সোনালীনিউজ

জনপ্রশাসনে পদোন্নতি ও লোভনীয় পদগুলোতে পদায়নের ক্ষেত্রে যোগ্য কর্মকর্তাদের বঞ্চিত করার অভিযোগ দীর্ঘ দিনের। মেধা ও যোগ্যতর ভিত্তিতে পদোন্নতি পদায়ন হওয়ার কথা থাকলেও তা হচ্ছে না। বিগত কয়েক বছর ধরে অব্যাহত এ ঘটনায় তদবিরেই ভরসা রাখছেন সরকারি কর্মকর্তারা। তারা নিজেদের পদোন্নতি এবং পদায়নে প্রভাবশালী সংসদ সদস্য ও মন্ত্রীদের কাছে ধরনা দিচ্ছেন। সংসদ সদস্য ও মন্ত্রীরাও বিধি লঙ্ঘন করে তাদের পক্ষে জনপ্রশাসন মন্ত্রী ও সচিবের কাছে আধাসরকারি পত্র দিচ্ছেন। তদবিরের মাধ্যমে পদোন্নতি ও পদায়ন পাওয়ায়  জনসেবায় প্রাধান্য না দিয়ে তদবিরকারীদের খুশি করতেই ব্যস্ত থাকছেন। কর্মচারীদের পক্ষে তদবির আইনত নিষিদ্ধ হলেও মানছেন না তদবিরকারীরা।

ভূমি রেকর্ড ও জরিপ অধিদপ্তরের মহাপরিচালক হিসেবে কর্মরত রয়েছেন বিসিএস দশম ব্যাচের কর্মকর্তা মোয়াজ্জেম হোসেন। আগামি ২৪ নভেম্বর অবসর উত্তর ছুটিতে (পিআরএল) যাবেন। এই কর্মকর্তার পিআরএল বাতিল করে আগামি ১ বছরের জন্য চুক্তিভিত্তিক নিয়োগ দিতে জনপ্রশাসন প্রতিমন্ত্রীকে আধাসরকারি পত্র দিয়েছেন ভূমিমন্ত্রী সাইফুজ্জামান চৌধুরী এমপি।

আধাসরকারি পত্রে তিনি লিখেছেন, ভূমি রেকর্ড ও জরিপ অধিদপ্তর কর্তৃক এস্টাবলিশমেন্ট অফ ডিজিটাল ল্যান্ড ম্যানেজম্যান্ট সিস্টেম ও ডিজিটাল পদ্ধতিতে ভূমি জরিপ করার জন্য ভূমি রেকর্ড ও জরিপ অধিদপ্তরের ডিজিটাল জরিপ পরিচালনার সক্ষমতা বৃদ্ধিকরণ প্রকল্প বাস্তবায়িত হচ্ছে। এই দুটি প্রকল্পের মাধ্যমে প্রথমবারের মতো বাংলাদেশের পটুয়াখালী ও বরগুনা জেলায় ডিজিটাল জরিপের মাধ্যমে মৌজা ম্যাপ ও খতিয়ান প্রস্তুত হবে। এ কাজের সাথে ভূমি রেকর্ড ও জরিপ অধিদপ্তরের মহাপরিচালক সরাসরি সম্পৃক্ত। জরিপের কাজে বর্তমান মহাপচিালকের বাস্তব জ্ঞান ও অভিজ্ঞতা দেশের জন্য গুরুত্বপূর্ণ এ প্রকল্প বাস্তবায়নে সহায়তা করবে। এ কার্যক্রম প্রযুক্তি নির্ভর হওয়ায় আগামি ২৪ নভেম্বর ভূমি রেকর্ড ও জরিপ অধিদপ্তরের মহাপরিচালক পিআরএল এ গেলে উল্লিখিত কার্যক্রম বাস্তবায়নে ব্যাঘাত সৃষ্টি হতে পারে।

এজন্য তার অবসর উত্তর ছুটি ও তদসংশ্লিষ্ট সুবিধাদি স্থগিতের শর্তে আগামি ২৫  নভেম্বর অথবা যোগদানের তারিখ থেকে পরবর্তী ১ বছরের জন্য ভূমি রেকর্ড ও জরিপ অধিদপ্তরের মহাপরিচালক হিসেবে চুক্তিভিত্তিক নিয়োগ প্রদানের জন্য প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা গ্রহণের জন্য আপনাকে আন্তরিকভাবে অনুরোধ জানাচ্ছি।

