আহলা দরবার শরীফ এর ইতিহাস ও বাংলাদেশ ইসলামী ছাত্রসেনা প্রতিষ্ঠা

চট্টগ্রামস্থ বোয়ালখালী থানার আহলা দরবার শরীফ বহু পূর্ব থেকে ইসলাম সূফী দর্শনে বিশ্বাসী তরিকতপন্থী মুসলমানদের এক মহা মিলন কেন্দ্র । ইসলাম ধর্মের মহৎ বাণী, শান্তি প্রচার ও প্রসারের উদ্দেশ্যে হযরত শেখ মোহাম্মদ গৌরী (রহঃ) সুদূর বাগদাদ শরীফ থেকে তৎকলীন বাংলা, গৌর রাজ্য হয়ে দীর্ঘ ভ্রমন শেষে ষোড়শ শতাব্দীর মাঝামাঝি সময়ে বোয়ালখালীর জমিনে তশরীফ আনেন । তাঁরসাধনা এবং শান্তির বাণী প্রচারের ফলে এই অঞলের মানুষ-জন ক্রমশঃ ইসলামের মহান দীক্ষা ও আধ্যাত্নিক দর্শনে জ্ঞান লাভ করে । ধর্মীয় কর্মকান্ড সম্পাদনের জন্য হযরত শেখ মোহাম্মদ গৌরী (রহঃ) ষোড়শ শতাব্দীর শেষ দিকে বর্তমান আহলা দরবার শরীফ প্রাঙ্গনে একটি মসজিদ নির্মাণ করেন যা এখনও বর্তমান রয়েছে)। সপ্তদশ শতাব্দীর প্রারম্ভে হযরত শেখ মোহাম্মদ গৌরী (রহঃ) বেছাল প্রাপ্ত হন । তাঁর মাজার শরীফ ক্রমে আধ্যাত্নিক সাধনার প্রবিত্র স্থান হিসেবেউল্লেখযোগ্য হয়ে উঠে । কথিত আছে যে হযরত শেখ মোহাম্মদ গৌরী (রহঃ) মদিনা মোনাওয়ারায় হযরত রাসূল আকরাম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এর রওজা মোবারক জেয়ারত কালে হুজুর পূরনূর সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এর কাছে আরজ করেন যেন, তাঁর বংশের প্রতিটি প্রজন্মেই আউলিয়া কেরামের জন্ম হয়। হযরত গাউছে পাক (রহঃ) এর আওলাদে পাক”শামসুল আরেফীন সৈয়দ সুলতান আহমদ বাগদাদী (রহঃ)” নামের আরেক সূফী সাধক সুদূর বাগদাদ শরীফ হতে সপ্তদশ শতাব্দীর শেষদিকে এই পবিত্র স্থানে আগমন করেন এবং গভীর আধ্যাত্নিক সাধনায় নিমগ্ন হন। জন শ্রুতি আছে যে, সপ্তদশ শতাব্দীর আরো শেষের দিকে জরীপ কর্মীরা এই এলাকায় এসে ধ্যানস্থ সাধক “শামসুল আরেফীন সৈয়দ সুলতান আহমদ বাগদাদী (রহঃ)” এর দর্শন লাভ করেন। তখন তিনি ‘আল্লাহু’ যিকিরে রত ছিলেন।দ্যানমগ্ন অবস্থায় তাঁর দেহ উই পোকার ঢিবি আচ্ছাদিত ছিল। ধ্যানস্থ অবস্থায় তাঁর ‘আল্লাহু’ যিকির অনুযায়ী জরীপকর্মিরা এই অঞ্চলের নাম ‘আল্লাহু’ শব্দের অনুগমনে ‘আহলা’ নিধারণ করেন। হযরত শেখ মোহাম্মদ গৌরী (রহঃ) এর বেছাল প্রাপ্তির পর তাঁর বংশধরদের মধ্যে যথাক্রমে হযরত শেখ দানু চৌধুরী সাহেব, হযরত শেখ মুনীর চৌধুরী সাহেব, হযরত শেখ আনিস চৌধুরী সাহেব ও হযরত মৌলভী সফর আলী চৌধুরী সাহেব খাদেম হিসেবে আহলা দরবার শরীফ কেন্দ্রে ধর্মীয় ও আধ্যাত্নিক জ্ঞানচর্চা বজায় রাখেন।