May be an image of map and text that says 'ADAM'

ইসলাম ধর্ম অনুযায়ী আল্লাহর সৃষ্ট প্রথম মানব হলেন আদম (আ:)।পবিত্র কুরআনের বর্ণিত রয়েছে আল্লাহ বলেন,”নিশ্চয়ই আমি তাকে মাটি থেকে সৃষ্টি করেছি, তারপর তার দেহে প্রাণ সঞ্চার করেছি”। আদম (আ:) এর পাঁজর থেকে সৃষ্টি করা হয় হাওয়া (আ:) কে। সৃষ্টির পর তাদের আবাস হয় বেহেশত বা জান্নাতে । মানুষ যেহেতু সকল সৃষ্টির সেরা তাই আদমকে সিজদা করার জন্য ফেরেশতাকুল কে আল্লাহ আদেশ দেন। আল্লাহর এই আদেশ সকল ফেরেশতাকুল প্রতিপালন করেন কিন্তু ইবলিশ তা অমান্য করেন। ফলে আল্লাহ ইবলিশকে জান্নাত থেকে বের করে শয়তান বানিয়ে দেন।

আবূ হূরায়রা থেকে বর্ণিত যে, হযরত মুহাম্মদ (সা:) বলেন, যখন আল্লাহ আদমকে সৃষ্টি করেছিলেন তখন তার উচ্চতা ছিল ৬০ কিউবিট বা হাত এবং বেহেশতে প্রবেশকালে আদম (আ:) এর আকার লাভ করবে মানুষ জাতি।

সৃষ্টির পর আদম (আ:) ও হাওয়ার (আ:) অবস্থান ছিল জান্নাতে। তাদের জন্য সেখানে এক ধরনের বিশেষ ফল(গন্দম) খাওয়া নিষিদ্ধ ছিল। আদম এবং হাওয়া উভয়ই শয়তানের প্রোচনায় এসে গন্দম ফল খেয়ে ফেলেন।

এটি মানুষের আদিপাপ বলে পরিগণিত হয়। মহান আল্লাহ এর শাস্তি স্বরূপ তাদেরকে বেহেশ্ত থেকে বিতাড়িত করেন এবং পৃথিবীতে পাঠিয়ে দেন। আদম (আ:)পৃথিবীতে শত শত বছর আল্লাহর কাছে তওবা করেন তাদের ভুলের জন্য। পবিত্র কুরআনে আছে, আদম আল্লাহর কাছে এই দোয়া করতেন

“রাব্বানা যালামনা আনফুসানা ওয়া ইল্লাম তাগফিরলানা ওয়া তারহামনা লানা কূনান্না মিনাল খাসেরীন”

অর্থাৎ”আল্লাহ ভুল করেছি,গুনা করেছি,অপরাধ করেছি তুমি যদি মাফ না করো মাফ করার কেহ নাই”

এই দোয়া করে তিনি চোখের পানি ফেলে ফেলে আল্লাহর কাছে তওবা করতেন। মহান আল্লাহ তাআলা আদম কে ক্ষমা করে দেন।

আদম (আ:) এবং হাওয়া (আ:) অবতরণ করেন পৃথিবীর ভিন্ন দুটি স্থানে। আদম অবতরণ করেন সিংহলে আর হাওয়া অবতরণ করেন হিজাযে। আরবের আরাফাত নামক প্রান্তরে দীর্ঘদিন পর পুনর্মিলন হয় তাদের। আল্লাহর তরফ থেকে পৃথিবীতে আগমনের পর আদম (আ:) ও হাওয়া (আ:)কে কাবাগৃহ নির্মাণের আদেশ প্রদান করা হয়। ক্বাবা নির্মিত হয়ে গেলে তাদেরকে তা তাওয়াফ করার আদেশ দেয়া হয়। আদমের নিঃসঙ্গতা দূরীকরণের জন্য হাওয়াকে সৃষ্টি করা হয় তার বাম পাঁজরের হাড় থেকে। হাওয়া ছিলেন তার স্ত্রী। পৃথিবীতে আগমনের পর ১৪০ জোড়া সন্তান হয় তাদের। ইসলামের ইতিহাসে , ইসলামের শিক্ষায় , ইসলামী জীবনীতে আমার হযরত আদম (আ:) সম্পর্কে আরো অনেক কিছুই জানার আছে।

May be an image of text

হজরত দাউদ (আ) এর জীবনী

আল্লাহর নবী হজরত দাউদ (সা) বনি ইসরাইল সম্প্রদায় থেকে নবী হিসেবে দুনিয়ায় আগমণ করেন। তাঁর পিতার নাম ইশা। হজরত দাউদ (আ) খুব সাহসী ও নির্ভিক ছিলেন। তিনি বীরত্বের জন্য সবার শ্রদ্ধার পাত্রে পরিণত হন। আল্লাহ তাঁকে নবীর মর্যাদার পাশাপাশি রাজার সম্মানও দান করেন। তিনি ইরাক, ফিলিস্তিন, সিরিয়া, জর্দান ও হিজাজ শাসন করেন। দাউদ (আ) ‘জবুর’ কিতাব লাভ করেছিলেন।

আল্লাহ তাঁকে অনেক অলৌকিক ক্ষমতা দান করেন। তাঁর কণ্ঠস্বর ছিল অত্যন্ত সুমিষ্ঠ। তিনি মধুর সুরে জবুর কিতাব তেলাওয়াত করলে পশু-পাখি, এমনকি পাহাড়-পর্বতও আল্লাহর প্রশংসায় মেতে উঠতো। আল্লাহর সাহায্যে তিনি গুলতি দিয়ে তখনকার অত্যাচারী শাসক জালুতকে হত্যা করেন এবং বনি ইসরাইল সম্প্রদায়কে জুলুমের হাত থেকে রক্ষা করেন। তাঁর জীবনের আরো অনেক চমকপ্রদ ও শিক্ষণীয় ঘটনা।

মহান আল্লাহ হযরত দাউদ আলাইহিস সালামের প্রতি যে অসংখ্য অনুগ্রহ বর্ষণ করেছিলেন সেদিকে ইংগিত করা হয়েছে। তিনি ছিলেন বাইতুল লাহমের ইয়াহুদা গোত্রের একজন সাধারণ যুবক। ফিলিস্তিনীদের বিরুদ্ধে একটি যুদ্ধের জালুতের মতো এক বিশাল দেহী ভয়ংকর শত্রুকে হত্যা করে তিনি রাতারাতি বনী ইরাঈলের নয়নমণিতে পরিণত হন। এ ঘটনা থেকেই তার উত্থান শুরু হয়।

এমনকি তালুতের ইন্তিকালের পরে প্রথমে তাকে ‘হাবরূনে’ (বর্তমান আল খালীল) ইয়াহুদিয়ার শাসনকর্তা করা হয়। এর কয়েক বছর পর সকল বনী ইসরাঈল গোত্র সর্বসম্মতভাবে তাকে নিজেদের বাদশাহ নির্বাচিত করে এবং তিনি জেরুসালেম জয় করে ইসরাঈলী রাজ্যের রাজধানীতে পরিণত করেন। তারই নেতৃত্বে ইতিহাসে প্রথমবার এমন একটি আল্লাহর অনুগত রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠিত হয় যার সীমানা আকাবা উপসাগর থেকে ফোরাত নদীর পশ্চিম উপকূল পর্যন্ত বিস্তৃত ছিল। এসব অনুগ্রহের সাথে সাথে আল্লাহ তাকে আরো দান করেন জ্ঞান, প্রজ্ঞা, বুদ্ধিমত্তা, ইনসাফ, ন্যায়নিষ্ঠা, আল্লাহভীতি, আল্লাহর বন্দেগীও তার প্রতি আনুগত্যশীলতা।

দাউদ আলাইহিস সালামের জন্য নয় বরং “তার সাথে” পাহাড় ও পাখীদেরকে অনুগত করা হয়েছিল এবং সে কারণে তারাও হযরত দাউদের (আ) সাথে আল্লাহর মহিমা ঘোষণা করতো। একথাটিই সূরা সাদ-এ বলা হয়েছেঃ “আমি তার সাথে পাহাড়গুলোকে অনুগত করে দিয়েছিলাম। সকাল-সাঁজে তারা আল্লাহর পবিত্রতা ও মহিমা ঘোষণা করতো। আর পাখিদেরকেও অনুগত করা হয়েছিল। তারা একত্র হতো, সবাই তাঁর পবিত্রতা ও মহিমা ঘোষণার পুনরাবৃত্তি করতো”।

সূরা সাবায় এর ওপর অতিরিক্ত বলা হয়েছে: ()”পাহাড়গুলোকে আমি হুকুম দিয়েছিলাম যে, তার সাথে সাথে পবিত্রতা ও মহিমা ঘোষণার পুনরাবৃত্তি করো এবং এই একই হুকুম পাখিদেরকেও দিয়েছিলাম। এ বক্তব্যগুলো থেকে যেকথা বুঝা যায় তা হচ্ছে এই যে, হযরত দাউদ যখন আল্লাহর প্রশংসা ও মহিমা গীতি গাইতেন তখন তাঁর উচ্চতর ও সুরেলা আওয়াজ পাহাড় গুঞ্জরিত হতো, পাখিরা থেমে যেতো এবং একটা অপূর্ব মূর্ছনার সৃষ্টি হতো।

এ অর্থের সমর্থন একটি হাদীস থেকে পাওয়া যায়। সেখানে উল্লেখ করা হয়েছে যে, একবার হযরত আবু মূসা আশ’আরী (রা) কুরআন তেলাওয়াত করেছিলেন। তাঁর কণ্ঠ ছিল অসাধারণ সুরেলা। নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম সেদিক দিয়ে যাচ্ছিলেন। তার আওয়াজ শুনে তিনি দাঁড়িয়ে গেলেন এবং অনেকক্ষণ শুনতে থাকলেন। তার পড়া শেষ হলে তিনি বললেনঃ () অর্থাৎ এ ব্যক্তি দাউদের সুরেলা কণ্ঠের একটা অংশ পেয়েছে।

সূরা সবায় এর ওপর আরো বিস্তারিতভাবে বলা হয়েছে: “আর আমি তার জন্য লোহা নরম করে দিয়েছি (এবং তাকে নির্দেশ দিয়েছি) যে পূর্ণমাপের বর্ম তৈরী করো এবং বুনন করার ক্ষেত্রে যথাযথ পরিমাণ রক্ষা করো”। এ থেকে জানা যায়, আল্লাহ হযরত দাউদকে লোহা ব্যবহার করার ক্ষমতা দান করেছিলেন। বিশেষ করে, যুদ্ধে ব্যবহারের জন্য বর্ম নির্মাণের কায়দা কৌশল শিখিয়ে দিয়েছিলেন। বর্তমান যুগের ঐতিহাসিক ও প্রত্মতাত্বিক গবেষণা ও অনুসন্ধান থেকে এ আয়াতের অর্থের ওপর যে আলোকপাত হয় তা হচ্ছে এই যে, পৃথিবীতে লৌহ যুগ() শুরু হয় খৃস্টপূর্ব ১২০০ ও ১০০০অব্দের মাঝামাঝি সময়ে।

আর এটিই ছিল হযরত দাউদ আলাহিস সালামের যুগ। প্রথম দিকে সিরিয়া ও এশিয়া মাইনরের হিত্তী (Hittites) জাতি লোহা ব্যবহার করে। ২০০০ থেকে ১২০০খৃস্ট পূবাব্দ পর্যন্ত এ জাতির উত্থান দেখা যায়। তারা লোহা গলাবার ও নির্মাণের একটা জটিল পদ্ধতি জানতো। সারা দুনিয়ার দৃষ্টি থেকে তারা একে কঠোরভাবে গোপন রাখে। কিন্তু এ পদ্ধতিতে যে লোহা তৈরী করা হতো তা সোনা রূপার মতো এত বেশী মূল্যবান হতো যে, তা সাধারণ কাজে ব্যবহার করা যেতো না। পরে ফিলিস্তিনীরা বনী ইসরাঈলকে যেভাবে গোপন রাখে।

তালূতের রাজত্বের পূর্বে হিত্তী ও ফিলিস্তিনীরা বনী ইসরাঈলকে যেভাবে উপর্যুপরি পরাজিত করে ফিলিস্তীন থেকে প্রায় বেদখল করে দিয়েছিল বাইবেলের বর্ণনা মতে এর একটি গুরুত্বপূর্ণ কারণ ছিল এই যে, তারা লোহার রথ ব্যবহার করতো এবং তাদের কাছে লোহার তৈরী অন্যান্য অস্ত্রও থাকতো। (যিহোশূয়১৭:১৬ বিচারকর্তৃগণ ১:১৯, ৪:২-৩)খৃস্ট পূর্ব ১০২০ অব্দে তালুত যখন আল্লাহর হুকুমে বনী ইসরাঈলদের শাসক পদে অধিষ্ঠিত হন তখন তিনি তাদেরকে পরপর কয়েকবার পরাজিত করে ফিলিস্তীনের বেশীর ভাগ অংশ তাদের কাছ থেকে ফিরিয়ে নেন। তারপর হযরত দাউদ(১০০৪-৯৬৫খৃঃ পূঃ) শুধুমাত্র ফিলিস্তিনীন ও ট্রান্স জর্দানই নয় বরং সিরিয়াও বড় অংশে ইসরাঈলী রাজ্য প্রতিষ্ঠা করেন। এ সময়ে লৌহ নির্মাণ শিল্পের যে গোপন কলাকৌশল হিত্তী ও ফিলিস্তীদের নিয়ন্ত্রণে ছিল তা উন্মোচিত হয়ে যায় এবং কেবলমাত্র উন্মোচিত হয়েই থেমে যায়নি বরং লৌহ নির্মাণের এমন পদ্ধতিও উদ্ভাবিত হয় যার ফলে সাধারণ ব্যবহারের জন্য লোহার কম দামের জিনিসপত্রও তৈরী হতে থাকে। ফিলিস্তীনের দক্ষিণে আদূম এলাকা আকরিক লোহায়(Iron Ore) সমৃদ্ধ ছিল।

সম্প্রতি এ এলাকায় যে প্রত্মতাত্বিক খননকার্য চালানো হয় তার ফলে এমন অনেক জায়গার প্রত্মতাত্বিক নিদর্শনসমূহ পাওয়া গেছে যেখানে লোহা গলাবার চুল্লী বসানো ছিল। আকাবা ও আইলার সাথে সংযুক্ত হযরত সুলায়মান আলাইহিস সালামের জামানার বন্দর ইসয়ুন জাবেরের প্রাচীন নিদর্শনগুলোর মধ্যে যে চুল্লী পাওয়া গেছে তা পর্যবেক্ষণের পরে অনুমান করা হয়েছে যে, তার মধ্যে এমনসব পদ্ধতি প্রয়োগ করা হতো যা আজকের অত্যাধুনিক যুগের এ প্রয়োগ করা হয়।

এখন স্বাভাবিকভাবেই হযরত দাউদ আলাইহিস সালাম সবার আগে ও সবচেয়ে বেশী করে এ নতুন আবিস্কারকে যুদ্ধের প্রয়োজনে ব্যবহার করে থাকবেন। কারণ কিছুকাল আগেই আশপাশের শত্রু জাতিরা এ লোহার অস্ত্র ব্যবহার করে তাঁর জাতির জীবন ধারণ কঠিন করে দিয়েছিল।
দাঊদ (আঃ)-এর জীবনীতে শিক্ষণীয় বিষয় সমূহ:

১. নেতৃত্বের জন্য প্রয়োজন স্বাস্থ্যবান ও আমানতদার হওয়া। আরও প্রয়োজন প্রজ্ঞা, ন্যায়নিষ্ঠা ও উন্নতমানের বাগ্মিতা। যার সব কয়টি গুণ হযরত দাঊদ (আঃ)-এর মধ্যে সর্বাধিক পরিমাণে ছিল।

২. এলাহী বিধান দ্বীন ও দুনিয়া দু’টিকেই নিয়ন্ত্রণ ও পরিচালনা করে। বরং দ্বীনদার শাসকের হাতেই দুনিয়া শান্তিময় ও নিরাপদ থাকে। হযরত দাঊদ-এর শাসনকাল তার জাজ্জ্বল্যমান প্রমাণ।

৩. দ্বীনদার শাসককে আল্লাহ বারবার পরীক্ষা করেন। যাতে তার দ্বীনদারী অক্ষুণ্ণ থাকে। দাঊদ (আঃ) সে পরীক্ষা দিয়েছেন এবং উত্তীর্ণ হয়েছেন। বস্ত্ততঃ তিনি ছিলেন আল্লাহর দিকে সদা প্রত্যাবর্তনশীল।

৪. যে শাসক যত বেশী আল্লাহর শুকরগুযারী করেন, আল্লাহ তার প্রতি তত বেশী সদয় হন এবং ঐ রাজ্যে শান্তি ও সমৃদ্ধি নাযিল করেন। বস্ত্ততঃ দাঊদ (আঃ) সর্বাধিক ইবাদতগুযার ছিলেন এবং একদিন অন্তর একদিন ছিয়াম পালন করতেন।

৫. যে শাসক আল্লাহর প্রতি অনুগত হন, আল্লাহ দুনিয়ার সকল সৃষ্টিকে তার প্রতি অনুগত করে দেন। যেমন দাঊদ (আঃ)-এর জন্য পাহাড়-পর্বত, পক্ষীকুল এবং লোহাকে অনুগত করে দেওয়া হয়েছিল।

May be an image of text

হযরত ইউসুফ (ইংরেজি: Joseph অথবা Yosef, হিব্রু: יוֹסֵף, আধুনিক Yosef তিবেরিয়ান Yôsēp̄; আরবি: يوسف, Yusuf) ইহুদিখ্রিস্ট, এবং ইসলাম ধর্মে স্বীকৃত একজন পয়গম্বর। কোরআন এবং হিব্রু বাইবেলের বর্ণনা অনুসারে, তিনি হযরত ইয়াকুব এর বারো ছেলের ১১তম ছেলে। তিনি স্বপ্নের ব্যাখ্যা দিতে জানতেন। ইউসুফ নামটি মুসলিম জাতি এবং মধ্যপ্রাচ্যর মধ্যে সাধারণ নামগুলোর একটি।

হিব্রু বাইবেল এবং কোরআনের বিভিন্ন স্থানে ইউসুফ নাম উল্লেখ করা হয়েছে, কিন্তু শুধু কোরআনের সূরা ইউসুফে তার ঘটনা সম্পূর্ণ ধারাবাহিকভাবে বর্ণনা করা হয়েছে।[৩] ইউসুফের ঈর্ষান্বিত ভাইরা তাকে হত্যার সিদ্ধান্ত নেয় কিন্তু তাঁর ভাই লাবুর বিরোধিতা তাকে কূপে ফেলে দিলে একদল বণিক ইউসুফ (আ.) কে বিক্রয় করে দেয়, পরবর্তীতে তিনি মিশরের বাদশাহর পরে দ্বিতীয় ক্ষমতাশালী ব্যক্তি হন।

ইয়াকুব (আ) ছিলেন বনি ইসরাইল এবং ইহুদীদের পূর্বপুরুষ। ইয়াকুব (আ) এর আরেক নাম ছিল ইসরাইল (আ); এ নামটাই ইহুদীরা গ্রহণ করেছে। অর্থাৎ ইয়াকুব (আ) থেকেই আমাদের এই ইতিহাস শুরু হবে। তবে এই ‘ইতিহাস’ কিন্তু কেবলই ধর্মীয় ইতিহাস, প্রত্নতাত্ত্বিক গবেষণায় এগুলো তেমন আমলে আনা হয় না। একদমই যে কিছু পাওয়া যায়নি তা নয়, তবে এত আগের খুব কম জিনিসই পাওয়া গিয়েছে। হজরত ইউসুফ (আ.) ছিলেন হজরত ইয়াকুব (আ.)-এর ১১তম পুত্র। হজরত ইয়াকুব (আ.)-এর জন্মভূমির নাম ‘কেনান’ যা বর্তমান ফিলিস্তিনের একটি অংশ। পরবর্তীতে এই অঞ্চল ‘হেবরন এবং খলিল’ নামেও পরিচিতি পায়। ফিলিস্তিন, লেবানন এবং সিরিয়াসহ পার্শ্ববর্তী অঞ্চলে হজরত ইয়াকুব (আ.)-এর কর্মপরিধির ব্যাপ্তি ছিল।

পবিত্র কোরআনে অন্য নবীদের কাহিনি বিভিন্ন সূরায় বর্ণিত হলেও ইউসুফ (আ.)-এর কাহিনি কেবল এই একটি মাত্র সূরায় বর্ণিত হয়েছে। নানাবিধ শিক্ষামূলক বর্ণনার কারণে সূরা ইউসুফকে কেন্দ্র করে রচিত হয়েছে একাধিক সাহিত্য

তবে সাহিত্যে বর্ণিত সব ঘটনা বা চরিত্র কোরআন ও হাদিস সমর্থন করে না।

তবুও কোরআন হাদিসের আলোকে বর্ণনা করা চেষ্টা করব।

হজরত ইয়াকুব (আ.) তাঁর ১২ পুত্রের মধ্যে হজরত ইউসুফ (আ.)-কে বেশি স্নেহ করতেন। মূলত সৌন্দর্যের কারণে শিশুকালে তিনি সবারই প্রিয়পাত্র ছিলেন, যা তাঁর সৎ ভাইয়েরা সহ্য করতে পারতেন না। এই ভাইয়েরা হজরত ইউসুফ (আ.)-কে শিশু অবস্থায় তাদের পিতার কাছ থেকে দূরে সরানোর ঘৃণ্য চক্রান্ত করেন। তারা বাবা ইয়াকুব (আ.)-এর কাছে ইউসুফ (আ.)-কে তাদের সঙ্গে বাইরে খেলতে নিয়ে যাওয়ার অনুমতি চান। ইয়াকুব (আ.) কখনো পুত্র ইউসুফ (আ.)-কে চোখের আড়াল করতেন না। তাই তাকে নেকড়ে বাঘ খেয়ে ফেলতে পারে উল্লেখ করে নিষেধ করেন, তবে উপর্যুপরি অনুরোধ এবং নিরাপত্তার নিশ্চয়তার কথা বলে সৎ ভাইয়েরা বাবাকে রাজি করান এবং ইউসুফ (আ.)-কে খেলতে নিয়ে যান। এরপর তাকে প্রথমে হত্যা করার পরিকল্পনা করলেও বড় ভাইয়ের পরামর্শে হত্যার বদলে কূপে ফেলে দেওয়া হয়। আর তার কাপড়ে রক্ত মাখিয়ে তা বাড়িতে বাবাকে দেখান এবং ইউসুফ (আ.)-কে নেকড়ে বাঘ খেয়ে ফেলেছে বলে উল্লেখ করেন। বাবা হজরত ইয়াকুব (আ.) এ ঘটনায় শোকে মুষড়ে পড়েন এবং পুত্রশোকে কাঁদতে কাঁদতে চোখ সাদা এবং অন্ধ হয়ে যান। পবিত্র কোরআনের সূরা ইউসুফের ৮ থেকে ১৮ নম্বর আয়াতে এ ঘটনার বর্ণনা রয়েছে।

