আঞ্চলিক স্থিতিশীলতা ও উন্নয়নের স্বার্থে রোহিঙ্গাদের স্থায়ী প্রত্যাবাসনে বিশ্ব সম্প্রদায়কে যথাযথ পদক্ষেপ নেওয়ার আহ্বান জানিয়েছেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। তিনি বলেছেন, আঞ্চলিক নিরাপত্তার জন্য রোহিঙ্গা সংকটের আশু সমাধান হওয়া উচিত। আঞ্চলিক সমৃদ্ধির জন্য শান্তি ও সম্প্রীতি জরুরি।

সোমবার (১১ নভেম্বর) সকালে রাজধানীর একটি হোটেলে তিন দিনব্যাপী ‘ঢাকা গ্লোবাল ডায়ালগ-২০১৯’র উদ্বোধনকালে শেখ হাসিনা এ কথা বলেন। বাংলাদেশ ইনস্টিটিউট অব ইন্টারন্যাশনাল অ্যান্ড স্ট্র্যাটেজিক স্টাডিজ (বিস) ও ভারতের অবজারভার রিসার্চ ফাউন্ডেশন যৌথভাবে এ সংলাপ অনুষ্ঠানের আয়োজন করেছে।

বৈশ্বিক স্বার্থ-সংশ্লিষ্ট বিভিন্ন বিষয়ে আলোচনা, বিতর্ক ও ধারণা বিনিময়ের এই আয়োজনে ৫০টি দেশের দেড় শতাধিক প্রতিনিধি অংশ অংশ নিচ্ছেন।

প্রধানমন্ত্রী বলেন, আঞ্চলিক নিরাপত্তার বিষয়ে আমি বলতে চাই, দমন-পীড়নের মুখে ১১ লাখেরও বেশি রোহিঙ্গা মিয়ানমার থেকে বাংলাদেশে পালিয়ে এসেছে, এই রোহিঙ্গারা কেবল বাংলাদেশের জন্য নয়, গোটা অঞ্চলের নিরাপত্তার জন্যও হুমকি। সেজন্য আমি এই হুমকির তাৎপর্য অনুধাবনের মাধ্যমে যথাযথ পদক্ষেপ নেওয়ার জন্য বিশ্ব সম্প্রদায়ের প্রতি আহ্বান জানাই।

এত বিপুল সংখ্যক রোহিঙ্গা আশ্রয় নেওয়ার পরও সংঘাতে না জড়িয়ে আঞ্চলিক নিরাপত্তা ও স্থিতিশীলতার স্বার্থে আলোচনার মাধ্যমে সংকট সমাধানে বাংলাদেশের প্রচেষ্টার কথা তুলে ধরেন প্রধানমন্ত্রী।

তিনি বলেন, এটা নিয়ে আমরা তাদের (মিয়ানমার) সঙ্গে ঝগড়া করছি না। বরং আলাপ-আলোচনার মাধ্যমে সমাধানের চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছি। আমরা মিয়ানমারকে সহযোগিতা করার চেষ্টা করে যাচ্ছি। এই সমস্যার আশু সমাধান হওয়া প্রয়োজন।

বাংলাদেশের পররাষ্ট্রনীতির কথা উল্লেখ করে প্রধানমন্ত্রী বলেন, ‘সকলের সঙ্গে বন্ধুত্ব, কারও সঙ্গে বৈরিতা নয়’- বঙ্গবন্ধু নির্দেশিত এই মূলনীতিই বাংলাদেশের পররাষ্ট্রনীতি। জাতির পিতার প্রদর্শিত এই পথে আমরা আন্তর্জাতিক ও আন্তঃরাষ্ট্রীয় সম্পর্ক স্থাপনে অঙ্গীকারাবদ্ধ।

তিনি আরও বলেন, প্রতিবেশী থাকলে সমস্যা থাকবে। বন্ধুত্বপূর্ণ সম্পর্কের মাধ্যমে সমস্যা সমাধান সম্ভব। আমরা ভারতের সঙ্গে ছিটমহল বিনিময় করেছি। এটা বিশ্বের একটি উদাহরণ।

