামুন : ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ‘অপরাজেয় বাংলার’ পর এই প্রথম ইউনিয়ন পর্যায়ে চট্টগ্রামের পটিয়ার ভাটিখাইন ইউনিয়ন পরিষদ চত্বরে নির্মিত হয়েছে মুক্তিযুদ্ধের ভাস্কর্য ‘বিজয় বাংলা’। রাজধানীর মতিঝিল এর পর পাবর্ত্য জেলা খাগড়াছড়িতে শাপলা ভাষ্কর্য আমার দ্বারা নির্মিত।
চট্টগ্রামে মুক্তিযুদ্ধের প্রথম মূর্ত ভাস্কর্য ‘বিজয় বাংলা’ গত ১৭ ডিসেম্বর ২০১৫ বৃহস্পতিবার উদ্বোধন করা হয়। এছাড়া গ্রামাঞ্চলে বোয়ালখালীতে সাংবাদিক মো. তাজুল ইসলাম রাজু’র উদ্দ্যেগে ও জেলা পরিষদ সচিব রবিন্দ্রশ্রী বড়ুয়া’র তত্বাবধানে ২০০১সালে একুশে পদক প্রাপ্ত বাদন শিল্পী বিনয় বাঁশী জলদাশ- এর সমাধী প্রাঙ্গনে ৬ফুট উচ্চতা সম্পন্ন ওভার লাইভ সাইজ ভাস্কর্য নির্মাণ করি, যা চট্টগ্রামে প্রথম। এ ভাস্কর্য দু’টি আলাদা আলাদা তৈরি করতে সময় লেগেছে প্রায় এক বছর।

বীরমুক্তিযোদ্ধা ওসমান সরোয়ার (সাবেক রাষ্ট্রদূত সংযুক্ত আরব আমিরাত)

আ.বো. : প্রতিষ্ঠিত ভাষ্কর্যগুলো নিয়ে আপনার পরিকল্পনা কি?
ভাস্কর মামুন : যেগুলো নির্মাণ করেছি তাতো স্ব-স্ব জাযগায় স্থাপন করা হয়েছে। ব্যক্তি বিশেষের ভাস্কর্যগুলো স্ব স্ব ভাবে নিজেরাই সংরক্ষণ করছেন। পাশাপাশি ওখান থেকে যেটুকু সম্ভব হয়েছে আমি কপি করে প্রায় শতাধিক ভাস্কর্য সংরক্ষণ করছি। ভাস্কর্যগুলো নিয়ে চট্টগ্রাম ও ঢাকায়  প্রদর্শনী করবো বলে পরিকল্পনা নিয়েছি। প্রথমে চট্টগ্রামে পরে ঢাকায় প্রদর্শনী করার পরিকল্পনা আমার আছে। ঢাকার পাঁচ থেকে দশ স্বনামধন্য ব্যাক্তির প্রতিকৃতি ভাস্কর্য এর সাথে যুক্ত হবে আশা রাখি। ২০২০- এ ঢাকায় কাজ করার ইচ্ছে রয়েছে। তাছাড়া যথার্থ সহায়তা পেলে ঢাকার বাইরেও প্রদর্শনীর আয়োজন করা যেতে পারে। এ বিষয়ে আমি সরকারের বদান্যতা কামনা করি। সর্বশেষে ভাষা আন্দোলন মিউজিয়াম ঢাকা কিংবা জাতীয় জাদুঘরের কাছে কাজগুলো শর্ত সাপেক্ষে হস্তান্তর করার ইচ্ছেও আমার আছে।

সৌদি আরবে বাংলাদেশ দূতাবাস সংলগ্ন ঈদগাহ মাঠে প্রতিষ্ঠিত ‘হলি প্রে টু অলমাইটি গড’