ঘটনাচক্রে তিনি একটি কাফেলার গোলাম সঙ্গী হয়ে মিশর যাত্রা শুরু করেন।

মিসরের দাস-দাসী বিক্রির হাটে সুদর্শন ইউসুফ (আ.)-এর আগমনে সাড়া ফেলে দেয় এবং তার মূল্য ক্রমেই বৃদ্ধি পেতে থাকে। সবশেষে ইউসুফ (আ.)-এর ওজনের সমপরিমাণ সোনা, মৃগনাভী এবং রেশমি বস্ত্রের বিনিময়ে তাকে কিনে নেন ‘অজিজে মিসর’ অর্থাৎ মিসরের অর্থ ও খাদ্যমন্ত্রীতুল্য রাজসভার একজন সদস্য। কোনো কোনো বর্ণনায় তাকে মিসরের তৎকালীন আমালেকা জাতীয় সম্রাট বায়য়াদ ইবনে ওয়াসাদের অর্থমন্ত্রী ‘কিতফি’ কিংবা ‘ইতফি’ বলে উল্লেখ করা হয়। তিনি তাকে তার স্ত্রী জুলায়খার হাতে সমর্পণ করেন। সে তার স্ত্রীকে ইউসুফ (আ.)-এর প্রতি বিশেষ যত্নবান হওয়ার নির্দেশ দেন এবং এই ইউসুফ (আ.) তাদের বিশেষ উপকারে আসবেন বলে প্রত্যাশা করেন। এভাবেই ইউসুফ (আ.) এবং জুলেখার পরিচয় হয়।

পবিত্র কোরআনে হজরত ইউসুফ (আ.)-কে নিয়ে সর্বাধিক আলোচিত ও চাঞ্চল্যকর ঘটনার নেপথ্যে থাকা প্রধান দুই চরিত্রের নাম সরাসরি উল্লিখিত হয়নি। সূরা ইউসুফে হজরত ইউসুফ (আ.)-কে ক্রয়কারীকে ‘আজিজ’ বা মন্ত্রী হিসেবে এবং তার স্ত্রীকে ‘আজিজের স্ত্রী’ বা ‘তার স্ত্রী’ হিসেবে সম্বোধন করা হয়েছে। তবে তাফসির এবং ঐতিহাসিক বর্ণনা মতে, এই আজিজের স্ত্রীই হলেন ইতিহাস-খ্যাত ‘জুলেখা’। আবার অনেকের মতে, তাঁর প্রকৃত নাম রঙ্গিল আর উপাধি হলো জুলেখা।

জুলেখার ঘরেই কৈশোর পেরিয়ে যুবক হয়ে ওঠেন ইউসুফ (আ.)। জুলেখা ক্রমেই যুবক ইউসুফ (আ.)-এর প্রতি আসক্ত হয়ে পড়েন। মূর্তি উপাসক জুলেখা তার ঘরে থাকা মূর্তির সামনে অন্যায় আবদার করতে ভয় পেতেন বলে কাপড় দিয়ে মূর্তির চোখ ঢেকে দিয়ে ইউসুফ (আ.)-কে নানাভাবে প্রলুব্ধ করতে সচেষ্ট ছিলেন। অন্যদিকে আল্লাহর একাত্ববাদে বিশ্বাসী ইউসুফ (আ.) আল্লাহ প্রদত্ত ইমানের শক্তিতে সব ধোঁকা ও প্রলোভনের ঊর্ধ্বে ছিলেন এবং সব সময় জুলেখাকে এ পথ ছাড়ার অনুরোধ জানান। কিন্তু ইউসুফ (আ.)-এর প্রেমে পাগল জুলেখা ছিলেন একরোখা।

সূরা ইউসুফের ২৩ নং আয়াত অনুসারে একদা জুলেখা ইউসুফ (আ.)-কে ঘরে পেয়ে দরজা বন্ধ করে দেন এবং তার প্রতি আহ্বান জানান। কিন্তু ইউসুফ (আ.) মহান আল্লাহ প্রদত্ত জ্ঞান, ধৈর্য, ইমান এবং ভীতির কারণে তা প্রত্যাখ্যান করেন। তাফসির ও আরবি সাহিত্যমতে, এ সময় হজরত ইউসুফ (আ.) আসন্ন বিপদ থেকে বাঁচতে ঘরের ছাদের দিকে দৃষ্টি দিলে অলৌকিকভাবে আরবি লেখা দেখতে পান। এ ছাড়াও ঘরে মূর্তির দিকে তাকিয়ে তিনি ‘আজিজ’-এর প্রতিচ্ছবি দেখতে পান এবং ঘরের দরজায় আজিজের উপস্থিতি অনুভব করেন। এরপর হজরত ইউসুফ (আ.) নিজেকে পবিত্র রাখার জন্য বন্ধ দরজার দিকে দৌড়ে যান।

এ সময় জুলেখা পেছন থেকে ইউসুফ (আ.)-কে জাপটে ধরলে তার পরিধেয় জামা পেছন থেকে ছিঁড়ে যায়। অলৌকিকভাবে এ সময় ঘরের বন্ধ দরজা (কারও মতে বাইরে থেকে বন্ধ দরজা) খুলে যায় এবং ইউসুফ (আ.) ও জুলেখা দরজার বাইরে জুলেখার স্বামী আজিজকে দেখতে পান। ঠিক তখনই চতুর জুলেখা তার ভোল পাল্টে ফেলেন এবং সূরা ইউসুফের ২৫ নং আয়াত অনুসারে এ সময় ইউসুফ (আ.)-এর বিরুদ্ধে মিথ্যা অভিযোগ দিয়ে তাকে কারাগারে পাঠানো বা অন্য কোনো কঠিন শাস্তির দাবি করেন। ২৬ নং আয়াতে বর্ণিত, এ সময় ইউসুফ (আ.) প্রকৃত সত্য তুলে ধরেন এবং জুলেখার পরিবারের একজন সঠিক সাক্ষ্য প্রদান করেন। পবিত্র কোরআনে এই সাক্ষ্য প্রদানকারীর বিস্তারিত পরিচয় নেই। তবে তাফসির এবং প্রচলিত বর্ণনা অনুসারে এই সাক্ষী ছিল একটি নিতান্ত কন্যাশিশু, যার মুখে তখনো স্পষ্ট করে কথা ফোটেনি।

যখন জুলায়খার স্বামী বুজতে পারল। তাকে তিরস্কার করল এবং বাইরে বিষয়টা না ছরানো জন্য বলে। কিন্তু বিষয়টা আর গোপন থাকে নি। যখন শহরের মহিলারা তাকে নিয়ে কটূক্তি করতে লাগল। তখন সে সবার জন্য একটি ভোজসভার আয়োজন করল

মহান আল্লাহ ইউসুফ (আ.)-এর প্রতি সদয় হন এবং তাঁকে ঘটনাক্রমে কিছুদিন কারাগারে রাখার ব্যবস্থা করেন।

সূরা ইউসুফের ৩০ নং আয়াত অনুসারে এ ঘটনার পর শহরজুড়ে জুলেখার কুকীর্তি নিয়ে সমালোচনার ঝড় ওঠে। আর আরব সাহিত্য মতে, রাজপ্রাসাদে যারা আজিজ বিরোধী ছিল, তারা এ ঘটনায় বহুমাত্রিক রং ছড়িয়ে প্রচার করতে থাকে। সূরা ইউসুফের পরবর্তী আয়াতগুলোতে এ ঘটনার পরিসমাপ্তি টানা হয়। এতে বলা হয়, আজিজের স্ত্রী (জুলেখা) যখন এই ষড়যন্ত্র বা অপবাদের ব্যাপক প্রচার সম্পর্কে অবগত হন, তখন শহরের গণ্যমান্য মহিলাদের তিনি এক ভোজসভায় আমন্ত্রণ জানান।

এই ভোজে অন্যান্য খাবারের সঙ্গে প্রত্যেকের জন্য ফল এবং তা কাটার জন্য একটি করে ধারালো ছুরি দেওয়া হয়। শহরের নারীরা যখন ছুরি দিয়ে ফল কাটায় ব্যস্ত, ঠিক তখন জুলেখা তাঁর পূর্ব পরিকল্পনা মতো পাশের কক্ষে থাকা ইউসুফ (আ.)-কে মহিলাদের সামনে আসতে হুকুম করেন। অত্যন্ত আকর্ষণীয় চেহারার অধিকারী হজরত ইউসুফ (আ.) যখন সামনে উপস্থিত হন, তখন তাঁর সৌন্দর্যের মোহে নারীরা তাঁর দিকে তাকিয়ে ফলের বদলে ধারালো ছুরি দিয়ে নিজ নিজ আঙ্গুল কেটে ফেলেন। এই সুযোগে জুলেখা সবার উদ্দেশে বলেন যে, এই সেই সুপুরুষ ইউসুফ (আ.), যার জন্য মহিলারা তার নিন্দা করছেন। সূরা ইউসুফের ৩১ নং আয়াত মতে, মহিলাদের মন্তব্য ছিল- ‘এ তো মানুষ নন, এ তো এক মহান ফেরেশতা’। এ সময় জুলেখা আবারও তাঁর কূটচাল প্রয়োগ করেন এবং একদিকে ইউসুফ (আ.)-কে পবিত্র বলে সাক্ষ্য দেন আর অন্যদিকে ভবিষ্যতে ইউসুফ (আ.) তাঁর কথার অবাধ্য হলে অপমানিত হওয়ার এবং কারাগারে নিক্ষেপ করার হুমকি দেন। কিছু মহিলাও এতে সায় দেন ও ইন্ধন জোগান। সূরা ইউসুফের ৩৩ নং আয়াত অনুসারে এ সময় হজরত ইউসুফ (আ.) মহান আল্লাহর কাছে কুচক্রী মহিলাদের কাছ থেকে আশ্রয় প্রার্থনা করেন এবং অপবিত্র ভোগ-বিলাসের পরিবর্তে কারাবাসই উত্তম বলে ফরিয়াদ জানান। তিনি উপলব্ধি করেন যে, কারাগারই হতে পারে তাঁর জন্য নিরাপদ আশ্রয়, অন্যথায় কুচক্রী জুলেখা ও অন্য নারীর প্রলোভন ও ষড়যন্ত্র থেকে বাঁচা দিনে দিনে কঠিন হয়ে উঠবে। মহান আল্লাহ ইউসুফ (আ.)-এর প্রতি সদয় হন এবং তাঁকে ঘটনাক্রমে কিছুদিন কারাগারে রাখার ব্যবস্থা করেন।

সূরা ইউসুফের পরবর্তী অংশে কারাগার থেকে হজরত ইউসুফ (আ.)-এর মুক্তি, রাজার স্বপ্নের ব্যাখ্যা প্রদানের মাধ্যমে রাজ দরবারে আকর্ষণীয় পদ লাভ, মিসরের দুর্ভিক্ষ, সৎ ভাইদের উচিত শিক্ষাদান, আপন ছোটভাই বেনিয়ামিনকে কাছে রাখা, পিতা ইয়াকুব (আ.)-এর চোখের দৃষ্টি ফিরে পাওয়া এবং সবশেষে পিতা-মাতাকে রাজদরবারে বসিয়ে সম্মান প্রদানের বর্ণনা রয়েছে। তবে আজিজের স্ত্রী বা জুলেখা সম্পর্কে পরবর্তীতে আর কোনো বর্ণনা পবিত্র কোরআনে দেওয়া হয়নি, হাদিসেও এ সংক্রান্ত বিশেষ কোনো তথ্য পাওয়া যায় না।

হাদিস বা পবিত্র কোরআনে উল্লেখ না থাকলেও বিভিন্ন সাহিত্যে ইউসুফ (আ.)-এর সঙ্গে জুলেখার পুনর্মিলনের বর্ণনা পাওয়া যায়। একটি সাহিত্যধারা মতে, সময়ের বিবর্তনে মিসরের আজিজ (জুলেখার স্বামী) মৃত্যুবরণ করার পর তাদের শুভ বিবাহ সম্পন্ন হয়। পরবর্তীতে তাদের কোলজুড়ে দুই পুত্র আফরাইম ইবনে ইউসুফ এবং মায়শা ইবনে ইউসুফের জন্মের বর্ণনাও পাওয়া যায়।

জীবনী

পরিবার

ইয়াকুবের বারো জন পুত্রের মধ্যে প্রথম দশ জন জ্যেষ্টপুত্র, তার প্রথমা স্ত্রী “লাইয়্যা বিনতে লাইয়্যানের” গর্ভে জন্মলাভ করে। তাঁর মৃত্যুর পর ইয়াকুব “লাইয়্যার” বোন “রাহীলকে” বিবাহ করেন। রাহীলের গর্ভে দু-পুত্র ইউসুফ এবং বিনইয়্যামিন জন্মলাভ করে। তার ছোট ছেলের জন্মের পরে তিনিও মৃত্যুমুখে পতিত হন। হিব্রু বাইবেল অনুসারে তার বার ছেলের নাম হলোঃ রেউবেন বা ইয়াহুদা, সিমোনলেভিজুদাহডাননাফতালিগাডআশেরইসশাচারজেবুলুন, ইউসুফ এবং বেনজামিন বা বেনইয়ামিন।

ইউসুফের স্বপ্ন

ইউসুফ ছোট সময় একদিন স্বপ্নে দেখলেন যে, একাদশ নক্ষত্রসূর্য ও চন্দ্র তার প্রতি অবনত অবস্থায় রয়েছে। পরের দিন ইউসুফ তার পিতাকে তার এই স্বপ্নের কথা বললেন। তার স্বপ্নের বাখ্যা হচ্ছে যে, এগারোটি নক্ষত্রের অর্থ হচ্ছে ইউসুফের এগারো ভাই, সূর্যের অর্থ পিতা এবং চন্দ্রের অর্থ মাতা। তিনি স্বপ্নের বর্ণনা শুনে বুঝতে পারলেন এবং ইউসুফের ভাইদের কাছে তার এই স্বপ্ন বৃত্তান্ত না করার জন্য ইউসুফকে বললেন। কারণ, স্বপ্নের তাৎপর্য অনুধাবন করে ভাইরা ইউসুফের প্রতি ঈর্ষান্বিত হয়ে তার ক্ষতি করতে পারে।

বৈমাত্রেয় ভাইরা

ইয়াকুব ছোট হিসেবে ইউসুফ ও বেনইয়ামিনকে খুব স্নেহ করতেন, এটা বৈমাত্রেয় ভাইদের ভালো লাগতো না। তারা আস্তে আস্তে ইউসুফের প্রতি ঈর্ষাপরায়ণ হয়ে ওঠে। তারা নিজেদের মধ্যে বলতে লাগলোঃ আমাদের তুলনায় আমাদের পিতা ইউসুফ ও তার অনুজ বেনিয়ামিনকে অধিক ভালবাসেন। অথচ আমরা দশ জন তাদের থেকে বড় হওয়ার কারণে বাড়ির সব কাজকর্ম করতে সক্ষম। তাই আমাদের পিতার উচিত, এ বিষয় অনুধাবন করা এবং আমাদেরকে অধিক মহব্বত করা। কিন্তু তিনি প্রকাশ্যে অবিচার করে যাচ্ছেন। তাই তোমরা হয় ইউসুফকে হত্যা কর, না হয় এমন দূরদেশে নির্বাসিত কর, যেখান থেকে সে আর ফিরে আসতে না পারে। কেউ মত প্রকাশ করল যে, ইউসুফকে হত্যা করা হোক। কেউ বললঃ তাকে কোন অন্ধকূপের গভীরে নিক্ষেপ করা হোক – যাতে মাঝখান থেকে এ কন্টক দূর হয়ে যায় এবং তখন আমাদের পিতার সমগ্র মনোযোগ আমাদের প্রতি হয়ে যাবে। হত্যা বা কূপে নিক্ষেপ করার পরে পরবর্তীকালে মাফ চেয়ে আমরা ভালো লোক হয়ে যাবে।

ইউসুফকে হত্যার পরিকল্পনা নিয়ে তার বৈমাত্রেয় ভাইদের মধ্যে মতপার্থক্য দেখা দেয়। একজন বললো, ইউসুফকে হত্যা করো না। যদি কিছু করতেই হয় তবে, কূপের গভীরে এমন জায়গায় নিক্ষেপ কর, যেখানে সে জীবিত থাকে এবং পথিক যখন কূপে আসে, তখন তাকে উঠিয়ে নিয়ে যায়। এভাবে একদিকে তোমাদের উদ্দেশ্য পূর্ণ হয়ে যাবে এবং অপরদিকে তাকে নিয়ে তোমাদেরকে কোন দূরদেশে যেতে হবে না কোন কাফেলা আসবে, তারা স্বয়ং তাকে সাথে করে দূর-দূরান্তে পৌঁছে দেবে। এ অভিমত প্রকাশকারী ছিল তাদের বড় ভাই শামঊনের।

একদিন ইউসুফের ভাইরা তার পিতা ইয়াকুবকে বললঃ আপনি ইউসুফ সম্পর্কে আমাদের প্রতি আস্থা রাখেন না, অথচ আমরা তার পুরোপুরি হিতাকাঙ্খী। আগামীকাল আপনি তাকে আমাদের সাথে ভ্রমণে পাঠিয়ে দিন, যাতে সে-ও স্বাধীনভাবে পানাহার ও খেলাধুলা করতে পারে। আমরা সবাই তার পুরোপুরি দেখাশোনা করব। তখন ইয়াকুব বললেনঃ তাকে প্রেরণ করা আমি দু’কারণে পছন্দ করি না। প্রথমত এ নয়নের মণি, দ্বিতীয়তঃ তোমাদের অসাবধানতার কারণে তাকে বাঘে খেয়ে ফেলতে পারে। ভাইরা পিতার কথা শুনে বললঃ আপনি এর জন্য ভয় পাবেন না। আমাদের দশ জনের শক্তিশালী দল তার দেখাশোনা করবে। আমরা সবাই থাকা সত্ত্বেও যদি বাঘেই তাকে খেয়ে ফেলে, তাহলে আমাদের শক্তিশালী দল নিষ্ফল হয়ে যাবে। তাহলে আমাদের দ্বারা কোন কাজের আশা করা যেতে পারে? তিনি একথা প্রকাশ করলেন না যে, আমি স্বয়ং তোমাদের পক্ষ থেকেই আশঙ্কা করি। তিনি অনুমতি দিয়ে দিলেন। কিন্তু ভাইদের কাছ থেকে প্রতিশ্রুতি নিয়ে নিলেন, যাতে ইউসুফের কোনরূপ কষ্ট না হয়। ভাইরা পিতার সামনে ইউসুফকে কাঁধে তুলে নিল এবং পালাক্রমে সবাই উঠাতে লাগল। কিছুদূর পর্যন্ত ইয়াকুবও তাদেরকে বিদায় দেয়ার জন্য গেলেন। তারা যখন ইয়াকু্বের দৃষ্টির আড়ালে চলে গেল, তখন ইউসুফ যে ভাইয়ের কাঁধে ছিলেন, সে তাকে মাটিতে ফেলে দিল। তাঁরা ইউসুফকে ব্যাপকভাবে আঘাত করে। এক পর্যায়ে তার ভাইরা পূর্ব পরিকল্পনা অনুযায়ী ইউসুফকে কূপের গভীরে নিক্ষেপ করতে সবাই ঐকমত্যে পৌঁছল।

যখন তারা তাঁকে কূপে নিক্ষেপ করতে লাগল, তখন তিনি কূপের প্রাচীর জড়িয়ে ধরলেন। ভাইয়েরা তার জামা খুলে তার দু’হাত বেঁধে দিল। তখন ইউসুফ পুনরায় তাদের কাছে দয়া ভিক্ষা চাইলেন। তখন তারা তাকে বললঃ যে এগারটি নক্ষত্র তোমার সামনে অবনত দেখেছ, তাদেরকে ডাক। তারাই তোমার সাহায্য করবে। অতঃপর একটি বালতিতে রেখে তাকে কূপে নামাতে লাগলো। মাঝপথে যেতেই উপর থেকে রশি কেটে দিল। পানিতে পড়ার কারণে তিনি কোন রূপ আঘাত পেলোনা। তিনি কূপের ভিতর নিকটেই একখন্ড প্রস্তর দেখলেন। তিনি তার উপর গিয়ে বসলেন। ইউসুফ তিন দিন পর্যন্ত কূপে অবস্থান করলেন। তার ভাই ইয়াহুদা প্রত্যহ গোপনে তাঁর জন্য কিছু খাদ্য আনত এবং বালতির সাহায্যে তাঁর কাছে পৌঁছে দিত।

সন্ধ্যাবেলায় ইউসুফের ভাইরা কাদঁতে কাদঁতে পিতার নিকট গেল। ইয়াকুব জিজ্ঞেস করলেনঃ ব্যাপার কি? তোমাদের ছাগলপালের উপর কেউ আক্রমণ করেনি তো? ইউসুফ কোথায়? তখন ভাইয়েরা বললঃ আমরা দৌড় প্রতিযোগিতা খেলছিলাম এবং ইউসুফকে আসবারপত্রের কাছে রেখে গিয়েছিলাম। ইতিমধ্যে বাঘ এসে ইউসুফকে খেয়ে ফেলেছে। আমরা সত্য বলছি কিন্তু আপনি তো আমাদের কথা বিশ্বাস করবেন না। ইউসুফের ভাইরা তার জামায় কৃত্রিম রক্ত লাগিয়ে এনেছিল, যাতে পিতার মনে বিশ্বাস জন্মাতে পারে যে, বাঘই তাকে খেয়ে ফেলেছে। কিন্তু তাদের মিথ্যা ফাঁস করে দেয়ার জন্য তাদেরকে একটি জরুরী বিষয় ভুলিয়ে দিয়েছিল। তারা যদি রক্ত লাগানোর সাথে সাথে জামাটিও ছিন্ন-বিছিন্ন করে দিত, তবে ইউসুফকে বাঘে খাওয়ার কথাটা বিশ্বাসযোগ্য হতে পারত। এভাবে ইয়াকুবের কাছে তাদের জালিয়াতি ফাঁস হয়ে গেল। তিনি বললেনঃ ইউসুফকে বাঘে খায়নি; ববং তোমরা মিথ্যা কথা বলছো।