কৃষি জমি সুরক্ষাসহ ভুমির সর্বোত্তম ব্যবহার নিশ্চিত করার লক্ষ্যে মৌজা ও প্লট ভিত্কি ডিজিটাল ভুমি জোনিং প্রকল্প হাতে নেয় সরকার। এই প্রকল্পের পিডি হিসেবে কর্মরত আছেন অবসরপ্রাপ্ত অতিরিক্ত সচিব মো: কফিল উদ্দীন। আগামি ১৫ নভেম্বর তার মেয়াদ শেষ হবে। তাকে পুনরায় আরও ১ বছরের জন্য চুক্তিভিত্তিক নিয়োগ দিতে জনপ্রশাসন প্রতিমন্ত্রী ফরহাদ হোসেনকে আধাসরকারি পত্র দিয়েছেন ভুমিমন্ত্রী সাইফুজ্জামান চৌধুরী। অপর আরেকটি পত্রে ভুমি মন্ত্রণালয়ের অতিরিক্ত সচিব আব্বাস উদ্দিন এর বদলি আদেশ বাতিলে জনপ্রশাসন প্রতিমন্ত্রীর হস্তক্ষেপ কামনা করেছেন ভুমিমন্ত্রী।

গত ১২ অক্টোবর ঢাকা উত্তর সিটি করপোরেশনের সচিব মোহাম্মদ মাসুদ আল ছিদ্দিককে (যুগ্মসচিব) চট্রগ্রামের অতিরিক্ত বিভাগীয় কমিশনার হিসেবে বদলী করে জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয়। তার এই বদলী বাতিল করে সচিব পদে বহাল রাখতে জনপ্রশাসন প্রতিমন্ত্রীর হস্তক্ষেপ কামনা করে আধাসরকারি পত্র দিয়েছেন ঢাকা উত্তর সিটি করপোরেশনের মেয়র আতিকুল ইসলাম।

পত্রে তিনি লিখেছেন, সিটি করপোরেশনের অধিক্ষেত্রের বিশাল সেবামূলক কার্যক্রম পরিচালনার জন্য বর্তমানে বেশকিছু শুন্য পদে সরাসরি নিয়োগ, পদোন্নতি ও গুরুত্বপূর্ণ প্রশাসনিক কার্যক্রম চলমান আছে। নির্দেশনা অনুযায়ী নগরীর অবকাঠামো উন্নয়ন ও ডেঙ্গু রোগ প্রতিরোধে মশক নিয়ন্ত্রণ কার্যক্রমে তিনি গুরুত্বপূর্ণ ভুমিকা পালন করছেন। যোগদানের পর হতে আন্তরিকতা, সততা ও নিষ্ঠার সাথে দায়িত্ব পালন করে প্রশাসনিক ক্ষেত্রে ইতিবাচক পরিবর্তন আনতে সক্ষম হয়েছেন।

এখানে বিশেষভাবে উল্লেখ্য, মোহাম্মদ মাসুদ আলম ছিদ্দিক অত্র কর্পোরেশনে তার মোট কর্মকাল ১ বছর ৩ মাস। তার বদলির আদেশ বাতিল না করা হলে ঢাকা উত্তর সিটি করপোরেশনে চলমান নিয়োগ ও পদোন্নতি কার্যক্রম মারাত্মকভাবে ব্যহতসহ প্রশাসনিক কাজে স্থবিরতা দেখে দিবে।

গত ১২ অক্টোবর জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয়ের এক প্রজ্ঞাপনে নাটোর জেলা পরিষদের নির্বাহী কর্মকর্তা সাইদুল ইসলামকে নীলফামারী জেলা পরিষদে এবং নীলফামারী জেলা পরিষদের নির্বাহী কর্মকর্তা অতুল মন্ডলকে নাটোর জেলা পরিষদে বদলির আদেশ দেয়। এই বদলি আদেশ বাতিল করতে জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয়ের সিনিয়র সচিবকে আধাসরকারি পত্র দিয়েছেন নাটোর-১ আসনের সংসদ সদস্য শহিদুল ইসলাম বকুল।

পত্রে তিনি লিখেছেন, নাটোর জেলা পরিষদের ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান এ্যাড. মো: সাজেদুর রহমান খান আমাকে জানিয়েছেন যে, নাটোর জেলা পরিষদের নির্বাহী কর্মকর্তা সাইদুল ইসলাম একজন বিনয়ী, নম্র, ভদ্র, সৎ, দক্ষ ও কর্মঠ কর্মকর্তা। তার সাথে জেলা পরিষদ চেয়ারম্যান কাজ করতে স্বাচ্ছন্দ বোধ করেন। এমতাবস্থায় সাইদুল ইসলাম এর বদলির আদেশ বাতিল করার জন্য বিনীত অনুরোধ করছি।

মহিলা ও শিশু বিষয়ক মন্ত্রণালয়ের তথ্য আপা প্রকল্পে সহকারী পরিচালক (সিনিয়র সহকারী সচিব) হিসেবে কর্মরত রয়েছেন বেগম হাছিনা বেগম। তাকে উপসচিব (নন ক্যাডার) পদে পদোন্নতি দেওয়ার জন্য আধাসরকারি পত্র দিয়েছেন মৎস ও প্রাণিসম্পদ মন্ত্রী শ ম রেজাউল করিম এমপি।

