কক্সবাজারে আশ্রয় নেওয়া রোহিঙ্গারা নিজেদের মধ্যে সার্বক্ষণিক যোগাযোগ আর খবর আদানপ্রদানে বিস্তৃত নেটওয়ার্ক গড়ে তুলেছে। তাদের হাতে হাতে এখন স্মার্টফোন। টেকনাফ ও উখিয়ার ক্যাম্পগুলোতে রয়েছে ইন্টারনেট ও উন্নত প্রযুক্তি। থ্রিজির পাশাপাশি কিছু ক্যাম্পে ব্রডব্যান্ড ও ডিশ সংযোগও দেওয়া হয়েছে। একাধিক অনলাইন টিভিতে সার্বক্ষণিক রোহিঙ্গাদের খবরও সম্প্রচার করা হচ্ছে। রোহিঙ্গাদের রয়েছে ফেসবুক গ্রুপ ও পেজ। এসব গ্রুপ ও পেজে সার্বক্ষণিক ছবি, ভিডিও এবং লেখা আপলোড করা হচ্ছে। ফলে যে কোনো ঘটনাই মুহূর্তের মধ্যে সব রোহিঙ্গার কানে পৌঁছে যায়।

সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে ছড়ানো মিথ্যা ভিডিও বার্তা আর সংবাদে রোহিঙ্গারা দ্রুত প্রভাবিত হচ্ছে বলে মনে করেন বিশেষজ্ঞরা। প্রশাসনেরও একই মত। এ ধরনের ঘটনায় যে কোনো সময় বড় ধরনের সহিংসতার আশঙ্কা করা হচ্ছে। উখিয়া ও টেকনাফে নিবন্ধিত ৩৪টি ক্যাম্পের ১১ লাখেরও বেশি রোহিঙ্গার অর্ধেকের হাতেই রয়েছে মোবাইল ফোন। স্থানীয়দের জাতীয় পরিচয়পত্র দিয়ে সিম নিবন্ধন করে এক শ্রেণির ব্যবসায়ী তা তুলে .দিয়েছে তাদের হাতে। এসব সিম ব্যবহার করে অপরাধমূলক নানা কাজের অভিযোগ উঠেছে কিছু রোহিঙ্গার বিরুদ্ধে। শুধু মোবাইল  সিম নয়, ক্যাম্পগুলোতে থ্রিজি  নেটওয়ার্কে ইন্টারনেট ও স্থানীয়ভাবে ব্রডব্র্যান্ড লাইনও ব্যবহার করছে রোহিঙ্গারা।

কয়েকটি মোবাইল অপারেটর রোহিঙ্গা ক্যাম্পে মোবাইল টাওয়ারও নির্মাণ করেছে। গত জুনে কক্সবাজার জেলা আইন-শৃঙ্খলা কমিটির সভায় এ নিয়ে উদ্বেগ প্রকাশ করে বলা হয়, পাঁচ লাখের বেশি মোবাইল সিম ব্যবহার করছে রোহিঙ্গারা।

টেকনাফের শালবাগান, নয়াপাড়া ও লেদা এবং উখিয়ার কুতুপালং ক্যাম্প ঘুরে দেখা গেছে, প্রত্যেক রোহিঙ্গার হাতেই মোবাইল ফোন। একাধিক মোবাইল সেটও দেখা গেছে কারও কারও হাতে। গত ২৫ আগস্ট কুতুুপালংয়ে রোহিঙ্গাদের বিশাল সমাবেশের ভিডিও হাজার হাজার মোবাইলে ধারণ করতে দেখা গেছে। প্রশাসনের সামনেই এ কাজ চলছে।

খলিল উল্যাহ নামে এক রোহিঙ্গা বলেন, কোনো কাগজ ছাড়াই স্থানীয় বাজার থেকে সিম কিনেছেন তারা। রোহিঙ্গা নেতা, ক্যাম্প চেয়ারম্যান ও মেম্বারদের মোবাইল নম্বর ক্যাম্পের কর্মকর্তা এবং আইন-শৃঙ্খলা বাহিনীর কাছেও আছে। তারা দরকার হলে ফোনে রোহিঙ্গাদের সঙ্গে কথা বলেন। তিনি বলেন, ‘মোবাইল আমাদের জন্য খুব দরকারি। ক্যাম্পে কোনো সমস্যা হলে আমরা তাৎক্ষণিক এনজিওকর্মী ও প্রশাসনকে জানাতে পারি। মোবাইল না থাকলে তো আমরা বিচ্ছিন্ন হয়ে যাব।’