শান্তি ও নিরাপত্তা ছাড়া কোনো দেশেরই উন্নয়ন ও সমৃদ্ধি নিশ্চিত করা সম্ভব নয় উল্লেখ করে প্রধানমন্ত্রী এই সংকট নিরসনে এশিয়া, প্রশান্ত মহাসাগরীয় ও ভারত মহাসাগরীয় অঞ্চলের সব দেশকে ঐক্যবদ্ধ প্রচেষ্টা চালানোর আহ্বান জানান।

প্রতিযোগিতার পরিবর্তে পরস্পরের প্রতি সহযোগিতার ওপর গুরুত্বারোপ করে শেখ হাসিনা বলেন, সমুদ্রসীমা ও সামুদ্রিক অর্থনীতির ক্ষেত্রেও বাংলাদেশ মনে করে, পরস্পরের সঙ্গে তীব্র প্রতিযোগিতা বা ‘জিরো-সাম গেম’ বঙ্গোপসাগর বা ভারত মহাসাগরের ‘নীল অর্থনীতি’ বিকাশের জন্য সহায়ক নয়। বরং তা এ অঞ্চলের নিরাপত্তা ও স্থিতিশীলতার ক্ষেত্রে বড় প্রতিবন্ধক।

বঙ্গোপসাগর ও ভারত মহাসাগর এলাকার নিরাপত্তায় এর সংলগ্ন সব দেশকে একযোগে কাজ করার আহ্বান জানিয়ে প্রধানমন্ত্রী বলেন, বঙ্গোপসাগর ও ভারত মহাসাগর এলাকায় জলদস্যুতা, সশস্ত্র ডাকাতি, উপকূলবর্তী ও সামুদ্রিক এলাকায় সন্ত্রাসী আক্রমণ, মানবপাচার, অস্ত্র ও মাদক পাচার- এর মত অপ্রথাগত নিরাপত্তা ঝুঁকি বিদ্যমান। এসব অপ্রথাগত নিরাপত্তা ঝুঁকি নিরসনে সবাইকে একযোগে কাজ করতে হবে।

এ অঞ্চলে সমুদ্রের গুরুত্ব তুলে ধরে শেখ হাসিনা বলেন, ভৌগোলিকভাবে বাংলাদেশ বঙ্গোপসাগর তথা ভারত মহাসাগরের তীরবর্তী দেশ। নানা কারণে এই মহাসাগর অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। ভারত মহাসাগর দিয়ে অনেকগুলো গুরুত্বপূর্ণ সমুদ্রপথ অতিক্রম করেছে, যা এশিয়ার বৃহৎ অর্থনীতিসমূহের জ্বালানি ও রসদের যোগান দেয়। বিশ্বের কনটেইনার শিপমেন্টের অর্ধেক এবং সমুদ্রবাহিত তেল বাণিজ্যের ৮০ শতাংশ অতিক্রান্ত হয় ভারত মহাসাগর দিয়ে। বিশ্বের প্রমাণিত তেল মজুদের ১৬ দশমিক ৮ শতাংশ ও প্রাকৃতিক গ্যাস মজুদের ২৭ দশমিক ৯ শতাংশ এই মহাসাগর ও তৎসংলগ্ন সাগরসমূহে অবস্থিত।

তিনি বলেন, সারাবিশ্বের ২৮ শতাংশ মৎস্য আহরিত হয় এই অঞ্চলে। এই বিপুল সম্পদের উৎস এবং কৌশলগত কারণে ভারত মহাসাগর বরাবরই অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ হিসেবে বিবেচিত হয়ে আসছে। আর্থ-সামাজিক উন্নয়ন ও সমৃদ্ধি বিবেচনায় বর্তমান শতক ‘এশিয়ার শতক’ হিসেবে বিবেচনা করা হচ্ছে। ফলে এই অঞ্চলের সমৃদ্ধির স্বার্থে শান্তি-সৌহার্দ্য বজায় রাখা আবশ্যক।

দারিদ্র্যকে এ অঞ্চলের সবার অভিন্ন শত্রু হিসেবে উল্লেখ করে প্রধানমন্ত্রী বলেন, দারিদ্র্য আমাদের প্রধান শত্রু। কাজেই আমাদের সব কাজের প্রধান লক্ষ্য হওয়া উচিত মানুষের দারিদ্র্য দূর করে তাদের সুন্দর এবং স্বাচ্ছন্দ্যময় জীবন নিশ্চিত করা।