জনপ্রশাসন প্রতিমন্ত্রী ফরহাদ হোসেনকে লেখা পত্রে তিনি লিখেছেন, বেগম হাছিনা বেগমকে আমি ব্যক্তিগতভাবে চিনি। তিনি তার সঠিক দায়িত্ব পালন করেন বলে আমি অবহিত। সিনিয়র সহকারি সচিব পদে তার চাকুরীর মেয়াদ চার বছর ছয় মাসের অধিক। জৈষ্ঠ্যতা, শিক্ষাগত যোগ্যতা, চাকুরীর অভিজ্ঞতাসহ সার্বিক দিক বিবেচনাপূর্বক তাকে উপসচিব (নন ক্যাডার) পদে পদোন্নতি প্রদান করলে তিনি স্বীয় মেধা, সততা ও দক্ষতা কাজে লাগিয়ে বর্তমান সরকারের নির্বাচনী ইশতেহার বাস্তবায়ন ও উন্নযন কর্মকান্ডে উল্লেখযোগ্য অবদান রাখতে সক্ষম হবেন মর্মে আমি দৃড়ভাবে বিশ্বাস করি। এজন্য তার পদোন্নতি প্রদানের বিষয়টি বিবেচনার জন্য আপনার ব্যক্তিগত সুদৃষ্টি ও আন্তরিক সহযোগীতা কামনা করছি।

দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা ও ত্রাণ মন্ত্রণালয়ে অতিরিক্ত সচিব হিসেবে কর্মরত আছেন রওশন আরা বেগম। তাকে সচিব পদে পদোন্নতি দিতে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নিতে জনপ্রশাসন প্রতিমন্ত্রীকে বিশেষভাবে অনুরোধ করেছেন নরসিংদী-৩ আসনের সংসদ সদস্য জহিরুল হক ভঞা মোহন।

চট্রগ্রাম সিটি করপোরেশনের এক্সিকিউটিভ ম্যাজিস্ট্রেট মারুফা বেগম নেলীর বিরুদ্ধে আনীত অভিযোগ হতে তাকে অব্যাহতি প্রদানের জন্য এবং তাকে এ কার্যালয়ে পদায়ন বহালের জন্য জনপ্রশাসন প্রতিমন্ত্রীকে বিশেষভাবে অনুরোধ করেন চটগ্রাম সিটি করপোরেশনের মেয়র রেজাউল করিম চৌধুরী।

১৯৭৯ সালের সরকারি কর্মচারী আচরণ বিধিমালা অনুযায়ী কোনো সরকারি কর্মচারী তার চাকরি-সংক্রান্ত কোনো বিষয়ে প্রভাব খাটাতে পারেন না। সরকারি কর্মচারী আচরণ বিধিমালা, ১৯৭৯-এর ৩০ ধারায় বলা হয়েছে, ‘কোনো সরকারি কর্মচারী তার চাকরি-সংক্রান্ত কোনো দাবির সমর্থনে প্রত্যক্ষ অথবা পরোক্ষভাবে সরকার বা কোনো সরকারি কর্মচারীর ওপর রাজনৈতিক বা অন্য কোনো বহিঃপ্রভাব খাটাইতে বা খাটাইবার চেষ্টা করিতে পারিবেন না।’

একই আইনে তদবির করার জন্য সংসদ সদস্যদের কাছে যাওয়ার ওপরও নিষেধাজ্ঞা দেয়া হয়েছে। আইনটির ২০ ধারায় বলা হয়েছে, ‘কোন সরকারি কর্মচারী কোনো ব্যাপারে তাহার পক্ষে হস্তক্ষেপ করার জন্য সংসদ সদস্য বা অন্য কোনো বেসরকারি ব্যক্তিকে প্রত্যক্ষ বা পরোক্ষভাবে অনুরোধ জানাইতে পারিবেন না।’

১৯৫৮ সালের ২৭ ফেব্রুয়ারি জারি করা এক স্মারকেও কোনো সরকারি কর্মচারী তার চাকরিসংক্রান্ত বিষয়ে হস্তক্ষেপ করার জন্য কোনো মন্ত্রী বা সংসদ সদস্যের কাছে তদবির করতে পারবেন না বলে স্পষ্ট নির্দেশনা রয়েছে।

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় লোক প্রশাসন বিভাগের প্রফেসর ড. মুসলেহ উদ্দীন আহমেদ বলেন, সরকারি কর্মচারীদের পক্ষে কোনো মন্ত্রী বা এমপি তদবির করতে পারেন না। সরকারি বিধিতে তদবির নিষিদ্ধ। যার তদবির করছেন তারা আইন লঙ্ঘন করছেন। যদি তারা এমনটি করতেই থাকেন তাহলে আইন থাকার প্রয়োজন কোথায়।

Print Friendly, PDF & Email

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here