টেকনাফের মোবাইল ফোন ব্যবসায়ী মোহাম্মদ আলী জোহার বলেন, ‘সিমগুলোর বেশিরভাগই চট্টগ্রাম থেকে আসা খুচরা ব্যবসায়ীরা বিক্রি করছে। তাছাড়া স্থানীয় কিছু ব্যবসায়ীও অতি মুনাফার আশায় অন্যের নামে রেজিস্ট্রেশন করে সিম বিক্রি করছে।’

রোহিঙ্গা জনগোষ্ঠী যেন মোবাইল নেটওয়ার্ক সুবিধা গ্রহণ করতে না পারে সেজন্য অপারেটরগুলোকে ব্যবস্থা নিতে ২০১৭ সালে ১০ অক্টোবর নির্দেশ দেয় বাংলাদেশ টেলিযোগাযোগ নিয়ন্ত্রণ কমিশন (বিটিআরসি)। মোবাইল ফোন অপারেটরগুলোকে এ বিষয়ে চিঠিও পাঠিয়েছে বিটিআরসি। এ ছাড়া সীমান্তবর্তী এলাকা এবং রোহিঙ্গা ক্যাম্পে সিম বিক্রি ও ব্যবহার বন্ধের জন্য বিভিন্ন সময় বিশেষ নির্দেশনা দেয় সরকার।

মিয়ানমার সীমান্তের টেকনাফ, উখিয়াসহ বিভিন্ন এলাকায় অবস্থিত বাংলাদেশের মোবাইল ফোন কোম্পানির টাওয়ারগুলোর আওতা মিয়ানমারের ভেতরে ১০ কিলোমিটার পর্যন্ত বিস্তৃত বলে স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ে রিপোর্ট দিয়েছে একটি গোয়েন্দা সংস্থা। ওই রিপোর্টে বলা হয়, এই নেটওয়ার্কের কারণে বাংলাদেশি বিভিন্ন মোবাইল ফোন অপারেটরের সিমকার্ড ব্যবহার হচ্ছে মিয়ানমারের ভেতরেও। তাই সব অপারেটরের টাওয়ার সীমান্ত এলাকা থেকে সরিয়ে নিতে সুপারিশ করে গোয়েন্দা সংস্থাটি। পাশাপাশি জরুরি ভিত্তিতে নেটওয়ার্কের ফ্রিকোয়েন্সি কমিয়ে দেওয়ার জন্যও অনুরোধ করা হয়। এ ব্যাপারে পরে টেলিযোগাযোগ মন্ত্রণালয়ে চিঠি পাঠায় স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়। কিন্তু এখনও এ বিষয়ে কোনো উদ্যোগ নেওয়া হয়নি।

বাংলাদেশ মুঠোফোন গ্রাহক অ্যাসোসিয়েশনের সভাপতি মহিউদ্দিন আহমেদ বলেন, অবৈধভাবে টেলিযোগাযোগ নেটওয়ার্ক ব্যবহার করে সংগঠিত হচ্ছে রোহিঙ্গারা। শনিবার গণমাধ্যমে পাঠানো এক বিবৃতিতে তিনি বলেন, আশ্রয় গ্রহণের সময় টেকনাফের এক শ্রেণির অসাধু ব্যক্তি ৫০০ থেকে এক হাজার টাকার বিনিময়ে রোহিঙ্গাদের কাছে সিম বিক্রি করে। এ বিষয়ে নিয়ন্ত্রক সংস্থা বা সরকার কর্ণপাত করেনি। এতে দেশের জাতীয় নিরাপত্তা হুমকির মুখে পড়েছে বলে মনে করেন তিনি।

স্থানীয়দের অধিকার আদায়ে আন্দোলনরত সংগঠন ‘আমরা কক্সবাজারবাসী’র সমন্বয়ক কলিম উল্লাহ কলিম সমকালকে বলেন, আইন অনুযায়ী শরণার্থীরা অবৈধভাবে মোবাইল ফোন ব্যবহার করতে পারে না। তবে রোহিঙ্গারা তো ব্যবহার করছে। তারা সিমগুলো কীভাবে নিচ্ছে, কারা দিচ্ছে এবং এর সঙ্গে কারা জড়িত তা খুঁজে বের করা খুবই জরুরি হয়ে পড়েছে। সরকারের এ বিষয়ে কঠোর হওয়া উচিত।