কাফেলা

এক কাফেলা সিরিয়া থেকে মিশর যাচ্ছিল। তারা পানির সংগ্রহ করার জন্য কূপে গেলেন। কাফেলার নাম ছিল “মালেক ইবনে দো’বর”। তিনি এই কূপে পৌঁছলেন এবং বালতি নিক্ষেপ করলেন। ইউসুফ তখন বালতির রশি শক্ত করে ধরলেন। পানির পরিবর্তে বালতির সাথে ইউসুফ উঠে আসলেন। কাফেলার লোকেরা তাঁকে বিক্রয় করার সিদ্ধান্ত করলেন। কাফেলার লোকের তাঁকে মিশর নিয়ে যাওয়ার পর বিক্রয়ের কথা ঘোষণা করতেই ক্রেতারা প্রতিযোগিতামূলকভাবে দাম বলতে লাগল। শেষ পর্যন্ত ইউসুফের ওজনের সমান স্বর্ণ, সমপরিমাণ মৃগণাভি এবং সমপরিমাণ রেশমী বস্ত্র দাম সাব্যস্ত হয়ে গেল। আবার কোথাও বলা হয়েছে, ইউসুফকে তার ভাইরা ইসমাঈলীদের এক কাফেলার কাছে ২০ রৌপ্য মুদ্রার বিনিময়ে বিক্রি করে দেয় এবং তাকে তারা মিশরে নিয়ে যায়। যে ব্যক্তি ইউসুফকে ক্রয় করেছিলেন, তিনি ছিলেন মিশরের অর্থমন্ত্রী অথবা ফেরাউনের পাহারাদার। তখন মিশরের ফেরাউনের ছিলেন আমালেকা জাতির জনৈক ব্যক্তি “রাইয়ান ইবনে ওসায়দ“। তিনি পরবর্তীকালে ইউসুফের ধর্ম গ্রহণ করেন। ক্রেতা আযীযে মিশরের (কিতফীর) স্ত্রীর নাম ছিল “রাঈল” কিংবা “যুলায়খা”। আযীযে-মিশর তার স্ত্রীকে নির্দেশ দিলেনঃ ইউসুফকে বসবাসের ভালো জায়গা দাও-ক্রীতদাসের মত রেখো না এবং তার প্রয়োজনাদির সুবন্দোবস্ত কর।

যৌবন

ইউসুফ যখন পূর্ণ শক্তি ও যৌবনে পদার্পণ করলেন, তখন প্রজ্ঞা ও ব্যুৎপত্তি হল। তখন ইউসুফ আযীযে-মিশরের বাসায় থাকতো। ইউসুফের আকর্ষণীয় চেহারা এবং তার নম্র আচরণ ক্রমেই যুলায়খা মুগ্ধ হয়ে উঠতে লাগলো। যুলায়খা ইউসুফের প্রতি প্রেমাসক্ত হয়ে পড়ল এবং তাঁর সাথে কুবাসনা চরিতার্থ করার জন্যে তাঁকে ফুসলাতে লাগল। একদিন সে এক কামরায় আটক করে তার মনের ইচ্ছা ব্যক্ত করলেন। কিন্তু ইউসুফ দৃঢ়তার সাথে তা প্রত্যাখ্যান করে। ইউসুফ যখন বাইরে যাওয়ার জন্য দরজার দিকে গেলেন তখন যুলায়খা তাঁর জামা ধরে বাইরে যেতে বাধা দিল। ফলে তার জামা পেছন দিক থেকে ছিড়ে গেল। ইউসুফ দরজার বাইরে চলে গেলেন এবং তার পিছনে যুলায়খাও গেল। উভয়ই দরজার বাইরে এসে আযীযে-মিশরকে সামনে দেখতে পেল।

তার স্ত্রী চমকে উঠল এবং ইউসুফ কিছু বলার আগেই যুলায়খা ইউসুফের প্রতি দোষ আরোপ করলো যে, ইউসুফ বিশ্বাস ভঙ্গ করেছে তাই তাকে কারাগারে নিক্ষেপ করা হোক বা অন্য কোন কঠিন শাস্তি দেয়া হোক। ইউসুফ নিজেকে নির্দোষ দাবী করে বললেন, যুলায়খা মিথ্যা বলছে, সেই অনেক দিন যাবত আমার সাথে কুবাসনা চরিতার্থ করার জন্যে আমাকে ফুসলাতে ছিল। কিন্তু আমি কখনই তাকে প্রশ্রয় দেইনি। আযীযে-মিশরের পক্ষে কে সত্য বলছে তা বুঝা কঠিন হয়ে পড়ল। ইউসুফের ছেড়া জামা দেখ সে বলল, যদি ইউসুফের জামা পিছনের দিকে ছেড়ে থাকে তাহলে সে নিশ্চয়ই পালাবার চেষ্টা করেছে। তাহলে ইউসুফ সত্য বলছে আর তুমি মিথ্যা বলছো। আর যদি ইউসুফের জামা সামনের দিকে ছেড়ে থাকে তাহলে ইউসুফ মিথ্যা বলছে আর তুমি সত্য বলছো। যখন দেখল যে, ইউসুফের জামা পিছনের দিকই ছেড়া, সে তখন নিশ্চিত হয় যে, যুলায়খা মিথ্যা বলছে।

আযীযে-মিশরের ইউসুফকে এই ঘটনা কাউকে না বলার জন্যে ইউসুফকে অনুরোধ করলেন। কিন্তু ঘটনাটি সবাই জেনে গেল। সাধারণ মানুষ যুলায়খাকেই এ ব্যাপারে অপরাধী মনে করতে থাকলো এবং লোকমুখে যুলায়খার সমালোচনা নগরব্যাপী ছড়িয়ে পড়লো। যুলায়খা যখন মিসরের নারীদের সমালোচনা শুনলো তখন সে তাদেরকে এক ভোজসভার জন্য আমন্ত্রণ করলো। যখন তার সেখানে উপস্থিত হল, তাদের সামনে বিভিন্ন প্রকার খাদ্য ও ফল উপস্থিত করা হল। ফল কাটার জন্য প্রত্যেকের কাছে একটি ছুরিও ছিল। মহিলারা যখন ছুরি দিয়ে ফল কেটে খাচ্ছিলেন তখন ইউসুফকে তাদের সামনে উপস্থিত করা হল। ইউসুফের সৌন্দর্য দেখে নিজেদের অজান্তেই সবাই ফলের পরিবর্তে নিজেদের হাত কেটে ফেলল। তখন যুলায়খা তাদেরকে বলল, দেখ এই সে যার জন্য তোমরা আমার সমালোচনা করেছ। কাজেই আশা করি এরপর থেকে আর আমার নিন্দা ও সমালোচনা করা হবে না। সে এটাও বলল যে, ইউসুফ যেহেতু আমার কথা অবমাননা করেছে এজন্য তাকে অবশ্যই কারাভোগ করতে হবে। যুলায়খার প্ররোচনায় আযীযে-মিশর তাকে কারাগারে পাঠালেন।

কারাগার

ইউসুফ যখন কারাগারে প্রবেশ করলেন তখন তার সাথে আরও দু’জন কয়েদিও কারাগারে প্রবেশ করল। তাদের একজন বাদশাহকে মদ্যপান করাত এবং অপরজন বাবুর্চি ছিল। তারা উভয়েই বাদশাহর খাদ্যে বিষ মিশ্রিত করার অভিযোগে গ্রেফতার করা হয়েছিল। একদিন তারা বললঃ আমরা আপনার কাছে আমাদের স্বপ্নের ব্যাখ্যা জানতে চাই। তাদের একজন যে বাদশাহকে মদ্যপান করাত সে বললঃ আমি স্বপ্নে দেখলাম যে, আঙ্গুর থেকে শরাব বের করছি। এবং দ্বিতীয় জন যে বাদশাহর বাবুর্চি ছিল সে বললঃ আমি স্বপ্নে দেখলাম যে, আমার মাথায় রুটিভর্তি একটি ঝুড়ি রয়েছে। তা থেকে পাখিরা ঠুকরে ঠুকরে আহার করছে। ইউসুফ তাদের স্বপ্নের ব্যাখ্যা দিলেন যে, তোমাদের একজন মুক্তি পাবে এবং চাকুরীতে পুনর্বহাল হবে। অপর জন অপরাধ প্রমাণিত হবে এবং তাকে শূলে চড়ানো হবে। পাখিরা তার মাথার মগজ ঠুকরে খাবে।

যে ব্যক্তি মুক্তি পাবে বলে ইউসুফের ধারণা ছিল তাকে বললেনঃ যখন তুমি মুক্তি পাবে এবং বাদশাহর চাকুরীতে পুনর্বহাল হবে, তখন বাদশাহর কাছে আমার বিষয়ে আলোচনা করো। কিন্তু কারাগার থেকে মুক্তি পাওয়ার পর ঐ ব্যক্তি ইউসুফের কথা ভুলে গেল৷ ফলে ইউসুফকে সাত বছর কারাগারে থাকতে হলো৷

ইউসুফের মুক্তি

একদিন বাদশাহ বললো, আমি সাতটি মোটাতাজা গাভী দেখলাম। এগুলোকেই অন্য সাতটি শীর্ণ গাভী খেয়ে যাচ্ছে। এবং আরও দেখলাম সাতটি গমের সবুজ শীষকে আরো সাতটি শুষ্ক শীষ নষ্ট করে ফেলছে। এ স্বপ্নের ব্যাখ্যার জন্য রাজ্যের জ্ঞানী ব্যাখ্যাতা ও অতীন্দ্রিয়-বাদীদেরকে একত্রিত করে স্বপ্নের ব্যাখ্যা জিজ্ঞেস করলেন। কিন্তু কেউ স্বপ্নটির ব্যাখ্যা দিতে পারলো না। তাই সবাই উত্তর দিল, এটা কল্পনাপ্রসূত স্বপ্ন। আমরা এরূপ স্বপ্নের ব্যাখ্যা জানি না। সঠিক স্বপ্ন হলে ব্যাখ্যা দিতে পারতাম।

তখন মুক্তিপ্রাপ্ত সেই কয়েদির ইউসুফের কথা মনে পড়ে গেল। সে অগ্রসর হয়ে বললঃ আমি এ স্বপ্নের ব্যাখ্যা বলতে পারব। তবে আমাকে কারাগার বদ্ধ ইউসুফের কাছে যেতে হবে। সে এই স্বপ্নের ব্যাখ্যা দিতে পারবে। বাদশাহ তাকে কারাগারে তাঁর সাথে সাক্ষাতের অনুমতি দিলেন। সে ব্যক্তি কারাগারে গিয়ে ইউসুফের কাছে বাদশাহর স্বপ্নের ব্যাখ্যা করার জন্য অনুরোধ করলো। ইউসুফ বললঃ সাত বছর ভাল ফলন হবে, এরপর সাত বছর দুর্ভিক্ষ হবে। ইউসুফ আরও বললেন, দুর্ভিক্ষের বছর অতিক্রান্ত হয়ে গেলে এক বছর খুব বৃষ্টিপাত হবে এবং প্রচুর ফসল উৎপন্ন হবে। তিনি পরামর্শ দিলেন যে, প্রথম সাত বছর যে অতিরিক্ত শস্য উৎপন্ন হবে, তা শীষের মধ্যেই রাখতে হবে, যাতে পুরানো হওয়ার পর গমে পোকা না লাগে। এ ব্যক্তি স্বপ্নের ব্যাখ্যা নিয়ে ফিরে আসে এবং বাদশাহকে তা অভিহিত করেন। বাদশাহ আদেশ দিলেন যে, ইউসুফকে কারাগার থেকে বাইরে নিয়ে এসো। বাদশাহর দূত এ বার্তা নিয়ে কারাগারে পৌছল। তখন ইউসুফ বললেন, বাদশাহকে জিজ্ঞাসা কর তার মতে ঐ নারীরা কেমন, যারা হাত কেটে ফেলেছিল? তিনি আমাকে এ জন্য দোষী বা সন্দেহ করে কিনা? বাদশাহ যখন ইউসুফের ঘটনা তদন্ত করার জন্য নারীদের জিজ্ঞাসা করলেন, তখন তারা বাস্তব ঘটনা স্বীকার করলো। বাদশাহ তখন ইউসুফকে তার উপদেষ্টা করে নিলেন। তখন ইউসুফ বাদশাহর কাছে দেশের উৎপন্ন ফসলসহ দেশীয় সম্পদ রক্ষণাবেক্ষণ করার দায়িত্ব তার কাছে সোপর্দ করার অনুরোধ করলেন। এক বছর অতীবাহিত হওয়ার পর শুধু অর্থ মন্ত্রণালয়ই নয়; বরং যাবতীয় সরকারী দায়িত্বও তাঁকে সোপর্দ করে দেয়া হলো। এই সময় তিনি আযীযে-মিশরের স্ত্রী যুলায়খাকে বিয়ে করেন।

দুর্ভিক্ষ

ইউসুফ এর হাতে মিসরের শাসনভার দেওয়ার পর স্বপ্নের ব্যাখ্যা অনুযায়ী প্রথম সাত বছর সমগ্র দেশে সুখ-শান্তি ও কল্যাণ নিয়ে আসে। এই সময় অনেক ফসল উৎপন্ন হয় এবং তা সঞ্চিত করে রাখা হয়। সাত বছর অতিক্রম হওয়ার পরে ভয়াবহ দুর্ভিক্ষ দেখা দেয়। ইউসুফ প্রথম বছরে দেশের মজুদকৃত শস্য খুব সাবধানে সংরক্ষিত করলেন। মিসরের অধিবাসীদের কাছে তাদের প্রয়োজন পরিমাণে খাদ্যশস্য পূর্বে সঞ্চিত করানো হলো। যখন দুর্ভিক্ষ ব্যাপক আকারে ছড়িয়ে পড়ল তখন চতুর্দিক থেকে লোকজন মিশরে আগমন করতে লাগল। ইউসুফ এক ব্যক্তিকে এক উট-বোঝাই খাদ্যশস্য দিতেন; এর বেশি দিতেন না।

হযরত ইয়াকুব বসবাস করতেন কেনান শহরে, যেটি ফিলিস্তিনের একটি অংশ। এখানে ইব্রাহিমইসহাকইয়াকুব ও ইউসুফের সমাধি অবস্থিত। এ এলাকাটি দুর্ভিক্ষ থেকে মুক্তি পেল না। ফলে ইয়াকুবের পরিবারেও খাদ্যশস্যের অভাব দেখা দিল। তারা জানতে পারলো যে, মিশরের বাদশাহ অল্প মূল্যের বিনিময়ে খাদ্যশস্য বিক্রি করছে। ইয়াকুব গম সংগ্রহ করার জন্য তার ছেলেদেরকে মিশরে পাঠালেন। তারা মিশরে পৌঁছার পর রাজ কোষাগারে গেলেন, কিন্তু তারা ইউসুফকে চিনতে পারলো না। কিন্তু ইউসুফ তাদেরকে চিনে ফেলল। এই সময় ইউসুফের বয়স ছিল চল্লিশ। ইউসুফের দশ ভাই দরবারে পৌঁছালে তিনি এমনভাবে প্রশ্ন করলেন যাতে তারা তাকে চিতে না পারে। ইউসুফের ভাইরা যখন গমের জন্য আবেদন করেন তখন তারা তাদের বৈমাত্রেয় ভাইয়ের জন্যও বরাদ্দ চাইলেন। তখন ইউসুফ বললেন, সে নিজে কেন আসে নি? তারা বললেন, আমাদের বাবা একজন বৃদ্ধ মানুষ। তাঁকে দেখাশোনার জন্য আমরা তাকে রেখে এসেছি। ইউসুফ বললেন, এবার আমি আপনাদের পিতা ও ভাইদের জন্য পুর্ণমাত্রায় খাদ্য দিয়ে দিচ্ছি। কিন্তু এরপরে আবার যখন আসবেন তখন অবশ্যই আপনাদের বৈমাত্রেয় ভাইকে সাথে করে নিয়ে আসতে হবে। আর তা না হলে আপনাদের কারো জন্যই খাদ্যশস্য দেওয়া হবে না। তারা পণ্যের যে মূল্য পরিশোধ করেছিল তাও তিনি গোপনে ফেরৎ দিয়ে দিলেন। যাতে পরে তাদের বৈমাত্রেয় ভাইকে সাথে করে নিয়ে আসে। তারা মিশর থেকে খাদ্যশস্য নিয়ে বাসায় গেলেন এবং পিতার কাছে মিশরের অবস্থা বর্ণনা করেন। তারা বলল: বেনইয়ামিনকে সাথে করে না গেলে এরপর আর মিশর থেকে খাদ্য আনা যাবে না। তারা মালপত্র খোলার পর দেখল তাদের পরিশোধকৃত মূল্য ফেরত দেওয়া হয়েছে। তারা তাদের পিতাকে বলল, বেনইয়ামিনকে আমাদের সাথে যেতে দিন যাতে আমরা খাদ্যশস্য পেতে পারি। প্রথমে পিতা ইয়াকুব তাদের সাথে বেনইয়ামিনকে পাঠানো তে ইতস্ত হলো। পরে অনেক প্রতিশ্রুতির দিয়ে রাজী করানো হয় । এবং তারা বলে যে আমরা আমাদের ভাইকে রক্ষণাবেক্ষণ করবো। তাদের পিতা তাদের নিকট থেকে প্রতিশ্রুতি নিলেন যেন তারা বেনইয়ামিনকে নিরাপদে ফিরিয়ে নিয়ে আসে। তারা যখন ইউসুফের কাছে পৌঁছল তখন তিনি তাদের প্রতি দু’জনকে একটি করে থাকার জন্য কক্ষ দিলেন। ফলে বেনইয়ামিন একা পরে যায়। ইউসুফ তাকে তার সাথে অবস্থান করতে বললেন। অবস্থান কালে ইউসুফ তার ভাইয়ের কাছ তার পরিচয় প্রকাশ করলেন। ইউসুফের ভাইদের যাত্রার দিন বেনইয়ামনের খাদ্যশস্য যে উটের পিটে দেওয়া হয়, তাতে একটি পাত্র গোপনে রেখে দেয়া হল।

তারা যখন যাত্রা শুরু করে তখন রাজ কর্মচারীর একজন বলল, ঐ কাফেলার মধ্যে অনুসন্ধান কর। তারা ঘটনা জানতে চাইলে বলে আমাদের একটি পাত্র হারিয়ে গিয়েছে। তারা বলল, আমরা চুরি করিনি। যদি আমাদের কেউ চুরি করে থাকি তাহলে তাকে দাস হিসেবে আপনাদের কাছে রেখে দিবেন। তারা সবার মালপত্র অনুসন্ধান করলো পরে যখন বেনইয়ামিনের মালপত্র অনুসন্ধান করলো তাতে তারা চুরি হয়ে যাওয়া পাত্রটি খুজে পেল। তখন ইউসুফের ভাইরা তার পক্ষে কথা না বলে বলতে লাগল, তার বড় ভাই ইউসুফও চোর ছিল। তারা বেনইয়ামিনের মুক্তির ব্যাপারে অনেক চেষ্টা করে নিরাশ হয়, ফলে তারা যখন নিজ দেশে ফিরে যাওয়ার ব্যাপারে মনস্থির করলো, তখন তাদের জ্যেষ্ঠ ভাই লাভি বাড়ি ফিরে যেতে রাজি হলেন না। সে বলল, ইউসুফের ঘটনায় আমরা পিতাকে যথেষ্ট আঘাত দিয়েছি। আমি মিশরে থেকে সে পর্যন্ত যাব না যে পর্যন্ত না পিতা আমাকে যেতে না বলেন। তোমরা বাড়ি ফিরে যাও। গিয়ে বল, বেনইয়ামিন চুরির অপরাধে আটক হয়েছে। পিতা যদি বিশ্বাস করতে না চায় তাহলে অন্যান্য সহযাত্রীদের কাছে জিজ্ঞাসা করতে বল এবং এটাও বল আমাদের বড় ভাই বেনইয়ামিনকে মুক্ত করার জন্য মিশরেই রয়ে গেছে। ইউসুফের বৈমাত্রেয় ভাইরা শেষ পর্যন্ত বেনইয়ামিন ও বড় ভাই লাভিকে মিশরে রেখেই দেশে ফিরে গেল। তারা তার পিতাকে বেনইয়ামিনের সম্পর্কে বললেন কিন্তু ইয়াকুব তা বিশ্বাস করলেন না। ইয়াকুব ইউসুফের জন্য কাঁদতে কাঁদতে তার চোখ সাদা হয়ে গিয়েছিল এবং দৃষ্টিশক্তি হারিয়ে ফেলেছিলেন। ইয়াকুব পুত্রদেরকে নির্দেশ দিলেন যে, তোমরা পুনরায় মিশরে যাও এবং সেখানে ইউসুফকে অনুসন্ধান কর। পাশাপাশি বেনইয়ামিনের মুক্তির জন্য চেষ্টা কর। এরপর তাদেরকে নিয়ে তোমরা আমার কাছে ফিরে এসো। ইয়াকুব পুত্রদের সাথে একটি পত্র লিখে দিলেন বাদশাহকে দেওয়ার জন্য।

তৃতীয়বার যখন তারা মিশরে গেল, তখন তারা অত্যন্ত অনুনয়-বিনয় করে ইউসুফকে বলল, আমরা দুর্ভিক্ষের কারণে ভীষণভাবে অভাব গ্রস্ত হয়ে পড়েছি। ফলে খাদ্য কেনার জন্য পর্যাপ্ত অর্থ সংগ্রহ করা আমাদের পক্ষে সম্ভব হয়নি। তারা আবদার করলো, প্রথমবার যেমন তাদের পূর্ণ অর্থ ফেরৎ দেয়া হয়েছিল এবার যেন অনুগ্রহ করে অর্ধেক মূল্য মাফ করে দেয়া হয়। তখন তারা ইউসুফকে হাতে পত্রটি দিয়ে বলল, আমাদের পিতা আপনাকে এই পত্রটি দিয়েছে। আর আমাদের ভাই বেনইয়ামিনকে আমাদের সাথে ফিরে যাওয়ার অনুমতি দিন। তিনি বললেন, তোমাদের কি মনে আছে যে, অজ্ঞতা ও অপরিনামদর্শীতার কারণে তোমরা তোমাদের ভাই ইউসুফ ও তার সহোদরের সাথে কি আচরণ করেছো? এ কথা শুনে ভাইরা চমকে উঠলো। তারা জিজ্ঞাসা করলো তাহলে কি তুমিই ইউসুফ? তিনি বললেনঃ হ্যাঁ, আর এ আমার ভাই বেনইয়ামিন। তখন তারা লজ্জিত হলো। এরপর তারা পিতার অবস্থা সম্পর্কে খুলে বললো। পিতা দৃষ্টিশক্তি হারিয়েছেন এটা শোনার পর ইউসুফ তার নিজের একটি জামা দিয়ে বললেন, এটা পিতার চোখের উপর রাখলে তিনি দৃষ্টিশক্তি ফিরে পাবেন। এরপর পরিবারের সকলকে নিয়ে আসার জন্য তিনি ভাইদেরকে পাঠালেন। ইউসুফের ভাইরা যখন তার পরিধানের জামা নিয়ে মিশর ত্যাগ করলো, তখন সিরিয়ার কেনানে বসে ইয়াকুব পরিবারের লোকজনকে উদ্দেশ্য করে বলতে লাগলেন, তোমরা যদি আমাকে অপ্রকৃতিস্থ মনে না কর তাহলে আমি নিশ্চিত করে বলবো যে, আমি ইউসুফের ঘ্রাণ পাচ্ছি। পরিবারের লোকজন বলল, ইউসুফের মৃত্যুর এত বছর পর তার বেঁচে থাকার আশা করা বা তার ঘ্রাণ অনুভব করা স্বপ্ন ছাড়া আর কিছু নয়। যখন তারা বাড়িতে ফিরে এসে ইউসুফের জামাটি তাদের বাবার চেখের উপর রাখলো সাথে সাথে তিনি দৃষ্টিশক্তি ফিরে পেলেন। ইউসুফ যখন জানতে পারলেন তার পরিবার মিসরের কাছাঁকাছি পৌঁছে গেছেন তখন তিনি তাদেরকে নিয়ে আসার জন্য শহরের বাইরে অপেক্ষা করতে লাগলেন। কাফেলা পৌঁছামাত্রই তিনি পিতাকে জড়িয়ে ধরে আলিঙ্গণ করলেন। ইউসুফ তার পরিবার নিয়ে মিশরে বসবাস করতে শুরু করলেন।

