“দরবেশ-আওলিয়া” তথা মুজাহিদদের মাধ্যমে চট্টগ্রামে ইসলাম প্রচার
চট্টগ্রামে ইসলামের প্রাথমিক অবকাঠামো নির্মাণ ও ইসলাম প্রচারে এই আউলিয়া তথা মুজাহিদদের ভূমিকা ছিল সবচেয়ে বেশি। তাঁরা অনাড়ম্বর জীবন যাপন করতে অভ্যস্ত ছিলেন। তারা অত্যন্ত সাদাসিধেভাবে মানুষের কাছে ইসলাম প্রচার করতেন এবং তাদের সুন্দর ব্যবহার, চরিত্রের মাধুরতা এতই প্রখর ছিলো যে, তাদের সংস্পর্শে এসে দলে দলে লোক ইসলামের ছায়াতলে আশ্রয় নিতে লাগল। চট্টগ্রামকে বার আউলিয়ার দেশ বলা হয়। ১৩৫৩-১৬৬৬ সালকে চট্টগ্রামের ইতিহাসে বার আউলিয়ার যুগ বলা হয়। যদিও বার আউলিয়া বলা হয়, এ অঞ্চলে অলীগণের সংখ্যা অনেক। চট্টগ্রামে দু’টি বার আউলিয়ার দরগাহ পরিলক্ষিত হয়। একটি ঢাকা-চট্টগ্রাম ট্রাক রোডে, অপরটি আরাকান সড়কে পদুয়াতে। কুমিরায় একটি বার আউলিয়ার গ্রাম আছে। যেখানে পাশাপাশি বারটি সমাধিও দেখা যায়।
ড. আব্দুল করীম পটিয়া থেকে উদ্ধারকৃত ও চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ে সংরক্ষিত ৪৪পৃষ্টা ব্যাপী একটি আরবী পান্ডুলিপির কথা তার বইতে উল্লেখ করেছেন। কিন্তু সেখানকার নামগুলো খুবই অগোছালো। সূঘছড়ীর মাওলানা ইসমাইল কাদেরী (মৃত্যু ১৯২৫) তার কবিতা গ্রন্থ ‘গুলশানে ফরজে আবাদী’তে বারজন অলীর নামোল্লেখ করেছেন। কবি মুহাম্মদ খান তার পুথি সাহিত্যে তাঁর মাতৃকূল পিতৃকূলের পরিচয়ে বারজন আউলিয়ার বিবরণ দিয়েছেন। তাঁর মতে কদল খান গাজী ১১জন মিত্র নিয়ে ইসলাম প্রচার করেন। মোঘল ঐতিহাসিক শাহাবুদ্দীন তালিশ তাঁর গ্রন্থ ‘ফতিয়ায়ে ইব্রিয়া’তে অনুরূপ মত প্রকাশ করেছেন। আউলিয়াগণ এ অঞ্চলে ইসলাম প্রচারে যথেষ্ট অবদান রেখেছেন। বস্তুত তাঁদের মাধ্যমে এ অঞ্চল আবাদ হয়েছে। ড. শিহাবুল হুদা ‘চট্টগ্রামের দরবেশ ও দরগাহ’ শিরোনামে পি.এইচ.ডি অভিসন্দর্ভ রচনা করেছেন। যাতে চট্টগ্রামের আউলিয়াদের বিস্তারিত বিবরণ এসেছে, ইহা একটি মৌলিক দলিল। চট্টগ্রামে ভৌগলিক অবস্থান ইসলাম প্রচারের জন্য খুবই সহায়ক ছিল। যাতায়াতের দুর্গমিতার কারণে বিজেতাদের আসতে বিলম্ব হলেও সমুদ্র ও পাহাড় বেষ্টিত অত্যন্ত মনোরম এই ভূখন্ডটি দ্বীনের মুবাল্লিগদের জন্য খুবই সহায়ক ছিল। ইতিহাস স্বাক্ষ্য দেয় যে, বনাঞ্চল আবৃত এই ভূখন্ডটি আওলিয়াদের তথা মুজাহিদদের মাধ্যমেই আবাদ হয়। পরবর্তীতে বিজেতাগণ বিজয়ী বেশে আসলে অলীগণ প্রথমত বিজয়ে তাদের সহায়তা করেন এবং বিজয় পরবর্তী নির্বিঘে দ্বীনের প্রচার ও প্রতিষ্ঠানাদি গড়ে তোলার কাজ করতেন। এ পর্যায়ে কতিপয় প্রসিদ্ধ “অলী” সম্পর্কে সংক্ষেপে আলোচনার আশা রাখিঃ
