মাতৃভূমি বা জন্মভূমির প্রতি ভালবাসাই স্বদেশপ্রেম। স্বদেশপ্রেম একটি অতি পবিত্র ও মহৎ গুণ। সৃষ্টিগতভাবে মানুষের অন্তরে স্বদেশপ্রেম গ্রোথিত। মনীষী-মহামনীষীগণ স্বদেশপ্রেমকে গুরুত্ব দিয়েছেন। স্বদেশ নিয়ে তাঁরা লেখালেখি করেছেন এবং কাব্য-মহাকাব্য রচনা করেছেন। কারণ, যিনি যে দেশে জন্মগ্রহণ করেন সে দেশের প্রতি তাঁর থাকে নাড়ীর টান। মানুষের অন্তরে জন্মভূমির প্রতি এ টান সৃষ্টিকর্তা কর্তৃক প্রদত্ত। তাই যুগে যুগে মানুষ তার জন্মভূমিকে মায়ের সাথে তুলনা করেছে এবং মায়ের মর্যাদা দিয়েছে। মা ও সন্তানের ভালবাসা যেমন অকৃত্রিম ও অতুলনীয় তেমনি জন্মভূমির প্রতি তার নাগরিকের ভালবাসা অকৃত্রিম ও অতুলনীয়। মাতৃভূমিকে ভালবাসতে গিয়ে পৃথিবীর বহু মানুষ ত্যাগের দৃষ্টান্ত স্থাপন করেছে।

জীবন উৎসর্গ করে স্বদেশপ্রেমের প্রমাণ দিয়েছে এবং এ আত্মত্যাগকে গৌরবের মনে করেছে। মহানবী হযরত মুহাম্মদ (দ.)-এর মধ্যেও ছিল গভীর স্বদেশপ্রেম, যদিও তিনি সমগ্র বিশ্বের নবী এবং মানব-দানব, পশু-পাখি সবার জন্য করুণা হিসেবে প্রেরিত। তাই স্বদেশকে ভালবাসা তাঁর সুন্নাত এবং এ ক্ষেত্রেও তিনি সবার জন্য অনুপম আদর্শ। তাঁর প্রতি অবতীর্ণ পবিত্র কুরআনের একটি সূরার নাম “আল-বালাদ” বা নগরী, যা দ্বারা তাঁর জন্মস্থান মক্কা নগরীকে উদ্দেশ্য করা হয়েছে। তাঁর জন্মভূমির শপথ করে সূরাটির সূচনা করা হয়েছে। এর একটি উদ্দেশ্য হলো, তিনি ও তাঁর উম্মাহ যেন জন্মভূমিকে গুরুত্ব দেন এবং ভালবাসেন। উক্ত সূরাতে বলা হয়েছে, “আমি শপথ করছি এ নগরীর। আর আপনার আগমন হয়েছে এ নগরে” (সুরা আল-বালাদ: ১-২)। ব্যাখ্যাকারগণ এ বিষয়ে একমত পোষণ করেছেন যে, এখানে নগর বলতে পবিত্র ভূমি মক্কা নগরীকে বুঝানো হয়েছে এবং শপথ করার উদ্দেশ্য হলো এর গুরুত্ব বুঝানো। এ প্রসঙ্গে আল্লামা পানিপত্তি (রহ.) বলেন, “আল্লাহ তায়ালা মহানবী (দ.)-এর আগমনকে বিশেষভাবে উল্লেখ করেছেন এ জন্য যে, মক্কা নগরীর গুরুত্ব যতটা না বেশি নিজের কারণে তার চেয়ে বেশি মহানবী (দ.)-এর জন্মভূমি হওয়ার কারণে” (তাফসীরে মাজহারি, ১০/২৬৪)। আল্লামা করম শাহ আজহারি বলেন, “যেহেতু আল্লাহর নবী (দ.) মক্কায় বসবাস করছিলেন তাই আল্লাহ তায়ালা এ নগরীর শপথ করেছেন’’ (জিয়াউল কুরআন, ৫/৫৬৫)। পবিত্র কুরআনের সূরা তীন-এ বলা হয়েছে, “শপথ এ নিরাপদ শহরের।” এখানেও আল্লাহ তায়ালা পবিত্র মক্কা নগরীর শপথ করেছেন। উল্লেখ্য যে, মহানবী (দ.)-এর অন্যতম উপাধি ছিল আল-আমীন বা অতি বিশ্বস্ত; যে নামে তিনি সুপরিচিত ছিলেন জাহিলী যুগেও। অপরদিকে পবিত্র মক্কা নগরীকেও বলা হয়েছে “আল-বালাদ্ আল-আমীন” বা নিরাপদ শহর। অতএব তাঁর উপাধির সাথে একাকার হয়ে গেছে স্বীয় জন্মভূমির নাম।

