হযরত খাজা মইনুদ্দিন চিশ্‌তী (রঃ) সিস্তান রাজ্যের সন্জর গ্রামে ৫৩৩ হিজরী ও ১১৩৮ ইংরেজি সালে জন্ম গ্রহণ করেন। পিতার নাম গিয়াসুদ্দিন ও মাতার নাম সৈয়দা উম্মুল ওয়ারা। পরে স্বপরিবারে খোরাসান শহরে ( বর্তমান আফগানিস্তান) হিজরত করেন। মাত্র ১৫ বৎসর বয়সে বাবা –মা উভয়কেই হারান।

একদিন নিজ জমিতে কাজ করে পরিশ্রান্ত অবস্তায় বিশ্রাম নিছিছলেন। মন সময় সেখানে এসে উপস্হিত হলেন এক অচেনা আগন্তুক। কিশোর খাজা মইনুদ্দিন তাকে বাগানের কিছু আঙ্গুর এনে আপ্যায়ন করলেন। আগন্তুক ছিলেন আল্লাহর এক অলি-আল্লাহ, হজরত ইব্রাহিম কান্দুযী (রঃ)। খুশী হলেন কিশোরের আপ্যায়নে। হাত তুলে দোয়া করলেন অনেকক্ষণ।তারপর ঝুলি থেকে বের করলেন এক টুকরো শুকনো রুতি। রুটির একাংশ কিছুক্ষণ চিবুলেন তারপর অন্য অংশটুকু মইনুদ্দিনকে খেতে দিলেন। আদেশ পালন করলেন মইনুদ্দিন একটু পরেই উচ্ছিষ্ট রুটির প্রতিক্রিয়া প্রকাশিত হতে শুরু করলো। বিস্মিত হলেন। অন্তরের আছছাদন যেন উবে যাছেছ একে একে। অদ্ভুত এক জ্যোতির্ময় অনুভব এসে ধীরে ধীরে আলোকিত করছে হৃদয়ের সর্বত্র। দরবেশ চলে গেলেন। অন্তরে জ্বালিয়ে দিয়ে গেলেন আল্লাহ প্রেমের অনন্ত অনল। এই হলো অলি-আল্লাহদের তাওয়াজ্জোহ এর ফল।

মইনুদ্দিন বাগান ও ভিটে বাড়ি সহ সবকিছু বিক্রি করে দিয়ে বেরিয়ে পরলেন আল্লাহর পথে। প্রথমেই জাহেরী  এলেম শিক্ষার জন্য হাজির হলেন বোখারা, সমরখন্দে। দীর্ঘ দিন সেখানে অবস্হান করে বুৎপত্তি অর্জন  করলেন জাহেরী এলমের সমস্ত শাখা প্রশাখায়। তারপর বেরিয়ে পরলেন বাতেনী ইলম অর্জনের উদ্দেশ্যে।
হাদিস শরীফে উল্লেখ আছে, জ্ঞান দুই প্রকার। জবানী ইলম ও বাতেনী ইলম।” (মেশকাত শরীফ)।

ইমাম মালিক (রঃ) বলেছেন-”যে ব্যক্তি বাতেনী জ্ঞান অর্জন করলো কিন্তু ইলমে শরীয়ত গ্রহণ করলো  না সে নিশ্চিত কাফের ,আর যে ব্যক্তি শুধু ইলমে শরীয়ত গ্রহণ করল কিন্তু বাতেনী ইলম গ্রহণ করলো না সে নিশ্চয় ফাছেক”। আর জ্ঞান অর্জন করা প্রতিটি মোসলমানের উপর যেহেতু ফরয তাই বাতেনী এলেম অর্জন করাও
ফরয। এই বাতেনী জ্ঞান অর্জনের জন্য আবার খাজা মইনুদ্দিন চিশ্‌তী (রঃ) বের হয়ে গেলেন বাতেনী জ্ঞান সম্পন্ন শিক্ষক অন্নেষনের উদ্দেশ্য।
৫৫০ হিজরি সাল। বাগদাদে এসে সাক্ষাৎ পেলেন হজরত বড় পীর আব্দুল কাদের জিলানী (রঃ) এর।কয়েক মাস উনার সাথে অবস্হানের পর আবার নুতন শিক্ষকের সন্ধানে বের হলেন। বিদায়ের সময় বড়পীর(রঃ) বললেন,’হে মইনুদ্দিন ।তুমি যখন হিন্দুস্হানে সফর করবে , তখন পথে পরবে ভাতীসা রমন্ত নামে এক স্হান। সে স্হানে আছে সিংহতুল্য এক মর্দে মুমিন।তার কথা মনে রেখ তুমি।’
