পর্ব ২

স্রষ্টার প্রতি তাঁর (অছি-এ গাউসুল আ’যমের) ছিল প্রগাঢ় আস্থা। যে কোন বিপদে আপদে ধৈর্য্য না হারিয়ে খোদার ইচ্ছার উপরই তিনি সম্পূর্ণরূপে নির্ভরশীল ছিলেন। ১৯৬১ সনে চট্টগ্রাম রেলওয়ে হাসপাতালে উপর্যপুরি দু’বার অপারেশনে জীবনাশঙ্কা দেখা দিলেও তাঁর দুঃখ-বেদনা, ভয়-ভীতি না দেখে সংশ্লিষ্ট চিকিৎসকগণ বিস্ময়ে বিমূঢ় হয়ে বলেছিলেন, “আপনার কোন মহাশক্তি আছে, না হলে এরকম লোক বাঁচতে পারে না”। প্রকৃতপক্ষে, ধৈর্য্য, সহিষ্ণুতা ও আল্লাহর উপর নির্ভরশীলতা হচ্ছে হযরত রাসূল করিম (দঃ)-এর অন্যতম চারিত্রিক বৈশিষ্ট্য। শত নির্যাতনের মাঝ দিয়ে মদিনার পথে হিজরতের সময় সওর পর্বত গুহার মধ্যে শত্রুবেষ্টিত অবস্থার সেই চরম সঙ্কটের মুখেও দয়াল নবী হযরত আবু বকর (রাঃ)-কে সম্বোধন করে বলেছিলেন, “আল্লাহর রহমত হতে নিরাশ হয়োনা। আমরা মাত্র দু’জন নই, সর্বশক্তিমান আল্লাহতালা আমাদের সাথে আছেন”।
(ঘ) পীরের অস্তিত্বে বিলীনতা বা বিধান ধর্মের শরাফত (Total Dedication to the spiritual guide)
হযরত খিজির (আঃ)-এর রহস্যময় জ্ঞান, হযরত দাউদ (আঃ)-এর অবলুপ্ত সুরের মোহিনী প্রকাশ, হযরত সোলায়মান (আঃ)-এর রাজকীয় ঐশ্বর্য, হযরত ঈসা (আঃ)-এর প্রেমের বাণী, বিশ্বনবী হযরত মোহাম্মদ মোস্তফা (দঃ)-এর বেলায়তী শান আহমদী নামের যুগোপযোগী পদচারণা, প্রখ্যাত ছাহাবী হযরত আবু হোরায়রা (রাঃ)-এর অনেক না-বলা কথা ও মহর্ষি বিপ্লবী ,মানসুর হাল্লাজ (রাঃ)-এর প্রেমের আবেশে তৌহিদী চিৎকার এবং সালমান (রাঃ)-এর বিদ্রোহী ভাষাকে অবলম্বন করেই হযরত গাউসুল আ’যম মাইজভান্ডারী (কঃ) মাইজভান্ডারী শরাফতের বীজ বপর করেছেন। মাইজভান্ডারী শরাফতের মূল কথা হল প্রেম। প্রেমের মাধ্যমে স্রষ্টার নৈকট্য অর্জন করতে হবে। মাশুকের জন্য আশেকের হৃদয়ে প্রেমের অগ্নিমিখা প্রজ্জ্বলিত করতে হবে। মহান আল্লাহ বলেন,
“আমি রহস্যময় ছিলাম, ভালবাসাতে আত্মপ্রকাশ করলাম”। (হাদিসে-কুদসি)।