মহানবী (দ.) হিজরতের পর ষোল অথবা সতেরো মাস পর্যন্ত বায়তুল মুকাদ্দাসের দিকে মুখ করে নামায আদায় করেন। কিন্তু তিনি মনের মধ্যে সদা লালন করতেন যে, তাঁর জন্মস্থানে অবস্থিত এবং পিতামহ হযরত ইব্রাহিম (আ.) কর্তৃক নির্মিত পবিত্র কাবা ঘর যদি তাঁর কিবলা হতো! তাঁর এ কামনা প্রিয় মাতৃভূমির প্রতি তাঁর ভালবাসার অন্যতম প্রমাণ। তিনি এ লক্ষ্যে বার বার আসমানি সিদ্ধান্তের আশায় ওপরের দিকে চেহারা উত্তোলন করছিলেন। এ প্রেক্ষিতে আয়াত নাযিল হলো, “নিশ্চয় আমি বার বার আপনাকে আসমানের দিকে তাকাতে দেখি। আমি আপনাকে সে কিবলার দিকে ফিরিয়ে দেব যা আপনি পছন্দ করেন। অতএব আপনি এখন মসজিদে হারামের দিকে ফিরে নামায আদায় করুন” (সূরা বাকারা: ১৪৫)।

দ্বীনের দাওয়াতের কাজ করতে গিয়ে মহানবী (দ.)-কে শারীরিক, মানসিক, আর্থিকসহ বিভিন্ন নির্যাতনের শিকার হতে হয়েছে। “শিয়াবে আবি তালেব” নামক স্থানে তাঁকে প্রায় তিন বছর সপরিবারে নির্বাসনে থাকতে হয়েছে। তিনি তখনো মাতৃভূমি ছেড়ে যাননি অথবা মাতৃভূমির জনগণকে অভিসম্পাত করেননি। বরং মাতৃভূমি এবং এর অধিবাসীদের জন্য দোয়া করেছেন বার বার। তাদের শুভ কামনা করেছেন। কিন্তু যখন অবিশ্বাসীদের অত্যাচারের মাত্রা ছাড়িয়ে গেল, মুসলমানদের কষ্টের সীমা রইল না তখন আল্লাহর পক্ষ থেকে নির্দেশ পেয়ে তিনি তাঁর অনুসারীদেরকে হিজরতের পরামর্শ দিলেন এবং ৬২২ খৃষ্টাব্দের রবিউল আউয়াল মাসে নিজেও মাতৃভূমি ত্যাগ করলেন। এ ক্ষেত্রে তিনি মাতৃভূমির প্রতি মায়া দেখালেন এভাবে যে, ভীষণ কষ্ট, নির্যাতন, এবং জীবনের ঝুঁকির মাঝেও তিনি প্রায় সবার পর হিজরত করার সিদ্ধান্ত নিলেন; যখন কুরাইশ যুবকরা তাঁকে চিরতরে খতম করার জন্য তাঁর ঘরের চতুর্দিকে বেষ্টনি তৈরি করেছিল। তিনি হযরত আবু বকরকে সাথে নিয়ে পথ চলতে চলতে যখন মক্কা নগরীর সীমানা অতিক্রম করছিলেন তখন “হাযওয়া” নামক স্থানে এসে হঠাৎ ঘুরে দাঁড়ালেন এবং প্রিয় মাতৃভূমির দিকে ফিরে মায়াভরা কন্ঠে নিন্মোক্ত বাক্য উচ্চারণ করলেন, “হে মক্কা, আল্লাহর শপথ, আল্লাহর এ পৃথিবীতে তুমিই আমার নিকট সর্বাধিক প্রিয় এবং তুমি আল্লাহর নিকটও সর্বাধিক প্রিয়। যদি তোমার