তৌফিকুল ইসলাম বাবর : চট্টগ্রামে ৩০ ডিসেম্বরের নির্বাচনে চট্টগ্রাম-৮ (বোয়ালখালী ও আংশিক চান্দগাঁও-পাঁচলাইশ) আসনে প্রার্থীদের জয়-পরাজয়ের মূল নিয়ামক হয়ে উঠেছিল কর্ণফুলী নদীর ঝুঁকিপূর্ণ কালুরঘাট সেতুর পাশে নতুন সেতু নির্মাণ। নির্বাচনে এটিই ছিল এলাকাবাসীর মূল দাবি। ভোটারদের মন জয় করতে এই দাবি পূরণ করার আশ্বাস দেন নৌকা প্রতীক নিয়ে নির্বাচন করা জাসদের কার্যকরী সভাপতি মইনউদ্দীন খান বাদল। এমনকি নির্বাচনের পর এক বছরের মধ্যে সেতুটির মাঠপর্যায়ের কাজ শুরু করতে না পারলে সংসদ থেকে পদত্যাগ করার ঘোষণাও দেন তিনি। কিন্তু নির্বাচনে জয়লাভের পর ছয় মাস অতিবাহিত হয়ে গেলেও সেতুর কাজ শুরু হওয়ার কোনো লক্ষণ নেই। এলাকায় পা রাখলেই এ নিয়ে প্রশ্নবাণে জর্জরিত হতে হয় তাকে। তাই শেষ পর্যন্ত গত ২৫ জুন সংসদে তিনি জানিয়েই দিলেন, হয় সেতুর কাজ শুরু করতে হবে, নতুবা ডিসেম্বরেই সংসদ থেকে পদত্যাগ করবেন।

সংসদে মইনউদ্দীন খান বাদলের বক্তব্যটি নিয়ে সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে আলোচনার ঝড় বইছে। শুধু চট্টগ্রাম-৮ আসনেই নয়, চট্টগ্রামজুড়েই কয়েক দিন ধরে মূল আলোচনায় পরিণত হয়েছে এ বিষয়টি। এ নিয়ে এলাকায় মিশ্র প্রতিক্রিয়া রয়েছে। একটি পক্ষ বলছে, নতুন সেতু আদায় করতে না পারলে সংসদ থেকে পদত্যাগ করাই উচিত তার। এতে এলাকাবাসীকে দেওয়া প্রতিশ্রুতিও রক্ষা হবে। আবার কেউ কেউ বলছেন, সংসদ থেকে পদত্যাগ করাটাই সমস্যার সমাধান হতে পারে না। তার উচিত সংসদে থেকেই নতুন সেতু নির্মাণে লড়াই করে যাওয়া।

সাংসদ মইনউদ্দীন খান বাদল বলেন, ‘এলাকাবাসীকে কথা দিয়েছি এক বছরের মধ্যে সেতুর কাজ শুরু হবে। না হলে পদত্যাগ করব। এলাকাবাসীকে দেওয়া প্রতিশ্রুতি আমি রাখব। এটা শুধুই কথার কথা নয়। সংসদেও আলটিমেটাম দিয়ে রেখেছি। আর ছয় মাস দেখব, সেতুর কাজ শুরু না হলে ডিসেম্বরেই পদত্যাগ করব।’ এমন চেষ্টার পরও চট্টগ্রামের গুরুত্বপূর্ণ এই সেতু এত দিন কেন হচ্ছে না- এ প্রশ্নের জবাবে ক্ষুব্ধ সাংসদ বাদল বলেন, ‘সরকারি দল করি না বলেই কালুরঘাটে নতুন সেতু নির্মাণের বিষয়টি গুরুত্ব দেওয়া হচ্ছে না। আমি জাসদ ছেড়ে সরকারি দল করলে যদি সেতু হয়, তাহলে আমি তা করতেও রাজি আছি।’

১৯১৪ সালে প্রথম বিশ্বযুদ্ধের সময় বার্মা ফ্রন্টের সৈন্য পরিচালনার জন্য ১৯৩০ সালে কর্ণফুলী নদীতে একটি আপৎকালীন সেতু নির্মাণ করা হয়। ব্রুনিক অ্যান্ড কোম্পানি ব্রিজ বিল্ডার্স হাওড়া নামে একটি প্রতিষ্ঠান ট্রেন চলাচলের উপযোগী করে ৭০০ গজের সেতুটি তৈরি করে। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ শুরু হলে মোটরযান চলাচলের জন্য সেতুতে ডেক বসানো হয়। ১৯৫৮ সালে এই এক লেনের সেতুটিই সব ধরনের যানবাহন চলাচলের জন্য উন্মুক্ত করে দেওয়া হয়। বয়সের ভারে এখন ন্যুব্জ এই সেতু। ফলে ২০০১ সালে আনুষ্ঠানিকভাবে কালুরঘাট রেল কাম সড়ক সেতুটিকে ঝুঁকিপূর্ণ ঘোষণা করে রেলওয়ে কর্তৃপক্ষ। জোড়াতালি দিয়ে কোনোভাবে টিকিয়ে রাখা হয়েছে। চরম ঝুঁকি নিয়ে চলাচল করছে হাজার হাজার মানুষ। এ অবস্থায় সেতু ব্যবহারকারী বোয়ালখালী উপজেলা ও পটিয়ার একাংশের বাসিন্দারা একই স্থানে নতুন সেতু নির্মাণের দাবি জানিয়ে আসছেন। অস্ট্রেলিয়া, তাইওয়ান ও বাংলাদেশের প্রতিষ্ঠান নতুন সেতু নির্মাণে সম্ভাব্যতা যাচাই করে। সেতু নির্মাণে বিভিন্ন সময় আশ্বাসও মেলে। কিন্তু সেতু আর হয়নি।

