জালালউদ্দিন সাগর:
শব্দের সাথে বসবাস তাঁর। বেড়ে ওঠা, সংসার। মানুষের ভেতরের মানুষটাও খুঁজে আনেন শব্দের গাথুঁনীতে। হোক সে কবিতায়, প্রবন্ধে কিংবা আত্মশুদ্ধির আলোচনা।
অরুণ দাশগুপ্ত। প্রাবন্ধিক, সম্পাদক এবং কবি। শব্দ ও বোধ যোজনের ক্ষেত্রে সম্পূর্ণ ভিন্ন একজন মানুষ তিনি। তাঁর কবিতার প্রতিটি পরতে থাকে মানবিক আকুলতা। থাকে স্বপ্ন ছোঁয়ার ব্যাপ্তি। অরুণ দাশগুপ্ত জন্মেছেন চট্টগ্রামের পটিয়ার ধলঘাটে। ১৯৩৬ সালে। বাবা অবিনাশ চন্দ্র দাশগুপ্ত এবং বা হেমপ্রভা দাশগপ্ত। ৮২ বছরে এসেও সংসারী হন নি তিনি। বিয়ে করেন নি কেন জানতে চাইলে তিনি বলেন, কবিতার সাথে প্রণয় আমার। বিয়ে করার সময় পেলাম কই।
কত সালে লেখার হাতেখড়ি জিজ্ঞেস করলে স্কুল বালকের মতো মাথার চুল হাতরান অনেকক্ষণ। বলেন, মনে পড়ছে না। তার পর আবারও চুলে হাত। স্কুলে যখন পড়ি তখন থেকেই কবিতা আর প্রবন্ধ, গল্প লেখা শুরু হয় কলেজ উঠার পর। লেখক হিসেবে লিটল ম্যাগাজিনেই প্রথম নাম ছাপা হয় আমার। বলেন, অরুণ দাশগুপ্ত।
পটিয়ার ধলঘাটে পাঠশালার হাতেখড়ি অরুণ দাশ গুপ্ত’র। তারপর চলে যান কলকাতায়। সেখানের কালাধন ইনস্টিটিউশন, সাউদার্ন থেকে মাধ্যমিক এবং স্কটিশচার্চ কলেজ কলকাতা থেকে উচ্চ মাধ্যমিক। তার পর বিশ^ভারতী লোক শিক্ষা সংসদ। কলকাতার দৈনিক লোকসেবক পত্রিকার মধ্য দিয়ে সাংবাদিকতার জীবন শুরু তাঁর। এর পর চলে আসেন দেশে। স্বাধীনতার পর মাহবুবউল আলম চৌধুরী সম্পাদিত দৈনিক স্বাধীনতা পত্রিকায় সহ সম্পাদক হিসেবে যোগ দেন। ১৯৭৩ সালে স্বাধীন বাংলাদেশের প্রথম পত্রিকা দৈনিক আজাদীতে যুক্ত হন সহ সম্পাদক পদে। বর্তমানে সহযোগী সম্পাদক।
অরুণ দাশগুপ্তের উল্লেখযোগ্য দুটি গ্রন্থ হলো, বিশ্লেষণধর্মী গ্রন্থ ‘রবীন্দ্রনাথের ঋতুর গান ও অন্যান্য’ এবং যুগপথিক কবি ‘নবীন চন্দ্র সেন’র জীবন পরিচয় কবিতার ও গদ্যগ্রন্থের আলোচনা ভিত্তিক গ্রন্থ। তাঁর সম্পাদিত লিটল ম্যাগাজিন ‘আপাতত’ প্রথাবিরোধী সাহিত্য আন্দোলনে অন্যবদ্য ভূমিকা রেখেছিলো।
অরুণ দাশগুপ্তের লেখা ‘রবীন্দ্রনাথের ঋতুর গান ও অন্যান্য’ গ্রন্থটি কবি সার্বভৌম রবীন্দ্রনাথের বিচিত্রমুখী স্রষ্টা-জীবনের একটি অন্যন্যসাধারণ দিককে তুলে ধরেছে; সেটি হলো তাঁর সঙ্গীত-সৃষ্টি। চট্টগ্রাম সিটি কর্পোরেশনসহ বিভিন্ন সংস্থা থেকে বেশ কিছু সম্মাননা পেলেও জাতীয় রবীন্দ্রসংঙ্গীত শিল্পী সংস্থা থেকে পাওয়া সম্মাননার কথা বিশেষভাবে উল্লেখ করেন তিনি।
জীবন সায়াহ্নে কবি অরুণ দাশগুপ্ত
চিরকুমার কবি অরুণ দাশগুপ্ত জীবন সায়াহ্নে এসে এখন অসুস্থ অবস্থায় পটিয়ার ধলঘাট গ্রামের বাড়িতে দিন কাটাচ্ছেন।
নব্বই ছুঁইছুঁই এই সাংবাদিক দৈনিক আজাদীর প্রয়াত সম্পাদক অধ্যাপক মোহাম্মদ খালেদের হাত ধরে ১৯৭৩ সালে যোগ দেন দৈনিক আজাদীতে।
