ডা. অধীর বড়ুয়া

গ্রাম ডাক্তার ও পল্লীচিকিৎসকদের ভূমিকা ইতিহাসলব্দ,করোনায় তাঁরা আবারো প্রজ্বলিত!
শুনেছিলাম দেশে ১৯৪২/৪৩ এর সমকালীন দুর্ভিক্ষের অচলাবস্থা, ১৯৬০ এর সমকালীন প্রবলবন্যায় দেশে সৃষ্ট ডায়রিয়া-কলেরা সংক্রামক ব্যাধির আক্রমণ, ১৯৭১ এর মহান মুক্তিযুদ্ধের যুদ্ধ বিধস্তের প্রাক্কালে, ১৯৯১ এর প্রলয়ংকরী ঘূর্ণিঝড় ও বন্যায় সংক্রামক ব্যাধির আত্মসামাজিক এবং গ্রামীণ চিকিৎসা ব্যবস্থায় গ্রাম ডাক্তার বা পল্লীচিকিৎসকদের ভূমিকার কথা তৃণমূল ও বিবেকবান জনগোষ্টী আদৌ ভুলেছে কিনা আমার জানা নেই।
ঐ সমস্ত দূর্যোগপূর্ণ প্রেক্ষাপটে দেশের আত্মসামাজিক ও অর্থনৈতিক অবস্থা কি রকম ছিল তা তৎসময়ে যাঁরা বিশ্লেষক ছিলেন তাঁরাই ভাল বলতে পারেন। এরিই বিচার বিশ্লেষণের প্রেক্ষাপটে দেশের আপামর জনগোষ্ঠীর অর্থনৈতিক অবস্থাও কোন কারণে স্বচ্ছলতা ছিলনা। থাকলেও আজকের দিনে যাঁরা উচ্চতর শিক্ষায় শিক্ষিত হয়ে বড় বড় চিকিৎসক রয়েছেন ঐ সমস্ত শ্রদ্ধার্ঘদের হয়তো তখন জম্ম হয়নি, জম্ম হলেও অতটুকুতে পৌঁছা সম্ভব হয়নি। সুতরাং তখন গ্রাম ডাক্তার তথা পল্লী চিকিৎসকদের ভূমিকাই ছিল চিকিৎসাসেবা গ্রহণকারীদের নিকট শেষ ভরসা।
শুধু তাই নয়, তৎপরবর্তী সময়ে এ স্বাধীন সার্বভৌম রাষ্ট্রে সাধারণ জনগণের নাগরিক অধিকার চিকিৎসা ব্যবস্থার সিংহভাগ এ গ্রাম ডাক্তার বা পল্লী চিকিৎসকদের হাতেই ছিল তা কেউ সরাসরি অস্বীকার করতে পারবেনা।
গ্রাম ডাক্তার বা পল্লী চিকিৎসকদের একটাই দোষ তারা বড় বড় মেডিকেল শিক্ষালয়ে বড় বড় বই পড়তে সক্ষম হয়নি,তাদের বড় বড় সনদ নেই। নেই ঠিক আছে, কিন্তু ছোট- খাট অর্জন, প্রচেষ্টা, ত্যাগ কখনো কমছিল না।