মৃত্যু

ইউসুফ ১১০ বছর জীবিত ছিলেন। মৃত্যুর পূর্বে তিনি ইসরাইলীদের শপথ করিয়ে বলেন, যখন তারা মিশর ত্যাগ করবে তখন তার হাড় তাদের সাথে নিয়ে যেতে পারে। তার মৃত্যুর পর তার মৃত দেহ মিশরের একটি কফিনে সংরক্ষণ করা হয়। ইসরাইলীরা তাদের কর্তৃক শপথ মনে রেখে ছিল, যখন তারা মিশর ত্যাগ করে মুসা সাথে তখন তারা ইউসুফের হাড় তাদের সাথে ইসরায়েলে নিয়ে যায়। তার হাড় সেচেমে কবর দেওয়া হয়েছে, এই জায়গাটি ইয়াকুব দিনাহ্ ছেলের কাছ থেকে কিনে ছিলেন।

May be an image of text

নবী ইবরাহীম (আ) এর অগ্নি পরীক্ষা
ইবরাহীম (আ) এর সাথে যখন যুক্তি ও বিতর্কে এঁটে উঠতে পারলো না, তাদের পক্ষে পেশ করার মত কোন দলীল-প্রমাণ থাকল না, তখন তারা বিতর্কের পথ এড়িয়ে শক্তি ও ক্ষমতা প্রয়োগের পথ অবলম্বন করে- যাতে করে নিজেদের নির্বুদ্ধিতা ও হঠকারিতা টিকিয়ে রাখতে পারে। অতঃপর আল্লাহ্ সুবাহানহুয়া তা’আলা তাদের চক্রান্তকে ব্যর্থ করে দেয়ার কৌশল গ্রহণ করেন।

‘তারা বলল, একে পুড়িয়ে দাও এবং তোমাদের উপাস্যদের সাহায্য কর, যদি তোমরা কিছু করতে চাও। আমি বললাম, হে অগ্নি! তুমি ইব্রাহীমের উপর শীতল ও নিরাপদ হয়ে যাও। তারা ইব্রাহীমের বিরুদ্ধে চক্রান্ত করল, অতঃপর আমি তাদেরকেই সর্বাধিক ক্ষতিগ্রস্থ করে দিলাম।’ -[ক্বুরআন ২১ : ৬৮-৭০]

তারা বিভিন্ন স্থান থেকে সম্ভাব্য চেষ্টার মাধ্যমে জ্বালানি কাঠ সংগ্রহ করতে থাকে। দীর্ঘদিন পর্যন্ত তারা এ সংগ্রহের কাজে রত থাকে। তাদের মধ্যে কোন মহিলা পীড়িত হলে মানত করত যে, যদি সে আরোগ্য লাভ করে তবে ইবরাহীম (আ) কে পোড়াবার লাকড়ি সংগ্রহ করে দেবে। এরপর তারা বিরাট এক গর্ত তৈরী করে তার মধ্যে লাকড়ি নিক্ষেপ করে অগ্নি সংযোগ করে। ফলে তীব্র দাহনে প্রজ্বলিত অগ্নিশিখা এত উর্ধে উঠতে থাকে, যার কোন তুলনা হয় না। তারপর ইবরাহীম (আ) কে মিনজানীক নামক নিক্ষেপণ যন্ত্রে বসিয়ে দেয়।

এ যন্ত্রটি কুর্দী সম্প্রদায়ের হাযান নামক এক ব্যক্তি তৈরী করে। মিনজানীক যন্ত্র সে-ই প্রথম আবিষ্কার করে। আল্লাহ্ তাকে মাটির মধ্যে ধসিয়ে দেন। কিয়ামত পর্যন্ত সে মাটির মধ্যে তলিয়ে যেতে থাকবে। তারপর তারা ইবরাহীম (আ) কে আষ্টেপৃষ্ঠে বেঁধে টেনে হেঁচড়ে নিয়ে যেতে থাকে। তখন তিনি বলতে থাকেন-
‘আপনি (আল্লাহ্) ব্যতীত আর কোন ইলাহ নেই, আপনি মহা পবিত্র, বাদশাহীর মালিক কেবল আপনিই, আপনার কোন শরীক নেই।’

অতঃপর তারা ইবরাহীম (আ) কে মিনজানীকের পাল্লায় হাত-পা বাঁধা অবস্থায় রেখে আগুনে নিক্ষেপ করে। তখন তিনি বলেন-
‘আমার জন্য আল্লাহ্-ই যথেষ্ট, তিনি উত্তম অভিভাবক।’

আবু ইয়ালা (র)… আবু হুরায়রা (রা) সূত্রে বর্ণনা করেন, রাসূলুল্লাহ (সা) বলেছেন, ইবরাহীম (আ) কে যখন আগুনে নিক্ষেপ করা হয় তখন তিনি এ দু’আটি পড়েন-
‘হে আল্লাহ্! আপনি আকাশ রাজ্যে একা আর এই যমীনে আমি একাই আপনার ইবাদাত করছি।’

পূর্ববর্তী যুগের কোন কোন আলিম বলেন, জিবরাঈল (আ) শূন্য থেকে ইবরাহীম (আ) কে বলেছিলেন- আপনার কোন সাহায্যের প্রয়োজন আছে কি? উত্তরে ইবরাহীম (আ) বলেছিলেন- সাহায্যের প্রয়োজন আছে, তবে আপনার কাছে নয় (আল্লাহর কাছে)।

আর আল্লাহর নির্দেশ বাণী অধিক দ্রুত গতিতেই পৌঁছে যায় –
‘(আল্লাহ্ বলেন) আমি বললাম, হে আগুন! তুমি ইবরাহীমের উপর শান্তিদায়ক হয়ে যাও।’

ইবরাহীম (আ) যখন প্রাচীর বেষ্টনীর মধ্যকার উক্ত গহ্বরে অবস্থান করছিলেন, তখন তার চতুষ্পার্শ্বে আগুনের লেলিহান শিখা দাউ দাউ করছিল, অথচ তিনি ছিলেন শান্তি ও নিরাপদে।

আবু হুরায়রা (রা) বলেন, ইবরাহীম (আ) এর পিতা আপন পুত্রের এ অবস্থা দেখে একটি উত্তম কথা বলেছিল, তা হল-
‘হে ইবরাহীম! তোমার প্রতিপালক কতই না উত্তম প্রতিপালক।’

তথ্যসূত্র: আল-বিদায়া ওয়ান নিহায়া, ১ম খণ্ড

May be an illustration of text

হজরত ইউনুস (আ.) একজন সম্মানিত নবী। পবিত্র কোরআনে স্বতন্ত্র একটি সুরা অবতীর্ণ হয়েছে তার নামে- ‘সুরা ইউনুস’। এ ছাড়াও পবিত্র কোরআনে আরও ছয়টি সুরায় তার সম্পর্কে আলোচনা করা হয়েছে। পৃথিবীতে দুজন নবী মায়ের নামে পরিচিত হয়েছেন। একজন হজরত ঈসা ইবনে মরিয়ম, অন্যজন হজরত ইউনুস ইবনে মাত্তা। মাত্তা হজরত ইউনুস (আ.)-এর মায়ের নাম। মায়ের নামেই তাকে ইউনুস ইবনে মাত্তা বলা হয়। কোরআন মাজিদে তাকে তিনটি নামে উল্লেখ করা হয়েছে- মূল নাম ইউনুস, জুননূন ও সাহিবুল হুত। ‘জুননূন’ ও ‘সাহিবুল হুত’-এর অর্থ মাছওয়ালা। মাছ সংশ্লিষ্ট ঘটনার দিকে ইঙ্গিত করে তাকে এ নামে উল্লেখ করা হয়েছে।

হজরত ইউনুস (আ.)-কে বর্তমান ইরাকের মসুল নগরীর নিকটবর্তী নিনাওয়া জনপদে নবী হিসেবে পাঠানো হয়েছিল। সুরা সাফফাতের ১৪৭নং আয়াতে এ সংক্রান্ত আলোচনা করা হয়েছে। তিনি মসুলবাসীকে আল্লাহর পথে ডাকলেন। হেদায়েতের পথপ্রদর্শন করলেন। ঈমান ও সৎকর্মের প্রতি আহ্বান করলেন। আখেরাতের বিষয়ে সতর্ক করলেন। জাহান্নামের ভীতি প্রদর্শন করলেন। জান্নাতের নাজ-নেয়ামতের কথা শোনালেন; কিন্তু তার সম্প্রদায়ের লোকজন অবাধ্যতা প্রদর্শন করল।

এক দিন-দুদিন করে দীর্ঘদিন অতিবাহিত হয়ে গেল। ইউনুস (আ.) তাদের ঈমান সম্পর্কে কিছুটা হতাশ হয়ে পড়লেন এবং তিন দিনের মধ্যে আল্লাহর আজাব তাদের ওপর নিপতিত হচ্ছে ঘোষণা দিয়ে নিজ এলাকা পরিত্যাগ করলেন। কিন্তু এলাকা পরিত্যাগ করার ক্ষেত্রে তিনি আল্লাহর নির্দেশের অপেক্ষা করেননি। এভাবে আল্লাহর নির্দেশের অপেক্ষা না করে নিজ উদ্যোগে বের হওয়াটা গুনাহ ছিল না, কিন্তু নবুয়তের শানের পরিপন্থি ছিল, যা আল্লাহর পছন্দ হয়নি। আল্লাহ তাঁর প্রিয় বান্দাদের এমন ছোটখাটো বিচ্যুতিতেও বড় ধরপাকড় করেন।

হজরত ইউনুস (আ.) এলাকা পরিত্যাগ করার পর লোকজন উপলব্ধি করল যে, এবার নিশ্চিত আল্লাহর আজাব চলে আসবে। তাই তারা সবাই মিলে আল্লাহর কাছে তওবা করল। লোকালয় ছেড়ে বন-বাদাড়ের দিকে চলে গেল। গবাদিপশু ও শিশুদেরও সঙ্গে নিল। সেখানে সবাই কায়মনোবাক্যে আল্লাহর কাছে আশ্রয় ও ক্ষমা প্রার্থনা করল। তাদের খাঁটি তওবা ও কাকুতি-মিনতির কারণে আল্লাহ তাদের ওপর থেকে আজাব সরিয়ে নেন।

এলাকা পরিত্যাগের পর হজরত ইউনুস (আ.) ভাবছিলেন, তার সম্প্রদায় হয়তো আল্লাহর আজাবে ধ্বংস হয়ে গেছে। তিনি কল্পনাও করতে পারেননি যে, তারা তওবা করে আল্লাহর প্রতি ঈমান নিয়ে আসবে। ফলে তিনি যখন জানতে পারলেন, তারা সবাই ঈমান নিয়ে এসেছে, একদিকে তিনি বিস্মিত হলেন, অন্যদিকে ভীতসন্ত্রস্তও হলেন। ভীত হওয়ার কারণ ছিল, তিনি তাদের বলেছিলেন, তিন দিনের মধ্যে আল্লাহর আজাব আসবে। কিন্তু তাদের দোয়ার কারণে সেই আজাব সরে গেছে। সুতরাং তারা তাকে মিথ্যাবাদী সাব্যস্ত করে হত্যা করতে পারে। তৎকালে মিথ্যা বলার শাস্তি ছিল হত্যা। এই শঙ্কায় তিনি স্বদেশে না ফিরে দূরদেশে হিজরতের ইচ্ছা করলেন। এ উদ্দেশ্যে মানুষবোঝাই একটি নৌকায় চড়ে বসলেন। নৌকা মাঝনদীতে পৌঁছামাত্র প্রচণ্ড বেগে ঝড়-তুফান শুরু হলো। বিশাল বিশাল ঢেউয়ের ধাক্কায় নৌকা ডুবে যাওয়ার উপক্রম হলো। অবস্থা বেগতিক দেখে মাঝিরা বলল, এখানে মালিকের অবাধ্যতা করে কেউ নৌকায় আরোহণ করেছে। মাঝিদের বিশ^াস ছিল, কোনো অন্যায় কাজ করে কেউ নৌকায় আরোহণ করলে এমন পরিস্থিতি তৈরি হয়। সুতরাং তারা বলল, এমন কেউ থাকলে তাকে নদীতে ফেলে দিতে হবে, তা হলে অন্য যাত্রীরা এই বিপদ থেকে রক্ষা পাবে। তখন যাত্রীদের মধ্যে লটারি দেওয়া হলো। লটারিতে হজরত ইউনুস (আ.)-এর নাম এলো। তিনবার লটারি হলো, প্রতিবার তার নামই বেরিয়ে এলো। হজরত ইউনুস (আ.) নদীতে ঝাঁপিয়ে পড়লেন। ইতোমধ্যে একটি বিশালদেহী মাছ এসে হজরত ইউনুসকে গিলে ফেলে। সেই মাছের প্রতি আল্লাহর নির্দেশ ছিল, হজরত ইউনুস (আ.)-এর অস্থিমজ্জার যেন ক্ষতি না হয়। সে তার খাদ্য নয়, তার উদর কিছু দিনের জন্য তার বন্দিখানা মাত্র।

মাছের উদরে গিয়ে তিনি একটি দোয়া পড়লেন। আল্লাহর কাছে আশ্রয় চাইলেন। ক্ষমা প্রার্থনা করলেন। তিনি বললেন, ‘লা ইলাহা ইল্লা আন্তা সুবহানাকা ইন্নি কুনতু মিনাজ জোয়ালিমিন।’ অর্থাৎ ‘হে আল্লাহ! আপনি ছাড়া আমার কোনো ইলাহ নেই। আপনি চিরপবিত্র, নিশ্চয়ই আমি নিজের ওপর জুলুম করে ফেলেছি।’ এই দোয়ার বরকতে মাছের পেট থেকে আল্লাহ তাকে মুক্তি দেন, নতুবা মাছের পেটই তার সমাধি হতো। আল্লাহ তায়ালা বলেন, ‘যদি ইউনুস আল্লাহর তাসবিহ পাঠ না করতেন, তবে তাকে কেয়ামত দিবস পর্যন্ত মাছের উদরেই থাকতে হতো।’ (সুরা সাফফাত : ১৪৩-১৪৪)

কিছুদিন পর মাছ হজরত ইউনুস (আ.)-কে নদীতীরে উদ্গিরণ করে দিল। আল্লাহ তায়ালা সেখানে তার শারীরিক সুস্থতার জন্য লতাবিশিষ্ট বৃক্ষ উদগত করে দেন। আল্লাহ তায়ালা বলেন, ‘অতঃপর আমি তাকে এক বিস্তীর্ণ-বিজন প্রান্তরে নিক্ষেপ করলাম, তখন তিনি ছিলেন রুগ্ণ। আমি তার জন্য এক লতাবিশিষ্ট বৃক্ষ উদগত করলাম।’ (সুরা সাফফাত : ১৪৫-১৪৬)
হজরত ইউনুস (আ.)-এর ঘটনা থেকে আমাদের শিক্ষণীয় বিষয় হলো- যেকোনো বিপদাপদে আল্লাহর দিকে মনোনিবেশ করা এবং তাঁর আশ্রয় কামনা করা। হাদিস শরিফে আছে, যেকোনো উদ্দেশ্য হাসিলের নিয়তে যদি কেউ ‘লা ইলাহা ইল্লা আন্তা সুবহানাকা ইন্নি কুনতু মিনাজ জোয়ালিমিন’ দোয়াটি পড়ে তবে আল্লাহ তার উদ্দেশ্য পূরণ করে দেন এবং বিপদ থেকে রক্ষা করেন। (তিরমিজি : ৩৫০৫; রুহুল মায়ানি : ৮/১০৯)। আল্লাহ এসব শিক্ষা আমাদের জীবনেও বাস্তবায়ন করার তাওফিক দিন। আমিন।

May be an image of boat and text

নূহ (আরবি: نوح; হিব্রু ভাষায়: נוֹחַ or נֹחַ, আধুনিক হিব্রু: Nóaḥ, তিবেরিয়ান: Nōªḥ; Nūḥ; আর্মেনীয়: “Noe” অথবা նօի) মুসলমানদের ধর্মীয় গ্রন্থ কুরআনের বর্ণনা অনুসারে, একজন নবী ছিলেন।কুরআনে নূহ শিরোনামে একটি পূর্নাঙ্গ সূরা নাযিল হয়েছে যেখানে তার এবং সমকালীন বিভিন্ন বিষয় সম্পর্কে বলা হয়েছে। খ্রিস্ট ধর্মের মূল ধর্মীয় গ্রন্থ বাইবেলও তার সম্পর্কে বিশদ বিবরণ পাওয়া যায়।

কুরআনের বর্ণনা

ইসলামের বর্ণনায়, আদম এর বংশধর নারী পুরুষরা তার শিক্ষা অনুসারে এক আল্লাহর উপাসনা করত। তাদের মধ্যে অনেক ধার্মিক ব্যক্তি ছিলেন যাদেরকে তার সম্প্রদায়ের মানুষ সম্মান ও মান্য করত। বলা হয় যে, যখন এই ধার্মিক লোকেরা মারা যায় তখন তাঁদের ভক্তরা তাঁদের বসার জায়গাগুলোকে উপাসনালয় বানিয়ে নেয় এবং তাঁদের চিত্রও সেখানে ঝুলিয়ে দেয়। তাদের উদ্দেশ্য ছিল, এভাবে তারা তাঁদেরকে স্মরণ করে তারাও তাঁদের মত আল্লাহর উপাসনা করবে। তারপর যখন কিছু কাল অতিবাহিত হল, তখন তারা এই চিত্রগুলোর মূর্তি নির্মাণ করল। আরও কিছু কাল পর পরবর্তী বংশধররা শয়তানের প্ররোচনায় এসব মূর্তির উপাসনা করতে শুরু করে। এসব পথভ্রষ্ট মানুষদের সঠিক দিক নির্দেশনা দেয়ার দায়িত্ব দিয়ে আল্লাহ হযরত নূহকে তাদের মাঝে নবি হিসাবে প্রেরণ করেন।

কুরআনে ৪৩ বার নূহ নবীর উল্লেখ পাওয়া গেছে। কুরআন অনুসারে, নূহ সাড়ে নয়শত বছরের দীর্ঘ বয়স লাভ করেছিলেন এবং সারা জীবন মানুষকে সঠিক পথে আনার জন্য কাজ করেন। কিন্তু তার জাতি তাঁকে প্রত্যাখ্যান করে। ফলে তার জাতি ভয়াবহ বন্যায় ধ্বংস হয়ে যায়।

কুরআনে বলা হয়েছে,

“নিশ্চয় আমরা নূহ্কে পাঠিয়েছিলাম তার সম্প্রদায়ের প্রতি এ নির্দেশসহ যে, আপনি আপনার সম্প্রদায়কে সতর্ক করুন তাদের প্রতি যন্ত্রণাদায়ক শাস্তি আসার আগে। তিনি বললেন, ‘হে আমার সম্প্রদায়, নিশ্চয় আমি তোমাদের জন্য স্পষ্ট সতর্ককারী – এ বিষয়ে যে, তোমরা আল্লাহ্-র উপাসনা করো, তাঁকে ভয় করো এবং আমার আনুগত্য করো। তিনি তোমাদের জন্য তোমাদের পাপসমূহ ক্ষমা করবেন এবং তোমাদেরকে অবকাশ দেবেন এক নির্দিষ্ট সময় পর্যন্ত। নিশ্চয় আল্লাহ্ কর্তৃক নির্দিষ্ট সময় উপস্থিত হলে তা বিলম্বিত করা হয় না; যদি তোমরা এটা জানতে’।”[কুরআন ৭১:১–৪]

তার সম্প্রদায়ের প্রতিক্রিয়া সম্পর্কে কুরআনে বলা হয়েছে,

“আর তারা বলে, ‘তোমরা তোমাদের উপাস্যদের বর্জন করো না। বর্জন করো না ওয়াদ, সুওয়া’, ইয়াগূছ, ইয়া‘ঊক ও নাসরকে’।”[কুরআন ৭১:২৩]

নূহের বিরুদ্ধে তাদের যুক্তি সম্পর্কে কুরআনে বলা হয়েছে,

“অতঃপর তার সম্প্রদায়ের নেতারা যারা কুফরী করেছিল, তারা বলল, ‘আমরা তো তোমাকে আমাদের মত একজন মানুষ ছাড়া কিছু দেখছি না এবং আমরা দেখছি যে, কেবল আমাদের নিচু শ্রেণীর লোকেরাই বিবেচনাহীনভাবে তোমার অনুসরণ করেছে। আর আমাদের উপর তোমাদের কোনো শ্রেষ্ঠত্ব আমরা দেখছি না; বরং আমরা তোমাদেরকে মিথ্যাবাদী মনে করি’।”[কুরআন ১১:২৭]

আরও বলা হয়েছে,

“অতঃপর তার সম্প্রদায়ের নেতারা, যারা কুফরী করেছিল, তারা বলল, ‘এ তো তোমাদের মতই একজন মানুষ, সে তোমাদের উপর শ্রেষ্ঠত্ব লাভ করতে চাচ্ছে। আর আল্লাহ্‌ ইচ্ছে করলে ফেরেশতাই পাঠাতেন। আমরা তো আমাদের পূর্বপুরুষদের কালে এরূপ ঘটেছে বলে শুনিনি। সে কেবল এমন এক লোক, যার মধ্যে পাগলামী রয়েছে। অতএব তোমরা তার সম্পর্কে কিছুকাল অপেক্ষা করো’।”[কুরআন ২৩:২৪–২৫]

তাদের যুক্তির জবাবে কুরআনে বলা হয়েছে,

“আর যদি রাসূলকে ফেরেশতা বানাতাম তবে তাকে পুরুষ মানুষই বানাতাম। ফলে তারা যে সন্দেহ করে, সে সন্দেহেই তাদেরকে রেখে দিতাম।”[কুরআন ৬:৯]

“তিনি (নূহ) বললেন, ‘হে আমার সম্প্রদায়, তোমরা আমাকে বল, আমি যদি আমার রব প্রেরিত স্পষ্ট প্রমাণে প্রতিষ্ঠিত থাকি এবং তিনি যদি আমাকে তার নিজের পক্ষ থেকে অনুগ্রহ দান করে থাকেন, অতঃপর সেটা তোমাদের কাছে গোপন রাখা হয়, আমরা কি এ বিষয়ে তোমাদেরকে বাধ্য করতে পারি, যখন তোমার এটা অপছন্দ কর? আর হে আমার সম্প্রদায়, এর বিনিময়ে আমি তোমাদের কাছে কোনো সম্পদ চাই না। আমার প্রতিদান শুধু আল্লাহর কাছে। যারা ঈমান এনেছে, আমি তাদের তাড়িয়ে দিতে পারি না। নিশ্চয় তারা তাদের রবের সাথে সাক্ষাৎ করবে। কিন্তু আমি তো দেখছি তোমরা এক অজ্ঞ জাতি’।”[কুরআন ১১:২৮–২৯]