অছি-এ-গাউসুল আ’যম কেবলমাত্র হযরত গাউসুল আ’যম মাইজভান্ডারী (কঃ)-এর অছি ছিলেন না, তিনি ছিলেন হযরত গাউসুল আ’যম মাইজভান্ডারী (কঃ)-এর রহস্য এবং হযরত গাউসুল আ’যম মাইজভান্ডারী (কঃ) নামক মহাশক্তির প্রতিনিধি বা ছায়ামাত্র ছিলেন। প্রথম জীবনের এতিম অবস্থা, জাগতিক জীবনে নানা বাধা-বিপত্তি, দ্বন্ধ-সংঘাত সবকিছুর মুখোমুখি তিনি হয়েছেন এক মহা সত্যকে (মাইজভান্ডারী শরাফত) প্রতিষ্ঠিত করার জন্য। তিনি তাঁর সকল জ্ঞান সম্পদ হযরত ছিদ্দিকে আকবর আবু বকর (রাঃ)-এর ন্যায় হযরত গাউসুল আ’যম মাইজভান্ডারী (কঃ)-এর জন্য উৎসর্গ করে গেছেন। হযরত গাউসুল আ’যম মাইজভান্ডারী (কঃ)-এর ধারক, বাহক ও অছি হিসেবে তিনি তাঁর (হযরত আকদাছে (কঃ)-এর ) জাহের ও বাতেন বাণী সমূহের সিন্দুক বা দরজা স্বরূপ ছিলেন, যেরূপ হযরত আলী (রঃ) হযরত রসূল করিম (দঃ)-এর জাহেরী ও বাতেনী এলেমের দরজা স্বরূপ ছিলেন। কিন্তু তাঁর জীবনের দিকে আলোকপাত করলে দেখা যাবে যে তিনি ব্যক্তিগতভাবে কোথাও নেই। অথচ হযরত গাউসুল আ’যম মাইজভান্ডারী (কঃ)-এর প্রকাশ, প্রচার, কাজকর্ম, রীতিনীতি সবকিছুর মধ্যেই তাঁর অস্তিত্ব এক উজ্জ্বল সূর্যের ন্যায় দেদীপ্যমান।
(ঙ) শরীয়তের প্রতি আস্থাশীলতা বা বিধান ধর্মের শরাফত (Adherence to the Principles of Shariah)
কোরআন, হাদীস ও সুন্নাহর সাথে পরিপূর্ণ সামঞ্জস্যপূর্ণ এবং শরীয়তের বিধান মোতাবেক স্রষ্টার হুকুম আহকাম (যথা: কলেমা, নামায, রোজা, হজ্জ্ব, জাকাত ও অন্যান্য বিধি নিষেধ) মেনে চলা মাইজভান্ডার দরবার শরীফের শরাফতের অন্যতম বৈশিষ্ট্য। উল্লেখ্য যে, হযরত আকদাছ (কঃ) নিয়মিত নামাযে পাঞ্জেগানা আদায় করতেন এবং নফল নামায, কোরআন শরীফ তেলাওয়াত, রোজা পালন ও মোরাকাবা মোশাহেদাতে থাকতেন। নামায ও খোদা-স্মরণ মানুষকে আলোর সন্ধান দেয়। অন্তরের কালিমা বিদূরিত করে। লোভ ও মোহ থেকে বাঁচায়। পর নির্ভরতা দূরীভূত করে খোদা-নির্ভরতা জাগ্রত করে। আত্ম-সন্তুষ্টি এনে দেয়। খোদায়ী ইচ্ছার উপর সবকিছু সমর্পণ করার মনোভাব সৃষ্টি করে। ফলে আর কোন সমস্যাই তখন সমস্যা মনে হয় না। মহান আল্লাহ বলেন,
“হে বিশ্বাস স্থাপনকারী, তোমরা আল্লাহকে অধিকতর স্মরণে রাখ ও স্মরণ করবে; প্রভাতে ও সন্ধ্যায় তাঁর পবিত্রতা বর্ণনা কর। তিনিও তাঁর ফেরশতাগণ তোমাদের উপর আশীর্বাদ করে থাকেন যেন তিনি তোমাদেরকে আলোকের দিকে বহির্গত করেন এবং তিনি বিশ্বাসীগণের প্রতি অনুগ্রহকারী”। (সুরা – আহজাব, আয়াত: ৪১-৪৩)
মহান আল্লাহ আরো বলেন,