বাংলাদেশ ভারত মহাসাগর ও বঙ্গোপসাগর এলাকাকে গুরুত্বের সঙ্গে বিবেচনা করে বলেও জানান শেখ হাসিনা।

তিনি বলেন, শুধু বাংলাদেশ নয়, ভারত মহাসাগরকে ঘিরে মোট ৪০টি উন্নয়নশীল দেশের অবস্থান। সেখানে বাস করে বিশ্বের জনসংখ্যার ৩৫ শতাংশ। বঙ্গোপসাগরকে ঘিরে আছে ছয়টি দেশ। আরও কয়েকটি দেশ যেমন- নেপাল, ভুটান, মালদ্বীপ, মালয়েশিয়া ও সিঙ্গাপুর যদিও বঙ্গোপসাগরের তীরে অবস্থিত নয়, তবুও তাদের অর্থনীতিতে বঙ্গোপসাগরের গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা আছে।

তিনি বলেন, এই সাগর ও মহাসাগরের সম্পদ, পরিবেশ, বাস্তুসংস্থান সরাসরি প্রভাবিত করে দেশগুলোর অর্থনীতি ও নিরাপত্তাকে। তাই, এই দেশগুলোর অর্থনীতি ও নিরাপত্তার জন্য বঙ্গোপসাগর ও ভারত মহাসাগর এলাকায় শান্তি ও স্থিতিশীলতা অত্যাবশ্যক।

প্রধানমন্ত্রী বলেন, আমি আরও মনে করি, সমুদ্র সম্পদের টেকসই ব্যবহার ও এর মাধ্যমে ‘নীল অর্থনীতির’ টেকসই উন্নয়নের জন্য সমুদ্র তীরবর্তী দেশগুলোর মধ্যে সহায়তাপূর্ণ, সৌহার্দ্যপূর্ণ, মর্যাদাপূর্ণ ও সমতাপূর্ণ সম্পর্ক আবশ্যক।

মাছসহ সামুদ্রিক সম্পদের মাত্রাতিরিক্ত আহরণ ও নানাবিধ দূষণ এই এলাকার সামুদ্রিক পরিবেশকে বিপন্ন করে তুলেছে উল্লেখ করে শেখ হাসিনা বলেন,  শুধু বঙ্গোপসাগর ও ভারত মহাসাগর নয়, বিশ্বের সব সাগর-মহাসাগরই আজ এই বিবিধি সমস্যায় আক্রান্ত। প্রতিবছর বিশ্বের সাগর-মহাসাগরগুলোতে যোগ হচ্ছে ৮ মিলিয়ন টন প্লাস্টিক বর্জ্য। দূষণ ও সামুদ্রিক সম্পদের মাত্রাতিরিক্ত আহরণ সামুদ্রিক বাস্তুসংস্থানকে বিনষ্ট করছে। পৃথিবীর সামগ্রিক পরিবেশকে ক্ষতিগ্রস্ত করছে। হুমকির মুখে ঠেলে দিচ্ছে মানুষের জীবন-জীবিকা। কোনো একক দেশের পক্ষে এই সমস্যার সমাধান করা সম্ভব নয়।

এসব সমস্যা সমাধানে ভারত ও প্রশান্ত মহাসাগর এলাকায় দ্বিপক্ষীয় ও বহুপক্ষীয় সহযোগিতা ও অংশীদারিত্ব জোরদার করতে সব রাষ্ট্রের প্রতি আহ্বান জানিয়ে প্রধানমন্ত্রী বলেন, বাংলাদেশ মনে করে, এই সহযোগিতা হতে হবে সবার অংশগ্রহণমূলক এবং সবার উন্নয়ন ও নিরাপত্তার লক্ষ্যে।

ভৌগোলিক অবস্থানের কারণে বাংলাদেশ দক্ষিণ এশিয়া এবং দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ার মধ্যে সেতুবন্ধ হিসেবে কাজ করছে বলেও উল্লেখ করেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা।

অনুষ্ঠানে পররাষ্ট্রমন্ত্রী ড. এ কে আবদুল মোমেন, ভারতের অবজারভার রিসার্চ ফাউন্ডেশনের প্রেসিডেন্ট ড. সমির শরণ, বিসের মহাপরিচালক মেজর জেনারেল এ কে এম আবদুর রহমান বক্তব্য রাখেন।

Print Friendly, PDF & Email

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here