আব্দুল খালেক ফারুক
খোশবাগের প্রধান ফটকে একজন লোক শুয়ে আছেন মাদুর বিছিয়ে। পাশে দেখা মিলল একটি কুকুরের। ওটাও শুয়ে আছে। বেঞ্চে বসে আছেন দুজন লোক। তাঁদের পাশের সাইনবোর্ডে লেখা ‘খোশবাগ’। নবাব আলীবর্দি খাঁর তৈরি করা এই ‘খোশবাগ’-এর অর্থ হচ্ছে ‘আনন্দের বাগান’। পশ্চিমবঙ্গ সরকারের পর্যটন বিভাগের সাইনবোর্ডেও মিললো সে কথারই সমর্থন। নবাব আলীবর্দি খাঁ দিল্লির জামা মসজিদের অনুকরণে ৭ দশমিক ৬৫ একর জমির ওপর খোশবাগ বা ‘গার্ডেন অব হ্যাপিনেস’ তৈরি করেন। এটি মূলত ছিল গোলাপের বাগান। এখানে ১০৮ ধরনের গোলাপ পাওয়া যেত। বৈকালিক অবকাশ কাটানোর জন্য নবাব আলীবর্দি খাঁ এখানে আসতেন। কোনো শত্রু যেন আক্রমণ করতে না পারে, সে জন্য খোশবাগের শেষ প্রান্ত থেকে মূল ফটক পর্যন্ত দেখার ব্যবস্থা ছিল। চারপাশে রয়েছে উঁচু প্রাচীর। এই সমাধিক্ষেত্রের একেবারে পশ্চিম প্রান্তে একটি কারুকার্যময় মসজিদ রয়েছে। এখানে নামাজ পড়তেন আলিবর্দি খাঁ। ১৬ বছর নবাবি করার পর অন্তিম ইচ্ছা অনুযায়ী নাতি সিরাজ এখানে সমাহিত করেন আলীবর্দি খাঁকে। আর শেষ পর্যন্ত এটি তাঁদের পারিবারিক কবরস্থানে পরিণত হয়। তবে খোশবাগে সমাহিত ৩৪ জনের মধ্যে ৩২ জনকেই হত্যা করা হয়েছিল। ব্যতিক্রম আলিবর্দি খাঁ ও নবাব সিরাজউদ্দৌলার স্ত্রী লুত্ফুন্নেছা।
মূল ফটক পেরিয়ে ভেতরে ঢোকার পর নজরে আসে ছোট ছোট কুঠুরি। দরজা-জানালাবিহীন। ইট বাঁধানো পথ ধরে এগোতে থাকি। মূল ফটক থেকে একজন গাইড আমাদের সঙ্গী হয়েছেন। নাম তাঁর গোবর্ধন। সমাধিক্ষেত্রে ঢুকেই তাঁর বর্ণনা শুরু হয়েছে। তুমুল উত্তেজনা নিয়ে একের পর এক কবর পেরিয়ে যাচ্ছি। প্রথম কবরটি সিরাজের নানি, আলীবর্দী খানের স্ত্রী শরিফুন্নেছা বেগমের। এর পরের কবরটি তাঁরই মেয়ে ঘসেটি বেগমের। পাশে সিরাজের মা আমিনা বেগমের কবর। পলাশীর যুদ্ধের পর তাঁদের প্রথমে বন্দি করা হয়। পরে ঢাকার জিঞ্জিরার প্রাসাদে পাঠানো হয় নির্বাসনে। পরে খোশবাগে বাস করার মিথ্যা প্রতিশ্রুতি দিয়ে দুুই বোনকে মুর্শিদাবাদে নিয়ে আসছিলেন মীর জাফরের বড় ছেলে মীরন। কিন্তু পথিমধ্যে তাঁদের হত্যা করে লাশ এনে দাফন করা হয় এই খোশবাগে। তার আগেই অবশ্য লর্ড ক্লাইভের নির্দেশে সিরাজের স্ত্রী লুত্ফুন্নেছাকে মুর্শিদাবাদে এনে খোশবাগে রাখা হয়।
এই কবরটির কিছু দূরে সিরাজের সমাধিস্থলে ঢোকার আগেই বাম দিকে চোখে পড়ল দানশা ফকিরের কবর। খোলা আকাশের নিচে পড়ে আছেন এই কুখ্যাত বিশ্বাসঘাতক। এই দানশা ফকিরই এক হাজার এক স্বর্ণমুদ্রার লোভে রাজমহলঘাটে সিরাজকে ধরিয়ে দিয়েছিলেন। কথিত আছে, সেই পুরস্কার আনতে গিয়ে তাঁর করুণ পরিণতি হয়। তাঁকে গুলি করে হত্যা করেন ক্লাইভ। বলেন, ‘সামান্য কটা টাকার লোভে তোমার নবাবকে ধরিয়ে দিয়েছ। এর চেয়ে বেশি টাকা পেলে তো আমার সঙ্গেও বিশ্বাসঘাতকতা করবে। অতএব, তোমাকে বাঁচিয়ে রাখা যায় না।’ তাঁকে হত্যার পর তাঁর স্ত্রী-সন্তানদেরও হত্যা করা হয়।