১. ইনসাইক্লোপেডিয়া অব ইসলামসহ আরো কতিপয় গবেষক ইরানের বিস্তাম শহরের বায়েজীদের চট্টগ্রামে আগমনের কথা উল্লেখ করলেও এর স্বপক্ষে কোন অকাট্য যুক্তি দাড় করাতে ব্যর্থ হয়েছেন।
২. বদর শাহ : চট্টগ্রামের সর্বাধিক আলোচিত অলি হচ্ছেন বদর উদ্দীন বদরে আলম। মিরাটে তাঁর জন্ম।তিনি সিলেটের হযরত শাহজালালের অনুসংগী ছিলেন। সেখানে তরফের রাজা অচেক নারায়নের বিরুদ্ধে যুদ্ধে অংশগ্রহণ করেন। হাজী খলীলকে সঙ্গে নিয়ে চট্টগ্রামে এসে ইসলাম প্রচার করেন। তিনি ১৪৪০ সালে ইন্তেকাল করেন। শাহাবুদ্দীন তালিশ উল্লেখ করেছেন যে, তিনি ১৩৪০ সালে চট্টগ্রামে আসেন। প্রখ্যাত মূর পর্যটক ইবনে বতুতা ১৩৪৬/৪৭ সালে চট্টগ্রামে আসেন। তিনিও তার সফরনামায় বদরের উল্লেখ করেন। চট্টগ্রাম, বিহার, আরাকানসহ বিভিন্ন স্থানে বদরের মোকাম থাকায় আসলে তিনি কোথায় সমাহিত তা নিয়ে মত পার্থক্য সৃষ্টি হয়েছে। বেঙ্গল গেজিটিয়ার ও ড. করীসসহ চট্টগ্রামের গবেষকদের ধারণা তিনি চট্টগ্রামেই সমাহিত। কেননা এ দরগাহের নির্মাণশৈলী সুলতানী আমলের। আরবী তুখরা অক্ষরে লিখা একটি শিলালিপি আছে। চাঁটি জ্বালিয়ে তাঁর জ্বীন-পরী তাড়ানো এবং চেরাগী পাহাড় আবাদ ইত্যাদি চমকপ্রদ অনেক জনশ্রুতি আছে, কিন্তু এর ঐতিহাসিক সত্যতা নিরুপণ করা খুবই দুস্কর। কেননা তিনি যে সময়ে চট্টগ্রামে আসেন তখন চট্টগ্রাম এত অনাবাদী থাকার কথা নয়।
৩. মোহছেন আউলিয়া : আনোয়ারায় সমাহিত। তিনি বদর শাহের ভাগ্নে ছিলেন।
৪. মোল্লা মিছকীন : ১৫৬১ সালে ইন্তেকাল করেন। পিতার নাম শায়খ ছারদু মোগলী, সিপাহদারপুর আদি নিবাস। তিনি বিয়ে শাদি করেননি। মহসিন কলেজের দক্ষিণ পাশে পাহাড়ের উপর তাঁর মাজার।
৫. শাহ সূফী আমানত খান : বিহারের অধিবাসী, ১৭৮০/১৭৯৩ সালে চট্টগ্রামে আসেন। জর্জকোর্টে পাখা টানার চাকুরি নেন। ১৮৪৪ সালের পূর্বেই ইন্তেকাল করেন।
৬. শাহ গরীবুল্লাহ : প্রকৃত নাম রূহুল্লাহ।সম্রাট শাহজাহানের পুত্র দারাশিকোহর ভৃত্য ছিলেন। ভাতৃ সংঘাতে দারা পরাজিত ও বন্দী হলে, তাঁর মালিকের দুর্দশা দেখে তার মন বিগলিত হয়, ফলে সরকারী চাকুরী হতে ইস্তেফা দিয়ে চট্টগ্রামে এসে নাসিরাবাদে খানকাহ প্রতিষ্ঠা করে দ্বীনের কাজ চালিয়ে যান। এখানে চট্টগ্রাম শহরে অবস্থিত চট্টগ্রামের কতিপয় অভিভাবক দরবেশের সংক্ষিপ্ত ফিরিস্তি দিলাম। অথচ চট্টগ্রামের প্রতিটি এলাকায় এরকম হাজারো দরবেশ শুয়ে আছেন যারা দ্বীন প্রচারের জন্য এদেশে এসেছিলেন।
৭. মুসলমানদের চট্টগ্রাম বিজয় : বখতিয়ার খিলজীর বঙ্গ বিজয়ের ১৫০ বছর পর সোনারগাঁওয়ের স্বাধীন সুলতান ফখরুদ্দীন মুবারক শাহের (১৩৩৮-১৩৪৯) সেনাপতি কদল খান গাজী উত্তর চট্টগ্রাম মুসলিম শাসনাধীনে নিয়ে আসেন।