তাদেরও সীমাবদ্ধ ছিল, থাকাটাও প্রয়োজন। আবার তাদেরকে ব্যাপক প্রশিক্ষণের আওতায় এনে এসেবার মানকে আরো ত্বরান্বিত করাও নীতি- নির্ধারক মন্ডলীদের নীতিমালায় রাখা দরকার ছিল। তা না করে কারো নিত্যান্ত নিজস্ব চাহিদাপত্রকে কাজে লাগানোর জন্য হঠাৎ গত কয়েক বছর আগে গ্রাম ডাক্তার বা পল্লী চিকিৎসকদের জন্য একটি তথাকথিত কালো আইন তৈরী করে তাদের উপর কামান দামানোর ব্যবস্থা সৃষ্টি করেন।
যাঁরা এ কালো আইনের পক্ষে ছিলেন তাদের উচিতও ছিল এ সমস্ত গ্রাম ডাক্তার বা পল্লী চিকিৎসকদের একটি পর্যায়ে নিয়ে আসার ব্যবস্থা গ্রহণ করার।
শুনেছি যাঁরা বড় হয়, তাঁরা গাদাও হয় এবং ভরও হয়। কিন্তু তাদের নিকট এ ভরত্ব প্রতীয়মান হয়নি।
এক সময় শুনেছিলাম শুধু বাংলাদেশ নয় বিশ্বের অনেক দেশে উচ্চতর ডাক্তারদের মাঝেও রুরাল মেডিকেল প্রাকটিশনারদের ভূমিকা এবং সংগঠন ছিল। আমি ব্যক্তিগতভাবেও ওয়াল্ড রুরাল মেডিকেল এসোসিয়েশন( জেনেভা, সুইজারল্যান্ড ঠিকানা) নামের একটি সংগঠনের নাম শুনেছি এবং তৎকার্যক্রম দেখেছি।
যদি গ্রাম ডাক্তার বা পল্লী চিকিৎসকরা এতই পাপী হতো তাহলে এ সংগঠনটিরও কি প্রয়োজন ছিল।
এখন বাংলাদেশে জম্মজাত জনপ্রিয় দু’য়েক জন চিকিৎসাবিদদের সাথে জীবিত থাকা অবস্থায় সরাসরি আলাপ চারিতার কথা তুলে ধরি—-
ক’ দিন পূর্বে আমাদের থেকে হারিয়ে যাওয়া সর্বজন শ্রদ্ধেয় জাতীয় অধ্যাপক ডাঃ নুরুল ইসলাম বলেছিলেন তাঁকে তাঁর মাতৃজঠর হতে ডেলিভারী করেছিলেন চন্দনাইশের বাদামতল এলাকার এক গ্রাম্য চিকিৎসক। শুধু ডেলিভারি করে এ মায়াময় পৃথিবীর আলো দেখাতে সাহায্যে করেননি এ তাঁর শিশুকালে চিকিৎসা সেবাও দিয়েছিলেন তিনি।
তাই জাতীয় অধ্যাপক ডাঃ নুরুল ইসলাম মৃত্যুর কমপক্ষে ১০ বৎসরাধিক পূর্বে গ্রাম ডাক্তারদের ভূমিকা ও তাঁর জম্মকথা শিরোনামে একটি বিশালাকৃতির বই লিখেছিলেন। বইটি খুঁজলেই এখন অনেকের নিকট পাওয়া যাবে। যা কালের স্বাক্ষী হয়ে রয়েছে।
তিনি যতদিন জাতীয় অধ্যাপক ছিলেন ততদিন নয় তাঁর জীবনে গ্রাম ডাক্তারদের একটা দখলত্ব ছিলো।