“অতএব তোমরা আমাকেই স্মরণ কর, আমিও তোমাদেরকে স্মরণে রাখব এবং তোমরা আমার নিকট কৃতজ্ঞ হও এবং অবিশ্বাসী হয়োনা”। (সুর – বাকারা, আয়াত: ১৫২) ।
বিধান ধর্মের শরাফত প্রতিষ্ঠার ক্ষত্রে অছি-এ-গাউসুল আ’যমের অবদান অপরিসীম। অছি-এ-গাউসুল আ’যম ছিলেন আদর্শ নামাজী ও দ্বীনদার। সুফী মতবাদের ধারক ও বাহক হিসেবে তিনি আজীবন কোরআন ও সুন্নাহ তথা শরার পা’বন্দ ছিলেন। ছোটবেলা থেকে তিনি পাঁচ ওয়াক্ত নামাজ ছাড়া ও তাহাজ্জুদ নামাজসহ অন্যান্য নফল এবাদতে নিজেকে সর্বদা মশগুল রাখতেন। তিনি প্রায়সঃ রোজা রাখতেন। মুরীদের প্রতি তাঁর প্রথম উপদেশ ছিল-
“নামাজ পড়, রোজা রাখ, মিথ্যে বলনা, চুরি করনা, জ্বেনা করনা”।
সকলের নামায পড়ার সুবিধার্থে তিনি দরবার শরীফ মসজিদ, এবাদতখানা প্রভৃতি প্রতিষ্ঠা করে গেছেন। কোরআন তেলাওয়াত তাঁর অন্যতম বৈশিষ্ট্য ছিল।
(চ) সপ্ত পদ্ধতির বাস্তব প্রয়োগ বা নৈতিক নিয়ন্ত্রণ ও আত্মশুদ্ধির শরাফত (Practical Application of the Seven Methods or Moral Control and Self-Purification)
নৈতিক উৎকর্ষ সাধনের জন্য উসূলে ছাবআ বা সপ্ত পদ্ধতির অনুশীলন হচ্ছে মাইজভান্ডারী শরাফতের একটি উল্লেখযোগ্য দিক। আত্ম-নির্ভরশীলতা, অনর্থ পরিহার, স্রষ্টার ইচ্ছায় সন্তোষ, সংযম, পরদোষ পরিহার ও নিজ-দোষ ধ্যান, লোভ-লালসা থেকে মুক্তি, নির্বিলাস জীবন যাপন প্রভৃতি কর্ম পদ্ধতি অনুশীলনের মাধ্যমে ষড়রিপু থেকে মুক্তিলাভ হচ্ছে মানব মুক্তির অন্যতম প্রধান উপায়। হযরত গাউসুল আ’যম মাইজভান্ডারির নীতি চলাচলন,আদর্শ কর্ম পদ্ধতির উপর গবেষণা করে,সপ্ত-পদ্ধতির প্রসার ও বাস্তবায়নের ক্ষেত্রে অছি-এ-গাউসুল আ’যমের ভূমিকা অতুলনীয়। তিনিই সর্ব প্রথম সপ্ত-পদ্ধতির রূপরেখা লিখিত আকারে প্রকাশ করেন এবং উহার খুঁটিনাটি ব্যাখ্যা করেন। তাঁর ক্ষুরধার লেখনীর মাধ্যমেই সপ্ত-পদ্ধতি সাধারণের মাঝে পরিচিতি ও বিকাশ লাভ করে। তিনি হচ্ছেন সপ্ত-পদ্ধতির বাস্তব মডেল বিশেষ। সপ্ত-পদ্ধতির প্রতিটি কর্ম প্রণালী তিনি বাস্তবে অক্ষরে অক্ষরে পালন করে গেছেন। স্রষ্টার প্রতি তাঁর ছিল প্রগাঢ় ভক্তি। তিনি কঠোর সংযম সাধনা করতেন এবং সারা বৎসর নফল রোজা রাখতেন। মহান আল্লাহ বলেন,
“হে বিশ্বাস স্থাপনকারীগণ। তোমাদের উপর রোজা বিধিবদ্ধ হলো যেরূপ তোমাদের পূর্ববর্তীগণের জন্য বিধিবদ্ধ হয়েছিল-যেন তোমরা সংযত হও”।(সুরা – বাকারা, আয়াত-১৮৩)।