অধিবাসীরা আমাকে বের করে না দিত তাহলে আমি তোমাকে ছেড়ে যেতাম না (তিরমিজি, ২/২৩০)। অন্য বর্ণনায় এসেছে, “হে মক্কা, তুমি আমার নিকট কতইনা উত্তম আর কতইনা প্রিয়! যদি তোমার অধিবাসীরা আমাকে বের করে না দিত তবে আমি তোমাতে ছাড়া অন্য কোথাও বসবাস করতাম না (প্রাগুক্ত)। হিজরত করার পরও তিনি মাতৃভূমি এবং এর জনগণের কথা সর্বদা ভাবতেন, তাদের মুক্তির চিন্তা করতেন। মাতৃভূমির স্মৃতিচারণ করতেন সময়ে সময়ে। এভাবে মদিনায় কেটে গেল প্রায় ৬টি বছর। একদিন তিনি স্বপ্ন দেখলেন যে, তিনি সদলবলে নিরাপদে পবিত্র মাতৃভূমি মক্কা নগরীতে প্রবেশ করছেন। যেহেতু তিনি মাতৃভূমির মায়ায় বিভোর ছিলেন এবং তাঁর স্বপ্ন মাত্রই অহি (ঐশীবাণী) সেহেতু সেই স্বপ্নের কথা তাঁর সহচরদের সামনে প্রকাশ করতে বিলম্ব করলেন না। এতে সাহাবাগণ যারপরনাই খুশি হয়েছেন। কারণ, মাতৃভূমির প্রেমে তাঁদের অন্তরাত্মা কাঁদছিল। পবিত্র কা‘বা যিয়ারতের জন্য তাঁদের হৃদয় ব্যাকুল হয়ে পড়েছিল। উক্ত স্বপ্নের কথা শুনার পর থেকে সাহাবাগণ (র.) মহানবীকে প্রায়শ প্রশ্ন করতেন কখন তাঁরা পবিত্র মক্কা গমন করবেন। এ প্রসঙ্গে আল-কুরআনের আয়াত অবতীর্ণ হলো, “আল্লাহ তাঁর রাসূলকে সত্য-স্বপ্নই দেখিয়েছেন। আল্লাহর ইচ্ছায় তোমরা অবশ্যই মসজিদে হারামে নিরাপদে প্রবেশ করবে- কেউ কেউ মুন্ডিতমস্তকে, কেউ কেউ চুল ছেঁটে। তোমাদের কোন ভয় থাকবে না। অবশ্যই তিনি যা জানেন তোমরা তা জান না। এ ছাড়াও তিনি তোমাদের জন্য নিশ্চিত করেছেন আসন্ন বিজয়” (সূরা আল-ফাত্হ্: ২৭)। উক্ত স্বপ্ন আর সাহাবাগণ (র.)-এর ব্যাকুলতা দেখে তিনি ৬ষ্ঠ হিজরিতে পবিত্র মদিনা হতে ১৪ শ সাহাবি নিয়ে মাতৃভূমি পবিত্র মক্কার উদ্দেশ্যে রওয়ানা দেন। পবিত্র মক্কার অনতি দূরে হুদায়বিয়া নামক স্থানে কুরাইশ কর্তৃক বাধাগ্রস্ত হয়ে তাদের সাথে সন্ধি করে তিনি সেবারকার মত ফিরে আসেন। এ প্রেক্ষিতে সূরা আল-ফাত্হ্ অবতীর্ণ হয় এবং আল্লাহ তায়ালা সেই সন্ধিকে মহা বিজয় বলে ঘোষণা দেন। মহানবী (দ.)-এর উক্ত কার‌্যাবলী ও হিজরতকালীন তাঁর বাণীসমূহ দ্বারা “স্বদেশপ্রেম ঈমানের অঙ্গ” হাদিসের অর্থগত বিশুদ্ধতা প্রমাণিত হয়।

