ড. ইফতেখার উদ্দিন চৌধুরী

এটি সর্বজনবিদিত যে, যেকোন অর্জনের পিছনে বর্জন-বিসর্জনের পালাবদলের অর্থান্তর নিহিত থাকে। অনুন্নয়ন-উন্নয়ন, অন্ধকার-আলো, অশুভ-শুভ, অন্যায়-ন্যায়, অবিচার-বিচার ইত্যাদির প্রতিটি অকল্যাণ-কল্যাণের সাথে জড়িয়ে রয়েছে করুণ আর্তনাদ, ঐকান্তিক প্রচেষ্টা, নির্ভুল পথচলা এবং জীবন পরিক্রমার কাঠিন্যে প্রাবল্য। প্রাণঘাতী কোভিড-১৯ বিশ্বব্যাপী সংক্রমণের অসংবৃত ভয়াবহ বিস্তার এবং প্রাণসংহারের উম্মত্ত তাণ্ডবের মাধ্যমে সমগ্র মানবসন্তানদের কঠিন ভীতির এক অন্ধকার বলয়ে নিমজ্জিত করেছে। বিশ্বস্বাস্থ্য সংস্থার সাম্প্রতিক প্রতিবেদন অনুসারে এই সংক্রমণের বিস্তার আশঙ্কাজনকভাবে বেড়ে চলেছে। আমাদের প্রিয় মাতৃভূমিও এই সংক্রমণ আক্রমণের বাইরে নয়। বিশ্ব মহামন্দা, প্রচণ্ড হারে বেকারত্ব এবং দারিদ্র্যের পরিসংখ্যান ইত্যাদি বাংলাদেশেও সম্ভাব্য প্রভাবের অতিশয় অসহায় অভ্যন্তরীণ অজানা দৃশ্যপট জনগণের মাঝে যারপরনাই হতাশার জাল বুনে চলেছে।
প্রধান সেনাপতি মাননীয় প্রধানমন্ত্রীর নেতৃত্বে দেশের সকল স্তরের পেশাজীবী এবং আপামর জনগণ অত্যন্ত আন্তরিকতা ও নিষ্ঠার সাথে এই করোনা যুদ্ধ জয়ে প্রাণান্তিক লড়ে যাচ্ছেন। আয়তনে অতি ক্ষুদ্র এই ব-দ্বীপের জনবহুলতা ও ঘনবসতির বিশ্লেষণে দেখা যায়, উন্নত বিশ্বের প্রতি বর্গ কিলোমিটারে পনের জনের বিপরীতে এখানে বার শত জনের বসবাস। ঘূর্ণিঝড়, দুর্যোগ, জলোচ্ছ্বাস, বন্যা, খরা, নদী ভাঙনসহ নানাবিধ প্রাকৃতিক সঙ্কট মোকাবেলায় প্রায় পুরোটা বছর ধরে সরকার, প্রশাসন, জনপ্রতিনিধি ও জনগণকে ব্যতিব্যস্ত থাকতে হয়। তবুও বীরত্বের গৌরবগাথায় ভয়কে জয় করে এই জাতি সকল সময়ে বীরের ভূমিকায় অবতীর্ণ হয়ে দুর্যোগ মোকাবেলায় বিশ্বনন্দিত হয়েছে। বঙ্গবন্ধু কন্যা দেশরত্ন শেখ হাসিনা অদৃশ্য ক্ষুদ্র এই অনুজীব বা ভাইরাসের কাছে হার না মানার প্রত্যয় ঘোষণা করে সকলের মনোবলকে অতি উঁচু মাত্রিকতায় আড়ম্বর করে চলেছেন।
কবি সুভাষ মুখোপাধ্যায়ের ‘ঘোষণা’ কবিতার কয়েকটি পংক্তির সমস্বরে স্বাধীন সার্বভৌম বাঙালি জাতি-রাষ্ট্রের সকল জনগণ উচ্চারণ করতে চাই – ‘এ দেশ আমার গর্ব,/ এ মাটি আমার কাছে সোনা।/এখানে মুক্তির লক্ষ্যে হয় মুকুলিত/আমার সহস্র সাধ, সহস্র বাসনা।… এদেশ আমার গর্ব/এ-মাটি আমার চোখে সোনা।/আমি করি তারি জন্মবৃত্তান্ত ঘোষণা।’ বঙ্গবন্ধুর নেতৃত্বে দীর্ঘ স্বাধীনতা সংগ্রাম ও মহান মুক্তিযুদ্ধে ঐক্যবদ্ধভাবে যেভাবে অংশগ্রহণ করে লালসবুজের পতাকা উড্ডীন করেছি, একইভাবে সময়ের পরিক্রমায় করোনাযুদ্ধেও আমরা জয়ী হব এবং নবতর বিজয়বৃত্তান্ত ঘোষণা করব ইনশাআল্লাহ।