বোয়ালখালী-কালুরঘাট সেতু বাস্তবায়ন পরিষদের আহ্বায়ক মো. আবদুল মোমিন বলেন, ‘আমরা জানি, চট্টগ্রামের কালুরঘাট সেতু নির্মাণে প্রধানমন্ত্রী আন্তরিক। কিন্তু এর পরও কী কারণে এই সেতু হচ্ছে না, তা আমাদের কাছে রহস্যজনক। এই সেতু হলে শুধু বোয়ালখালী নয়, পটিয়াসহ দক্ষিণ চট্টগ্রামের বিপুলসংখ্যক মানুষ প্রতিদিনের চরম দুর্ভোগ থেকে রক্ষা পাবেন।’

রেল সূত্রে জানা যায়, কালুরঘাট সেতু নির্মাণে ব্যয় ধরা হয়েছিল এক হাজার ১৬৪ কোটি ৯৮ লাখ টাকা। এর মধ্যে সরকারের নিজস্ব তহবিল থেকে ৩৮১ কোটি ১৭ লাখ এবং কোরিয়ার ইকোনমিক ডেভেলপমেন্ট কো-অপারেশন ফান্ডের (ইডিসিএফ) ঋণ থেকে ৭৮৩ কোটি ৮১ লাখ টাকা ব্যয় করার পরিকল্পনা ছিল। রেলওয়ে পূর্বাঞ্চলের কর্মকর্তারা জানিয়েছেন, সেতুটি হলে চট্টগ্রাম ও কক্সবাজার করিডোরের অপারেশনাল বাধা দূর হবে। মাতারবাড়ী গভীর সমুদ্রবন্দরের জন্য বড় আকারের করিডোরও তৈরি করা যাবে।

বাজেট নিয়ে আলোচনা করতে গিয়ে সংসদে কালুরঘাট সেতুর নির্মাণকাজ শুরু না হওয়ায় ক্ষোভ প্রকাশ করে মইনউদ্দীন খান বলেন, ‘কালুরঘাট সেতু নির্মাণে খরচ হবে এক হাজার ১৬৩ কোটি টাকা। এর মধ্যে জিওবি দেবে ৩৭৯ কোটি। বাকি টাকা দিচ্ছে দক্ষিণ কোরিয়া। মাত্র শূন্য দশমিক শূন্য ১ শতাংশ সুদে ৪০ বছরে এই অর্থ পেমেন্ট করতে হবে। কিন্তু কিছুই হলো না। ৫০ হাজার লোক ওই রাস্তা দিয়ে ক্রস (যাতায়াত) করে প্রতিদিন। তারা আমার মৃত মাকে গালি দেয়। আই উইল নট লেট বেয়ার ইট।’

সেতু নির্মাণের দাবিতে সোমবার চট্টগ্রাম প্রেস ক্লাবে সমাবেশ করেছে নাগরিক অধিকার সংরক্ষণ নামে একটি সংগঠন। চট্টগ্রাম আইনজীবী সমিতির সাধারণ সম্পাদক অ্যাডভোকেট আইয়ুব খানের সভাপতিত্বে এতে প্রধান অতিথি ছিলেন দৈনিক আজাদীর সম্পাদক এম এ মালেক। প্রধান বক্তা ছিলেন পূর্বকোণের প্রকাশক জসিম উদ্দিন চৌধুরী। বিশেষ অতিথি ছিলেন চট্টগ্রাম চেম্বারের সভাপতি মাহাবুবুল আলম, মহানগর আওয়ামী লীগের ভারপ্রাপ্ত সাধারণ সম্পাদক রেজাউল করিম চৌধুরী। একই দাবিতে শনিবার কালুরঘাট সেতুতে অনশন কর্মসূচি পালন করবেন স্থানীয় মুক্তিযোদ্ধারাসহ সর্বস্তরের মানুষ।

সুত্র: সমকাল

Print Friendly, PDF & Email

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here