তারপরও তার সম্প্রদায় বিশ্বাস না করে আল্লাহ্-র শাস্তি নিয়ে আসতে বলেছে এবং তাঁকে মৃত্যুর হুমকিও দিয়েছে বলে কুরআনে বর্ণিত হয়েছে,

“তারা বলল, ‘হে নূহ, তুমি আমাদের সাথে বাদানুবাদ করছ এবং আমাদের সাথে অতিমাত্রায় বিবাদ করেছ। অতএব যার প্রতিশ্রুতি তুমি আমাদেরকে দিচ্ছ, তা আমাদের কাছে নিয়ে আস, যদি তুমি সত্যবাদীদের অন্তর্ভুক্ত হও’।”[কুরআন ১১:৩২]

“তারা বলল, ‘হে নূহ, তুমি যদি বিরত না হও তবে অবশ্যই তুমি প্রস্তরাঘাতে নিহতদের অন্তর্ভুক্ত হবে’।”[কুরআন ২৬:১১৬]

দীর্ঘকাল তাওহীদের প্রতি আহ্বানের পর যখন আর কেউ ঈমান আনার সম্ভাবনা থাকল না, তখন কাফিরদের মহাপ্লাবনের মাধ্যমে ধ্বংস করে দেয়া হয় এবং নৌকায় আরোহণ করে নূহ ও অন্য মুমিনরা বেঁচে যায় বলে কুরআনের বিভিন্নস্থানে বলা হয়েছে।

“অতঃপর সে তার প্রতিপালককে আহবান করল যে, ‘নিশ্চয় আমি পরাজিত, অতএব তুমিই প্রতিশোধ গ্রহণ কর’। ফলে আমি বর্ষণশীল বারিধারার মাধ্যমে আকাশে দ্বারসমূহ খুলে দিলাম। আর ভূমিতে আমি ঝর্ণা উৎসারিত করলাম। ফলে সকল পানি মিলিত হল নির্ধারিত নির্দেশনা অনুসারে। আর আমি তাকে (নূহকে) কাঠ ও পেরেক নির্মিত নৌযানে আরোহণ করালাম। যা আমার চাক্ষুস তত্ত্বাবধানে চলত, তার জন্য পুরস্কার স্বরূপ, যাকে প্রত্যাখ্যান করা হয়েছিল।”[কুরআন ৫৪:১০–১৪]

বাইবেলের বর্ণনা

বাইবেলে বর্ণনা অনুসারে, নোয়াহ ছিলেন প্লাবন পূর্ব যুগের দশম শ্রদ্ধেয় নেতা। তার পিতা ছিলেন একজন গোত্রপতি। মাতার পরিচয় জানা যায়নি। নোয়াহর বয়স যখন পাঁচশত বছর তখন সেমহামম্ এবং যাপেট নামে তার তিন পুত্রের জন্ম হয়।

বুক অব জেনেসিসের বর্ণনা

বুক অব জেনেসিসের ৬-৯ পরিচ্ছেদে নূহের প্লাবনের বিশদ বর্ণনা আছে। বর্ণনায় বলা হয়েছে, পৃথিবীর মানুষের বিশাল পাপের কারণে ঈশ্বর পৃথিবীতে মহাপ্লাবনের মাধ্যমে পৃথিবী ধ্বংস করেন। নূহের নৌকায় তুলে নেয়া পৃথিবীর সমস্ত প্রানীর জোড়া থেকে পুনরায় তাদের সৃষ্টি করেন। ঈশ্বর এই মর্মে প্রতিজ্ঞা করেন যে, তিনি আর কোন প্লাবন সৃষ্টি করবেন না।

May be an image of text that says 'ISMAIL'

আল্লাহপাক কোরআন মজিদে এই ঘটনার বর্ণনা দিয়েছেন এভাবে- আল্লাহর নবী হজরত ইবরাহিম (আ.) ছেলে ইসমাইলকে বললেন যে, ‘হে আমার প্রিয় বৎস! আমি স্বপ্নে দেখেছি যে, আমি তোমাকে জবাই করছি। এ ব্যাপারে তোমার মতামত কী, ভেবে দেখ? ইসমাইল (আ.) সঙ্গে সঙ্গে বললেন, ইয়া আবাতিফ আল মা তু-মার, সাতাজিদুনি ইনশাআল্লাহু মিনাস সোয়াবেরিন।’ ‘আব্বাজান! যে আদেশ আপনার প্রতি এসেছে, তা আপনি কার্যকর করুন। আপনি আমাকে ধৈর্যশীলদের মধ্যে পাবেন, ইনশাআল্লাহ।’ যেমন বাবা তেমন ছেলে। কথায় বলে ‘বাপ কা বেটা’। ইনশাআল্লাহ-এর আক্ষরিক তরজমা ‘আল্লাহ যদি চান’। ইসমাইল (আ.) বরকত হাসিলের জন্যই আল্লাহর ইচ্ছার সঙ্গে নিজের মত ও সিদ্ধান্তকে যুক্ত করেছেন। অন্যথায় তার সিদ্ধান্তটি ছিল অবিচল। মনে কোনো সংশয় রেখে বলেননি যে, আল্লাহ যদি চান। এভাবে পিতাণ্ডপুত্র উভয়ে নিজেকে সমর্পণ করলেন।

‘ফালাম্মা আসলমা’- ‘অতঃপর তারা যখন আল্লাহর আদেশের সামনে মাথা নত করে দিলেন।’ ‘ওয়াতাল্লাহু লিল জাবিন’- ‘আর তাকে (ইসমাইলকে) শুইয়ে দিলেন (মাটির ওপরে) কপাল-পার্শ্ব রেখে।’ কপালের এক পার্শ্বকে বলা হয় জাবিন। অর্থাৎ কাত করে শোয়ালেন। এই দৃশ্য বড় হৃদয়বিদারক। তখন ইবরাহিম (আ.) বললেন, হে বৎস! তুমি আল্লাহর হুকুম পালনে আমার বড় সহায় হলে। অতঃপর ছেলে যা যা বললেন, ইবরাহিম আঞ্জাম দিলেন।

কোরআন মজিদ তার বর্ণনা দিয়েছে এভাবে- ‘ওয়া না-দাইনাহু আঁই ইয়া ইবরাহিম, ক্বাদ সাদ্দাকতার রু-য়া ইন্না কাজালিকা নাজজিল মুহসিনিন।’ ‘আমি তাকে ডাক দিয়ে বললাম, হে ইবরাহিম! তোমার স্বপ্নকে বাস্তবে পরিণত করেছ। এভাবেই আমি আমার সত্যনিষ্ঠ বান্দাদের প্রতিদান দিয়ে থাকি।’ ইবরাহিম (আ.) মাথা তুলে চোখের বাঁধন খুলে দেখলেন, পাহাড়ের ওপর থেকে একটি দুম্বা নেমে আসছে, দেখতে হৃষ্টপুষ্ট। অন্তত চল্লিশ বসন্ত বেহেশতের চারণভূমিতে বিচরণ করেছে। হজরত ইবনে আব্বাস (রা.) বলেন, এই দুম্বা ছিল হজরত আদম (আ.) এর ছেলে হাবিলের দেওয়া কোরবানি, যা আল্লাহর দরবারে কবুল হয়েছিল। জান্নাত কাননে তা পালিত হয়েছে। এজন্য আল্লাহপাক একে ‘জিবহিন আজিম’ মহা মর্যাদাবান কোরবানি বলে অভিহিত করেছেন।

জিবরাইল (আ.) বললেন, এই দুম্বা আপনার ছেলের পরিবর্তে উৎসর্গিত। ইসমাইলের পরিবর্তে এটি জবাই করেন। তখন জিবরাইল (আ.) তাকবির ধ্বনি দিলেন, ‘আল্লাহু আকবার আল্লাহু আকবার’। ইবরাহিম (আ.) তাকে অনুসরণ করে বললেন, ‘লা ইলাহা ইল্লাল্লাহু আল্লাহু আকবার’। সঙ্গে সঙ্গে ইসমাইল (আ.) ও বললেন, ‘আল্লাহু আকবার ওয়ালিল্লা হিল হামদ’। এই তাকবির নিয়মে পরিণত হয় ঈদের দিনগুলোতে ও হজের সময়ের জন্য। (তাফসিরে কাশফুল আসরার অষ্টম খণ্ড : পৃ. ২৯৩)।

May be an image of text

হযরত ইলিয়াস (আ.)-এর জীবনী।

পবিত্র কুরআনে মাত্র দু’জায়গায় হযরত ইলিয়াস (আঃ)-এর আলোচনা দেখা যায়। সূরা আন‘আম ৮৫ আয়াতে ও সূরা ছাফফাত ১২৩-১৩২ আয়াতে। সূরা আন‘আমে ৮৩-৮৫ আয়াতে ১৮ জন নবীর তালিকায় তাঁর নাম রয়েছে। সেখানে কোন আলোচনা স্থান পায়নি। তবে সূরা ছাফফাতে সংক্ষেপে হ’লেও তাঁর দাওয়াতের বিষয়ে আলোকপাত করা হয়েছে। ঐতিহাসিক বর্ণনায় এ বিষয়ে প্রায় সবাই একমত যে, তিনি হযরত হিয্ক্বীল (আঃ)-এর পর এবং হযরত আল-ইয়াসা‘ (আঃ)-এর পূর্বে দামেষ্কের পশ্চিমে বা‘লা বাক্কা (بعلبك) অঞ্চলের বনু ইস্রাঈলগণের প্রতি প্রেরিত হয়েছিলেন। এই সময় হযরত সুলায়মান (আঃ)-এর উত্তরসুরীদের অপকর্মের দরুণ বনু ইস্রাঈলের সাম্রাজ্য দু’ভাগে বিভক্ত হয়ে পড়েছিল। এক ভাগকে ‘ইয়াহূদিয়াহ’ বলা হ’ত এবং তাদের রাজধানী ছিল বায়তুল মুক্বাদ্দাসে। অপর ভাগের নাম ছিল ‘ইস্রাঈল’ এবং তাদের রাজধানী ছিল তৎকালীন সামেরাহ এবং বর্তমান নাবলুসে। ইলিয়াসের জন্মস্থান : হযরত ইলিয়াস (আঃ) ফিলিস্তীনের পার্শ্ববর্তী জর্ডানের আল‘আদ নামক স্থানে জন্মগ্রহণ করেন। আল্লাহ পাক তাঁকে নবী হিসাবে মনোনীত করেন এবং ফিলিস্তীন অঞ্চলে তাওহীদের প্রচার ও প্রসারের নির্দেশ দান করেন। ফিলিস্তীনের ধর্মীয় ও সামাজিক অবস্থা : এই সময় ফিলিস্তীনের বায়তুল মুক্বাদ্দাস ও নাবলুস অঞ্চলে বনু ইস্রাঈলদের দুই গ্রুপের দু’টি রাজধানী ছিল। তারা আপোষে পরস্পরে মারমুখী ছিল। ফেলে আসা নবুঅতী সমাজ ব্যবস্থা থেকে তারা অনেক দূরে একটি পতিত সমাজে পরিণত হয়েছিল। কিতাবধারী ও কিতাবহীন জাহেলী সমাজের মধ্যে পার্থক্য করার কোন উপায় ছিল না। তখনকার ‘ইস্রাঈল’-এর শাসনকর্তার নাম ছিল ‘আখিয়াব’ বা ‘আখীব’। তার স্ত্রী ছিল ‘ইযবীল’। যে বা‘ল (بعل) নামক এক দেবমূর্তির পূজা করত। সে বা‘ল মূর্তির নামে এক বিশাল উপাসনালয় তৈরী করে এবং সেখানে সকল বনু ইস্রাঈলকে মূর্তিপূজায় আহবান করে। দলে দলে লোক সেদিকে আকৃষ্ট হচ্ছিল। মূসা-হারূণ, দাঊদ ও সুলায়মান নবীর উম্মতেরা বিনা দ্বিধায় শিরকের মহাপাতকে আত্মাহুতি দিচ্ছিল। এমন এক মর্মান্তিক অবস্থায় আল্লাহ পাক তাদের নিকটে তাওহীদের বাণী প্রচারের জন্য ইলিয়াসকে নবী হিসাবে প্রেরণ করেন। ইলিয়াসের দাওয়াত : শিরকে আচ্ছন্ন ফিলিস্তীনবাসীকে হযরত ইলিয়াস (আঃ) তাওহীদের দাওয়াত দেন এবং শিরক পরিত্যাগ করার আহবান জানান। কেননা শিরক ও তাওহীদের একত্র সহাবস্থান কখনোই সম্ভব নয়। ইলিয়াস ও তাঁর দাওয়াত সম্পর্কে আল্লাহ বলেন, وَإِنَّ إِلْيَاسَ لَمِنَ الْمُرْسَلِيْنَ- إِذْ قَالَ لِقَوْمِهِ أَلاَ تَتَّقُوْنَ- أَتَدْعُوْنَ بَعْلاً وَتَذَرُوْنَ أَحْسَنَ الْخَالِقِيْنَ- اللهَ رَبَّكُمْ وَرَبَّ آبَائِكُمُ الْأَوَّلِيْنَ- فَكَذَّبُوْهُ فَإِنَّهُمْ لَمُحْضَرُوْنَ- إِلاَّ عِبَادَ اللهِ الْمُخْلَصِيْنَ- وَتَرَكْنَا عَلَيْهِ فِي الْآخِرِيْنَ- سَلاَمٌ عَلَى إِلْ يَاسِيْنَ- إِنَّا كَذَلِكَ نَجْزِي الْمُحْسِنِيْنَ- إِنَّهُ مِنْ عِبَادِنَا الْمُؤْمِنِيْنَ- (الصافات ১২৩-১৩২)- ‘নিশ্চয়ই ইলিয়াস ছিল প্রেরিত রাসূলগণের অন্যতম’ (ছাফফাত ১২৩)। ‘যখন সে তার সম্প্রদায়কে বলল, তোমরা কি ভয় কর না’? (১২৪) ‘তোমরা কি বা‘ল দেবতার পূজা করবে আর সর্বোত্তম স্রষ্টাকে পরিত্যাগ করবে’? (১২৫) ‘যিনি আল্লাহ, তোমাদের পালনকর্তা ও তোমাদের পূর্বপুরুষদের পালনকর্তা’ (১২৬)। ‘অতঃপর তারা তাঁকে মিথ্যা প্রতিপন্ন করল। অতএব তারা অবশ্যই গ্রেফতার হয়ে আসবে’ (১২৭)। ‘কিন্তু আল্লাহর খাঁটি বান্দাগণ ব্যতীত’ (১২৮)। আমরা এই নিয়মের উপরে পরবর্তীদেরকেও রেখে দিয়েছি’ (১২৯)। ‘ইলিয়াস-এর উপরে শান্তি বর্ষিত হৌক’ (১৩০)। ‘এভাবেই আমরা সৎকর্মীদের প্রতিদান দিয়ে থাকি’ (১৩১)। ‘নিশ্চয়ই ইলিয়াস ছিল আমাদের বিশ্বাসী বান্দাদের অন্তর্ভুক্ত’ (ছাফফাত ৩৭/১২৩-১৩২)। দাওয়াতের ফলশ্রুতি : বিগত নবীগণের যে দুরবস্থা হয়েছিল, ইলিয়াস (আঃ)-এর ভাগ্যে তার ব্যতিক্রম হয়নি। তিনি ইস্রাঈলের শাসক আখিয়াব ও তার প্রজাবৃন্দকে বা‘ল দেবমূর্তির পূজা করতে নিষেধ করলেন এবং এক আল্লাহর প্রতি ইবাদতের আহবান জানালেন। কিন্তু দু’একজন হকপন্থী ব্যক্তি ছাড়া কেউ তাঁর কথায় কর্ণপাত করল না। তারা ইলিয়াস (আঃ)-এর বিরুদ্ধে নানা অপপ্রচারে লিপ্ত হ’ল। তাকে যত্রতত্র অপমান-অপদস্থ করা শুরু করল। এমনকি দৈহিক নির্যাতনও শুরু হয়ে গেল। কিন্তু ইলিয়াস (আঃ) তাঁর দাওয়াত চালিয়ে যেতে থাকেন। অবশেষে রাজা ও রাণী তাঁকে হত্যা করার সিদ্ধান্ত নেন। ফলে তিনি রাজধানী ছেড়ে অনেক দূরে এক পাহাড়ের গুহায় আত্মগোপন করলেন এবং দুর্ভিক্ষ নাযিলের জন্য আল্লাহর নিকটে প্রার্থনা করলেন। ফলে সারা দেশে ব্যাপক দুর্ভিক্ষ দেখা দিল। ইলিয়াস (আঃ) মনে করলেন দুর্ভিক্ষ দূর করার জন্য তিনি যদি তাদেরকে মো‘জেযা প্রদর্শন করেন, তাহ’লে হয়ত তারা শিরক বর্জন করে তাওহীদ কবুল করবে এবং এক আল্লাহর ইবাদতে ফিরে আসবে। বাদশাহর দরবারে ইলিয়াসের উপস্থিতি : আল্লাহর হুকুমে হযরত ইলিয়াস (আঃ) তাওহীদের দাওয়াত নিয়ে সরাসরি ইস্রাঈলের বাদশাহ আখিয়াবের দরবারে হাযির হ’লেন। তিনি বললেন, দেশব্যাপী এই দুর্ভিক্ষের কারণ হ’ল আল্লাহর নাফরমানী। তোমরা নাফরমানী থেকে বিরত হ’লে এ আযাব দূর হ’তে পারে। তোমরা বলে থাক যে, তোমাদের বা‘ল দেবতার নাকি সাড়ে চারশ’ নবী (!) আছে। তাই যদি হয়, তাহ’লে তুমি তাদের সবাইকে একত্রিত কর। তারা এই দুর্ভিক্ষ দূর করার জন্য বা‘ল দেবতার নামে কুরবানী করুক। আর আমি একই উদ্দেশ্যে আল্লাহর নামে কুরবানী পেশ করি। যার কুরবানী আসমান থেকে আগুন এসে ভস্ম করে দেবে, তার ধর্মই সত্য বলে গণ্য হবে। ইলিয়াস (আঃ)-এর এ প্রস্তাব সবাই সানন্দে মেনে নিল। আল্লাহ ও বা‘ল দেবতার নামে কুরবানীর ঘটনা : পূর্ব সিদ্ধান্ত অনুযায়ী ‘কোহে কারমাল’ নামক পাহাড়ী উপত্যকায় সকলে সমবেত হ’ল। বা‘ল দেবতার নামে তার মিথ্যা নবীরা কুরবানী পেশ করল। সকাল থেকে দুপুর পর্যন্ত বা‘ল দেবতার উদ্দেশ্যে আকুতি-মিনতি ও কান্নাকাটি করে প্রার্থনা করা হ’ল। কিন্তু দেবতার কোন সাড়া পাওয়া গেল না। আসমান থেকে কোন আগুন নাযিল হ’ল না। অতঃপর হযরত ইলিয়াস (আঃ) আল্লাহর নামে কুরবানী করলেন এবং যথাসময়ে আসমান থেকে আগুন এসে তা খেয়ে গেল। বস্ত্ততঃ এটাই ছিল কুরবানী কবুল হওয়ার নিদর্শন। এভাবেই কবুল হয়েছিল আদমপুত্র হাবীলের কুরবানী। তখনকার সময় মুশরিকদের মধ্যেও এ রীতি গ্রহণযোগ্য ছিল, যা ইলিয়াসের বর্তমান ঘটনায় প্রমাণিত হয়। আসমান থেকে আগুন এসে কুরবানী কবুলের এই অভাবনীয় দৃশ্য দেখে অনেকে সাথে সাথে সিজদায় পড়ে গেল এবং ইলিয়াসের দ্বীন কবুল করে নিল। সকলের নিকটে ইলিয়াস (আঃ)-এর সত্যতা স্পষ্ট হয়ে গেল। কিন্তু বা‘ল পূজারী কথিত ধর্মনেতারা তাদের যিদের উপরে অটল রইল। এইসব মিথ্যা নবীরা ও তাদের স্বার্থান্ধ অনুসারীরা ঈমান আনল না। ইলিয়াস (আঃ)-কে পুনরায় হত্যার ষড়যন্ত্র : ওদিকে আখিয়াবের স্ত্রী ইখবীল হযরত ইলিয়াস (আঃ)-কে পুনরায় হত্যার চক্রান্ত শুরু করে দিল। ফলে তিনি রাজধানী সামেরাহ (নাবলুস) ছেড়ে চলে গেলেন এবং কিছুদিন পর বনু ইস্রাঈলের অপর রাজ্য পার্শ্ববর্তী ইয়াহূদিয়াহতে উপস্থিত হ’লেন। ঐসময় বা‘ল পূজার ঢেউ এখানেও লেগেছিল। হযরত ইলিয়াস (আঃ) সেখানে পৌঁছে তাওহীদের দাওয়াত শুরু করলেন। সেখানকার সম্রাট ‘ইহুরাম’-এর কাছেও তিনি দাওয়াত দিলেন। কিন্তু নিরাশ হ’লেন। অবশেষে তাঁর ভবিষ্যদ্বাণী অনুযায়ী সে ধ্বংসপ্রাপ্ত হ’ল। কয়েক বছর পর ইলিয়াস (আঃ) পুনরায় ‘ইস্রাঈলে’ ফিরে এলেন এবং ‘আখিয়াব’ ও তার পুত্র ‘আখযিয়া’-কে সত্য পথে আনার চেষ্টা করলেন। কিন্তু তারা তাদের শিরকী ধ্যান-ধারণায় অটল রইল। অবশেষে তাদের উপরে বৈদেশিক আক্রমণ ও মারাত্মক রোগ-ব্যধির গযব নাযিল হ’ল। অতঃপর আল্লাহ পাক তাঁর নবীকে উঠিয়ে নিলেন। হযরত ইলিয়াস (আঃ) জীবিত আছেন কি? সুয়ূত্বী, ইবনে আসাকির, হাকেম প্রমুখের বিভিন্ন বর্ণনায় প্রতীয়মান হয় যে, চারজন নবী জীবিত আছেন। তন্মধ্যে খিযির ও ইলিয়াস দুনিয়াতে এবং ইদরীস ও ঈসা আসমানে রয়েছেন। কিন্তু হাকেম ও ইবনু কাছীর এসব বর্ণনাকে বিশুদ্ধ বলেননি। সারকথা, হযরত ইলিয়াস (আঃ)-এর জীবিত থাকার বিষয়টি কোন ছহীহ হাদীছ দ্বারা প্রমাণিত নয়। অতএব এসব বর্ণনার প্রতি কর্ণপাত করার কোন প্রয়োজন নেই। ইলিয়াস (আঃ) স্বাভাবিক প্রক্রিয়ায় মৃত্যুবরণ করেছেন বলেই আমরা বিশ্বাস করব।

May be an image of text

হযরত ইসহাক ছিলেন ইবরাহীম (আঃ)-এর প্রথমা স্ত্রী সারাহ-এর গর্ভজাত একমাত্র পুত্র। তিনি ছিলেন হযরত ইসমাঈল (আঃ)-এর চৌদ্দ বছরের ছোট। এই সময় সারাহর বয়স ছিল ৯০ এবং ইবরাহীমের বয়স ছিল ১০০। অতি বার্ধ্যক্যের হতাশ বয়সে বন্ধ্যা নারী সারাহ্-কে ইসহাক জন্মের সুসংবাদ নিয়ে ফেরেশতারা আগমন করেছিলেন ইব্রাহীম (আঃ)-এর কাছে । পবিত্র কুরআনে আকর্ষণীয় ভঙ্গীতে এ বিষয়ে আলোচিত হয়েছে সূরা হূদ ৭১-৭৩ আয়াতে, হিজর ৫১-৫৬ আয়াতে এবং যারিয়াত ২৪-৩০ আয়াতে- যা আমরা ইবরাহীমের জীবনীতে বর্ণনা করেছি। আল্লাহ ইসমাঈলকে দিয়ে যেমন মক্কার জনপদকে তাওহীদের আলোকে উদ্ভাসিত করেছিলেন, তেমনি ইসহাক্বকে নবুঅত দান করে তার মাধ্যমে শাম-এর বিস্থির্ণ এলাকা আবাদ করেছিলেন।

হযরত ইবরাহীম (আঃ) স্বীয় জীবদ্দশায় পুত্র ইসহাক্বকে বিয়ে দিয়েছিলেন রাফক্বা বিনতে বাতওয়াঈল (رفقا بنت بتوائيل )-এর সাথে। কিন্তু তিনিও বন্ধ্যা ছিলেন। পরে ইবরাহীমের খাছ দো‘আর বরকতে তিনি সন্তান লাভ করেন এবং তাঁর গর্ভে ঈছ ও ইয়াকূব নামে পরপর দু’টি পুত্র সন্তান জন্ম লাভ করে। তার মধ্যে ইয়াকূব নবী হন। পরে ইয়াকূবের বংশধর হিসাবে বনু ইস্রাঈলের হাযার হাযার নবী পৃথিবীকে তাওহীদের আলোকে আলোকিত করেন। কিন্তু ইহুদী নেতাদের হঠকারিতার কারণে তারা আল্লাহর গযবে পতিত হয় এবং অভিশপ্ত জাতি হিসাবে নিন্দিত হয়। যা ক্বিয়ামত পর্যন্ত অব্যাহত থাকবে।

ইসহাক্ব (আঃ) ১৮০ বছর বয়স পান। তিনি কেন‘আনে মৃত্যুবরণ করেন এবং পুত্র ঈছ ও ইয়াকূবের মাধ্যমে হেবরনে পিতা ইবরাহীমের কবরের পাশে সমাহিত হন। স্থানটি এখন ‘আল-খালীল’ নামে পরিচিত’।

উল্লেখ্য যে, হযরত ইসহাক্ব (আঃ) সম্পর্কে পবিত্র কুরআনের ১৪টি সূরায় ৩৪টি আয়াতে বর্ণিত হয়েছে।

No photo description available.