শুরু হল নুতন শায়েখের সন্ধান।পথে বিভিন্ন অলির সাথে সাক্ষাতের পর এসে উপস্হিত হলেন খোরাসান এবং ইরাকের মধ্যবর্তী নিশাপুর অন্চলের হারুন নগরে। এই শহরেই বসবাস করেন আউলিয়া সম্প্রদায়েরমস্তকের মুকুট হজরত ওসমান হারুনী(রঃ)। উনার নিকট বায়াত হবার দরখাস্ত পেশ করলে মন্জুর হল। উনার সাথে বিশ বৎসরের অধিক সময় অতিবাহিত করে কামালিয়াতের সর্বোচ্চ স্তরে পৌছলেন।
এবার দাওয়াতের পালা। অলী আল্লাহগণ হলেন নবী রাসুলদের প্রকৃত উত্তরসুরী। সেই দায়িত্বের ভার এসে পড়ল খাজা মইনুদ্দিন চিশ্‌তী (রঃ) এর উপর। ইতিমধ্যে নুতন এক ছাত্র এসে হাজির হয়েছে খাজার দরবারে। খাজা মইনুদ্দিন চিশ্‌তী (রঃ) ছাত্র জনাব কুতুবুদ্দিন বখতিকে সাথে নিয়ে হজ্ব পালনের উদ্দেশ্যে রওনা হলেন মক্কায়। হজ্ব পর্ব শেষ করে মদীনা শরীফ এসে হজরত খাজা মইনুদ্দিন চিশ্‌তী (রঃ) রসুলে পাক(সাঃ) এর কাছ থেকে এক অবিস্মরণীয় সুসমাচার। হযরত রসুলে পাক(সাঃ) জ্যোতির্ময় চেহারায় আবির্ভুত হয়ে জানালেন,”প্রিয় মইনুদ্দিন। তুমি আমার ধর্মের মইন(সাহায্যকারী)। আমি তোমাকে হিন্দুস্হানের বেলায়েত প্রদান করলাম। হিন্দুস্হান বুৎপরোস্তির অন্ধকারে নিমজ্জিত। তুমি আজমীরে যাও।সেখানে তোমর মাধ্যমে পবিত্র ইসলামের ব্যাপক প্রসার ঘটবে।
সুসমাচার শুনে পরিপৃপ্ত হলেন খাজা মইনুদ্দিন চিশ্‌তী (রঃ)।
পরক্ষণেই চিন্তিত হলেন তিনি। কোথায় আজমির? বিশাল হিন্দুস্হানের কোন দেশে আছে রসূল নির্দেশিত আজমীর?
চিন্তিত অবস্হায় তন্দ্রাছ্ছন্ন হয়ে পরেছিলেন খাজা মইনুদ্দিন চিশ্‌তী (রঃ)। সেই অবস্হায় তিনি দেখলেন, হজরত মোহাম্মদ(সাঃ) তার শিয়রে উপবিষ্ট। তিনি তাকে আজমীর শহরের দৃশ্য দেখিয়ে দিলেন। সেই সঙ্গে দিয়ে দিলেন প্রয়োজনীয় পথ নির্দেশনা। এরপর দয়াল নবী (সাঃ) তার হাতে দিলেন একটি সুমিষ্ট আনার। তারপর তার জন্য দোয়ায়ে খায়ের করে যাত্রা শুরু করবার নির্দেশ দিয়ে দিলেন।
সফর শুরু হলো আবার।সঙ্গে সাথী কুতুবুদ্দিন।চলতে চলতে এসে পৌছলেন লাহোর। মনে পড়ে গেল হজরত বড়পীর(রঃ) এর সেই মুল্যবান উপদেশ -মর্দেমুমিন সেই সিংহ পুরুষ এর কথা, সেই ভাতীসা রমস্হ জায়গার কথা। হজরত খাজা মইনুদ্দিন চিশ্‌তী (রঃ) জানতে পারলেন এই লাহোরেই আছে সেই সিংহতুল্য মর্দে মুমিনের মাজার শরীফ। তার মোবারক নাম হজরত দাতাগন্জ্ঞে বখশ(রঃ)। তিনি একাধারে দুই মাস অবস্হান করলেন। তারপর শুরু হল যাত্রা।