ছিলেন সিনিয়র সহকারী সম্পাদক ও সাহিত্য সম্পাদক। পত্রিকাটির সাহিত্য পাতা প্রকাশিত হয়েছে তাঁর নিবিড় তত্ত্বাবধানে।
১৯৩৬ সালের ১ জানুয়ারি ধলঘাট গ্রামে জমিদার যশোদা নন্দন ওয়াদ্দেদার (দাশগুপ্ত) এর পুত্র অবিনাশ ওয়াদ্দেদারের ঔরসে জন্ম অরুণ দাশগুপ্ত’র। কবিতা, চিত্রকলা, ছোটগল্প, সঙ্গীত ক্ষেত্রে তাঁর অবাধ বিচরণ। পেয়েছেন অনেক পুরস্কার। অরুণ দাশগুপ্ত রচিত ও প্রকাশিত গ্রন্থাবলী ‘রবীন্দ্রনাথের ছয় ঋতুর গান ও অন্যান্য’, ‘নবীনচন্দ্র সেন’, ‘কবিতা চিন্তা ও অন্যান্য প্রবন্ধ’, কবিতার বই ‘খাণ্ডবদাহন’।
ধলঘাট স্কুলে প্রাথমিক শিক্ষা শেষে তাঁকে পাঠিয়ে দেওয়া হয় কলকাতায়। সেখানে মাধ্যমিক, উচ্চ মাধ্যমিক ও বিশ্ববিদ্যালয় জীবন শেষ করেন তিনি। দেশমাতৃকার টানে ফিরে আসেন চট্টগ্রামে। ততদিনে জমিদারি প্রথা বিলুপ্তির পথে। হাতছাড়া হয়ে গেছে বিপুল সম্পদ। এসময় মিরসরাইয়ের এক গ্রামে প্রতিষ্ঠিত উচ্চ বিদ্যালয়ে তিনি নিলেন শিক্ষকতার চাকরি। এরপর ফটিকছড়ির নারায়ণহাট স্কুলে। অবশেষে সব ছেড়ে আসেন সাংবাদিকতায়।
কবির সর্বশেষ অবস্থা জানিয়ে লেখক রবিন ঘোষ বলেন, অরুণ দাশগুপ্ত কখনো ভাবেননি পূর্বপুরুষের সম্পদ নিয়ে। কিছু দান করেছেন, কিছু হাতছাড়া হয়েছে নানা কারণে। এখন নিজের বাড়িতেই আছেন। নারায়ণ দে নামের এক ভদ্রলোক ও তার পরিবার পিতৃতুল্য কবিকে দেখভাল করছেন। আমরা কি পারি না গুরুতর অসুস্থ ৮৬ বছরের অরুণ দাশগুপ্তের পাশে দাঁড়াতে?
কবি ও নাট্যকার অভীক ওসমান বলেন, অরুণ দাশগুপ্ত এনায়েতবাজার মহিলা কলেজের পাশে কেশব সেনের নীচতলার ঘরটিতে থাকতেন। সেখানে চট্টগ্রামের শিল্প সাহিত্য সংস্কৃতিপ্রেমীদের আড্ডা জমতো। ‘কল্যাণী’র আড্ডার কথা বেশ মনে রয়েছে। কল্যাণী সেন অপর্ণা চরণের অ্যাসিটেন্ট হেড মিস্ট্রেস, টাঙ্গাইল নিবাসী চট্টগ্রামের প্রথম সিভিল সার্জন ডা. কেশব সেনের কন্যা। সেখানে ‘বুধ সন্ধ্যা’ আড্ডা বিখ্যাত ছিল। অরুণ দাশগুপ্ত আড্ডায় তরুণদের অধিকতর লেখার জন্য উৎসাহ দিতেন। চট্টগ্রামে তথা বাংলাদেশে অনেক লেখক গড়ে তুলেছে আজাদী। তার পেছনের কারিগর অরুণ দাশগুপ্ত। শান্তিনিকেতন অরুণ দাশগুপ্ত’র চাক্ষুষ অভিজ্ঞতাকে সমৃদ্ধ করেছে।
অভীক ওসমান বলেন, একসময় অরুণ দাশগুপ্ত এনায়েত বাজার বাসভবন থেকে মিনতির বাসায় রহমতগঞ্জস্থ যোগেশ ভবনে গেলেন। যোগেশ ভবন সংস্কার কার্যক্রম শুরু হলে তিনি সংশ্লিষ্ট পেছনের গলিতে অন্য বিল্ডিংয়ের ওপর থাকতেন। সবসময় সুতি খাদি কাপড় পড়তেন। চিরকুমার বলতেন, ‘ধোবে কে? সেজন্য বস্ত্র পরিধান করি। ’ সর্বশেষ শুনেছিলাম তিনি হাসপাতালে। কল্যাণী এখন অট্টালিকা, যোগেশ ভবন হাইরাইজ বিল্ডিং। এই নগরে তার উপকারভোগী অনেকে রক্তীয় আত্মীয়-স্বজন আছেন। কলকাতায় থাকলে তার মর্যাদা হতো, ঢাকায় থাকলে প্রচার পেতেন, পদক পেতেন। এখন ধলঘাটে একা পড়ে রয়েছেন।
জীবন সায়াহ্নে এসে কিংবদন্তি শিক্ষক