ঊনবিংশ শতাব্দীর মাঝামাঝি সময়ে মৌলভী সফর আলী সাহেব এর ঔরশে কুতুবে জামান জনাব কাজী আছাদ আলী (রহঃ) জন্মগ্রহন করেন।পূর্ব পুরুষদের আধ্যাত্নিক ঐতিহ্যে লালিত হওয়ার কারণে শৈশবে তাঁর মনে গভীর খোদাপ্রেম, সৃষ্টি জিজ্ঞাসা ও ধর্মানুরাগের উন্মেষ ঘটে। মাধ্যমিক শিক্ষার সমাপনান্তে ঊনবিংশ শতাব্দীর শেষের দিকে উচ্চশিক্ষার্থে তিনি হিন্দুস্থান গমন করেন। জনাব কাজী আছাদ আলী (রহঃ) চট্টগ্রামের তৎকালীন রাঙ্গুনিয়ায় কাজী (বিচারক) পদে নিয়জিত হন। শৈশবে লালিত খোদা প্রেম ও আধ্যাত্নিক জিজ্ঞাসা দীর্ঘদিন তাকেঁ একজন কাজী হিসেবে আটকে রাখতে পারেনি। জমিদারীর ভোগবিলাসী জীবনও তাকে কখনাও হাতছানি দেয়নি।এসময় তিনি উপমহাদেশখ্যাত মাইজভান্ডার শরীফের গোড়াপত্তনকারী “গাউছুল আজমহ যরত মাওলানা শাহসূফী সৈয়দ আহমদউললাহ (কঃ)” এর আধ্যাত্নিক শিষ্যত্ব লাভ করেন। সাধনা ও রেয়াজতের সু-কঠিন সৌপান সমূহ পার হয়ে সিদ্বি লাভের পর তিনি হযরত কেবলা (কঃ) এর অন্যতম ‘খলিফা’ হিসেবে পরিনত হন এবং ‘জনাব’ উপাধি পান। খেলাফত প্রাপ্তির পর জনাব কাজী আছাদআলী কেবলা (রহঃ) আহলা দরবার শরীফে অবস্থান নিয়ে সুফীতত্তের চর্চা ও ইসলাম ধর্ম প্রচারে নিয়োজিত হন এবং হাজার হাজার ধর্মপ্রাণ মুসলমানকে দীক্ষা দান করেন। মানুষকে খোদাপ্রেমের শিক্ষাদান ও ত্বরীকত প্রচারের দায়িত্ব সুচারুরূপে সম্পন্ন করে “জনাব কাজী আছাদআলী কেবলা (রহঃ)” ১৩৩৬ হিজরী ১৯১৫ইং ১লা শাবান বেছালপ্রাপ্ত হন। জাহেরী জীবদ্দশায় একবার জযবা হালতে তিনি ভবিষ্যৎবাণী করেন যে, তাঁরএকজন কৃষ্ণবর্ণের পূত্রসন্তান জন্মগ্রহন করবেন। এই কৃষ্ণবর্ণের পূত্রসন্তাই হচ্ছেন হাযতে রওয়া, মুশকিল কূশা, সুলতানুলমোনাজেরীন, ইমামে আহলে সুন্নাত ওয়াল জামায়াত “হযরতুল আল্লামা শাহ্সূফী আবুল মোকারেম মোহাম্মদ নূরুল ইসলাম সাহেব কেবলা (রহঃ)” প্রকাশ (নূরী বাবা)। হযরত নূরী বাবা (রহঃ)শিক্ষাজীবন শেষে দেশে ফিরে আসেন এবং সাধককূল শিরমনি “মাওলানা সৈয়দ গোলামুর রহমান আল-ক্বাদেরী (কঃ)” এর আধ্যাত্নিক শিষ্যত্ব লাভ করেন।