এবারের যাত্রার গন্তব্য দিল্লী। এগিয়ে চলল হজরত খাজা মইনুদ্দিন চিশ্‌তী (রঃ) এর বেহেশতী কাফেলা। এখন আর কাফেলা দুইজনের মধ্যে সীমাবদ্ধ নয়। বিভিন্ন স্হানে বিরতির সময় সঙ্গে যুক্ত হয়েছেন কিছু খাটি আল্লাহ অনুরক্ত ফকির দরবেশ। আস্তে আস্তে এর সংখ্যা এসে দাড়িয়েছে চল্লিশে। সঙ্গী সাথী সহ
দিল্লী এসে উপস্হিত হলেন হজরত খাজা মইনুদ্দিন চিশ্‌তী (রঃ)। দিল্লীর শাসক তখন হিন্দুরাজা খান্ডরাও। আজমীর অধিপতি পৃথ্বিরাজের ভাই ছিলেন তিনি। পৃথ্বিরাজই তাকে তার প্রতিনিধি হিসেবে দিল্লীর শাসনভার অর্পন করেছিলেন।
রাজমহলের অদুরেই নির্মিত হলো ফকির দরবেশদের ডেরা। নির্ভয়ে তরা শুরু করলেন তাদের নিয়মিত ইবাদত বন্দগী। ক্রমে ক্রমে ইসলামের আলো প্রসারিত হতে থাকলো। দিল্লীর আধ্যাতিক দৈন্যতায় এলো ইমানের জ্যোতির্ময় জোয়ার। পিতৃ ধর্ম ত্যাগ করে দলে দলে লোক এসে প্রবেশ
করতে থাকলো আল্লাহর মনোনীত একমাত্র ধর্ম ইসলামের সুবাসিত কাননে। বিরোধিতা যেমন বাড়তে লগলো। তামনি বাড়তে থকলো বিজয়ের বিরতিহীন অভিঘাত। কিন্তু গন্তব্যত এখানে নয় । এগিয়ে যেতে হবে আরো সন্মুখে। রসুল পাক(সাঃ) এর নির্দেশিত সেই আজমীরের আকর্ষণ একসময় উদ্বেলিত করে তুললো খাজা মইনুদ্দিন চিশ্‌তী (রঃ) এর অন্তরকে। দিল্লীর কুতুব হিসেবে নির্বাচিত করলেন হযরত কুতুবুদ্দিন বখতিয়ার কাকী(রঃ) কে। দিল্লীর দ্বীন প্রচার ও নওমুসলিমের বিড়াট কাফেলার হেফাজতের দায়িত্ব হযরত কাকির উপর।
খাজা মইনুদ্দিন চিশ্‌তী (রঃ) তাঁর আত্নোৎসর্গকারী ফকির দরবেশদের নিয়ে রওয়ানা হলেন আজমীর অভিমুখে। পিছনে পরে থাকলো দিল্লী, দিল্লীর শোকাকুল জনতা ও দিল্লীর নব নিযুক্ত কুতুব হযরত বখতিয়ার কাকী(রঃ)।
আজমীর শহরের উপকন্ঠে এসে উপস্হিত হলেন খাজা মইনুদ্দিন চিশ্‌তী (রঃ) । সফর সঙ্গীগণ সবাই পরিশ্রান্ত। বিশ্রামের ব্যবস্হা করতেই হয়।এই সেই হিন্দুস্হানের বেলায়তের প্রতিশ্রুত কেন্দ্রভুমি আজমীর। চারিদিকে পাহাড়, পাথর মরুভুমি। নিকটেই বৃক্ষছায়া। এখানেই বিশ্রামের জন্য উপবেশন করলেন দরবেশদের কাফেলা।
স্হানটি ছিল রাজা পৃথ্বিরাজের উষ্ঠ্র বাহিনির বিশ্রামস্হল। রাজার লোকেরা কিছুক্ষণ যেতে না যেতেই সবাইকে স্হান ত্যাগ করতে বলল। বিস্মিত হলেন খাজা মইনুদ্দিন চিশ্‌তী (রঃ)। উটের দলতো এসে পৌঁছবে সেই সন্ধ্যাবেলায়। অথচ লোকগুলি তাদেরকে এখনই তাড়িয়ে দিতে চায়।তিনি বললেন, ”ঠিক আছে আমরা চললাম। তোমাদের উটই এখানে বসে বসে বিশ্রাম করুক।”