৮. ১৩৫৩ সালে চট্টগ্রাম ইলিয়াছ শাহের অধীনে চলে যায়। এ বংশের সুলতান গিয়াসুদ্দীন আজম শাহ (১৩৮৯-১৪১০) চীন সম্রাটের সাথে কুটনৈতিক সম্পর্ক করেন।
৯. এ সময়ে কয়েকটি চীনা মিশন চট্টগ্রামের ভেতর দিয়ে বাংলায় প্রবেশ করে এবং বাংলার প্রধান বন্দর হিসেবে চট্টগ্রামের আত্মপ্রকাশ ঘটে। সুলতান রুকনুদ্দীন বরবক শাহের সেনাপতি রাস্তি খান হাট হাজারী যোবরা গ্রামে একটি মসজিদ নির্মাণ করেন। পরাগল খান ও তৎপুত্র নসরত খান সুলতান হোসেন শাহের পক্ষে চট্টগ্রামের থানাধার ছিলেন। মীরসরাই থানার পরাগলপুর ও পরাগল খানের বিরাট দিঘী ও মসজিদের ধ্বংসাবশেষ এখনো বিদ্যমান।
১০. হাবশীদের অত্যাচারে এক পর্যায়ে চট্টগ্রামে মুসলিম শাসন সংকোচিত হয়। কেবলমাত্র তা উত্তর চট্টগ্রামে সীমাদ্ধ ছিল। দক্ষিণ চট্টগ্রাম আরাকান রাজ্যের অধীনে চলে যায়। নসরত খান ত্রিপুরার কবল হতে চট্টগ্রামকে মুক্ত করতে সক্ষম হন এবং চট্টগ্রাম শহরের ৮ মাইল দূরে ফতেয়াবাদ রাজধানী স্থাপন করেন। সেখানে তার নামে নসরত শাহদিঘী (বড় দিঘী) এখনো তার স্মৃতি বহন করছে।
১১. গৌড়ে হোসেন শাহের রাজত্বকালে (১৪১৩-১৭) ত্রিপুরায় রাজা ধর্ম মানিক্যের সাথে তুমুল যুদ্ধ হয়। ত্রিপুরা রাজ তার রাজ্যসীমা আরাকানের অভ্যন্তর পর্যন্ত নিয়ে যান। ধর্ম মানিক্যের মৃত্যুর পর সমগ্র চট্টগ্রাম এবং আরাকানের উত্তরাংশে হোসেন শাহীর কর্তৃত্ব সু-প্রতিষ্ঠিত হয়। তখন পরাগল খান, আমির্জা খান প্রমুখ চট্টগ্রামের শাসক ছিলেন।
১২. ১৫২২ সালে মহারাজদেব মানিক্য পুনরায় চট্টগ্রাম দখল করেন। আরাকানিরা এত তাড়াতাড়ি পালালো যে, তারা তাদের অর্থ-সম্পদ নিয়ে যেতে পারেনি, ঐ সকল স্থানে কিছু কিছু চিহ্ন রেখে যায়। পরে যখনই সুযোগ আসতো তারা এসে তা খনন করে নিয়ে যেতো। বর্তমানেও অনেক লোভাতুর মানুষকে তাদের রেখে যাওয়া গুপ্তধন খুঁজতে দেখা যায় এবং এদের প্রতারণার ফাঁদে অনেকে সর্বশান্ত হয়ে যায়। ত্রিপুরা রাজ দু’বছরও অধিকার অক্ষুন্ন রাখতে পারেনি। সুলতান নসরত শাহ (১৫১৯-৩৩) ১৫২৪ খ্রিস্টাব্দে সমগ্র চট্টগ্রাম দখল করে নেন। তিনি চট্টগ্রামের নাম রাখেন ফতেয়াবাদ। ১৫১৭ সালে চট্টগ্রামে পর্তুগীজদের আগমন ঘটে। ১৫৩৮ সালে শের শাহের সেনাপতি কর্তৃক চট্টগ্রাম বিজয় হয়। ১৫৩৮-৮০ পর্যন্ত চট্টগ্রামে আরাকানীদের শাসন চলে। কিন্তু এ শাসন কোন ক্রমেই অনুক্রমিক ছিল না। চট্টগ্রামে মুসলমানদের প্রধান প্রতিদ্বন্দী ছিল ত্রিপুরা রাজ ও আরাকান রাজ। এক পর্যায়ে