সীমিত সম্পদের যথার্থ ব্যবহার নিশ্চিত করে করোনা প্রতিরোধে সরকারি-বেসরকারি পর্যায়ে গৃহীত নানা উদ্যোগ অবশ্যই প্রশংসার দাবি রাখে। দুঃখজনক হলেও সত্য, মানবিকতা-মনুষ্যত্ব-নৈতিকতা ও আদর্শের পরিচায়ক হিসেবে স্বীয় অবস্থানকে বর্ণালী করার পরিবর্তে কতিপয় নরপশুর নিষ্ঠুর ও নির্মম অর্থলিপ্সু আচরণ স্বাস্থ্যসেবার প্রয়োজনীয় সুবিধা, সরঞ্জাম ও আনুষঙ্গিক অন্যান্য দ্রবাদির সরবরাহ, ক্রয়-বিক্রয়ে সিন্ডিকেট দুর্বৃত্তায়নের পরিগ্রহ কৃত্রিম সঙ্কট সৃষ্টির অপচেষ্টা অব্যাহত রেখেছে। ত্রাণ নৈরাজ্য বা সার্বিক সমন্বয়হীনতার প্রাতিষ্ঠানিক বিষয়সমূহ অনেকটা সঙ্কুচিত হলেও প্রান্তিক পর্যায় থেকে সর্বক্ষেত্রে অস্বাভাবিক দ্রব্যমূল্য বৃদ্ধি করে অনৈতিক ও অবৈধ উপার্জনের পথ কোনভাবেই রুদ্ধ করা যাচ্ছে না।
দৈনিক আজাদীর মত নিবেদিত কিছু গণমাধ্যম শুরু থেকেই করোনা প্রতিরোধে সার্বিক স্বাস্থ্য সুরক্ষা, সামাজিক দূরত্ব, স্বাস্থ্যবিধি ও নির্দেশনা মেনে চলার ইতিবাচক প্রচার-প্রচারণার মাধ্যমে অনিবার্য সচেতনতা ও সতর্কতার বিষয়ে একনিষ্ঠভাবে তাদের কার্যক্রমকে এগিয়ে নিয়ে যাচ্ছে। অন্যদিকে কিছু সংখ্যক কথিত সামাজিক যোগাযোগ বা অনলাইনভিত্তিক মাধ্যমের গুজব রটনা জনগণের মাঝে এক অজানা আতঙ্ক সৃষ্টির অপপ্রয়াস চলমান রয়েছে। বিগত রমজান মাস ও ঈদ উপলক্ষে কিছু কিছু সংস্থার অপরিপক্ক ও অদূরদর্শী কর্মকৌশলের নিদারুণ সমন্বয়হীনতায় নগর-শহর-গ্রাম এবং প্রত্যন্ত অঞ্চলেও জনসমাগম এবং স্থানান্তর প্রক্রিয়ায় সংক্রমণ বিস্তারে মারাত্মক আকার ধারণ করেছে। করোনা প্রতিরোধে আক্রান্ত ও প্রাণসংহারের নেতিবাচক হারকে করেছে দ্রুততর অদমনীয়।
ইতিমধ্যে অঞ্চলভিত্তিক রেডজোন বা লকডাউনের ব্যবস্থা অবশ্যই সাহসী ও সময়োপযোগী পদক্ষেপ। কিন্তু লকডাউন অঞ্চলের যেসব দৃশ্য ইলেকট্রনিক মিডিয়ায় প্রকাশ পেয়েছে তা মোটেও সন্তোষজনক নয়। এখানেও সমন্বয়হীনতার বিষয়টি পরিলক্ষিত হয়েছে। অতিসম্প্রতি প্রায় আটাত্তর হাজার মানুষের ঘনবসতিপূর্ণ এলাকা চট্টগ্রাম