মুহাম্মদ মফিজ উদ্দিন

মাইজভান্ডারী তরিকার প্রবতর্ক হজরত গাউসুল আজম মাইজভান্ডারী (কঃ) যুগে যুগে মানব গোষ্ঠীকে হেদায়েতের বাণী পৌঁছে দিতে কামেল প্রতিনিধি নিযুক্ত করে দেশ বিদেশে তাসাউফের কারখানা বানিয়েছেন, এ ধারাবাহিকতায় ভারতের ” আলিগড় জামেউল উলুম আলিয়া মাদরাসা” র সুপ্রসিদ্ধ মুহাদ্দিস আল্লামা শাহসুফি শেখ অছিয়র রহমান চরণদ্বীপি (কঃ) হযরত গাউসুল আজম মাইজভান্ডারী (কঃ) বেলায়তের বাগানের প্রথম ও প্রধান।
মাইজভান্ডারী তরিকার জ্যোতির্ময় মহাপুরুষ বায়াত হওয়ার পর থেকে কুতুবুল আকতাব হযরত মাওলানা শাহসূফী শেখ অছিয়র রহমান ফারুকী চরণদ্বীপি (ক.) (প্রকাশ-মৌলানা আকদছ শাহ চরণদ্বীপি) আধ্যাত্মিক সাধনায় আত্মনিয়োগ করেন। তিনি প্রায় সময় তদীয় পীর হযরত আকদছ কেবলার (ক.) খেদমতে হাজির হইতেন। অবসর সময় মসজিদে, অলি দরবেশগনের মাজার শরীফে গমন করিতেন। পোমরা গ্রামের খাঁর মসজিদ, হাটহাজারী খোসালা মসজিদ, অলি খাঁর মসজিদ, আন্দরকিল্লা জামে মসজিদ ইত্যাদিতে গমন করতেন। এই সময় দৈনিক এক খতম কোরান শরীফ পাঠ করতেন। রাতে চল্লিশ রাকাত নফল ও তাহাজ্জুদ নামায পড়তেন। সর্বদা রোযা রাখতেন, খুব অল্প সময় নিদ্রা যেতেন। কিন্তু বিছানায় পৃষ্ঠ বা পার্শ্ব লাগায় শুতেন না। উপবেশন অবস্থায় হাঁটুর উপর মাথা রেখে বা দেওয়ালে ঠেশ দিয়া শুতেন। এই রূপে সংসারের প্রতি অনাসক্তি ও কঠোর রেয়াজত দিন দিন বর্ধিত হতে দেখে তাঁহার আব্বাজান বিশেষ চিন্তিত হইয়া পড়েন এবং তাঁহাকে বলেন, বাবা তুমি রাত-দিন এত মেহনত করতেছ, তদ্বারা তোমার স্বাস্থ্যের ক্ষতি হওয়ার আশংকা করতেছি। মাইজভান্ডারী ছাহেব তোমাকে পাগল বানাইছে। তুমি তথায় আসা-যাওয়া বন্ধ কর, তা হা হলে স্বাস্থ্যের উন্নতি হইবে। সংসার ধর্ম পালন কর, অর্থাৎ উপার্জনের চেষ্টা কর। তোমার মঙ্গল হইবে।

মৌলানা আকদছ (ক.) তাঁহার আব্বাজানকে প্রতুত্তরে বলেন, “মাইজভাণ্ডারী ছাহেব আমাকে বাদশা বানাইতে চান্! আর আপনি চান তালুকদার জমিদার বানাতে। তিনি আমাদিগকে বেহেস্তের (মেওয়া) নেয়ামত খাওয়াতে চান। আর আপনি চান পিয়াজ, রসুন ও শাকসব্জী খাওয়াতে। তিনি চান আমাকে আল্লাহর পরোয়ানা বানাতে। আপনি চান সে আগুন হইতে বাঁচাইতে। আব্বাজান আমাকে বাঁচাইবার বৃথা চেষ্টা করবেন না। আমাকে ক্ষমা করুন, আমি পাগল আগুনে পুড়িয়া মরতেছি, মরিব! সেই আগুনে পোড়ার জন্যই আমার বাঁচা। বেচে থাকির জন্য নয়। অতএব, সে আগুনে জ্বলিয়া পুড়িয়া দগ্ধ না হইলে আমার জনম-জীবন বৃথা যাবে। আমার পীর হযরত গাউছে পাক মাইজভাণ্ডারী কেবলার ঐ তীক্ষ্ণ দৃষ্টি আমার অন্তরের অন্তঃস্থল ভেদ করেছে। আমি তাঁহার প্রেম সাগরে ডুব দিয়া তাঁহার মধ্যে হারিয়া গেছি।” তখন তিনি হাফিজের বয়াত আবৃত্তি করেন-