পরিশ্রান্ত কাফেলা আবার এগিয়ে চললো সামনের দিকে। অদুরে ‘আনা সাগর’। সাগরতো নয় একটি বিশাল হ্রদ। লোকে বলে আনা সাগর। আনা সাগরের পাড় ঘেষে অজস্র মন্দির। খাজা মইনুদ্দিন চিশ্‌তী (রঃ) এই হ্রদেরই এক ছোট টিলার উপর বসবাসের স্হান নির্বাচন করলেন। সে রাতেই মুখে মুখে আগন্তুক দরবেশের আগমন সংবাদ ছড়িয়ে পড়লো সর্বত্র। সকালে মহা রাজ পৃথ্বিরাজও শুনতে পেলেন এক অদ্ভুত সংবাদ। উষ্ঠশালার কর্মচারীগণ এসে জানালো। গতকাল সন্ধ্যায় যে উটগুলি উষ্ঠ্রশালায় আনা হয়েছিল সবগুলি এখনও শুয়ে আছে। কিছুতেই উঠবার নাম করছে না। সঙ্গে সঙ্গে মুসলমান দরবেশ দলের ঘটনাও বর্ণীত হলো রাজার কাছে। দরবেশ দলের নেতা উষ্ঠ্রশালা পরিত্যাগের সময় বলেছিলেন , ”তোমাদের উটই এখনে বসে বসে বিশ্রাম করুক।”
ইতিপুর্বে বিক্ষিপ্তভাবে মুসলমান ফকিরদের সম্পর্কে এরকম অনেক কথা রাজার কর্নগোচর হয়েছিল। চিন্তিত হয়ে পড়লেন রাজা পৃথ্বিরাজ। মনে পড়ে গেল তার রাজমাতার ভবিষ্যতবাণীর কথা। তিনি বলেছিলেন ”এক মুসলমান ফকিরের অভিসম্পাদেই পৃথ্বিরাজের রাজ্য ধ্বংস হয়ে যাবে।”
একি তবে সেই ফকির ? সম্ভবত এই ফকিরের কথাতেই এই অবস্হার সৃষ্টি হয়েছে। কর্মচারীদেরকে ফকিরদের কাছে ক্ষমা চাওয়ার জন্য নির্দেশ দিলেন রাজা। রাজ আদেশ পালন করল শ্রমিকেরা ।
হযরত খাজা মইনুদ্দিন চিশ্‌তী (রঃ) বললেন যাও। এ অবস্হা আর থাকবে না। উটশালায় ফিরে এসে বিশ্বয়ের সঙ্গে সবাই লক্ষ্য করল উটগুলো স্বাভাবিকভাবে চলাচল শুরু করেছে। ফকিরের কারামতি দেখে সবাই অবাক হয়ে গেল। ধীরে ধীরে আজমীরের অবস্হান্তর ঘটতে লাগলো। কৌতুহল নিবারনের জন্য লোকজন যাতায়াত শুরু করে দিল হযরত খাজার আস্তানায়। তাঁর পবিত্র চেহারা আর তাঁঁর সাথীদের প্রাণখোলা মধুর চরিত্রের প্রভাবে সম্মোহিত হতে লাগলো আজমিরবাসী। হযরত খাজা মইনুদ্দিন চিশ্‌তী (রঃ) এর সোহবতের (সাক্ষাৎ) বরকতে তাদের অন্তরের অন্ধকার দুর হতে লাগলো। জেগে উঠলো আজমেরীর সত্যান্বেষী জনতা। কিন্তু আতংকিত হলো পুরোহিতরা, শোষক বর্নবাদী হিন্দু সমাজ। ভীত হলো হিংস্র রাজপুরুষগণ এবং সামন্তবাদী সম্রাট।
ইসলাম বিদ্বেসী ক্রোধান্ধ শহর লোকজন রাজ দরবারে গিয়ে হযরত খাজা মইনুদ্দিন চিশ্‌তী (রঃ) ও তাঁঁর সহচরদের বিরুদ্ধে অভিযোগ করলো।
অভিযোগ শুনে ক্রুদ্ধ হয়ে উঠলেন রাজা পৃথ্বিরাজ। অহংকারের নীচে চাপা পরে গেল মায়ের সদুপদেশবানী। রাজা একদল সৈন্যকে আদেশ দিলেন ফকির দরবেশদলকে এক্ষণি রাজ্য থেকে বিতাড়িত করতে। রাজার আদেশ পেয়ে ঝাপিয়ে পরলো অভিযানে। হযরত খাজা মইনুদ্দিন চিশ্‌তী (রঃ) নির্বিকার। আল্লাহ পাকের সাহায্য কামনা করলেন তিনি। সাথে সাথেই আক্রমনকারীদের কেউ হলেন অন্ধ, কারও শরীর হল নিঃসাড়। কেউ হলো ভুতলশায়ী।