তিনি বলেন, রোহিঙ্গাদের মোবাইল ফোন ব্যবহার করার কারণে আমাদের স্বাধীনতা, সার্বভৌমত্ব এবং নিরাপত্তা যথেষ্ট হুমকির মুখে পড়েছে। সরকার দ্রুত এ ব্যাপারে পদক্ষেপ গ্রহণ না করলে ভবিষ্যতে রোহিঙ্গারা আরও বিপজ্জনক হয়ে উঠতে পারে। কারণ ইন্টারনেটের গ্রুপ চ্যাটিংয়ের মাধ্যমে দ্রুতই তারা লাখ লাখ লোকের সমাবেশ ঘটাতে পারে। অনেক রোহিঙ্গা মিয়ানমারের সঙ্গে সরাসরি যোগাযোগ রক্ষা করছে। এতে এখানকার রাষ্ট্রীয় গোপন তথ্য ফাঁসের আশঙ্কা রয়েছে।

অভিযোগ রয়েছে, মোবাইল নেটওয়ার্ক ব্যবহার করে বিভ্রান্তি ছড়িয়ে রোহিঙ্গা প্রত্যাবাসন সফল হতে দিচ্ছে না রোহিঙ্গাদের একটি শক্তিশালী চক্র। প্রশাসন বলছে, রোহিঙ্গা শিবিরে অবৈধ মোবাইল ফোন বন্ধে কয়েক দফা ভ্রাম্যমাণ আদালতের অভিযান পরিচালনা করা হয়েছে এবং তা এখনও চলমান। এরপরও এসব পুরোপুরি বন্ধ না হওয়ায় নেওয়া হচ্ছে আলাদা উদ্যোগ।

কক্সবাজারের অতিরিক্ত জেলা প্রশাসক (রাজস্ব) মোহাম্মদ আশরাফুল আফসার বলেন, অনেকে বাংলাদেশি নাগরিকদের নাম ব্যবহার করে অবৈধভাবে মোবাইল সিম ব্যবহার করছে। বিটিআরসির মাধ্যমে এসব অবৈধ সিম বন্ধ করার জন্য আমরা এরই মধ্যে উদ্যোগ নিয়েছি।

এ ব্যাপারে বিটিআরসির চেয়ারম্যান জহুরুল হক বলেন, ‘আমরা বিষয়টি অবগত আছি। রোববার মোবাইল ফোন অপারেটরগুলোকে এ বিষয়ে চিঠি পাঠানো হয়েছে। সাত দিনের মধ্যে এ বিষয়ে ব্যবস্থা নিতে বলা হয়েছে।’ মিয়ানমারের ভেতরে বাংলাদেশের মোবাইলের নেটওয়ার্কের বিষয়ে বিটিআরসি চেয়ারম্যান বলেন, ‘এটা টেকনিক্যাল বিষয়। এ বিষয়ে আমাদের কিছুই করার নেই।’

সক্রিয় একাধিক অনলাইন টিভি : এদিকে রোহিঙ্গা ক্যাম্পগুলোতে রোহিঙ্গা ভাষায় সম্প্রচার হচ্ছে একাধিক অনলাইন টেলিভিশন চ্যানেল। এসব টিভিতে জানানো হয় রোহিঙ্গারা রাখাইনে ফিরে গেলেই তাদের গ্রেফতার করবে মিয়ানমার সরকার।