চট্টগ্রাম মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের সাবেক কমিউনিটি মেডিসিন বিভাগের বিভাগীয় প্রধান প্রফেসর ডাঃ সুলতানুল আলম এসটিডির একটি সেমিনারে বলেছিলেন তিনি জম্মগ্রহণ করেছিলেন সীতাকুণ্ডের গ্রাম্য চিকিৎসক কালু ডাক্তারের হাতে। শুধু জম্ম নয় তাঁর মা-বাবার পরিবারে তিনি সহ সবাইকে কালু ডাক্তার( তিনি ডাকতেন কালু কাকা) চিকিৎসা করতেন।
চট্টগ্রামের সুপরিচিত প্যাথলজিষ্ট যথাক্রমে মুক্তিযোদ্ধা- লেখক ডাঃ মাহফুজুর রহমান আজীবন গ্রাম ডাক্তার বা পল্লী চিকিৎসকদের আন্দোলনের সাথে জড়িত থেকে তাদের স্বাধীনতা সংগ্রামসহ এদেশে বিভিন্ন ক্রান্তিকালে তাদের ভূমিকার কথা প্রায়শঃ কথায় ও লেখায় তুলে ধরতেন।
এছাড়াও দেশে- বিদেশে বিভিন্নভাবে প্রতিষ্টিত অনেক বরেণ্য ব্যক্তি, মন্ত্রী, এমপি, সচিব ও উচ্চ পদস্থ কর্মকর্তা যে এ গ্রাম ডাক্তার বা পল্লী চিকিৎসকদের হাতে জম্ম গ্রহণ করেননি তা বলতে পারবেন না। আবার হয়তো খোঁজ নিলে জানা যাবে ঐ গ্রাম ডাক্তার বা পল্লী চিকিৎসকের পরিবারের বা তাঁর ঘামের টাকার নির্যাস নিয়ে বা তাঁর ঔরষে জম্ম গ্রহণ করে অনেকেই বড় মাপের বিচারক আজকের গ্রাম ডাক্তার বা পল্লী চিকিৎসকদের বিরুদ্ধে সৃষ্ট কালো আইনের
ফাঁসির রায় দেবেন সে রকম ব্যক্তিও রয়েছেন।
ইতিহাস পর্যালোচনায় করলে আপনার সমাজ, আপনার পারিবারিক ঐতিহ্যে গ্রাম ডাক্তার বা পল্লী চিকিৎসকদের গৌরবগাঁথা ইতিহাস উঠে আসবে। হয়তো আপনি বড় পদস্থ হওয়ায় সরাসরি গ্রাম ডাক্তার বা পল্লী চিকিৎসক আপনার দাদা ছিলেন বা বাবা ছিলেন বা শ্বশুর ছিলেন বা অন্য কোন প্রবল শ্রদ্ধেয় ব্যক্তি ছিলেন এ কথা লিখতে পারবেন না, হয়তো পারবেন আমার অমুখ ডাক্তার ছিলেন। তখন হয়তো ইতিহাস বিবর্জিত হবে না, হবে নিজের অর্জিত।
২০২০ সালের অনেকটা প্রথমার্ধে পুরোবিশ্ব করোনা ভাইরাসের থাবায় বিপন্ন। এ থাবা আমাদের দেশেও আঘাত হানা শুরু করেছে। শুরুর প্রাক্কালে দেশের প্রতিটি প্রত্যন্ত অঞ্চলে ছিটিয়ে – ছড়িয়ে থাকা নিদিষ্ট সময়ে চেম্বারে বসে শ্রদ্ধেয় উচ্চতর সনদধারী ডাক্তাররা উচ্চ মাপের ফি নিয়ে গ্রামের খেটে খাওয়া পরিবারের রোগীদের চিকিৎসা সেবা দিতেন তাঁরা চেম্বারে না এসে নিজেকে সেইভ হোম কোয়ারান্টাইনে রেখেছেন, তাঁদের রোগী গুলো দিশেহারা হয়ে উচ্চতর ডিগ্রী সম্পন্ন বড় ডাক্তারদের একাংশের রোষানলে পড়ে বিধস্ত হওয়া গ্রাম ডাক্তার বা পল্লী চিকিৎসকদের খুঁজে নিচ্ছে তাদের রোগীরা।
আবারো প্রমানিত হতে চললো, গ্রামডাক্তার বা পল্লীচিকিৎসকরা ছিলো, আছে – থাকবেন।
গ্রামের সিংহভাগ মানুষ এখনো যদি শতকরা হিসেব কষা হয় দেখবেন গ্রাম ডাক্তার বা পল্লী চিকিৎসকদের হাতে প্রাথমিক চিকিৎসা সেবা নিচ্ছেন। এতে দেশের তৃণমূল মানুষের চিকিৎসা ব্যবস্থাও এগিয়ে রয়েছে বলে বিশ্বাস করি।
গ্রামের বিশ্বস্ত বা সুখ- দুঃখের মানুষ হিসেবে গ্রামডাক্তার বা পল্লীচিকিৎসকদের হাতে রোগী আসলে তাঁরা প্রাথমিক চিকিৎসা দিয়ে আরো ভাল চিকিৎসার জন্য পার্শ্ববর্তী সরকারী হাসপাতাল বা উচ্চতর চিকিৎসকদের নিকট রেফার করেন, তারপরও শতাংশ হিসেবে কয়েকটি রোগী গ্রামডাক্তার বা পল্লীচিকিৎসকদের হাতে অনেক সময় ভুল চিকিৎসার শিকার হয় যা অবাস্তব নয়।
অপরদিকে তুলনামূলক ভাবে উচ্চতর চিকিৎসক বা বড় হাসপাতালেও এ সমস্যা হয়ে থাকেনা তাও বলা মুশকিল।