নিরুপায় হয়ে পায়ে পড়ে ক্ষমা প্রার্থনা করলো তারা। দয়ার সাগর গরীবে নেওয়াজ হযরত খাজা মইনুদ্দিন চিশ্‌তী (রঃ) ক্ষমা করে দিলেন সবাইকে।
রাজা পৃথ্বিরাজ ভেবে কুল পান না কি করবেন তিনি। সমরাস্ত্র, সুসজ্জিত সৈন্যদল কোন কিছুই যে আর কাজে আসছে না। এক দুরাগত যবন ফকিরের নিকট পরাজয় বরন করতে হবে তাকে ? ঐশ্বরিক ক্ষমতাধর এই ফকিরের আনুগত্য স্বীকার করবেন নাকি তাকে বিতাড়নের প্রচেষ্টা অব্যাহত রাখবেন। এ কি বিশ্বয়কর সংকট। চুপ করে থাকলেও বিপদ । বিরুদ্ধাচরন করলেও সমস্যা। এদিকে দলে দলে লোকজন গ্রহণ করছে ফকিরের প্রচারিত একত্ববাদী ধর্মমত।
রাজা ভেবে চিন্তে ঠিক করলেন, হিন্দু ধর্মের আধ্যাধিক সিদ্ধপুরুষদের দ্বারা প্রতিরোধ করতে হবে ফকিরকে। তাই সিদ্ধপুরুষ বলে খ্যাত ”রামদেও” কে অনুরোধ করলেন তার যোগমন্ত্র বলে এই যবন ফকিরকে বিতাড়িত করতে। রামদেও রাজী হলেন। তার ধীর্ঘ সাধনালব্দ্ধ আধ্যাধিক শক্তিতে হযরত খাজা মইনুদ্দিন চিশ্‌তী (রঃ) কে পরাস্ত করার বাসনায় হাজির হলেন হযরতের দরবারে।
হযরত খাজা মইনুদ্দিন চিশ্‌তী (রঃ) তখন ছিলেন ধ্যানমগ্ন অবস্হায়। কিছুক্ষণ পর চোখ খুললেন হযরত। দৃষ্টিপাত করলেন রামদেও খাজা মইনুদ্দিন চিশ্‌তী (রঃ) এর জ্যোতির্ময় চেহারার দিকে। মুগ্ধ হয়ে গেলেন রামদেও। তার আধ্যাতিক শক্তি মুহুর্তের মধ্যে নিশ্চিন্ন হয়ে গেল। অন্ধকারে আলো জ্বললে মুহুর্তেই যেমন করে অন্ধকার অপসারিত হয়।হজরত খাজার কদম মোবারকে লুতিয়ে পড়লেন রামদেও। নির্দ্বধায় স্বীকার করলেন ইসলাম। খাজা মইনুদ্দিন চিশ্‌তী (রঃ) তার নাম রাখলেন মোহাম্মদ সাদী।
রামদেও এর ইসলাম গ্রহণের সংবাদ শুনে রাজা ক্ষোভে দুঃখে অস্হির হয়ে উঠলেন। কিন্তু বিদূষী মায়ের উপর্যুপরি উপদেশের বাধ্য হয়ে সংযত হলেন রাজা। কিন্তু কিছুদিন পরই দেখা দিল আরেক বিপদ।
আনা সগরের পানি শুধুমাত্র উচ্চ বর্ণের হিন্দু এবং পুরোহিত সম্প্রদায়
ছাড়া অন্য কেও ব্যবহার করতে পারতো না। নিম্ন বর্ণের  হি্ন্দুরা এটা তাদের ধর্মীয় বিধান বলে মনে করত। কিন্তু মুসলমানরা কি আর বর্ণভেদের ধার ধারে ? একদিন আনাল সাগরে অজু করতে গেলেন হজরত খাজার একজন সাগরেদ। পুরোহিতরা অপমান করে তাড়িয়ে দিলো তাকে। সাগরেদ সমস্ত ঘটনা বর্ণনা করলেন খাজা মইনুদ্দিন চিশ্‌তী (রঃ) কে। হযরত খাজা মোহাম্মদ সাদীকে ”আনা সাগর” থেকে এক ঘটি পানি আনার নির্দেশ দিলেন। নির্দেশ মত মোহাম্মদ সাদী ‘আনা সাগর’ থেকে এক ঘটি পানি আনতেই দেখা গেলো এক আশ্চর্য দৃশ্য। কোথায় সাগর ? সব পানি তার শুকিয়ে গিয়েছে একেবারে।