হযরত নূরী বাবা (রহঃ) তাঁর সারা জাহেরী জীবনে ভ্রান্তও বাতিলপন্থীদের বিরুদ্ধে অসংখ্য মোনাজেরা বা সম্মুখ বিতর্কে অবতীর্ণ হন এবং শরীয়তের সংশ্লিষ্ট দলিলাদির মাধ্যমে বক্তব্য উপস্থাপনার সাবলিলতায় সহজেই প্রতিপক্ষকে পরাভূত করে ইসলামের সঠিক পথে শামিল করেন। হযরত বাবা ভান্ডারী (কঃ) এর সুযোগ্য খলিফা এবং জনাব কাজী আছাদআলী কেবলা (রহঃ) এর বংশের অন্যতম আধ্যাত্নিক পুরুষ বিশিষ্ট মোনাজের ওত্বরিকত প্রচারক “হযরতুলআল্লামা শাহ্সূফী আবুল মোকারেম মোহাম্মদ নূরুল ইসলাম আল-ক্বাদেরী আল-চিশতী সাহেব কেবলা (রহঃ)”১৯৭৬ইং ১৪ডিসেম্বর,২৮শে অগ্রহায়ন তারিখে ভোর ৬টা ২২মিনিটে বেছালপ্রাপ্ত হন। তাঁর জাহেরী জীবদ্দশায় তিনি তার জ্যেষ্ঠপুত্র এবং সুযোগ্য উত্তরাধিকারী -পীরে তরিক্বত, রাহনুমায়ে শরীয়ত,মোজাদ্দেদে জামান,হাদীয়ে দ্বীন ও মিল্লাত,মোনাজেরে আহলে সুন্নাত,মুশক্বিল ক্বোশা,পীরে কামেল হযরতুল আল্লামা আলহ্বাজ শাহসূফী সৈয়দ আবু জাফর মোহাম্মদ সেহাবউদ্দীন খালেদ আল্ ক্বাদেরী-আল্ চিশতী (রহঃ)কে তাঁর জাহেরী অবর্তমানে স্থলাভিষিক্ত (সাজ্জাদানশীন) ঘোষনা করেন।পিতার আধ্যাত্নিকতায় মজে জীবনের একপর্যায়ে তাঁর কাছে শিষ্যত্ব(বায়াত) গ্রহন করেন।স্বীয় পিতা বেছালপ্রাপ্ত হওয়ার পূর্বে তাঁকে খেলাফতদান করেন। “হযরতুল আল্লামা জনাবমা ওলানা আলহ্াজ শা্হ সূফী সৈয়দ আবুজাফর মোহাম্মদ সেহাবউদ্দীন খালেদ সাহেব কেবলা কাবা আল-ক্বাদেরী আল-চিশতী (রহঃ)” আল্লাহর দ্বীন ওত্বরিকতের খেদমতে নিজের পূর্ণজীবন উৎসর্গ করে গেছেন। অলি আল্লাহ ও মুরশিদের প্রতি ভক্তদেরকে পূনঃ পূনঃ আদব শিক্ষা দিযে গেছেন। তিনি ভক্ত মুরিদদের সাথে সবসময় আধ্যত্নিক আলোচনায় মশগুল থাকতেন। আল্লাহ ও আল্লাহর রাসূল আহমেদ মোস্তবা,মোহাম্মদ মোস্তাফা (দঃ),সাহাবাগণ,পীরানে পীর দস্তগীর হযরত বড়পীর মীর মহিউদ্দীন আবদুল কাদের জিলানী (রহঃ), খাজায়ে খাজেগান হিন্দলওলী হযরত খাজা গরীবে নেওয়াজ মঈনুদ্দীন চিশতী আজমেরী ছেনজেরী ও প্রখ্যাত পীর মাশায়েখদের কথা বলতেন।ভক্তরা মুগ্ধহয়ে তা শুনতো । তিনি সর্বপ্রথম রাজধানী ঢাকায় ১২ইরবিউল আউয়ালে পবিত্র জশনে জুলুসে ঈদ-এ-মিলাদুন্নব ী (দঃ) আয়োজন করেন। তিনি বাংলাদেশ ইসলামী ছাত্র সেনার প্রতিষ্ঠাতা। আল্লাহ ও আল্লাহর রাসূল (দঃ) এর আদেশ-নির্দেশের সামগ্রিক ও নিঃশর্ত অনুসরনকে আদর্শএবং আল্লাহতা’লায়ার প্রদত্ত ও তাঁর প্রিয় নবী (সাঃ) প্রদর্শিত বিধানানুসৃত ”আহলে সুন্নাত ওয়াল জামায়াত” এর আদর্শের আলোকে মানব জীবনে মহানবী (সাঃ) এর মহান আদর্শ প্রতিফলনের মাধ্যমে আল্লাহ ও আল্লাহর রাসূল (দঃ) এর সন্তুষ্টি অর্জনকে উদ্দেশ্য ও