চট্টগ্রামের দখল নিয়ে ত্রিপুরা রাজ ও আরাকান রাজের মধ্যে রক্তক্ষয়ী সংঘর্ষ হলে ত্রিপুরা রাজ চিরদিনের জন্য চট্টগ্রাম হতে বিতাড়িত হন এবং ১৫৮১-১৬৬৬ সাল পর্যন্ত এখানে আরাকানী শাসন চলে। মোগলগণ বাংলায় শাসন ক্ষমতা আয়ত্বে রাখলেও বার বার চট্টগ্রাম দখলের চেষ্টা করে ব্যর্থ হন। পরিশেষে ভ্রাতৃসংঘাতে পরাজিত শাহ সূজা আওরঙ্গজেবের সেনাপতি মীর জুমলার তাড়া খেয়ে আরাকানে আশ্রয় নিলে আরাকান রাজ বিশ্বাসঘাতকতা করে শাহ সূজাকে সপরিবারে হত্যা করে। ভ্রাতৃশোকার্ত মর্মাহত আওরঙ্গজেব ভ্রাতৃহত্যার প্রতিশোধ নেয়ার জন্য ঢাকার মোঘল সুবেদার শায়েস্তা খাঁকে নির্দেশ দেন। সম্রাটের নির্দেশে শায়েস্তা খান স্বীয় পুত্র বুজর্গ উমেদ খানকে ১৬৬৬ খ্রিস্টাব্দে নৌ সেনাসহ আরাকানীদের বিরুদ্ধে প্রেরণ করেন। উমেদ খান আরাকানী ও পর্তুগীজদের দ্বন্দের সুযোগে কৌশলে পর্তুগীজদের দলে ভিড়িয়ে তাঁর নৌশক্তি বৃদ্ধি ঘটান এবং উমেদ খানের নৌ সেনাধ্যক্ষ ইবনে হুসাইন কর্ণফুলী নদীর মোহনায় আরাকানীদের উপর তীব্র আক্রমণ চালিয়ে বিধ্বস্ত করে দেন এবং মোগলদের হাতে আরাকানীদের বিখ্যাত চাঁটিগাঁ দূর্গের (আন্দরকিল্লা) পতন ঘটে। এইভাবে চট্টগ্রামে মোগল আধিপত্য প্রতিষ্ঠিত হয় এবং সম্রাটের নির্দেশে চট্টগ্রামের নাম রাখলেন ইসলামাবাদ যা ১৭৬১ খ্রিস্টাব্দে ১৫ ফেব্রুয়ারি মীর কাসিম কর্তৃক চট্টগ্রাম ইংরেজদের হাতে তুলে দেয়া পর্যন্ত অব্যহত ছিল। ১৬৬৬-১৭১০ খ্রিস্টাব্দ পর্যন্ত প্রধানতঃ হাজারী মনসবদারদের হাতেই চট্টগ্রামের ফৌজদার নিযুক্ত হতেন। কিন্তু ১৭১০ খ্রিস্টাব্দ হতে ফৌজদারদের পরিবর্তে নায়েবরাই চট্টগ্রাম শাসন করতেন। এর পর আরাকানীরা কয়েকবার চট্টগ্রাম উদ্ধারের চেষ্টা করে ব্যর্থ হয়।
তথ্যসূত্র :
১। সৈয়দ সুলাইমান নদভী : আরবৌঁ কি জাহাজরানী, পৃ.১৩৫-৩৮
২। ইবনে খুরদাদবিহ : কিতাবুল মাসালিক ওয়াল মামালিক, পৃ.১৬৫
৩। সুলাইমান ইবনে আহমদ : সিলসিলাতুত তাওয়ারিখ, পৃ.৭৫
৪। মাওলানা আব্দুল্লাহিল কাফী : মাসিক তরজুমানুল কুরআন।
৫। এ.কে.এম মুহিউদ্দীন : চট্টগ্রামে ইসলাম, পৃ.২৭-২৮
৬। হামীদুল্লাহ খান : তারীখ-ই-হামীদ-১৮৫৩, কলকাতা
৭। ড. আব্দুল করীম : চট্টগ্রামে ইসলামী ঐতিহ্য
৮। ওহিদুল আলম : চট্টগ্রামের ইতিহাস, পৃ.২৪।
৯।অধ্যাপক খালেদ সম্পাদিত : হাজার বছরের চট্টগ্রাম, পৃ.২৪।
১০।ড. আব্দুল করীম : চট্টগ্রামে ইসলাম, পৃ.৩৬।
১১। ওহিদুল আলম: প্রাগুক্ত, পৃ.২৮। সুখময় মুখপধ্যায় : বাংলার ইতিহাসের দু’শো বছর, পৃ.৮
১২। মাহবুবুল আলম : চট্টগ্রামের ইতিহাস পুরানো আমল, পৃ.৮৭-৮৯
বিভাগের সম্পাদক
এবি/টিআর