এই আলৌকিক ঘটনা রাজাকে জানালো প্রজারা। বিব্রত বোধ করলো রাজা। রাজা বাধ্য হয়ে আবারও তাদের প্রজাদের দুর্ব্যবহারের জন্য ফকিরের কাছে ক্ষমা চাইতে নির্দেশ দিলেন রাজা। প্রমাদ গুনলেন পুরোহিত সম্প্রদায়। কিন্তু উপায়ন্তর না দেখে তারা খাজা মইনুদ্দিন চিশ্‌তী (রঃ) এর কাছে গিয়ে ক্ষমা ভিক্ষা করলেন ।
মানুষের দুর্দশা দেখে ও পুরোহিতদের ক্ষমার প্রেক্ষিতে মোহাম্মদ সাদীকে পুনরায় ঘটিতে ভরা পানি আনা সাগরে ঢেলে দিতে নির্দেশ দিলেন। নির্দেশ পালিত হলো। ঘটির পানি ঢেলে দেয়ার সাথে সাথেই ভরে গেল বিশাল হ্রদ ‘আনাল সাগর’। এই আলৌকিক ঘটনার পর বহুলোক ইসলামের সুশীতল ছায়ায় আশ্রয় নিল খাজা মইনুদ্দিন চিশ্‌তী (রঃ) এর হাত ধরে।
পৃথ্বিরাজ ভেবে পান না কি করে এ মুসলমান ফকিরকে প্রতিহত করা যায় । কেউ কেউ রাজাকে বুদ্ধি দিলেন বিখ্যাত ঐন্দ্রজালিক অজয় পালকে দিয়ে কিছু করা যায় কিনা ? রাজা তাকেই ডেকে পাঠালেন এবং রাজকীয় পুরস্কারের প্রস্তাব করলেন। অজয় পাল তার সর্বশক্তি দিয়ে খাজা মইনুদ্দিন চিশ্‌তী (রঃ) কে ঘায়েল করার চেষ্টা করলেন। কিন্তু মিথ্যা কি কখনো সত্যকে প্রতিহত করতে পারে ? অজয় পালও তার ভুল বুঝতে পেরে তার সঙ্গী সাথী সহ ইসলাম ধর্ম গ্রহণ করলেন। খাজা মইনুদ্দিন চিশ্‌তী (রঃ) অজয় পালের নাম রাখলেন ‘আব্দুল্লাহ বিয়াবানী’।
সংবাদ শুনে মুষড়ে পরলেন রাজা। নিজ রাজ্য রক্ষার কথা চিন্তা করে সংঘর্ষমুক্ত সহাবস্হানের পথ অবলম্বন করলেন রাজা। কিন্তু সত্য মিথার সংষর্ষ যে অবসম্ভাবী। আবারও সংঘর্ষের সূত্রপাত হলো এভাবে-

রাজ দরবারের একজন কর্মচারী ছিলেন খাজা মইনুদ্দিন চিশ্‌তী (রঃ) এর একান্ত অনুরক্ত। মুসলমানও হয়ে গিয়েছিলেন তিনি। রাজা একথা জেনেও তাকে খুব পছন্দ করতেন তার উত্তম স্বভাব, বিশ্বস্হতা ও সততার জন্য। কিন্তু রাজদরবারের অন্যান্য সদস্যদের প্ররোচনায় এক সময় সেই কর্মচারীর উপর ক্ষিপ্ত হয়ে উঠলেন রাজা। খাজা মইনুদ্দিন চিশ্‌তী (রঃ) এর কাছে বার বার হেনস্ত হবার সমস্ত ক্ষোভ যেন গিয়ে পড়লো তার উপর। মুসলমান কর্মচারী সমস্ত দুঃখের কথা খাজা মইনুদ্দিন চিশ্‌তী (রঃ) এর কাছে বর্ণনা করার পর খাজাকে অনুরোধ করলেন তার জন্য রাজার কাছে একটি সুপারিশ পত্র পাঠাতে। পর দুঃখে কাতর খাজা মইনুদ্দিন চিশ্‌তী (রঃ) একান্ত বিনয় ও নম্রতার মাধ্যমে সেই কর্মচারীর পক্ষে একটি সুপারিশ পত্র পাঠালেন। সেই সঙ্গে রাজাকে জানালেন ইসলাম গ্রহণের একান্ত আহ্বান।