নগরীর উত্তর কাট্টলী ওয়ার্ডের দৃষ্টান্ত ব্যাখ্যা করা যেতে পারে। প্রচুর সংখ্যক গার্মেন্টস ও অন্যান্য ক্ষুদ্র শিল্প প্রতিষ্ঠানের কারণে এখানে শ্রমজীবী মানুষের আবাসন-আধিক্য স্থানীয় লোকের সংখ্যার তুলনায় অনেক বেশি। দেশের বিভিন্ন প্রত্যন্ত অঞ্চল থেকে জীবিকার সন্ধানে এসব কর্মক্ষম মহিলা-পুরুষ-তরুণ-প্রৌঢ় নির্বিশেষে শ্রমজীবীরা কর্মস্থলের কাছাকাছি বসবাস করার আগ্রহ এই অঞ্চলকে করোনা সংক্রমণের ঝুঁকিপূর্ণ অঞ্চলে পরিণত করেছে। পাশাপাশি রয়েছে সাগরিকা শিল্পাঞ্চল যেখানে রয়েছে আরো অধিক সংখ্যক গার্মেন্টস ও শিল্পকর্মী । সাথে রয়েছে পরিবহন ও ক্ষুদ্র মাঝারি শিল্প, নির্মাণ বা অন্যান্য খাতে নিয়োজিত দিনমজুর।
উল্লেখিত কারণে লকডাউনের মধ্যেও আইন শৃংখলা বাহিনী বিশেষ করে পুলিশ ও সেনা সদস্যদের নজরদারি থাকা সত্ত্বেও জীবিকা অর্জন, অর্থ উপার্জন ও চাকরি হারানোর ভয়ে কোন না কোনভাবে গ্রাম অঞ্চলে বিভিন্ন অলি-গলি বা চলাচল পথে এসব জনগোষ্ঠীর একস্থান থেকে অন্য স্থানে গমন বা প্রত্যাবর্তন রোধ করে কার্যকর লকডাউন খুবই দূরূহ ব্যাপার। দীর্ঘ একুশ দিনের সময়কালকে কমিয়ে বিশাল জনগোষ্ঠীর এসব অঞ্চলগুলোকে আরো ছোট পরিসরে বিভাজিত করে লকডাউনের ব্যবস্থা করা হলে এই কার্যক্রমকে অধিকতর সহনীয় ও গ্রহণীয় করা যেত। একই ওয়ার্ডকে গার্মেন্টস বা শিল্পাঞ্চল ও আবাসিকসহ অন্যান্য বিষয় বিবেচনায় তিন চারটি জোনে ভাগ করে ক্রমান্বয়ে লকডাউনের ব্যবস্থা অনেক বেশি মনোময় হতো।
অধিকন্তু সংক্রমিত ব্যক্তি বা উপসর্গ নিয়ে শনাক্তকরণের জন্য আগ্রহীর সংখ্যা বেশি হওয়ার কারণে লকডাউনের কার্যকারিতায় অনেকক্ষেত্রে শিথিল মনোভাব পোষণ করতে হচ্ছে। লকডাউনের ন্যূনতম ৭-১০ দিন আগে স্থানীয় জনপ্রতিনিধি, এলাকাভিত্তিক গণ্যমান্য ব্যক্তি বা সুধীমহল, তরুণসমাজসহ সিটি কর্পোরেশনের পক্ষ থেকে অন্যান্য সংস্থার সাথে সমন্বয় সভা করে সকলের সম্পৃক্ততায় লকডাউন বাস্তবায়ন দৃশ্যমান করা যেত। সময়কালকে আরো কমিয়ে এনে যাতে জীবন-জীবিকার সংঘাত দুর্বিষহ পর্যায়ে না পৌঁছে, ঘরবন্দী মানুষদের দীর্ঘ সময় ঘরবন্দী না রেখে শারীরিক মানসিক প্রশান্তি ও প্রাণশক্তি-মনোবল বৃদ্ধির সহায়তাকল্পে স্থানীয় দীঘি, পুকুর, খেলার মাঠসমূহে স্বাস্থবিধি নির্দেশনা মেনে সামাজিক দূরত্ব বজায় রেখে নির্মল বায়ু সেবনের ব্যবস্থা রাখা গেলে লকডাউন পূর্ণতা পেত।