‘কছ্‌ব দাওরে নরগাস্ত তরফে নিস্ত আজ আফিয়াত
বেহক্কে বোফরুশন্দ মস্তরী বমস্থানে সামা।’

অর্থাৎ- ‘ওগো ঔ চাহনীতে বিশ্ব মজেছে ঝরিয়াছে কত অশ্রুধার।
মোরে পাগল করিয়াছে ঐ মত্ত আঁখি, কুল মান রাখা হইল ভার।’

জনাব মৌলানা আকদছ শাহ চরণদ্বীপি (ক.) এর কঠোর রেয়াজত দিন দিন বর্ধিত হইতে লাগিল। তিনি স্বীয় পীরের খেদমতে উপস্থিতির পর হইতে তাঁহার আর এক রকম ‘হাল’ হল। তিনি হযরত কেবলার কাছে না গিয়ে, দূর হইতে তাঁহার দিকে চেয়ে থাকতেন। হযরত কেবলা হুজরা শরীফে থাকিলে তিনি বাহিরের উঠানে দাঁড়িয়ে তাঁহার দিকে চেয়ে থাকতেন। তখন হতে তাঁহার কঠোর রেয়াজত ও মহব্বত আরও বৃদ্ধি পাইল। হাফিজ (রা.) যথার্থ বলিয়াছেন-

‘আয়না তোমার আত্মার গো তরল তোমার ঐ লাবণি
সাধ জাগে ঐ ধ্যানের চরণ, করি আমার নয়ন মণি।’
পুনঃ- ‘না না আমার ভয় করে গো, নয়ন পাতার কাঁটায় পাছে-
কোমল পায়ে বাজে ব্যথা ধ্যানে থাক সারাক্ষণই।’

জনাব মৌলানা আকদছ শাহ চরণদ্বীপি (ক.) কোন কোন সময় ৫/৭ দিন পর্যন্ত অনাহারে থেকে উপবেশন বা দন্ডায়মান অবস্থায় (বরজখ) ‘ধ্যানমগ্ন’ থাকতেন। শীতকালে শীতে তাঁহার শরীর বরফের ন্যায় ঠান্ডা হয়ে যেত। তিনি সর্বদা যথাসম্ভব চক্ষের পলক পরিবর্তন না করে ফ্যাল ফ্যাল দৃষ্টিতে হযরত আকদছের (ক.) দিকে চেয়ে থাকতেন। তখন তাঁহাকে দেখলে জীবন হীন জড় পদার্থের ন্যায় বোধ হত। তাঁহার পটলচেরা পলকহীন চক্ষুদ্বয়ের করুণ দৃষ্টি হযরত আকদছ (ক.) এর চেহারা মোবারকের উপর ন্যস্ত করতে অনর্গল অশ্রু বর্ষণ করতেন। চোখের জলে বক্ষস্থল ভেসে যেত। সেই হৃদয় বিদারক নীরব-রোদন দৃশ্য দেখলে নিতান্ত পাষাণ হৃদয়ও বিগলিত হত।