চিঠি পেয়ে রাগে হিতাহিত জ্ঞান হারিয়ে ফেললেন পৃথ্বিরাজ। মুসলমান কর্মচারীকে চাকুরীচ্যুত করলেন রাজা। সেই সঙ্গে খাজা মইনুদ্দিন চিশ্‌তী (রঃ) এর বিরুদ্ধে উচ্চারণ করলেন অশালীন বক্তব্য। সংবাদ শুনে খাজা মইনুদ্দিন চিশ্‌তী (রঃ) এর প্রেমময় অন্তরেও প্রজ্জলিত হলো রুদ্ররোষের সর্বধ্বংসী আগুন। তিনি একটুকরা কাগজে লিখে পাঠালেন রাজা পৃথ্বিরাজকে-”মান তোরা যেন্দা বদস্তে লশকরে ইসলাম বছোপর্দম”। অর্থাৎ আমি তোমাকে তোমার জীবিতাবস্হাতেই মুসলিম সেনাদের হাতে সোদর্প করলাম। এর পরেই স্বপ্ন দেখলেন সুলতান শাহাবুদ্দিন মোহাম্মদ ঘুরী এবং উনার নেতৃত্বেই হিন্দুস্হানে উরলো মুসলমানদেরবিজয় পতাকা এবং পতন হলো মহারাজা পৃথ্বিরাজের।

নিদ্রাভিবুত ছিলেন সুলতান শাহাবুদ্দিন মোহাম্মদ ঘুরী। স্বপ্নে দেখলেন শ্বেত শুভ্র বস্ত্রাবৃত এক জ্যোতির্ময় মহাপুরুষ সিংহাসনে বসা। তার সামনে দন্ডায়মান অনেক অনুচর। তাদের মধ্যে একজন সুলতান ঘোরীকে হাত ধরে একদল সুসজ্জিত মুসলমান সেনাদলের নিকট নিয়ে গেল। আর সেই সময় সেই জ্যোতির্ময় মহাপুরুষ তাকে লক্ষ্য করে বললেন,”যাও তোমাকে আমি হিন্দুস্হানের শাসন ক্ষমতা দান করলাম।”
স্বপ্ন ভেঙ্গে গেল। চমকিত হলেন সুলতান। এ নিশ্চয়ই শুভ স্বপ্ন হবে। সকালে ঘনিষ্ঠজনদের সঙ্গে স্বপ্নের বৃত্তান্ত জানালেন। সবাই একবাক্যে বললেন, মনে হয় অচিরেই হিন্দুস্হান আপনার করতলগত হবে। এ স্বপ্ন তারই আগাম সুসংবাদ।
সুলতান মনস্হির করলেন হিন্দুস্হান অভিযান শুরু করার। সেনাপতি কুতুবুদ্দিন আইবেককে প্রস্তুত হবার নির্দেশ দিলেন। ৫৮৮ হিজরি সালে সুলতান শাহাবুদ্দিন মোহাম্মদ ঘুরী তার বিশাল সেনাবাহিনী নিয়ে হিন্দুস্হান অভিমুখে রওয়ানা হলেন। অন্তরে বিগত যুদ্ধের পরাজয়ের গ্লানি। সে গ্লানি এবার মুছতেই হবে। ইতি পুর্বে দুই দুইবার হিন্দুস্হান আক্রমন করেও সফল হতে পারেন নি। শুরু হল তুমুল যুদ্ধ। সুলতান শাহাবুদ্দিন মোহাম্মদ ঘুরীর সৈন্যসংখ্যা রাজা পৃথ্বিরাজের সৈন্যের তুলনায় একেরারেইকম। কিন্তু ইমানের বলে বলীয়ান এক আল্লাহর একছ্ছত্র শক্তির প্রতি নির্ভর করে তারা নির্ভয়ে এগিয়ে চললো। এই বাহিনীর প্রধান সেনাপতি কুতুবুদ্দিন আইবেক। তারায়েনা প্রান্তরে দুই বাহিনীর মধ্যে প্রচন্ড যুদ্ধ শুরু হলো। মুসলমানদের প্রচন্ড আক্রমনের সামনে ছত্রভঙ্গ হয়ে গেল পৌত্তলিক সৈন্যবাহিনী। নাস্তানাবুদ হয়ে পালিয়েও নিস্তার পেল না তারা। ক্ষিপ্রগতিতে রাজপুত সৈন্যদের পশ্চাদ্ধাবন করে যাকে যেভাবে পাওয়া গেল, তাকে সেভাবেই হত্যা করতে লাগলো মুসলমান সৈন্য বাহিনী। উপায়ন্তর না দেখে যুদ্ধের ময়দান থেকে পালিয়ে গেলো সেনাপতি খান্ডে রাও। রাজা পৃথ্বিরাজও সরস্বতী নদীর তীর ধরে পালাবার চেস্টা করার