কুরআন-সুন্নাহর আলোকে হিজরত করা একটি গুরুত্বপূর্ণ ইবাদত। হিজরতকারীর মর্যাদা আল্লাহ তায়ালা ও তাঁর প্রিয় নবী (দ.)-এর নিকট অত্যাধিক। পবিত্র কুরআন ও হাদিসের বহু জায়গায় হিজরত ও হিজরতকারীর গুরুত্ব বর্ণিত হয়েছে। হিজরতকারীদের জন্য ঘোষণা করা হয়েছে বহু পুরস্কার। হিজরত ও হিজরতকারীদের এসব মর্যাদা ও পুরস্কারের মূল কারণ হলো, তারা দ্বীনের স্বার্থে নিজের মাতৃভূমি ত্যাগ করেছেন। আর মাতৃভূমি ছেড়ে যাওয়া বড় কষ্টের। অন্য যেকোন ত্যাগের তুলনায় এটি কঠিন ও কষ্টকর।

জনগণ, ভাষা, সংস্কৃতি, সুনির্দিষ্ট ভূখন্ড ইত্যাদি মিলে একটি রাষ্ট্রের জন্ম হয়। মাতৃভাষা, দেশের জনগণ ও দেশীয় সংস্কৃতিকে ভালবাসা মাতৃভূমিকে ভালবাসার নামান্তর। মহানবী (দ.) নিজের ভাষা, সংস্কৃতি ও জাতিকে ভালবাসতেন। যে সংস্কৃতি ও অভ্যাস তাঁর ঐশীনীতি বিরুদ্ধ নয় সেগুলোকে তিনি সমর্থন করেছেন। যেমন আরবি ভাষা সম্পর্কে তিনি বলেন, “তোমরা আরবদেরকে তিন কারণে ভালবাসবে- যেহেতু আমি আরবি, কুরআনের ভাষা আরবি এবং জান্নাতবাসীর ভাষাও আরবি (বায়হাকি)। একদা তাঁর সামনে ভুনা গোসাপ পরিবেশন করা হলে তিনি সেটি গ্রহণ করার ইচ্ছা করলেন। তখন কেউ বললেন, এটি ভুনা গোসাপ। তখন তিনি হাত গুটিয়ে নিলেন। হযরত খালেদ (র.) প্রশ্ন করলেন, গোসাপ হারাম কি-না। তিনি বললেন, “না, যেহেতু আমার দেশে সেটি নেই তাই আমি তা পছন্দ করছি না” (ছহিহ বুখারি, ২/৮১২)। তিনি আরবদেরকে রাগাতে এবং তাদের সাথে প্রতারণা করতেও নিষেধ করেছেন। অতএব মহানবী (দ.) স্বজাতি, স্বদেশ ও স্বভাষাকে ভালবেসেছেন। আমাদের উচিৎ এ ক্ষেত্রেও তাঁর অনুসরণ করা এবং মাতৃভূমির সেবায় সর্বোচ্চ ত্যাগ স্বীকার করা। কারণ, যেকোন দেশের উন্নতির মূলভিত্তি হলো তার নাগরিকদের স্বদেশপ্রেম।

ড. মুহাম্মদ নুর হোসাইন সহযোগী অধ্যাপক, আরবি বিভাগ, চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয় ও খতিব, চবক জামে মসজিদ।

Print Friendly, PDF & Email

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here