অসংখ্য বস্তিতে ভরা এসব অঞ্চলে ছোট্ট একটি ঘরে আনুমানিক ৫-৭ জনের বসবাস কোনভাবেই স্বাস্থ্য সুরক্ষার সুষ্ঠু পরিবেশ নিশ্চিতে সহায়ক হতে পারে না। একটি প্রায়োগিক পরিকল্পনা অর্থাৎ অতীব জরুরি, মধ্য ও দীর্ঘ মেয়াদী কর্মকৌশল এবং জীবন-জীবিকার সমন্বয় সাধন না করে এই ধরনের লকডাউনের অত্যধিক প্রয়োজনীয়তা থাকা সত্ত্বেও সফলতা অর্জনে কতটুকু ফলপ্রসূ হবে, তার একটি বস্তুনিষ্ঠ নিরীক্ষণ প্রয়োজন। এলাকাভিত্তিক করোনা টেস্টের জন্য শুধু নমুনা সংগ্রহ নয়, অধিকতর কম সময়ে দ্রুততার সাথে প্রায় সরকারি-বেসরকারি উদ্যোগে টেস্টের ফলাফল প্রদান সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ হয়ে দাঁড়িয়েছে। করোনা টেস্টের ফলাফল ব্যতিরেকে হাসপাতালে করোনা ছাড়াও অন্যান্য নানাবিধ রোগে চরম দুর্ভোগে পতিত হচ্ছে প্রতিনিয়ত অসংখ্য নারী-শিশু-পুরুষ-তরুণ-বৃদ্ধ।
এসব বিষয়গুলোকে যথাযথ বিবেচনায় না এনে এবং বিভিন্ন সংস্থার সমন্বয়কে বিশেষ করে করোনা টেস্টের ফলাফল জ্ঞাত হওয়ার লক্ষ্যে টেস্টের সুবিধাগুলোকে অনেক বেশি জোরদার করার জন্য মনোযোগী হতে হবে। সামাজিক ম্যাপিং তৈরি করে আর্থ-সামাজিক চালচিত্রের সমূহ পর্যালোচনাভিত্তিক পরিকল্পনা গ্রহণে ব্যত্যয় ঘটলে মনুষ্যত্ব ও মানবতার নবতর অনুসন্ধানে চট্টগ্রাম তথা বাংলাদেশ পিছিয়ে থাকবে। ভোগবাদি সাম্প্রতিক বিশ্বায়ন আধুনিক মানবিক সমাজ সভ্যতার প্রাগ্রসরতার মূলে যে কুঠারাঘাত হেনেছে, বিরোধ-বিচ্ছেদ-বিভাজন-বৈষম্যের দেয়াল নির্মাণ করে মানবিকতাকে হত্যা করছে, বাংলাদেশসহ আক্রান্ত করোনাবিশ্বের উপলব্ধিতে বিশ্ববাসী সত্যাপণ্য মূল্যবোধ আবিষ্কারে অধিকতর সতৃষ্ণ না হলে মানবসভ্যতার প্রগতি ও জ্ঞাননির্ভর মানবিক অগ্রযাত্রা বাধাগ্রস্ত হবে – নি:সন্দেহে তা বলা যায়। পরিশেষে প্রার্থিত আবেদনটুকু হচ্ছে এই – রেডজোন ও লকডাউনের অপরিহার্যতা যথার্থ উপলব্ধিতে এনে করোনা বিস্তার প্রতিরোধে সকল জনগোষ্ঠী স্ব স্ব অবস্থান থেকে সক্রিয় ভূমিকা পালন করে এর সফলতাকে কালোচিত করে তুলবে।

লেখক: শিক্ষাবিদ, সমাজবিজ্ঞানী; সাবেক উপাচার্য, চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়

সৌজন‌্যে- দৈনিক আজাদী

Print Friendly, PDF & Email

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here