সময় মোসলমানদের সৈন্যদের হাতে বন্দী হয়ে গেল রাজা। শেষাবধি হত্যা করা হল তাকে। ৫৮৮ হিজরী সালে ভয়াবহ এ যুদ্ধে সুলতান সাহাবুদ্দিন ঘোরী নিরংকুশ বিজয় লাভ করলেন। আরো সামনে এগিয়ে চললো ঘোরী বাহিনী। এর পর সহজেই এক এক করে সরস্বতী,সামানা ও হাশিসহ অধিকৃত হল দিল্লী। সুলতান দিল্লীর দায়িত্ব দিলেন কুতুবুদ্দিন আইবেককে । তারপর সুলতান শাহাবুদ্দিন মোহাম্মদ ঘুরী এগিয়ে চললেন আজমীরের দিকে।
তার এই এই অপ্রতিরুদ্ধ অগ্রাভিযানের সামনে অবনত হলো যুদ্ধে নিহত হিন্দু রাজাদের পুত্রগন। দেউল নামক স্হানে সম্রাটের সঙ্গে সাক্ষাত করলো অনেক রাজপুত্রগণ। মুসলিম শাসনের প্রতি তাদের আনুগত্যের বিনিময়ে সম্রাট তাদেরকে দান করলেন বিভিন্ন রাজ্যের জায়গী। সুলতান এগিয়ে চললেন আজমীরের দিকে।
এদিকে আজমীরে ক্রমাগত বেড়েই চলছে খাজা মইনুদ্দিন চিশতী (রঃ) এর কাফেলা। ইসলাম কবুলকারীদের সংখ্যা এখন লক্ষ লক্ষ।শুধু আজমীরে নয় এখন খাজা মইনুদ্দিন চিশতী (রঃ) এর জামাত এখন ছড়িয়ে পরেছে হিন্দুস্হানের কোনায় কোনায়। দর্শনার্থীদের ভীর সব সময় লেগেই থাকে।
সুলতান শাহাবুদ্দিন মোহাম্মদ ঘুরী অবশেষে আজমীর এসে পৌছলেন। তখন সন্ধ্যা হয় হয়। সুর্যাস্ত হওয়ার পর সচকিত হয়ে উঠলেন সুলতান শাহাবুদ্দিন মোহাম্মদ ঘুরী। দুরে কোথায় আজানের ধ্বনি শোনা যায়। সেদিকে এগিয়ে যেতেই তিনি দেখলেন একদল নুরানী জান্নাতী লোক হাত বেধে দাড়িয়েছেন। দরবেশদের জামাতের সঙ্গে নামাজ আদায় করলেন সুলতান। সালাত শেষে জামাতের ইমামের মুখের দিকে তাকিয়েই চমকে উঠলেন সুলতান শাহাবুদ্দিন মোহাম্মদ ঘুরী। এইতো সেই জ্যোতির্ময় মহাপুরুষ, স্বপ্নে যিনি জানিয়েছেন হিন্দুস্হান বিজয়ের সুসংবাদ।
সুলতান শ্রদ্ধাভরে পরিচিত হলেন হজরত খাজার সাথে। তিনদিন হযরতের মোবরক সহবতে অতিবাহিত করে স্বদেশ প্রত্যাবর্তন করলেন সুলতান। তার প্রতিনিধি হিসেবে দিল্লীতে রেখে গেলেন কুতুবুদ্দিন আইবেক কে। তিনিও বায়াত গ্রহণ করলেন খাজার প্রতিনিধি খাজা বখতিয়ার কাকী(রঃ) হাতে। এরপর রাজনৈতিক ও রুহানী শক্তির সম্মিলিত প্রচেষ্টায় পৌত্তলিকতা উচ্ছেদের অভিযান চলতে থাকলো সমান্তরাল গতিতে। কুতুবুদ্দিন আইবেক ক্রমে ক্রমে প্রসারিত করলেন মুসলিম রাজ্যের সীমানা। কনৌজ,বানারস সহ আরো বহু স্হানে উড়িয়ে দিলেন মুসলমানদের বিজয়পতাকা।

(গ্রন্থ সহায়তা – মোহাম্মদ মামুনুর রশীদ রচিত -” চেরাগে চিশতী”,প্রকাশক-সেরহিন্দ প্রকাশন, ওয়ারী ,ঢাকা।)

Print Friendly, PDF & Email

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here