একদা হযরত ইয়াহিয়া (আঃ) এর সাথে ইবলিশের দেখা হয় । ইবলিশের হস্তস্হিত একটি বস্তুর প্রতি ইঙ্গিত করে আল্লাহর নবী জিজ্ঞাসা করলেন, এটা কি তোমার হাতে ? ইবলিশ বললো, – এটা শাহওয়াত বা প্রবৃত্তির তাড়না । এটা দিয়ে আমি বনী আদমকে শিকার করে থাকি । হযরত ইয়াহিয়া (আঃ) জিজ্ঞেস করলেন, আমাকে শিকার করার জন্য কি তোমার কাছে কিছু আছে ? ইবলিশ বললো , – না; তবে এক রাত্রিতে আপনি পরিতৃপ্ত হয়ে ভোজন করেছিলেন, সেই সুযোগে আমি আপনাকে অবসাদ গ্রস্ত করে নামায হতে উদাসীন করে দিয়েছিলাম । হযরত ইয়াহিয়া (আঃ) বললেন, ‘আজ থেকে আমি আর কোনদিন তৃপ্ত হয়ে আহার করবো না ।’ ইবলিশ বললো,- তাহলে আমিও আজ থেকে আর কোনদিন বনী আদমকে নসীহত করবো না ।

হযরত সুলাইমান (আঃ) বলেছেন, ‘যে ব্যাক্তি স্বীয় প্রবৃত্তিকে নিয়ন্ত্রণে রাখতে পেরেছে, সে দ্বিগ্বিজয়ী সেনাপতির চাইতেও বড় বাহাদুর ।’

মহানবী (সাঃ) বলেছেন, ‘ জঠর জ্বালার মাধ্যমে তুমি তোমার অন্তকরণকে জোর্তিময় করে তোল, ক্ষুধা ও তৃষ্ঞার অস্ত্রের মাধ্যমে তুমি তোমার রিপুর বিরুদ্ধে জিহাদে প্রবৃত্ত হও । ক্ষুধার সাহায্যে তুমি সদা বেহেশ্তের দরজায় কষাগাত করতে থাক । কেননা, এতে তোমার আমলনামায় জিহাদের সওয়াব লিপিবদ্ধ হবে । ‘

হযরত লোকমান হাকীম (রহঃ) স্বীয় পুত্রকে উপদেশ দিতে গিয়ে বলেছিলেন, -‘অধিক মাত্রায় নিদ্রা ও ভোজন থেকে নিজকে বিরত রাখ । কেননা, অধিক নিদ্রাযাপনকারী ও অধিক ভোজনকারী কিয়ামতের দিন আমল ও ইবাদত শূন্য হবে ।’

সুত্রঃ মুকাশাফাতুল ক্বুলুব । হযরত ইমাম গাজ্জ্বালী (রহঃ)

May be an image of Bactrian camel and text that says 'SALEH'

হজরত সালেহ (আ.)-এর অলৌকিক উট।

হজরত সালেহ (আ.) ছিলেন হজরত নুহ (আ.)-এর ছেলে সামের বংশধর। তার সম্প্রদায়ের নাম ছিল সামুদ। সামের অধস্তন বংশধরে একজন প্রতাপশালী লোক ছিল সামুদ। সেই বীরপুরুষের নামেই এই গোত্রের নামকরণ হয়। এই গোত্রের বসবাস ছিল সৌদি আরবের উত্তর-পশ্চিম প্রান্তে হিজর নামক স্থানে; সেই স্থানটি এখন ‘মাদায়েনে সালেহ’ নামে পরিচিত। সামুদ ছিল শক্তিশালী ও বীরের জাতি। প্রস্তর খোদাই ও স্থাপত্যবিদ্যায় তাদের বিশেষ পারদর্শিতা ছিল। পর্বত খোদাই করে তারা বাসস্থান নির্মাণ করত। মাদায়েনে সালেহ অঞ্চলে এখনও সেই আমলের স্থাপত্যের নিদর্শনাবলি ও সামুদি শিলালিপি বিদ্যমান রয়েছে।

সামুদ জাতিও প্রথমে আল্লাহ ও পরকালে বিশ্বাসী ছিল। কিন্তু কালের বিবর্তনে এক সময় আল্লাহ ও পরকালকে ভুলে যায় এবং মূর্তিপূজা শুরু করে এবং শিরকে লিপ্ত হয়। আল্লাহ তায়ালা স্বীয় চিরন্তন বিধান অনুযায়ী তাদের হেদায়েতের জন্য হজরত সালেহ (আ.)-কে নবী হিসেবে প্রেরণ করেন। হজরত সালেহ (আ.) ছিলেন সম্ভ্রান্ত, বিচক্ষণ, প্রজ্ঞাময়, জ্ঞানী ও পণ্ডিত ব্যক্তি। যতদিন তিনি অহিপ্রাপ্ত হননি এবং মূর্তিপূজা পরিত্যাগ করে আল্লাহর একত্ববাদের দিকে আহ্বান করেননি গোত্রের লোকজন ততদিন তাকে সমীহ ও মান্য করত। নবুয়ত লাভের পর তিনি তাদেরকে মূর্তিপূজা পরিত্যাগ করে এক আল্লাহর ইবাদত করতে আহ্বান করেন। তিনি বললেন, ‘হে আমার জাতি! আল্লাহর ইবাদত করো, তিনি ছাড়া তোমাদের কোনো উপাস্য নেই। তিনিই জমিন হতে তোমাদের সৃষ্টি করেছেন, তার মধ্যে তোমাদের বসতি দান করেছেন। অতএব তাঁর কাছে ক্ষমা প্রার্থনা করো, অতঃপর তাঁরই দিকে ফিরে চলো। আমার পালনকর্তা নিকটেই আছেন। কবুল করে থাকেন, সন্দেহ নেই।’ (সুরা হুদ : ৬১)

সালেহ (আ.) ছিলেন বিশুদ্ধভাষী এবং উচ্চকণ্ঠের বাগ্মী। বড় বড় সমাবেশে তিনি দাওয়াতের কাজ করতেন। যুক্তির নিরিখে দরদি কণ্ঠে আল্লাহর বাণীসমূহ শোনাতেন। মূর্তিপূজার কঠিন পরিণতির কথা বলতেন। আখেরাতের কথা শোনাতেন। জান্নাতের নেয়ামতরাজির কথা বলে তাদের উদ্বুদ্ধ করতেন। জাহান্নামের ভীতি প্রদর্শন করতেন। কিন্তু গোত্রের লোকজন যেই মাত্র তার মুখে মূর্তিপূজার অসারতার বাণী শুনল, সঙ্গে সঙ্গে হজরত সালেহের প্রজ্ঞা ও পাণ্ডিত্য অস্বীকার করে বলল, ‘হে সালেহ! ইতঃপূর্বে তোমার কাছে আমাদের বড় আশা ছিল। আমাদের বাপ-দাদা যা পূজা করত তুমি কি আমাদেরকে তার পূজা করতে নিষেধ করো? কিন্তু যার প্রতি তুমি আমাদের আহ্বান করছ আমাদের তাতে এমন সন্দেহ রয়েছে যে, মন মোটেই সায় দিচ্ছে না।’ (সুরা হুদ : ৬২)। হজরত সালেহ (আ.) তাদেরকে বিভিন্নভাবে উপমা ও দৃষ্টান্ত বলে বলে বোঝাতে থাকলেন। বললেন, দুনিয়া চিরস্থায়ী বাসস্থান নয়। এখানকার ভোগবিলাস ক্ষণিকের মাত্র। সুতরাং তোমরা পরকালের চিন্তা করো।

কিন্তু সামুদ জাতির অধিকাংশ লোক হজরত সালেহ (আ.)-কে অস্বীকার করল। তবে যুক্তিতর্কে কোনোভাবেই যখন তারা হজরত সালেহ (আ.)-কে সত্যের দাওয়াত থেকে নিবৃত করতে পারল না তখন সবাই মিলে সিদ্ধান্ত নিল- তার কাছে অলৌকিক কোনো দাবি পেশ কববে। এক দিন তারা সবাই একত্রিত হয়ে হজরত সালেহকে বলল, আপনি যদি সত্যি আল্লাহর নবী হন তবে আমাদেরকে কাতেবা পাহাড়ের ভেতর থেকে দশ মাসের গর্ভবতী সবল ও স্বাস্থ্যবতী উষ্ট্রী বের করে দেখান। হজরত সালেহ (আ.) তাদের থেকে প্রতিশ্রুতি ও অঙ্গীকার নিলেন, যদি আমি তোমাদের দাবি পূরণ করতে পারি তা হলে তোমরা আমার প্রতি ও আমার দাওয়াতের প্রতি বিশ্বাস স্থাপন করবে কি না? সবাই এই প্রতিশ্রুতি দেওয়ার পর তিনি আল্লাহর কাছে দোয়া করলেন। আল্লাহ তায়ালা তার দোয়া কবুল করলেন। সেই পাহাড় ফেটে ভেতর থেকে তাদের দাবির অনুরূপ একটি গর্ভবতী উষ্ট্রী বের হয়ে এলো।

এই অলৌকিক উষ্ট্রী দেখে উপস্থিত অনেকেই হজরত সালেহ (আ.)-এর ওপর ঈমান নিয়ে আসে। কিন্তু এমন প্রকাশ্য মুজেজা প্রত্যক্ষ করেও কিছু হতভাগা ঈমান আনল না। হজরত সালেহ (আ.) তাদের সতর্ক করে বললেন, ‘আল্লাহর এই উষ্ট্রীটি তোমাদের জন্য আল্লাহর নিদর্শন। অতএব তাকে আল্লাহর জমিনে বিচরণ করতে দাও এবং তাকে মন্দভাবে স্পর্শও করো না। নতুবা অতিসত্বর তোমাদেরকে আজাব পাকড়াও করবে।’ (সুরা হুদ : ৬৪)। কিন্তু গোত্রের কিছু দুষ্কৃতকারী লোক এই অলৌকিক প্রাণীটি হত্যা করে ফেলে। হত্যা করেই তারা ক্ষান্ত হলো না, হজরত সালেহ (আ.)-এর কাছে এসে ঔদ্ধত্য প্রদর্শন করে বলল, তুমি সত্যিকারের রাসুল হলে তোমার প্রতিশ্রুত আজাব আনো দেখি! আমরা তো উষ্ট্রীটি হত্যা করেছি। তখন আল্লাহর পক্ষ থেকে তাদের ওপর শাস্তি নেমে আসে।

আল্লাহ তায়ালা সেই অবস্থার বিবরণ দিয়ে বলেন, ‘অতঃপর তারা উষ্ট্রীকে হত্যা করল এবং স্বীয় প্রতিপালকের আদেশ অমান্য করল। তারা বলল, হে সালেহ! নিয়ে এসো যা দ্বারা আমাদের ভয় দেখাতে, তুমি যদি রাসুল হয়ে থাকো। অতঃপর পাকড়াও করল তাদেরকে ভূমিকম্প। ফলে সকালবেলায় নিজ নিজ গৃহে উপুড় হয়ে পড়ে রইল।’ (সুরা আরাফ : ৭৭-৭৮)। অন্য আয়াতে আছে, তাদের ওপর প্রচণ্ড ও বিকট শব্দবোমা নিক্ষিপ্ত হয়েছিল। সামুদ সম্প্রদায়ের ওপর একই সঙ্গে ভূমিকম্প ও বিকট গর্জন এসেছিল এবং তারা এই দুটি শাস্তিতে মৃত্যুমুখে পতিত হয়।

যুগে যুগে আল্লাহ তায়ালা বহু নবী-রাসুল প্রেরণ করেছেন। তাদের মাধ্যমে পৃথিবীর মানুষদের হেদায়েত ও পথপ্রদর্শন করেছেন। যারা আল্লাহ ও তাঁর রাসুলগণকে অস্বীকার করেছিল তাদের ভয়াবহ ও রোমহর্ষক পরিণতি হয়েছে। সেসব পরিণতির কিয়দংশ পরবর্তীদের শিক্ষার জন্য দৃষ্টান্তস্বরূপ রেখে দিয়েছেন। যেমন- ডেড সি, ফেরাউনের লাশ এবং হজরত সালেহ (আ.)-এর সম্প্রদায়ের বিধ্বস্ত বাড়িঘর। মানুষ যেন এসব নিদর্শন দেখে দাম্ভিকতা পরিত্যাগ করে আল্লাহর প্রতি বিশ্বাস স্থাপন করে এবং তাঁর প্রতি সেজদাবনত হয়। আল্লাহ তায়ালা আমাদের শিক্ষা অর্জনের তৌফিক দান করুন। আমিন।

May be an image of text

ধৈর্যের মূর্তপ্রতীক ছিলেন আইয়ুব (আ.)। বছরের পর বছর শারীরিক ও আর্থিক কষ্টে ভুগেও মহান আল্লাহর প্রতি পরিপূর্ণ কৃতজ্ঞ ছিলেন তিনি। পবিত্র কোরআনে চারটি সুরার আটটি আয়াতে আইয়ুব (আ.)-এর কথা এসেছে। যথা- সুরা : নিসা, আয়াত : ১৬৩, সুরা : আনআম, আয়াত : ৮৪, সুরা : আম্বিয়া, আয়াত : ৮৩-৮৪ এবং সুরা : সাদ, আয়াত : ৪১-৪৪।

কোরআন থেকে শুধু এতটুকু জানা যায় যে তিনি কোনো দুরারোগ্য রোগে আক্রান্ত হয়ে সবর করে যান এবং অবশেষে আল্লাহর কাছে দোয়া করে রোগ থেকে মুক্তি পান। এই অসুস্থতার দিনগুলোতে তাঁর সন্তান-সন্ততি, বন্ধু-বান্ধব সবাই উধাও হয়ে গিয়েছিল। এরপর আল্লাহ তাআলা তাকে সুস্থতা দান করেন। মহান আল্লাহ তাঁকে সন্তান ও সম্পদ দিয়েছিলেন, অসুস্থতার পাশাপাশি সেগুলোও ছিনিয়ে নেন।

কিন্তু তাঁর স্ত্রী ছিলেন অত্যন্ত স্বামীভক্ত। তিনি সারাক্ষণ তাঁর সেবা করতেন। এমনকি একপর্যায়ে পরিবারের খরচ মেটাতে তিনি অন্য মানুষের বাসায় কাজ করতেন। অন্যদিকে ধীরে ধীরে রোগ-ব্যাধি, দুঃখ-কষ্ট বাড়তে থাকে আইয়ুব (আ.)-এর।

বিপদ যত বাড়ে, তিনি তত বেশি আল্লাহকে ডাকতে থাকেন, যেভাবে শীত যত বাড়ে মানুষ তত বেশি শীতবস্ত্র দিয়ে নিজেকে জড়িয়ে রাখে। আল্লাহর জিকির দিয়ে তিনি তাঁর দেহ ও অন্তর তরতাজা রাখেন।
বিপদে ধৈর্য ধারণ এবং আল্লাহর পরীক্ষা হাসিমুখে বরণ করে তিনি ‘সবরকারী’ ও ‘চমৎকার বান্দা’ খেতাবে ভূষিত হয়েছেন। তাঁর ধৈর্যের পরম পরাকাষ্ঠা দেখে মহান আল্লাহ বলেন, ‘আমি (আল্লাহ) তাকে ধৈর্যশীল হিসেবে পেয়েছি।’ (সুরা : সাদ, আয়াত : ৪৪)

বছরের পর বছর তিনি অসুস্থ শরীর নিয়ে সন্তানহীন, সঙ্গীহীন ও সম্পদহীন হয়ে কোনো এক প্রান্তরে একান্তে অবস্থান করেন।

আর মহান আল্লাহর কাছে দোয়া করতে থাকেন। তাঁর দোয়ার ভাষ্য কোরআনে এভাবে এসেছে : ‘আর স্মরণ করো আইয়ুবকে, যখন সে তার রবকে ডেকেছিল, (বলেছিল) আমি তো দুঃখ-কষ্টে পড়েছি (দুঃখ-কষ্ট আমাকে স্পর্শ করেছে), আর আপনি তো সর্বশ্রেষ্ঠ দয়ালু!’ (সুরা : আম্বিয়া, আয়াত : ৮৩)
দোয়ার ধরন অত্যন্ত নমনীয় ও মার্জিত; যথাযথ আদব ও শিষ্টাচারপূর্ণ। নেই অভিযোগ, নেই অনুযোগ। ‘কষ্ট আমাকে স্পর্শ করেছে’—কঠিন বিপদেও মধুময় আবেদন। আবেদনের ভেতর ভাব আছে, মর্মস্পর্শী আবেগ আছে, আছে কষ্টের কথাও। তবু কোনো আবদার নেই, চাওয়া-পাওয়া নেই। শুধু এ কথা বলে থেমে যাচ্ছেন : ‘আপনি তো সর্বশ্রেষ্ঠ দয়ালু।’

আল্লাহর বিরুদ্ধে কোনো নালিশ নেই, কোনো জিনিসের দাবি নেই। তাতেই খুশি হয়ে মহান আল্লাহ তাঁর দোয়া কবুল করেন। তাঁর দোয়া কবুল করে আল্লাহ বলেন, ‘আমি তার ডাকে সাড়া দিলাম। আর তার যত দুঃখ-কষ্ট ছিল তা দূর করে দিলাম এবং তার পরিবার-পরিজন তাকে দিয়ে দিলাম। তাদের সঙ্গে তাদের মতো আরো দিলাম আমার পক্ষ থেকে রহমত এবং ইবাদতকারীদের জন্য উপদেশস্বরূপ।’ (সুরা : আম্বিয়া, আয়াত : ৮৪)

কিভাবে দূর হলো অসুখ—সে বিষয়ে পবিত্র কোরআনে এসেছে, ‘(আমি তাকে বললাম,) তুমি তোমার পা দিয়ে (ভূমিতে) আঘাত করো। (ফলে পানি নির্গত হলো এবং দেখা গেল যে) এটি গোসলের জন্য ঠাণ্ডা পানি ও (পানের জন্য উত্তম) পানীয়।’ (সুরা : সাদ, আয়াত : ৪২)

এটি ছিল অলৌকিক ঝরনা। ইতিপূর্বে শিশু ইসমাঈল (আ.)-এর ক্ষেত্রে এমনটা ঘটেছে। তাঁর পদাঘাতে জমজমকূপ তৈরি হয়েছিল। এটা নবীদের মুজিজা। এটা নবীদের বরকত। নবী-রাসুলদের পদতলে মহান আল্লাহ বরকত ঢেলে দেন। সেই বরকত থেকে সিক্ত হয় প্রকৃতি ও পৃথিবী। এই বরকতের পানি দিয়ে আইয়ুব (আ.) গোসল করেন। তিনি সুস্থ হয়ে যান। একে একে সম্পদ ফিরে পান এবং সন্তান লাভ করেন।

আইয়ুব আলাইহিস সালাম তাঁর প্রাকৃতিক কাজ সারতে বের হতেন। কাজ সারার পর তাঁর স্ত্রী তার হাত ধরে নিয়ে আসতেন। একদিন তিনি প্রাকৃতিক কাজ সারার পর স্ত্রীর কাছে ফিরতে দেরি করছিলেন। আগমনে দেরি দেখে স্ত্রী এগিয়ে যান। ততক্ষণে অলৌকিক ঝরনায় গোসল করে আইয়ুব (আ.) সম্পূর্ণ সুস্থ ও সুন্দর হয়ে যান। তাঁর স্ত্রী তাকে দেখে বলেন, হে মানুষ, আল্লাহ আপনার ওপর বরকত দিন, আপনি কি ওই অসুস্থ আল্লাহর নবীকে দেখেছেন? আল্লাহর শপথ, যখন তিনি সুস্থ ছিলেন তখন তিনি দেখতে আপনার মতো ছিলেন। তখন আইয়ুব (আ.) বলেন, আমিই সেই ব্যক্তি। এভাবে তিনি সুস্থ হন।

আইয়ুব (আ.)-এর দুটি উঠান ছিল। একটি গম শুকানোর, অন্যটি যব শুকানোর। মহান আল্লাহ সে দুটির ওপর দুই খণ্ড মেঘ পাঠালেন। এক খণ্ড মেঘ সে গমের উঠানে এমনভাবে স্বর্ণ ফেলল যে সেটি পূর্ণ হয়ে গেল। অন্য মেঘ খণ্ডটি সেটির ওপর এমনভাবে রৌপ্য বর্ষণ করল যে সেটাও পূর্ণ হয়ে গেল। (সহিহ ইবনে হিব্বান, হাদিস : ২৮৯৮, মুস্তাদরাকে হাকিম, হাদিস : ৪১১৫)

এভাবে সোনা-রুপায় দানায় তিনি প্রচুর সম্পদের মালিক হয়ে যান। হাদিসের বর্ণনা থেকে আরো জানা যায়, আল্লাহর পক্ষ থেকে ঝাঁকে ঝাঁকে স্বর্ণের পঙ্গপাল আইয়ুব (আ.)-এর কাছে আসে। তিনি সেগুলো সংগ্রহ করেন। রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেন, একবার আইয়ুব (আ.) কাপড় খুলে (অর্থাৎ বাথরুম ছাড়াই খোলা স্থানে) গোসল করছিলেন, এ অবস্থায় একঝাঁক স্বর্ণের পঙ্গপাল তাঁর ওপর পড়তে শুরু করে, তিনি সেগুলো মুঠি মুঠি তার কাপড়ে জমা করছিলেন। তখন মহান আল্লাহ তাঁকে ডাক দিয়ে বলেন, হে আইয়ুব, আমি কি তোমাকে যা দেখছ তা থেকেও বেশি দিয়ে ধনী বানাইনি? জবাবে আইয়ুব (আ.) বলেন, ‘ইয়া রাব্বি, লা গিনা বি আন বারাকাতিকা (অর্থ : হে রব, তবে আপনার দেওয়া বরকত থেকে আমি কখনো মুখাপেক্ষীহীন হবো না।’ (বুখারি, হাদিস : ৭৪৯৩)

পুরো ঘটনা থেকে জানা যায়, বড় পরীক্ষায় আছে বড় পুরস্কার। সম্পদ ও সন্তান হারিয়ে কঠিন অসুস্থ হয়েও জিকির, ইবাদত ও আমল থেকে বিচ্যুত হননি আইয়ুব (আ.)। আল্লাহর রহমত থেকে নিরাশ হননি। মার্জিত ভাষায় অভিযোগহীন, বিরামহীন তিনি দোয়া করেন। মহান আল্লাহ তাঁর দোয়া কবুল করেন। সবরের ফল দুনিয়ায় দিয়ে দেন। সুস্থতা, সম্পদ ও সন্তান—সব কিছু ফিরিয়ে দেন। মুমিনদের জন্য এই ঘটনায় আছে বিশেষ বার্তা।

May be an image of text

ওজনে কম দিয়ে ধ্বংস হওয়া একটি জাতির গল্প!