এরপর সেই কাঙ্ক্ষিত কবরটির সামনে এসে দাঁড়াই। গাইড গোবর্ধন যখন নবাব সিরাজউদ্দৌলার নাম উচ্চারণ করেন, সঙ্গে সঙ্গেই কবরটির দিকে সবার দৃষ্টি চলে যায়। শিয়রের দিকে মার্বেল পাথরে খোদাই করা সিরাজের পুরো নাম ‘মির্জা আলী মোহাম্মদ সিরাজউদ্দৌলা’। তাঁর কবরের পূর্ব পাশে ছোট ভাই মির্জা মেহেদির কবর। মীরনের দোসররা তাঁকে তক্তাচাপা দিয়ে হত্যা করেছিল। আর পশ্চিমে সিরাজের প্রিয় নানা আলীবর্দী খানের সমাধি। সিরাজের কবরের পাশে দাঁড়ালেই যেকোনো বাঙালি আবেগে আপ্লুত হয়ে পড়েন। ১৭৫৭ সালের ২৩ জুন পলাশির যুদ্ধে পরাজয়ের পর আরো সৈন্য সংগ্রহের জন্য পাটনার দিকে যাওয়ার সময় রাজমহলে নদীর ঘাটে ধরা পড়েন সিরাজ। এরপর তাঁকে বন্দি করে রাখা হয় জাফরগঞ্জ প্রাসাদে। বন্দি অবস্থায় মীরজাফরের পুত্র মীরনের হুকুমে মোহাম্মদি বেগ প্রথমে তাঁকে ছুরিকাঘাতে হত্যা করেন। পরে সিরাজের মৃতদেহটি টুকরো টুকরো করে বস্তাবন্দি করে ঘোড়ার পিঠে চাপিয়ে পুরো মুর্শিদাবাদ শহর প্রদক্ষিণ করান মীরন।
সিরাজের পায়ের কাছে তাঁর প্রিয়তমা স্ত্রী লুত্ফুন্নেছার কবর। নিজের শেষ দিন পর্যন্ত এই সমাধিক্ষেত্রের দেখাশোনা করেছেন তিনি। আর তাঁর পাশেই রয়েছে সিরাজের একমাত্র মেয়ে উম্মে জোহরা। এই সমাধি সারির সর্বশেষে রয়েছে পূর্ণিয়ার নবাব শওকত জং ও তাঁর পরিবারের কবরগুলো। সিরাজের সমাধিটি একটি ঘরের ভেতর। চৌকাকৃতির একটি সমতল ছাদের ঘর। সেটির বাইরে বের হতেই চোখে পড়ল সারি সারি কয়েকটি কবর। এরা ইতিহাসের মহা ট্র্যাজেডির অংশ হয়েছিলেন। সিরাজের মৃত্যুর খবর পেয়ে ঢাকা, মুঙ্গের ও পাটনা থেকে তাঁর ১৭ জন আত্মীয় ও শুভাকাঙ্ক্ষী এসেছিলেন তাঁর কবর জিয়ারত করতে। কিন্তু কুচক্রী মীরন তাঁদের খাবারের সঙ্গে বিষ মিশিয়ে হত্যা করেন। পরে এখানে সেই মৃতদেহগুলো সমাহিত করা হয়। এত অঘটন আর বিশ্বাসঘাতকতার জন্য ইতিহাসে কুখ্যাত মীরনের পরিণতিও কিন্তু শুভ হয়নি। বজ্রাঘাতে মৃত্যু হয় তার।
এত সব ট্র্যাজেডি ইতিহাসের খানিকটা চাক্ষুষ সাক্ষী হতে পেরে আবেগ সংবরণ করা কঠিন হয়ে গেল। সেই মানুষগুলোর আত্মার শান্তি কামনা করে খোশবাগ থেকে বিদায় নিলাম। ছবি : লেখক
কিভাবে যাবেন
কলকাতা থেকে মুর্শিদাবাদের বহরমপুর ২০০ কিলোমিটার পথ। বাস ছাড়াও বেশ কয়েকটি ট্রেন রয়েছে। ট্রেন ভাড়া নন-এসি ২০০ রুপি আর এসি ৫০০-৮০০ রুপি। বহরমপুর স্টেশন থেকে ঘোড়ার গাড়িতে চেপে মুর্শিদাবাদের বিভিন্ন ঐতিহাসিক স্থাপনা ঘুরে বেড়ানোর সুযোগ রয়েছে। ভাগীরথী নদী পারাপারের জন্য আছে ফেরি, নৌকা ও ট্রলার।