তিনি চরম শত্রুকেও উদারতার সাথে গ্রহণ করতেন এবং শত্রু মিত্র নির্বিশেষে জীবনে কাউকে দুর্ব্যবহার করেননি। বিপুল ধন সম্পত্তির অধিকারী হয়েও তিনি ছিলেন সকল প্রকার লোভ লালসামুক্ত। তাঁর অন্তরে স্রষ্টার প্রেম ভালবাসা ছাড়া কোন প্রকার কামনা বাসনা ছিলনা যাহা বেলায়তে খিজরীর অন্তর্গত। মহান আল্লাহ বলেন,
“জেনে রাখ, তোমাদের ধনসম্পদ ও তোমাদের সন্তান-সন্ততি বিড়ম্বনা ব্যতিত নহে এবং নিশ্চয় আল্লাহরই নিকট মহান প্রতিদান রয়েছে”। (সুরা-আনফাল, আয়াত:২৮)
তিনি ছিলেন সৎ কর্মানুরাগী। কর্মঠ ও সঞ্চয়ী লোকদেরকে তিনি ভালবাসতেন। তিনি মিতব্যয়ী ছিলেন এবং যে কোন সম্পদকে খোদার রহমত মনে করতেন এবং উহার সর্বাধিক ব্যবহার ও সংরক্ষণ সুনিশ্চিত করতেন। তিনি পরিবার পরিজন ছেড়ে মনে জঙ্গলে গিয়ে বৈরাগ্য সাধনার মাধ্যমে মুক্তি তালাশ করাকে অপছন্দ করতেন। তিনি ছিলেন অতীব দয়ালু ও সহমর্মী। পশুপাখীদের প্রতিও তাঁর দয়া অবারিত ছিল। মোট কথা, সপ্ত-পদ্ধতির পরিপূর্ণ অনুশীলনের মাধ্যমে তিনি নৈতিকতার সকল দিক দিয়ে চরম উৎকর্ষ অর্জনে সক্ষম হয়েছিলেন। নবী করিম (দঃ) তাই যথার্থাই বলেছেন, “আমার উম্মতের মধ্যে এমন ব্যক্তিত্ব সম্পন্ন লোকও আছেন যিনি গুণে, হিম্মতে, হেকমতে আমার সমকক্ষ”। হযরত গাউসুল আ’যম মাইজভান্ডারী (কঃ) তাই যথার্থই তাঁর আদরের পৌত্র ‘দেলা ময়নাকে’ উপলক্ষ করে বলেছিলেন, “নবাব হামারা দেলা ময়না হ্যায়। ফের আওর কোন নবাব হ্যায়?” অর্থাৎ “হযরত দেলাওর হোসাইন মাইজভান্ডারী (কঃ) নবাব। আর নবাব কে আছে?”

সৌজন্যে

“মাইজভাণ্ডারী গাউসিয়া হক কমিটি বাংলাদেশ “,আতুরার ডিপো হাসেম বাজার শাখা। অস্থায়ী ঠিকানাঃখালেদা-মাহমুদা ম্যানশন,সঙ্গীত রোড,পাঁচলাইশ,চট্ট্রগ্রাম. আলাপনী-০১৮৩৮৬৩৭৬৯৮।ই-মেইলঃhoqcommity@gmail.com।

মাইজভাণ্ডার দরবার শরীফের শরাফতের উল্লেখযোগ্য দিকসমূহ ও অছি-এ গাউসুল আ’যম এর অবদান

মাইজভাণ্ডার দরবার শরীফের শরাফতের উল্লেখযোগ্য দিকসমূহ ও অছি-এ গাউসুল আ’যম এর অবদান

মাইজভাণ্ডার দরবার শরীফের শরাফতের উল্লেখযোগ্য দিকসমূহ ও অছি-এ গাউসুল আ’যম এর অবদান

Print Friendly, PDF & Email

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here