মাদইয়ান সম্প্রদায়ের কাছে প্রেরিত হয়েছেন হজরত শোয়াইব (আ.)। হজরত শোয়াইব (আ.) ছিলেন হজরত ইবরাহিম (আ.) এর তৃতীয় স্ত্রী কাতুরার ঘরের পুত্র মাদইয়ানের বংশধর। এ জন্য হজরত ইবরাহিম (আ.) এর এই বংশধরকে বনি কাতুরা বলা হয়। কোনো কোনো বর্ণনা মতে, হজরত শোয়াইব (আ.) হজরত সালেহ (আ.) এর বংশোদ্ভূত নবী ছিলেন। যেহেতু তিনি মাদইয়ান সম্প্রদায়ের কাছে প্রেরিত হয়েছেন, তাই পরবর্তী সময়ে তার নামেই তার কওমের নাম হয়ে যায় কওমে শোয়াইব। বর্তমান সিরিয়ার মুয়ান নামক স্থানে সে কওমে শোয়াইবের বসবাস ছিল বলে জানা যায়। কোরআনে কারিমের কোথাও তাদের ‘আসহাবে মাদইয়ান’ ও ‘আহলে মাদইয়ান’ নামে উলেস্নখ করা হয়েছে। আবার কোথাও ‘আসহাবে আইকা’ নামে উলেস্নখ করা হয়েছে। আসহাবে আইকা ও মাদইয়ান একই সম্প্রদায়ের দুই নাম, নাকি তারা পৃথক পৃথক সম্প্রদায়- সে ব্যাপারে যথেষ্ট মতবিরোধ থাকলেও প্রসিদ্ধ মতানুসারে মাদইয়ান ও আসহাবে আইকা একই সম্প্রদায়। যাদের পিতার দিকে সম্বোধন করে মাদইয়ান বলা হতো আর ভৌগোলিক দিক থেকে আসহাবে আইকা বলা হতো। আইকা অর্থ বনজঙ্গল। এ জায়গার মাটি অত্যমত্ম উর্বর হওয়ায় সে স্থানে ফলফলাদিসহ বিভিন্ন ধরনের গাছ-গাছালি বেশি হতো। তাই কোরআনে কারিমে তাকে ‘আইকা’ বলে সম্বোধন করা হয়েছে। মাদইয়ানবাসী পার্থিব লোভ-লালসায় মত্ত হয়ে পাস্পরিক লেনদেনের সময় ওজনে কমবেশি করে মানুষের হক আত্মসাৎ করত। মহান আল্লাহ তায়ালার সঙ্গে শরিক স্থাপন করত। গাছপালা ও মূর্তি পূজায় তারা লিপ্ত থাকত। লেনদেনের ক্ষত্রে দুর্নীতি, প্রতারণা, ছিনতাই, রাহাজানি ও মজুদদারির মতো জঘন্য অন্যায় তারা করত। এসব পাপে তারা এমনভাবে লিপ্ত ছিল যে, তারা কখনোই উপলব্ধি করত না, তারা অন্যায় করছে বা তারা যা করছে তা গর্হিত কাজ। বরং তারা অবাধ্যতা প্রদর্শন করতে পেরে আনন্দ বোধ করত। এভাবে তারা ভূপৃষ্ঠে বিশৃঙ্খলা সৃষ্টি করত। তাদের কাছে পাঠানো হলো হজরত শোয়াইব (আ.)কে। হজরত শোয়াইব (আ.) সর্বপ্রথম তাদের তাওহিদের দাওয়াত দিলেন। বললেন, ‘হে আমার সম্প্রদায়! তোমরা আল্লাহ তায়ালার ইবাদত করো, যিনি ছাড়া আর কোনো মাবুদ নেই।’ (সুরা আরাফ : ৮৫)। তাওহিদের দাওয়াত দেয়ার পরপরই হজরত শোয়াইব (আ.) তাদেরকে তাদের কুকর্ম ওজনে কম দেয়ার হীন মানসিকতাকে দূর করার দাওয়াত দিলেন। তিনি বলেন, ‘তোমরা পরিমাপে ও ওজনে কম দিও না। আজ আমি তোমাদের ভালো অবস্থায় দেখতে পাচ্ছি। কিন্তু আমি তোমাদের ব্যাপারে পরিবেশ নষ্টকারী দ্বীনের আজাবের ভয় পাচ্ছি। হে আমার কওম! ন্যায়-নিষ্ঠার সঙ্গে ওজন পূর্ণরূপে করো। লোকদের জিনিসপত্রে কোনোরূপ ক্ষতি করো না। আর পৃথিবীতে বিপর্যয় সৃষ্টি করো না।’ (সুরা আরাফ : ৮৪-৮৫)। ‘মানুষের জিনিসপত্রে কোনোরূপ ক্ষতি করো না।’ এ কথা থেকে বোঝা যায়, ওজনে কম দেয়া যেমন হারাম, তেমনি হারাম অপরের অধিকারে হসত্মক্ষপ করা। হজরত শোয়াইব (আ.) তাদের আরও উপদেশ দিলেন, মানুষকে ভীতি প্রদর্শন করে তাদের সম্পদ গ্রহণ করার জন্য রাসত্মাঘাটে ওৎপেতে বসে থেকো না। কোরআনে কারিমে বলা হয়েছে, ‘আর তোমরা পথেঘাটে এই উদ্দেশ্যে বসে থেকো না যে, আল্লাহ তায়ালার বিশ্বাসীদের হুমকি দেবে, আল্লাহ তায়ালার পথে বাধা সৃষ্টি করবে এবং তাতে বক্রতা অনুসন্ধান করবে। স্মরণ করো যখন তোমরা সংখ্যায় ছিলে কম, আল্লাহ তায়ালা তোমাদের অধিক করেছেন এবং লক্ষ্য করো কিরূপ অশুভ পরিণতি হয়েছে ফিতনাকারীদের।’ (সূরা আরাফ, আয়াত নং : ৮৫)। আয়াতের শেষাংশে তাদের ভীতি প্রদর্শন করার জন্য বলা হয়েছে- পূর্ববর্তী ফ্যাসাদ সৃষ্টিকারী কওমের করুণ পরিণতির দিকে লক্ষ্য করো, কওমে নূহ, আদ, সামুদ ও কওমে লুতের ওপর কী ভীষণ গজব নাজিল হয়েছিল। তাই তোমরা এ ধরনের আজাব আসার আগেই সতর্ক হয়ে যাও। এভাবে হজরত শোয়াইব (আ.) তাদের বিভিন্নভাবে নবীসুলভ সহনশীলতার সঙ্গে বুঝিয়েছেন। কিন্তু বিনিময়ে তিনি শুধু উপহাস-পরিহাসই পেয়েছেন। অবশেষে তারা যখন সীমা লঙ্ঘন করে ফেলল তখন আল্লাহ তায়ালার আজাব এসে গেল। প্রথমে কয়েকদিন তাদের অঞ্চলে ভীষণ গরম পড়ল। গোটা জাতি ছটফট করতে লাগল। অতঃপর কাছের একটি ময়দানের ওপর গাঢ় মেঘমালা দেখা গেল। ময়দানে ছায়া পড়ল। শীতল বাতাস বইতে লাগল। এলাকার সবাই সেই ময়দানে জমায়েত হলো। বলতে লাগল এই মেঘ আমাদের ওপর বৃষ্টি নাজিল করবে। যখন সবাই সেখানে সমবেত হলো, তখন মেঘমালা থেকে অগ্নিবৃষ্টি বর্ষিত হতে শুরু হলো। নিচের দিকে শুরু হলো ভূমিকম্প। ফলে সবাই সেখানে নাসত্মানাবুদ ও ধ্বংস হয়ে গেল। কোরআনে কারিমে বলা হয়েছে, ‘তাদের ভীষণ ভূমিকম্প পাকড়াও করল। ফলে তারা নিজেদের গৃহের অভ্যমত্মরে উপুড় হয়ে পড়ে রইল।’ (সূরা আরাফ : ৯১)। তাফসিরকাররা এ সীদ্ধামেত্ম উপনীত হলেন যে, তাদের ওপর মোট তিন ধরনের আজাব অবতীর্ণ হয়েছিল। এক. মেঘমালা থেকে অগ্নিবৃষ্টি বর্ষিত হয়, দুই. এরপর বিকট শব্দ শোনা যায়, তিন. সর্বশেষ ভূমিকম্প হয়। এ প্রসঙ্গে হজরত আবদুল্লাহ ইবনে আববাস (রা.) বলেন, হজরত শোয়াইব (আ.) এর সম্প্রদায়ের ওপর প্রথমে এমন আজাব চাপিয়ে দেয়া হয়, যেন জাহান্নামের দরজা তাদের জন্য খুলে দেয়া হয়েছিল। ফলে তাদের শ্বাস রুদ্ধ হতে থাকে। তখন ছায়া তো দূরের কথা, পানিতেও তাদের শামিত্ম ছিল না। অতঃপর তারা অসহ্য গরমে অতিষ্ঠ হয়ে ভূগর্ভস্থ কক্ষ প্রবেশ করে দেখল, সেখানে আরও বেশি গরম। তখন তারা অস্থির হয়ে ময়দানের দিকে ধাবিত হলো। সেখানে আল্লাহ তায়ালা একটি ঘন কালো মেঘ পাঠিয়ে দিলেন, যার নিচে শীতল বাতাস বইছিল। তারা সবাই গরমে দিগ্বিদিক জ্ঞানহারা হয়ে মেঘের নিচে এসে ভিড় করল। তখন মেঘমালা থেকে তাদের ওপর অগ্নিবৃষ্টি বর্ষিত হতে শুরু হলো এবং ভূমিকম্পও হলো। অপরদিকে বিকট গর্জনও তাদের পাকড়াও করল। ফলে তারা সবাই ভস্মসত্মূপে পরিণত হলো। (আলবাহরুল মুহিত)। বর্তমানে আমাদের সমাজে এমন লোকের অভাব নেই, যারা হজরত শোয়াইব (আ.) এর কওম যে অপরাধ করেছে সেরকম অপরাধে লিপ্ত। এ ঘটনায় তাদের জন্য রয়েছে সর্তকবাণী। সুতরাং যারা ওজনে কম দেন তাদের এ ঘটনা থেকে শিক্ষা অর্জন করা উচিত।

May be an image of text

May be an image of text that says 'Suleiman SULFIMAN SULE'

হযরত সোলায়মান (আ) এর জীবনী।

আল্লাহ তাআলা পৃথিবীর শুরু থেকে শেষপর্যন্ত অসংখ্য নবী-রাসুল প্রেরণ করেছেন।যার সঠিক সংখ্যার কোনোসুস্পষ্ট তথ্য নেই।কুরআনের বর্ণনা মতে এ সকল নবী-রাসূলদেরমধ্যে তিনি যাদেরকে নবুয়ত দানের পাশাপাশি রাজত্ব ও হিকমত প্রদান করেছেন, তাদের মধ্যেহজরত সুলাইমান আলাইহিস সালাম অন্যতম সংক্ষেপে তার রাজত্বের বিবরণ তুলে ধরা হলো-

জন্ম পরিচিতি
সুলাইমান আলাইহিস সালাম হজরত দাউদ আলাইহিস সালামের ১৯ সন্তানের মধ্যে একজন। রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের আগমনের প্রায় দেড় হাজার বছর পূর্বে নবুয়ত লাভ করেন। আল্লাহ তাআলা তাঁকে প্রজ্ঞা, জ্ঞান ও নবুয়ত দান করেন। তিনি শাম ও ইরাক অঞ্চলে তাঁর পিতার রেখে যাওয়া রাজ্যের বাদশাহি লাভ করেন।

শৈশব কাল
আল্লাহ তাআলা হজরত সুলাইমান আলাইহিস সালামকে শৈশবেই প্রখর মেধা ও প্রজ্ঞা দান করেছিলেন। যার প্রমাণ পাওয়া যায়- তাঁর পিতার (দাউদ আলাইহিস সালাম) দরবারে বকরির পাল ও শষ্যক্ষেত্র বিনষ্টের বিচারের ফয়সালায়। হজরত দাউদ আলাইহিস সালাম বিচারে তাঁর দেয়া ফয়সালা বাতিল করে হজরত সুলাইমান আলাইহিস সালামের ফয়সালা বহাল রাখেন। তাছাড়া দুই মহিলার ‘এক সন্তান’কে উভয়ের সন্তান বলে দাবির ফয়সালায় হজরত দাউদ আলাইহিস সালামের দরবারে উপস্থিত হলেন। দাউদ আলাইহিস সালাম বয়স্ক মহিলাকে সন্তান প্রদানের ফয়সালা দেন। সে ফয়সালাও সুলাইমান আলাইহিস সালাম তীক্ষ্ণ মেধার মাধ্যমে সঠিক রায় দেন। যা পিতার ফয়সালার বিপরীতে যায়। হজরত দাউদ নিজের ফয়সালা বাতিল করে পুত্র সুলাইমান আলাইহিস সালামের ফয়সালা বলবৎ রাখেন।

রাজত্বকাল
হজরত সুলাইমান আলাইহিস সালাম পিতার মৃত্যুর পর শৈশবেই মাত্র ১৩ বছর বয়সে তিনি রাজত্বের দায়ভার গ্রহণ করেন। রাজত্ব লাভের চতুর্থ বৎসর হতে তিনি বাইতুল মুকাদ্দাস নির্মাণ কাজ শুরু করেন। তিনি ৫৩ বছরের দুনিয়ার জিন্দেগিতে ৪০ বছর যাবত রাজ্য পরিচালনা করেন। তবে কত বৎসর বয়সে তিনি নবুয়ত লাভ করেছিলেন, তা সঠিক জানা যায়নি। তবে তাঁর রাজ্য ছিল তৎকালীন বিশ্বের সবচেয়ে সুখী ও শক্তিশালী রাজ্য। তাঁর উল্লেখযোগ্য বৈশিষ্ট্যসমূহ, আল্লাহ তাআলা দাউদ আলাইহিস সালামের ন্যায় হজরত সুলাইমান আলাইহিস সালামকেও বিশেষ গুণ ও বৈশিষ্ট্য দান করেন এবং তাঁকে নিয়ামত দান করেন। তাঁর প্রতি

আল্লাহর বিশেষ নিয়ামত ও বৈশিষ্ট্যগুলো হলো- বায়ু প্রবাহ অনুগত হওয়া।
আল্লাহ বলেন- ‘আর আমি বায়ুকে সুলাইমানের অধীন করেছিলাম, যা সকালে এক মাসের পথ এবং বিকালে এক মাসের পথ অতিক্রম করতো। (সুরা সাবা : আয়াত ১২)

‘তামা’কে তরল ধাতুতে পরিণত করে নহর প্রবাহিত করা। আল্লাহ বলেন- ‘আমি তার জন্যে গলিত তামার এক ঝর্ণা প্রবাহিত করেছিলাম।’ (সুরা সাবা : আয়াত ১২) জিন জাতি তাঁর অধীনস্থ হওয়া। আল্লাহ বলেন- ‘কতক জিন তার সামনে কাজ করত তার পালনকর্তার আদেশে। তাদের যে কেউ আমার আদেশ অমান্য করবে, আমি জ্বলন্ত অগ্নির-শাস্তি আস্বাদন করাব।’ (সুরা সাবা : আয়াত ১২) পক্ষীকুলকে অনুগত করা।

আল্লাহ বলেন- ‘সুলায়মান দাউদের উত্তরাধিকারী হয়েছিলেন। বলেছিলেন, ‘হে লোক সকল! আমাকে উড়ন্ত পক্ষীকূলের ভাষা শিক্ষা দেয়া হয়েছে এবং আমাকে সব কিছু দেয়া হয়েছে। নিশ্চয় এটা সুস্পষ্ট শ্রেষ্ঠত্ব।’ (সুরা নমল : আয়াত ১৬)
পিপীলিকার ভাষা বুঝার ক্ষমতা।

আল্লাহ বলেন, ‘যখন তারা পিপীলিকা অধ্যূষিত উপত্যকায় পৌঁছলো, তখন এক পিপীলিকা বলল, হে পিপীলিকার দল! তোমরা তোমাদের গৃহে প্রবেশ কর। অন্যথায় সুলায়মান ও তার বাহিনী অজ্ঞাতসারে তোমাদেরকে পিষ্ট করে ফেলবে। তার কথা শুনে সুলায়মান মুচকি হাসলেন এবং বললেন, হে আমার পালনকর্তা, তুমি আমাকে সামর্থ দাও যাতে আমি তোমার সেই নিয়ামতের কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করতে পারি, যা তুমি আমাকে ও আমার পিতা-মাতাকে
দান করেছ।’ (সুরা নমল : আয়াত ১৮-১৯)

অতুলনীয় সাম্রাজ্য লাভ। আল্লাহ বলেন, ‘সোলায়মান বললঃ হে আমার পালনকর্তা, আমাকে মাফ করুন এবং আমাকে এমন সাম্রাজ্য দান করুন যা আমার পরে আর কেউ পেতে পারবে না। নিশ্চয় আপনি মহাদাতা। (সুরা ছোয়াদ : আয়াত ৩৫)

প্রাপ্ত অনুগ্রহ রাজির হিসাব না রাখার অনুমতি পাওয়া। আল্লাহ বলেন, ‘এবং অন্য আরও অনেককে অধীন করে দিলাম, যারা আবদ্ধ থাকত শৃঙ্খলে। এগুলো আমার অনুগ্রহ, অতএব, এগুলো কাউকে দাও অথবা নিজে রেখে দাও-এর কোন হিসেব দিতে হবে না। (সুরা ছোয়াদ : আয়াত ৩৯-৪০)

ওফাত
বিশাল সাম্রাজ্যের বাদশা ও আল্লাহর নবী সুলাইমান আলাইহিস সালাম ৫৩ বছর জীবিত ছিলেন। ৪০ বছর রাজত্ব পরিচালনা করেন। সর্বশ্রেষ্ঠ এবং সর্বশেষ নবী হজরত মুহাম্মাদ ইবনে আবদুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের দুনিয়ায় আগমনের ১৫৪৬ বছর পূর্বে হজরত সুলাইমান আলাইহিস সালাম ইন্তেকাল করেন। আল্লাহ তাআলা কুরআনে বর্ণিত নবী-রাসুলদের জীবনী ও নবুয়তের বর্ণনাকে মুসলিম উম্মাহর জন্য উপদেশ হিসেবে গ্রহণ করার এবং

কুরআন-
সুন্নাহর প্রতি যথাযথ দায়িত্ব পালন করার তাওফিক দান করুন। আমিন।

সুলাইমান (আঃ) এর জীবনী থেকে শিক্ষণীয় বিষয় সমূহ উল্লেখ কর?