হযরত আকদছ (ক.) এর আদেশ অনুযায়ী হাটহাজারী খোসালা মসজিদ ও পোমরা খাঁর মসজিদে গিয়া ধ্যানমগ্ন অবস্থায় থাকতেন। উভয় মসজিদে ফজর, মাগরিব ও এশার ওয়াক্তের আজান হত না। সন্ধ্যা হতে সারা রাত্রি তথায় লোক যাতায়াত করত না, অদৃশ্য হতে ঢিলা পাথর নিক্ষেপ করত ইত্যাদি ভয়ভীতির দরুণ লোক যাতায়াত সম্ভবপর ছিল না। অতঃপর মৌলানায়ে আকদছ (ক.) মসজিদদ্বয়ে বহুদিন ধ্যানে মগ্ন ছিলেন। তাঁহার শুভাগমন কল্যাণে এখন তাহা ভয়ভীতি শূন্য আবাদ মসজিদ রূপে প্রসিদ্ধি লাভ করেছে।
চট্টগ্রাম শহরে আন্দরকিল্লা জামে মসজিদ, অলি খাঁর মসজিদ, বার আউলিয়ার আস্তানা, সোলতান বায়েজিদ বোস্তামী (রা.) এর দরগাহ ইত্যাদি পবিত্র স্থানে অনেক সময় মোরাকাবা (ধ্যানমগ্নতা) অবস্থায় আবার কোন কোন সময় জজ্‌বাতি অবস্থায় অতিবাহিত করতেন। কথিত আছে, সোলতান বায়েজিদ বোস্তামী (রা.) দরগাহের সামনে মৌলানা আকদছ (ক.) সাতদিন পর্যন্ত অনাহারে-অনিদ্রায় ছিলেন। তিনদিন পর্যন্ত প্রবল বৃষ্টিপাতের সময়ও তাঁহার ধ্যানমগ্নতার বিঘ্ন ঘটে নাই। বার আউলিয়ার আস্তানায় ৭দিন পর্যন্ত দাঁড়ানো অবস্থায় অনাহার-অনিদ্রায় কাটাইয়াছেন। আবার পাহাড় জঙ্গলে আউলিয়াগণের খানকা চিল্লায় ইত্যাদি পবিত্র স্থানে সর্বদা ভ্রমণ করতেন। নিজের শরীরের দিকে দৃষ্টিপাত করতেন না। চর্ম জর্জরিত হইয়া শোণিত বিন্দু গড়াইয়া পড়িত, অথচ তাঁহার কোন খেয়ালই ছিল না। আবার সময় সময় তাঁহার পীর হযরত কেবলার (ক.) খেদমতে উপস্থিত হইয়া অনর্গল অশ্রু বর্ষণ করতেন। আবার কোন কোন সময় বেখুদীর হালে হযরত কেবলার (ক.) মোবারক পা দুইখানা এমনভাবে জড়িয়ে ধরতেন যে তাহাতে তিনি অস্থির হয়ে পড়তেন। বহু চেষ্টার পর তাঁহার বাহুপাশ হতে হযরত কেবলার (ক.) চরণযুগল মুক্ত করতে হত। এইভাবে হযরত আকদছ (ক.) এর খেদমতে অনেক দিন গত হইলে মৌলানা আকদছ (ক.) এর বড় ভ্রাতা শাহসুফি আলীম উল্লাহ (রঃ) হযরত কেবলার খেদমতে হাজির হয়ে মৌলানা আকদছ (ক.) এর কঠোর রেয়াজত ও জজবাতি অবস্থা পরিবর্তনের জন্য আরজ করলেন। তদুত্তরে হযরত আকদছ গাউসুল আজম মৌলানা শাহসুফি সৈয়দ আহমদ উল্লাহ মাইজভাণ্ডারী (ক.) বলেন-

“মিঞা! আমার এই ছেলেটি আমার বাগানের গোলে গোলাপ, তৌহিদ পতাকাধারী রহমানীয়া শানে বিরাজমান। তাঁহার প্রেম পিপাসা এত প্রবল হইয়াছে যে, তাঁহাকে সোরাহি সোরাহি সরাব পান করাইতেছি তবুও তৃপ্ত হয় না, সরাবের পাত্রশুদ্ধ খাইতে চায়। আপনি আমার ছেলেটির জন্য চিন্তা করিবেন না।”

মৌলানায়ে আকদছ শাহ চরণদ্বীপি (ক.) কে সময় সময় হযরত কেবলার নিকট হইতে দূরে সরাইয়া রাখতেন। আবার সময় সময় হযরত কেবলার নিকটেই অবস্থান করিতেন। এইরূপে তিন বৎসর কাল কঠোর রেয়াজতের পর আল্লাহ তা’আলার করুণা সিন্ধু উথলিয়া উঠল। আশেকে ছাদেকের প্রতি কৃপাদৃষ্টি নিপতিত হল। তিনি হযরত গাউসুল আজম মাওলানা শাহসুফি সৈয়দ আহমদ উল্লাহ (ক.) মাইজভাণ্ডারী কর্তৃক বেশারতপ্রাপ্ত হয়ে নবজীবন লাভ করলেন। তাওয়াজ্জোয়ে এত্তেহাদীর বদৌলতে পীরের গুণবিশিষ্ট রূহের যাবতীয় আধ্যাত্মিক শক্তি তাঁহার (রূহে) আত্মায় সঞ্চারিত হল। হযরত গাউসুল আজম মাইজভাণ্ডারী (ক.) এর মোবারক চাদরখানা তাঁহার নিজ দাস্ত মোবারকে ১৩০০ হিজরী সনে মৌলানা আকদছ শাহ চরণদ্বীপি (ক.) এর আপাদমস্তকে পরিয়ে দিয়ে তাঁহার প্রিয়তম প্রধান ও প্রথম খলিফার পদে অভিষিক্ত করলেন।

আগামী ১২ ভাদ্র, ২৭ আগস্ট বাবাজান কেবলা চরণদ্বীপির (ক.) শততম বেছাল বার্ষিকী উরস শরিফ ঐতিহ্যবাহী চরণদ্বীপ দরবার শরীফে অনুষ্ঠিত হবে। আল্লাহ, মহান এই আউলিয়ার অশেষ ফয়ুজাত আমাদের সবাইকে নসীব করুন।

Print Friendly, PDF & Email

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here