আ.বো. : আপনার দেশ ও দেশের বাইরের কাজগুলো সর্ম্পকে বলেন?
ভাস্কর মামুন : এশিয়া মহাদেশের কয়েকটি দেশে আমি খুবই আন্তরিকভাবে নির্মিত ভাস্কর্যগুলো নিয়ে আনুষ্ঠানিক প্রদর্শনী করেছি। যেমন- পাকিস্থানের রাওয়াল পিন্ডি আর্ট কলেজ, ভারতের মুম্বাই স্কুল অব আর্টস, নেপালের কাটমুন্ড শিল্প মন্দির, মায়ানমারে ইয়াঙ্গুন আর্ট স্কুল, থাইল্যান্ডের আর্টস অব এক্সিভিশন, কলকাতায় নন্দন আর্ট গ্যালারী, ত্রিপুরা বিশ্ববিদ্যালয় অডিটোরিয়াম, সৌদি আরবের বাংলাদেশ দূতাবাসের রাষ্ট্রদূত ওসমান সরওয়ার এর আয়োজনে দূতাবাস প্রাঙ্গনে, বাংলাদেশের রাজধানী ঢাকায় ভাষা আন্দোলন মিউজিয়াম প্রভৃতি স্থানে অত্যন্ত ভাবে প্রদর্শনী করেছি। এতে অনেকেই আমাকে সহযোগিতা করেছেন। আমি ব্যক্তিগত ভাবে তাঁদের কাছে কৃতজ্ঞ। আগামীতে চট্টগ্রামে প্রদর্শনী করার মত যে ক’টি অডিটোরিয়াম/ভেন্যু আছে যেমন- শিল্পকলা একাডেমী, থিয়েটার ইনিষ্টিটিউট, শিশু একাডেমী, ডি.সি.হিল, অলিয়াঁস ফ্রঁসেস এর মতো যে কোন একটি স্থানে প্রদর্শনী অনুষ্ঠিত হবে।

সমাজ বিজ্ঞানী প্রফেসর ড. অনুপম সেন

আ.বো. : বোয়ালখালী প্রসঙ্গে বলুন?
ভাস্কর মামুন : বোয়ালখালীর ইতিহাস ঐতিহ্য হাজার বছরের। এখানে ৩জন একুশে পদক প্রাপ্ত ব্যক্তি আছেন, যা বাংলাদেশের কোন উপজেলায় নেই। এখানে সাহিত্যিক, শিক্ষাবিদ, সাংস্কৃতিবিদ, রাজনীতিবিদ ব্যক্তি যেমন আছেন- তেমন ধর্নাঢ্য ব্যক্তিরও অভাব নেই। তাই বোয়ালখালীতে উপযুক্ততা পেলে কাজ করার আগ্রহ আছে। ইতোমধ্যে বোয়ালখালীর স্বনামধন্য ৫জনের ভাস্কর্য তৈরী করলাম, আরো ১০টি করার পরিকল্পনা আছে। তবে সংশ্লিষ্ট সকলের সহযোগীতা চাই।

কলকাতা মিডিয়া ফোরাম ঘোষিত ‘লেজেন্ড অব বেঙ্গল-২০১৮ গ্রহণকারীদের সাথে ভাষ্কর ডিকে দাশ মামুন

আ.বো. : আপনাকে ধন্যবাদ?
ভাস্কর মামুন : আলোকিত বোয়ালখালী পত্রিকাটি সঙ্গে আমার পরিচিতি ২০০৬ সালে। সে থেকে এ পত্রিকায় দেখলাম সারাদেশে পাঠকের একটা গভীর সংযোগ আছে। ইতিহাস ঐতিহ্য ও শিক্ষনীয় বিষয়ে এ পত্রিকাটি খুবই যত্নশীল মনে হয়েছে। ইতিহাস যেমন মানুষ ভুলে না এবং মানুষকে ভোলায় না। তেমনি এই পত্রিকাটিকে মানুষ ভুলবেনা। আলোকিত বোয়ালখালী’র অগণিত পাঠককে আমার আন্তরিক শুভেচ্ছা জানাচ্ছি। বিজ্ঞ পাঠকগণ যেন ধীর্ঘসময় এই পত্রিকাকে আপন করে রাখে। আপনাকেও ধন্যবাদ।

চবি.র প্রাক্তণ ভিসি প্রফেসর আবু ইউসুপ
চক্ষুরোগ বিশেষজ্ঞ ডা. রবিউল হােসেন
রাজনীতিবীদ মিয়া ফারুকী
সংগীতজ্ঞ আবদুল গফুর হালী
চট্টগ্রাম নৌবাহিনীতে ডলফিন ভাস্কর্য ( প্রফেসর খালিদ স্যারের সাথে প্রধান সহেযাগী হিসেবে দায়িত্ব পালন করেছি )
Print Friendly, PDF & Email

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here