১. নবুঅত ও খেলাফত একত্রে একই ব্যক্তির মাধ্যমে পরিচালিত হওয়া সম্ভব।

২. ধর্মই রাজনীতির প্রধান চালিকা শক্তি। ধর্মীয় রাজনীতির মাধ্যমেই পৃথিবীতে প্রকৃত শান্তি প্রতিষ্ঠা করা সম্ভব।

৩. প্রকৃত মহান তিনিই, যিনি সর্বোচ্চ ক্ষমতার অধিকারী হয়েও অহংকারী হন না। বরং সর্বদা আল্লাহর প্রতি বিনীত থাকেন।

৪. শত্রুমুক্ত কোন মানুষ দুনিয়াতে নেই। সুলায়মানের মত একচ্ছত্র এবং অপ্রতিদ্বন্দ্বী বাদশাহর বিরুদ্ধেও চক্রান্ত, ষড়যন্ত্র ও মিথ্যাচার চালানো হয়েছে।

৫. সম্পূর্ণ নিঃস্বার্থভাবে প্রজাসাধারণের কাজ করলেও তারা অনেক সময় না বুঝে বিরোধিতা করে। যেমন বায়তুল মুক্বাদ্দাস মসজিদের নির্মাণ কাজ সমাপ্ত না হওয়ায় আল্লাহ বাকী সময়ের জন্য সুলায়মানের প্রাণহীন দেহকে লাঠিতে ঠেস দিয়ে দাঁড় করিয়ে রাখেন জিন মিস্ত্রী ও জোগাড়েদের ভয় দেখানোর জন্য। যাতে তারা কাজ ফেলে রেখে চলে না যায় এবং নতুন চক্রান্তে লিপ্ত হবার সুযোগ না পায়।

May be an image of text

হজরত মুসা (আ.)-এর কাহিনি আমরা কেবল মোজেজা বা মুখরোচক আশ্চর্য ঘটনা হিসাবেই শুনে থাকি। লাঠির আঘাতে লোহিত সাগরের পানি দুই দিকে সরে গিয়ে তলদেশ বের হয়ে আসা, তারপর বনি ইসরাইলের সাগরের ওপারে চলে যাওয়ার পর ফেরাউন বাহিনীর ডুবে মরা মুসা (আ.)-এর কাহিনি বলতে কেবল এ সবেই দৃষ্টি সীমাবদ্ধ রাখা হয়, অন্তর্নিহিত উদ্দেশ্য উদঘাটনের চেষ্টা করা হয় না।

অথচ এ কাহিনির প্রকৃত মর্ম হলো প্রত্যেক মানুষের জন্য জরুরি যে নিজ জাতিকে জুলুম ও জিল্লতি থেকে উদ্ধার করে উন্নতির পথ প্রদর্শন করা। বনি ইসরাইল নেহায়েত অসহায় অবস্থায় ছিল, শাসকশ্রেণি তাদের পুত্রসন্তানদের হত্যা করত আর কন্যাসন্তানদের জোরপূর্বক সেবাদাসী বানিয়ে রাখত।

মুসা (আ.)-এর কাহিনি সেসব গুণ অর্জনের শিক্ষা দেয় যার মাধ্যমে প্রত্যেক ব্যক্তি নিজ জাতিকে উন্নত করার ক্ষমতায় বলিয়ান হতে সক্ষম।

আল্লাহতায়ালা হজরত মুসা (আ.)-কে নির্দেশ করেন, তুমি এবং তোমার ভাই হারুন, দুজনেই ফেরাউনের কাছে যাও। আল্লাহ বলেন-যাও তার কাছে এবং বলো, আমরা তোমার রবের প্রেরিত, বনি ইসরাইলকে আমাদের সঙ্গে যাওয়ার জন্য ছেড়ে দাও এবং তাদের কষ্ট দিও না। আমরা তোমার কাছে নিয়ে এসেছি তোমার রবের নিদর্শন এবং শান্তি তার জন্য যে সঠিক পথ অনুসরণ করে।

(সূরা ত-হা, আয়াত ৪৭)-এর সঙ্গে আল্লাহতায়ালা হজরত মুসা (আ.)-কে নির্দেশ দিলেন তার জাতিকে যেন অতীতের বিভিন্ন জাতির উত্থান-পতনের ইতিহাস শুনিয়ে সতর্ক করা হয়।

ইরশাদ করেন : আমি এর আগে মুসাকেও নিজের নিদর্শনাবলিসহকারে পাঠিয়ে ছিলাম। তাকেও আমি হুকুম দিয়েছিলাম, নিজের সম্প্রদায়কে অন্ধকার থেকে বের করে আলোকের মধ্যে নিয়ে এসো এবং তাদের আল্লাহর সময় (ইতিহাস) স্মরণ করাও। এ ঘটনাবলির মধ্যে বিরাট নিদর্শন রয়েছে এমন প্রত্যেক ব্যক্তির জন্য যে সবর করে ও কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করে। (সূরা ইবরাহিম, আয়াত ৫)।

হজরত শাহ ওলিউল্লাহ দেহলবি (রহ.) তার কিতাব ‘ফাওজুল কাবির’-এর তৃতীয় পৃষ্ঠায় লিখেন : আলোচ্য আয়াতে দতাজকির বি-আইয়ামিল্লাহ ‘বা আল্লাহর সময় স্মরণ করানো-মানে ওইসব ঘটনার বর্ণনা উদ্দিষ্ট করা হয়েছে যেখানে নেককার বান্দাদের পুরস্কৃত করা হয়েছে আর নাফরমান বান্দাদের আজাব দেওয়া হয়েছে।

এরপর আল্লাহতায়ালা ইরশাদ করেন : আর আমি মুসা ও তার ভাইকে ইশারা করলাম এই বলে যে, মিসরে নিজের কওমের জন্য কিছু ঘরের বন্দোবস্ত করো, নিজেদের ওই ঘরগুলোকে কেবলায় পরিণত করো এবং নামাজ কায়েম করো। আর ইমানদারদের সুখবর দাও। (সূরা ইউনুস, আয়াত ৮৭)। অর্থাৎ এখন তোমাদের মুক্তির সময় কাছাকাছি চলে এসেছে।

খেয়াল করে দেখুন, একটা মৃত জাতিকে জিন্দা করার জন্য আল্লাহতায়ালা ‘পূর্বকালের বিভিন্ন জাতির উত্থান-পতনের ইতিহাস এবং সফলতার পূর্ণ আশা’ হৃদয়ে বদ্ধমূল করার শিক্ষা দিচ্ছেন। এ দুই বিষয়ের শিক্ষার যে কী ফায়দা, ওই জামানার মানুষজন খুব ভালো করেই তা বুঝে নিয়েছিল।

তারপর দেখুন, ফেরাউনের জাদুকরেরা যখন হজরত মুসা (আ.)-এর ধর্ম কবুল করে নিল, তখন ফেরাউন বলল : এখন আমি তোমাদের হাত-পা বিপরীত দিক থেকে কেটে দেব এবং খেজুর গাছের কাণ্ডে তোমাদের ক্রুশবিদ্ধ করব। (সূরা ত-হা, আয়াত ৭১)।

তখন তারা জওয়াব দিল : যা করার করতে পার। (সূরা ত-হা, আয়াত ৭২)।

হজরত মুসা (আ.) ও সঙ্গী-সাথিরা নিজেদের মূল উদ্দেশ্য ও মাকসাদের পরিপূর্ণতার জন্য সব রকমের ত্যাগ স্বীকার করতে প্রস্তুত ছিলেন। এভাবেই তারা সফল হয়েছেন এবং দুশমনেরা ধ্বংস হয়ে গেছে।

হজরত মুসা (আ.)-এর কাহিনিতে বৈচিত্র্যের মধ্যেও জাতিগত ঐক্য বজায় রাখার ওপর খুব জোর দেওয়া হয়েছে। মুসা (আ.) যখন তুর পাহাড়ে আল্লাহর সাক্ষাতে যান এবং হজরত হারুন (আ.)-কে তার স্থলাভিষিক্ত করেন, তখন বনি ইসরাইলে একদল গোমরাহ হয়ে গিয়ে গরুর বাছুর পূজা করতে শুরু করে।

হজরত মুসা (আ.) তুর পাহাড় থেকে ফিরে এসে যখন দেখলেন তার জাতির এ অবস্থা, তিনি ভয়ানক রেগে গিয়ে হজরত হারুন (আ.)-এর চুল-দাড়ি ধরে বললেন : (মুসা) বললেন, হে হারুন! তুমি যখন দেখলে এরা পথভ্রষ্ট হয়ে যাচ্ছে তখন আমার পথে চলা থেকে কিসে তোমাকে বিরত রেখেছিল?… তুমি কি আমার হুকুম অমান্য করেছ? (সূরা ত-হা, আয়াত ৯২-৯৩)। মানে তারা যখন গোমরাহ হয়ে যাচ্ছে, তুমি কেন জোর-জবরদস্তি করে হলেও তাদের বাধা দাওনি?

উত্তরে হজরত হারুন (আ.) বললেন : আমার আশঙ্কা ছিল তুমি এসে বলবে যে, তুমি বনি ইসরাইলের মধ্যে বিভেদ সৃষ্টি করেছ এবং আমার কথা রক্ষা করনি। (সূরা ত-হা, আয়াত ৯৪)-এর মানে হজরত হারুন (আ.) যখন তার জাতিকে সংশোধনের চেষ্টা করে কামিয়াব হননি, তখন কিছু সময়ের জন্য তাদের গোমরাহির ওপর নিশ্চুপ ছিলেন, সেটাও এক বৃহৎ স্বার্থে যে, এখন যদি তাদের গোমরাহি বন্ধ করার জন্য জোর-জবরদস্তি করি, তাহলে সম্ভাবনা আছে পুরো জাতি খণ্ডে খণ্ডে বিভক্ত হয়ে যাবে, ঐক্যবদ্ধ থাকবে না।

এখানে লক্ষণীয় যে, একজন পয়গম্বর বিচ্ছিন্নতা বা অনৈক্যের বিপরীতে বাছুর পূজার মতো শিরকি কাণ্ডেও কিছু সময়ের জন্য নীরবতা পালন করেছেন। বাস্তবতা হলো যতক্ষণ পর্যন্ত কোনো জাতি একতাবদ্ধ থাকে, তালিম-তরবিয়ত তাদেরকে খুব ভালোভাবে প্রভাবিত করে। আর যখন তাদের মধ্যে বিচ্ছিন্নতা দেখা দেবে, তাদের ধ্বংস অনিবার্য, কোনোভাবেই তারা সফলকাম হতে পারবে না।

May be an image of text

হযরত হারুন (আঃ) এর জীবনী।

নাম হারুন। তিনি আল্লাহর একজন রাসুল। মুসা কালিমুল্লাহ (আঃ) এর বড় ভাই। তিন বছরের বড় তিনি মুসার চেয়ে। আল্লাহ যখন মুসা (আঃ) কে রাসুল নিয়োগ করেন, তখন তিনি আল্লাহর কাছে দোয়া করেছিলেন তিনি যেনো তাঁর ভাই হারুনকেও রাসুল নিয়োগ করে তাঁর হাত শক্ত করেন। আল্লাহ তাঁর দোয়া কবুল করেন এবং হারুনকে মুসার সহযোগী রাসুল নিয়োগ করেন। হযরত হারুন ছিলেন বনী ইসরাইলদের শ্রেষ্ঠ রাসুলগনের একজন। তিনি ছিলেন সুবক্তা।

দাওয়াতী ও সাংগঠনিক জীবন

মহান আল্লাহ বলেন –
“আমি মূসা ও হারুনের প্রতি অনুগ্রহ করেছি। তাঁদের উভয়কে আমি উদ্ধার করেছি মহাকষ্ট থেকে। আমি তাঁদের সাহায্য করেছি। ফলে তারা বিজয়ী হয়েছে। তাঁদের আমি সঠিক পথ দেখিয়েছি। তাঁদের উভয়কে আমি সুস্পষ্ট কিতাব দান করেছি। পরবর্তী প্রজন্মের কাছে তাঁদের উভয়ের সুনাম অক্ষুন্ন রেখেছি। মুসা ও হারুনের প্রতি বর্ষিত হোক সালাম। এভাবেই আমি উপকারী লোকদের প্রতিদান দিয়ে থাকি। আসলে ওরা দু’জনেই ছিলো আমার প্রতি বিশ্বস্ত দাস।” (সূরা আস সাফফাত, আয়াত ১১৪-১২২)

আল্লাহর এ বানী থেকে হযরত হারুনের সঠিক মর্যাদা বুঝা যায়। তিনি ভাই মুসার সাথে ফেরাউনের দরবারে উপস্থিত হন। ফেরাউনকে দাওয়াত প্রদান করেন। ফেরাউন তাঁদের দুজনকেই মিথ্যাবাদী বলে অস্বীকার করে। সে বলে, এরা দুই ভাই রাষ্ট্র ক্ষমতা দখল করার জন্যে এসেছে। অতপর ফেরাউন হযরত মুসা ও হারুন দুজনের বিরুদ্ধে ষড়যন্ত্র শুরু করে। অতপর মুসা ও হারুনের সাথে ফেরাউনের যে দ্বন্দ্ব-সংঘাত হয়, তাঁর পরিনতিতে আল্লাহ ফেরাউনকে ধংস ও নির্মূল করে দেন। ফেরাউন ডুবে মরার পর সিনাই উপত্যকায় থাকাকালে হযরত মুসা হযরত হারুনকে নিজের খলিফা বা ভারপ্রাপ্ত নেতা মনোনীত করে চল্লিশ দিনের জন্যে তূর পাহাড়ে নির্জনবাসে যান। হযরত হারুন ভারপ্রাপ্ত নেতা থাকাকালেই সামেরি গ-বাছুর বানিয়ে সেটার পূজা করতে বলে সকলকে। হারুন তাঁকে বারন করেন। এ ব্যাপারে তিনি কঠোর পদক্ষেপ নিতে চেয়েছিলেন। কিন্তু জাতি দ্বিধাবিভক্ত হবার উপক্রম হয়ে পড়ায় তিনি সেই পদক্ষেপ নেননি। হযরত মুসা চল্লিশ দিন পর তাওরাত নিয়ে ফেরত এসে হযরত হারুনের উপর ক্রোধান্বিত হন। এ ঘটনাটি কুরআনে এভাবে উল্লেখ করা হয়েছে –

“(গ-বাছুর পুজাকরতে নিষেধ করে) হারুন তাঁদের বলেছিলো, হে আমার জাতি তোমরা তো পরীক্ষায় পড়েছো। তোমাদের প্রভু বড় করুনাময়। কাজেই তোমরা আমার অনুসরন করো এবং আমার নির্দেশ মানো। কিন্তু তারা তাঁকে বলে দিলো মুসা ফিরে না আসা পর্যন্ত আমরা এর পূজা করবো। মুসা ফিরে এসে বললো- হে হারুন তুমি যখন দেখলে এরা পথভ্রষ্ট হয়ে যাচ্ছে, তখন এদেরকে আমার অনুসরনের পথে আনতে তোমাকে কিসে বাধা দিয়েছে? তুমি কি আমার হুকুম অমান্য করলে? হারুন বললো- হে আমার সহোদর ভাই, আমার দারি ও চুল ধরে টেনোনা। আমার ভয় হচ্ছিলো তুমি এসে বলবে- হারুন তুমি কেন বনী ইসরাইলদের মধ্যে বিভেদ সৃষ্টি করলে? কেন আমার কথা রক্ষা করোনি।” (সূরা তোয়াহা, আয়াত ৯০-৯৪)

অন্যস্থানে বলা হয়েছে-
“মুসা নিজের ভাইয়ের চুল ধরে টানলো। হারু বললো – হে আমার সহোদর, এই লোকগুলো আমায় কোণঠাসা করে ফেলেছিলো এবং আমাকে হত্যা করার জন্যে উদ্যত হয়েছিলো। কাজেই তুমি শত্রুদের কাছে আমায় হেয় করোনা এবং আমাকে যালিম গণ্য করোনা। তখন মুসা দোয়া করলো – হে প্রভু, আমাকে আর আমার ভাইকে ক্ষমা করে দাও। আর আমাদেরকে রবেশ করাও তোমার অনুগ্রহের মধ্যে। তুমিই তো সব দয়াবানের বড় দয়াবান।” (সূরা আল আরাফ, আয়াত ১৫০-১৫১)

এ থেকে বুঝা যায়, হযরত হারুন জীবনের ঝুকি নিয়েও নিজ কওমকে সত্য পথে পরিচালিত করার চেষ্টা করেছিলেন। তবে জাতির মধ্যে অনৈক্য ও বিভেদ সৃষ্টি হোক এটা তিনি চাননি। আসলে তিনি ছিলেন বড়ই প্রজ্ঞাবান ও মহান রাসুল।

হযরত মুসা (আঃ) এর মৃত্যুর এগারো মাস পূর্বে তিনি ইন্তেকাল করেন। ভাই মুসার মতই তিনি ছিলেন একজন বলিষ্ঠ সংগ্রামী পুরুষ। তারা দুই ভাই নেতৃত্ব প্রদান করেন এক বিশাল জাতির।

May be an image of tree, lumberyard and text

হজরত জাকারিয়া [আ.] গাছের ভেতরে ঢুকে আশ্রয় নিয়েছিলেন, কথাটি কতটুকু সহিহ?

হযরত যাকারিয়া আ. সম্পর্কে লোকমুখে শুনা যায় যে, তাকে কাফেররা হত্যার জন্য ঘিরে নিলে তিনি নিরুপায় হয়ে গাছের কাছে আশ্রয় চাইলে গাছ দ্বিখন্ডিত হয়ে যায়। তিনি ঐ গাছের মধ্যে আশ্রয় নেন। গাছ পূর্ববৎ হয়ে যায়। কিন্তু তাঁর জামার আচল বের হয়ে থাকায় কাফেররা চিনে ফেলে এবং অস্ত্র দিয়ে গাছ চিরে, এতে নবীও দুই ভাগ হয়ে যান। এরূপ একটি কাহিনী শুনা যায়। এটা কতটুকু সত্য? বর্ণিত ঘটনাটি সম্পূর্ণ ভিত্তিহীন। সহীহ হাদীসে তা পাওয়া যায় না। ইবনে কাছীর রাহ. আলবিদায়া ওয়ান নিহায়া(২/২২৮-২২৯) গ্রন্থে এই ঘটনাটি খুবই আপত্তিকর বলে মন্তব্য করেছেন। সুতরাং তা বর্ণনা করা যাবে না। হযরত যাকারিয়া আ. ও অন্যান্য নবীদের সম্পর্কে করআন মজীদ ও সহীহ হাদীসে যতটুকু বর্ণনা আছে ততটুকু জানাই আমাদের জন্য যথেষ্ট। তাই হযরত যাকারিয়া আ.-এর সম্পর্কে কুরআন মজীদের কয়েকটি আয়াতের তরজমা ও একটি সহীহ হাদীসের অনুবাদ পেশ করা হল। (তরজমা) আপনার পালনকর্তার অনুগ্রহের বিবরণ, তার বান্দা যাকারিয়া আ.-এর প্রতি, যখন তিনি নিজ পালনকর্তাকে গোপনে আহবান করেছিলেন। তিনি প্রার্থনা করলেন, হে আমার পালনকর্তা! আমার অস্থিসমূহ দুর্বল হয়ে পড়েছে। বার্ধক্যে মস্তক সুশুভ্র হয়ে গেছে। (মাথার সমস্ত চুল পেকে সাদা হয়ে গেছে)। হে আমার পালনকর্তা! আপনাকে ডেকে আমি কখনো বিফল মনোরথ হইনি। আর আমি আমার পরে স্বজনবর্গ হতে আশঙ্কা করছি ( যে, তারা শরীয়তের এবং ধর্মের সেবা করবে না।) এবং আমার স্ত্রী বন্ধ্যা। অতএব আপনি বিশেষভাবে আপনার পক্ষ থেকে আমাকে একজন ওয়ারিশ (পুত্র) দান করুন। সে আমার এবং ইয়াকুব-এর বংশের উত্তরাধিকারী হবে। হে আমার পালনকর্তা! তাকে আপনি সন্তোষজনক করুন। (আল্লাহ তাআলা বললেন,) যে যাকারিয়া! আমি তোমাকে একটি পুত্রের সুসংবাদ দিচ্ছি। তার নাম হবে ইয়াহইয়া। ইতিপূর্বে আমি এ নামে কারো নামকরণ করিনি। তিনি বললেন, হে আমার পালনকর্তা! কেমন করে আমার পুত্র হবে, অথচ আমার স্ত্রী যে বন্ধ্যা। আর আমিও যে বার্ধক্যের শেষ প্রান্তে উপনীত। তিনি বললেন, এমনিতেই হবে। তোমার পালনকর্তা বলে দিয়েছেন, এটা আমার জন্য সহজ। … (সূরা মারইয়াম : ১-১১) সহীহ মুসলিমে (২/২৬৮) হযরত আবু হুরায়রা রা. থেকে বর্ণিত হাদীস থেকে প্রতীয়মান হয় যে, তিনি নিজ হাতে জীবিকা নির্বাহ করতেন এবং পেশায় তিনি ছিলেন একজন ছুতার। [শরহুন নববী মুসলিম ১৫/১৩৫] কুরআন মজীদের নিম্নোক্ত সূরাগুলোতেও তার সম্বন্ধে আলোচনা আছে। [সূরা আলইমরান : ৩৭-৪১; সূরা আম্বিয়া : ৯০-৯৮; সূরা আনআম : ৮৫; সূরা হুদ : ৭২-৭৩।]

May be an illustration of text

হযরত ঈসা (আঃ) ছিলেন বনু ইস্রাঈল বংশের সর্বশেষ নবী ও কিতাবধারী রাসূল। তিনি ‘ইনজীল’ প্রাপ্ত হয়েছিলেন। তাঁরপর থেকে শেষনবী মুহাম্মাদ (ছাঃ)-এর আবির্ভাব পর্যন্ত আর কোন নবী আগমন করেননি। এই সময়টাকে فترة الرسل বা ‘রাসূল আগমনের বিরতিকাল’ বলা হয়। ক্বিয়ামত সংঘটিত হওয়ার অব্যবহিত কাল পূর্বে হযরত ঈসা (আঃ) আল্লাহর হুকুমে পুনরায় পৃথিবীতে অবতরণ করবেন এবং মুহাম্মাদী শরী‘আত অনুসরণে ইমাম মাহদীর নেতৃত্বে সারা পৃথিবীতে শান্তির রাজ্য কায়েম করবেন। তিনি উম্মতে মুহাম্মাদীর সাথে বিশ্ব সংস্কারে ব্রতী হবেন। তাই তাঁর সম্পর্কে সঠিক ও বিস্তৃত ধারণা দেওয়া অত্যন্ত যরূরী বিবেচনা করে আল্লাহ পাক শেষনবী মুহাম্মাদ (ছাঃ)-এর মাধ্যমে বিশ্ববাসীকে জানিয়ে দিয়েছেন। উল্লেখ্য যে, মূসা (আঃ)-এর অনুসারী হওয়ার দাবীদার ইহুদীরা তাঁকে নবী বলেই স্বীকার করেনি। অত্যন্ত লজ্জাষ্করভাবে তারা তাঁকে জনৈক ইউসুফ মিস্ত্রীর জারজ সন্তান বলে আখ্যায়িত করেছে (নাঊযুবিল্লাহ)। অন্যদিকে ঈসা (আঃ)-এর ভক্ত ও অনুসারী হবার দাবীদার খৃষ্টানরা বাড়াবাড়ি করে তাঁকে ‘আল্লাহর পুত্র’ (তওবাহ ৯/৩০) বানিয়েছে’। বরং ত্রিত্ববাদী খৃষ্টানরা তাঁকে সরাসরি ‘আল্লাহ’ সাব্যস্ত করেছে এবং বলেছে যে, তিনি হ’লেন তিন আল্লাহর একজন (ثَالِثُ ثَلَثَةٍ =মায়েদাহ ৭৩)। অর্থাৎ ঈসা, মারিয়াম ও আল্লাহ প্রত্যেকেই আল্লাহ এবং তারা এটাকে ‘বুদ্ধি বহির্ভূত সত্য’ বলে ক্ষান্ত হয়। অথচ এরূপ ধারণা পোষণকারীদের আল্লাহ দ্ব্যর্থহীনভাবে ‘কাফের’ বলে ঘোষণা করেছেন (মায়েদাহ ৫/৭২-৭৩)। কুরআন তাঁর সম্পর্কে সঠিক তথ্য উপস্থাপন করেছে। আমরা এখন সেদিকে মনোনিবেশ করব।

উল্লেখ্য যে, হযরত ঈসা (আঃ) সম্পর্কে পবিত্র কুরআনের মোট ১৫টি সূরায় ৯৮টি আয়াতে বর্ণিত হয়েছে।

May be an image of text

সর্বকালের সর্বশ্রেষ্ঠ মহামানব হযরত মোহাম্মদ (সা) এর জীবনী লিখে শেষ করা যাবেনা।উনার জীবনের প্রতিটি সেকেন্ড আমাদের অনুসরণীয় আদর্শ। হযরত মোহাম্মদ সা:কে গভীরভাবে জানতে হলে বিভিন্ন গ্রন্থ পড়তে পারেন।

তথ্যসূত্র- বিভিন্ন অনলাইন থেকে

Print Friendly, PDF & Email

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here