আরেকটি কথা মনে পড়ে গেল- যখন প্রাথমিক ও মাধ্যমিকে পড়ছি তখন ব্যাকরন বা রচনা বইয়ে ‘ গ্রাম ডাক্তার ‘ রচনা পড়েছিলাম। সেখানে লেখা ছিল গ্রাম ডাক্তাররা সমাজের গণ্যমান্য ব্যক্তি বা গ্রামীণ বুদ্ধিজীবী সে হিসেবে তাঁদের অনস্বীকার্য ভূমিকার কথা ঐ রচনা সমূহে লিপিবদ্ধ ছিল। তখন অন্য কোন উচ্চতর ডিগ্রী সম্পন্ন পেশার কাহিনীতে রচনা তেমন ছিলনা। হয়তো ” গ্রাম ডাক্তার ‘ রচনা পড়ে পরীক্ষায় নম্বর পেয়ে পরে উচ্চতর শিক্ষা লাভ করে অন্য পেশার কাহিনীতে জড়িত হয়েছেন।

এরচনা পড়ে আমিও ৯০ দশকের পর বিভিন্ন প্রশিক্ষণ ও শিক্ষা তথা হাতে কলমে নিয়ে এমহান পেশায় জড়িত হয়েছিলাম। তৎপরবর্তী বিভিন্ন এলাকায় আমার নাম-যশও ছড়িয়ে পড়েছিল এবং অনেক ধনী- গরীব আমার হাতে চিকিৎসা সেবাও পেয়ে উপকৃত হয়েছে।
তখন একাজে আমার পরিধিও বিস্তৃত ছিল, সেবার মানও ভাল ছিল, গ্রামের দরিদ্র গোষ্টী কখনো স্বল্প টাকায় বা কখনো বিনামূল্যে দিন অবধি এসেবা পেত। এ পেশায় অগনিত মানুষের উপকার সাধন করেছি।
কিন্তু দেশে একটি এ পেশার বিরুদ্ধে কালো আইন সৃষ্টি করার পর আত্মসন্মান অটুট রাখার মানসে এ পেশা থেকে দূরত্ব বজায় রেখে স্বল্প আয়ে দিনাতিপাত করছি।
আত্মসম্মান অটুট রাখার মানসে এ মহান পেশাকে দূরে টেলে দিলেও দেশে চলমান করোনা ভাইরাস সৃষ্ট পরিস্থিতিতে উচ্চতর ডিগ্রী সম্পন্ন শ্রদ্ধাভাজন চিকিৎসকরা আমাদের আশ-পাশে করে যাওয়া চেম্বার গুলোতে রোগী না দেখার কারণে তাঁদের রোগী গুলো আবারো আমাকে খুঁজতে শুরু করেছে। তখন চিন্তা করলাম, আমরা কি এখনো আছি।
তাহলে ছিলাম, যেতে চেয়েও পারিনি, থাকতে পারবো কি?
তবে আমি ব্যক্তিগত ভাবে বিভিন্ন কাজে জড়িয়ে পড়ায় রোগী হারা হয়ে পড়েছি। এখন আমি হাওয়ায় ঘুরছি।
সব কিছু মিলে আমাদেরকে স্বীকার করতে হবে আমরা কেউ ভাল নয়, অভিশপ্তও নয়, তবে ভালো থাকার চেষ্টায় থাকছি বা কাজ করছি কি?

“গ্রাম ডাক্তার বা পল্লী চিকিৎসক ভাইবোনরা আপনাদের তো কিছুই নেই, আছে দৃঢ় মনোবল, এই মুহুর্তে এটাই কাজে লাগান”

“জাতির দূর্দিনে গ্রাম ডাক্তার বা পল্লী চিকিৎসকরা সততা- সাধ্যানুসারে ও সতর্কতার সহিত আপনারা গণ মানুষের পাশে থাকুন”

বিঃদ্রঃ
এলেখাটি কাউকে ব্যঙ্গ বা কটক্ করার মানসে নয়, বাস্তবতার আলোকে নিজ ক্ষুদ্র অনুভবের আলোকে তুলে ধরা হয়েছে।

Print Friendly, PDF & Email

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here