লক্ষ্য করে ১৯৮০সালে ২১জানুয়ারী বাংলার জমিনে বাংলাদেশ ইসলামী ছাত্রসেনা প্রতিষ্ঠা করেন। এই স্বপ্নদ্রষ্টার পরিকল্পনা ও পরামর্শে চট্টগ্রাম নগরীর দেবপাহাড়স্থ খানকায়ে আসাদীয়া নূরীয়া সেহাবীয়ায়১১ জন সদস্য নিয়ে তিনি সুন্নিয়তের একক অরাজনৈতিক সংগঠন হিসেবে বাংলাদেশ ইসলামী ছাত্রসেনা প্রতিষ্ঠা করেন। তিনি এমন একজন কামেল ওলী ছিলেন যে, তাঁর সহচর্যে এসে, তাঁর কাছে বায়াত গ্রহণ করে অনেক বিপথগামী লোক সঠিক পথে ফিরে এসেছেন । তিনি যে কোন স্তরের আশেকে রাসূল (দঃ)ছিলেন, তা নিজেরস্ব-চোখে যারা দেখেননি, তাদের বিশ্বাস করতে কষ্ট হবে। ধর্মীয় অনুষ্ঠানাদির মধ্যে ছেমা মাহফিলের প্রতি ছিল তাঁর প্রচন্ড আকর্ষণ। তিনি নিজের পছন্দ অনুযায়ি গজল শিল্পী/ছেমা শিল্পী দাওয়াত দেয়ার জন্য পারামর্শ দিতেন।তিনি ছেমা মাহফিল করতে এবং শুনতে খুব পছন্দ করতেন । ছেমা চলাকালীন সময়ে জযবা হালতে নিজে যেমন কাঁদতেন তেমনি ভক্ত দেরকে কাঁন্নার জলে ভাসাতেন । সেজদা, ছেমা, কেয়ামও দরুদ এর পক্ষে তিনি ভক্তদের মাঝে যৌক্তিক দলিল উপস্থাপন সহকারে তা বয়ান করতেন। তিনি সুন্নিয়তের প্রচার-প্রসার এবং জাগ্রত করার নিমিত্তে দেশের বিভিন্ন স্থানে সফর করতেন ।তিনি বীর দর্পে বাতিল পন্থীদের সাথে একাই জিহাদ করে গেছেন । এ জন্য বর্তমান সময়ের সুন্নিয়তের বিশিষ্ঠ আলেম ওলামাগণ তাঁকে এ যুগের ‘খালেদবিন ওয়ালিদ’ উপাধি দেন । জীবনদ্বশায় আল্লাহ ও তাঁর পেয়ারা হাবীব (সাঃ) এর গুণগান মানুষের কাছে পৌছে দিয়ে- -পীরে তরিক্বত, রাহনুমায়ে শরীয়ত,মোজাদ্দেদে জামান,হাদীয়ে দ্বীন ও মিল্লাত,মোনাজেরে আহলে সুন্নাত,মুশক্বিল ক্বোশা,পীরে কামেল হযরতুল আল্লামা আলহ্বাজ শাহসূফী সৈয়দ আবু জাফর মোহাম্মদ সেহাবউদ্দীন খালেদ আল্-ক্বাদেরী, আল্-চিশতী (রহঃ) ২২চৈত্র ১৪১৭বঙ্গ, ৫এপ্রিল ২০১১ইং রাত ৮টা ১৫ মিনিটে বেছালপ্রাপ্ত হন ।তাঁর জাহেরী জীবদ্দশায় তিনি তার একমাত্র পুত্র এবং সুযোগ্য উত্তরাধিকারী “হযরত শাহসূফী সৈয়দ আবরার ইবনে সেহাব আল-ক্বাদেরী আল-চিশতী (মাঃজিঃআঃ) কে তাঁর স্থলাভিষিক্ত (সাজ্জাদানশীন) ঘোষনা করেন। আমীন…!!

ছুম্মা আমীন…!!!

link page-https://anjumaneasadiyanuriyashehabiya.wordpress.com/author/anjumaneasadiyanuriyashehabiya/page/2/

এবি/টিআর

Print Friendly, PDF & Email

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here