গত ২৫ আগস্ট রোহিঙ্গা ভাষার সব অনলাইন টিভির প্রধান খবর ছিল উখিয়ায় রোহিঙ্গা সমাবেশ। খবরে বলা হয়, রোহিঙ্গাদের অধিকার আদায় এখন সময়ের ব্যাপার মাত্র। সৌদি আরব, পাকিস্তান, মালয়েশিয়াসহ বিভিন্ন দেশ থেকে এসব টিভি পরিচালনা করে প্রবাসী রোহিঙ্গারা। আর বাংলাদেশ থেকে কিছু রোহিঙ্গা ভিডিও ফুটেজ ও ছবি মেইলে পাঠিয়ে দেয়। ভিডিওগুলো সম্পাদনা করে কণ্ঠ দিয়ে খবর প্রচার করা হয় অনলাইন টিভিগুলোতে। প্রতিটি খবরেই মূলত রোহিঙ্গাদের ঐক্যবদ্ধ থাকা এবং কোনো অবস্থাতেই শর্ত না মানলে মিয়ানমার না যাওয়ার পরামর্শ দেওয়া হয়। ক্যাম্পগুলোতে আলাদা আলাদা জটলা বেঁধে রোহিঙ্গাদের ‘আরাকান টাইমস’, ‘রোহিঙ্গা নিউজ’, ‘আরাকান টুডে’, ‘রোহিঙ্গা টিভি’ নামের এসব অনলাইন টিভির খবর দেখতে দেখা যায়। এরকম অন্তত ১০টি অনলাইন টিভির সন্ধান মিলেছে। এসব টিভিতে প্রতিদিন সংবাদ সম্প্রচার করা হয়। ওয়েবসাইট ও ফেসবুকের পাশাপাশি এসব টিভি ইউটিউব চ্যানেলেও সম্প্রচার হচ্ছে। এসব টিভির ফেসবুক পেজে লাখ লাখ লাইক আছে আবার ইউটিউবেও লাখের ওপরে সাবস্ট্ক্রাইব দেখা গেছে।

রোহিঙ্গাদের নিয়ে খবরের ফুটেজগুলো আবার বিভিন্ন ফেসবুক পেজ ও গ্রুপে শেয়ার দেওয়া হয়। এসব ফেসবুক গ্রুপ ও পেজ নিয়ন্ত্রণ করে প্রবাসী রোহিঙ্গা ও ক্যাম্পে থাকা কিছু রোহিঙ্গা তরুণ। তারা প্রতিনিয়ত ফেসবুকে নানা রকম তথ্য দেয়। সাম্প্রতিক সময়ে রোহিঙ্গা প্রত্যাবাসনবিরোধী নানা প্রচারণাও চালানো হয় ফেসবুকে। গত ২৫ আগস্ট সমাবেশে কয়েক লাখ লোকের উপস্থিতির পেছনে অনলাইন টিভি ও ফেসবুক গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রেখেছে বলে মনে করে রোহিঙ্গারা।

রোহিঙ্গা সোসাইটি ফর পিস অ্যান্ড হিউম্যান রাইটস সংগঠনের সভাপতি মুহিব উল্লাহ বলেন, রোহিঙ্গাদের অধিকাংশই মোবাইল ফোন ব্যবহার করে। কিন্তু এটা যে অবৈধ তা তারা জানে না। কেউ এখন পর্যন্ত তাদের এ বিষয়ে কিছু বলেনি। প্রশাসনের লোকেরাই তো তাদের সঙ্গে মোবাইলে নিয়মিত ফোন করে খবরাখবর নেন।

তিনি বলেন, ‘বাংলাদেশ ও রাখাইনের সব খবর আমরা মোবাইল ফোনে সারাবিশ্বের রোহিঙ্গাদের সঙ্গে আদানপ্রদান করি। মোবাইল ফোন আমাদের জন্য খুব জরুরি। আমাদের কিছু আত্মীয়-স্বজন এখনও রাখাইনে আছে। তাদের সঙ্গে আমাদের সব সময় যোগাযোগ আছে। কখন কাকে হত্যা করা হয় কিংবা গ্রেফতার করা হয় সব খবর মিনিটের মধ্যে আমাদের কাছে চলে আসে। মিয়ানমার সরকার কী করছে সে খবরও আছে আমাদের কাছে। আর এসব যোগাযাগ আমরা করি মোবাইলের মাধ্যমে।’

অনলাইন টিভি ও ফেসবুক গ্রুপের বিষয়ে তিনি বলেন, ক্যাম্পগুলোতে খবর দেখার কোনো সুযোগ নেই। কিছু ক্যাম্পে ডিশ থাকলেও বাংলা ভাষা বুঝতে রোহিঙ্গাদের সমস্যা হয়। ফলে প্রবাসী বন্ধুরা রোহিঙ্গা ভাষায় কিছু অনলাইন টিভি চালু করেছে। সেখানে তারা রোহিঙ্গাদের খবরাখবর দেন।-সমকাল

Print Friendly, PDF & Email

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here