আন্তর্জাতিক ডেস্ক : সম্প্রতিকালে ছড়িয়ে পড়া করোনা ভাইরাসে আক্রান্ত আরও ১৫ জনের মৃত্যুর খবর নিশ্চিত করেছে চীন। সেখানে এখন পর্যন্ত সব মিলিয়ে ৪১ জনের মৃত্যু হয়েছে। শনিবার (২৫ জানুয়ারি) নতুন করে ৪০০ রোগী শনাক্ত করা হয়েছে। যার ফলে ভাইরাসে আক্রান্ত রোগীর সংখ্যা বেড়ে দাঁড়িয়েছে ১ হাজার ৩০০ জন।

এছাড়া ভাইরাসটি অস্ট্রেলিয়া ও আশেপাশের দেশেও পৌঁছে গেছে বলে জানিয়েছে নিউইয়র্ক টাইমস। ভাইরাসের বিস্তার রোধে চীনের হুবেই প্রদেশের রাজধানী উহানে বন্ধ ঘোষণা করা হয়েছে যানবাহন চলাচল।

ওষুধের দোকানগেুলোতে বিক্রি বেড়েছে ভাইরাস প্রতিরক্ষামূলক সামগ্রির।

বছরের এই সময়টাতে উহানে পর্যটন মৌসুম ধরা হলেও করোনা প্রাণঘাতী করোনা ভাইরাস ছড়িয়ে পড়ায় উহানের সঙ্গে বিচ্ছিন্ন করা হয়েছে অন্য ১২টি শহরের যাতায়াত ব্যবস্থা। এর ফলে সেখানে বসবাসরত প্রায় সাড়ে ৩ কোর্টি মানুষ দিন কাটাচ্ছে আতঙ্ক আর উৎকণ্ঠার মাঝে।

করোনা ভাইরাস কি?

১৯৬০ সালে প্রথমবারের মতো করনা ভাইরাস আবিষ্কার করা হয়, তবে কিভাবে এই ভাইরাসের উৎপত্তি তা জানা সম্ভব হয়নি। Corona শব্দের অর্থ জ্যোতির্বলয়। সূর্য থেকে ছিটকে পড়া আলোকরশ্মির মতো হওয়ায় ভাইরাসটির নামকরণ করা হয় করোনা ভাইরাস। মানুষ ও পশু-পাখি কখনো কখনো (সব সময় না) এই ভাইরাসটির দ্বারা আক্রান্ত হয়ে থাকে।

করোনা ভাইরাস

অন্যান্য ভাইরাসের মতোই ছড়িয়ে থাকে করোনা ভাইরাস। যেমন, হাঁচি-কাঁশি ও কফের মাধ্যমে এক ব্যক্তি থেকে অন্য ব্যক্তিতে ছড়িয়ে পড়ে। মূলত হাঁচি-কাঁশি দেওয়ার পর জীবাণুযুক্ত হাত দিয়ে কাউকে স্পর্শ করলে, দরজার হাতল বা একাধিক মানুষ ব্যবহার করে এ জাতীয় বস্তু থেকে আরেকজনের শরীরে করোনা ভাইরাসের জীবাণু ছড়ায়। তাই ভাইরাস প্রতিরোধে এ বিষয়গুলোতে খেয়াল রাখা জরুরি।

ওয়ার্ল্ড হেলথ অর্গাইজেশন (ডব্লিইএইচও) জানিয়েছে, করোনা ভাইরাস প্রধাণত পশু-পাখি ও মানুষের মধ্যে সংক্রমিত হয়। আরও বলা হয়েছে, সার্স-করোনা ভাইরাস সিভেট বিড়াল থেকে মানুষে এবং মার্স-করোনা ভাইরাস এক ধরনের উট থেকে মানুষে সংক্রমিত হয়। তাছাড়া বিভিন্ন ধরনের করনা ভাইরাসযুক্ত প্রাণী মানুষের চারপাশে থাকলেও তা মানুষকে খুব একটা আক্রান্ত করে না।

করোনা ভাইরাসে আক্রান্ত হলে যে লক্ষণগুলো প্রকাশ পায়:

করোনা ভাইরাসের লক্ষণগুলো অন্যান্য শ্বাস-প্রস্বাস সংক্রান্ত রোগের লক্ষণের মতোই। যেমন, আক্রান্ত ব্যক্তির নাক দিয়ে সর্দি ঝরে, হাঁচি, কাঁশি, গলাব্যথা ও জ্বর হয়। তবে বেশিরভাগ ক্ষেত্রে রোগীরা বুঝতে পারে না সে করোনা ভাইরাসে আক্রন্ত, নাকি সাধারণ সর্দি-কাশিতে।

এ ক্ষেত্রে আক্রান্ত এলাকায় সাধারণ সর্দি-কাঁশি হলেও নাক, গলা ও রক্তের পরীক্ষা করিয়ে নিশ্চিত হতে হবে সেটা করোনা ভাইরাস কি না। এ ক্ষেত্রে পরীক্ষার ফলাফল অনুযায়ী চিকিৎসা নিতে হবে।

করোনা ভাইরাস মূলত শ্বাসযন্ত্রের নিচের অংশ শ্বাসনালি ও ফুসফুসকে আক্রান্ত করে। এর ফলে, বিশেষ করে বয়স্ক মানুষ নিউমোনিয়া ও হৃদরোগে আক্রান্ত হয়। এছাড়া রোগপ্রাতিরোধ ক্ষমতা কমে যায়।

দ্রুত করোনা ভাইরাস ছড়িয়ে পড়া প্রতিরোধে নানা পদক্ষেপ নিচ্ছে চীন। এগুলোর মধ্যে রয়েছে-

কোনো লক্ষণ ছাড়ায় মানুষ ছাড়াতে পারে করোনা ভাইরাস: মেডিকেল জার্নাল ল্যানসেটের শুক্রবারের এক প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, আক্রান্ত ব্যক্তি কোনো লক্ষণ প্রকাশের আগেই অন্যদের মাঝে করোনা ভাইরাস ছড়াতে পারে।

গবেষণায় দেখা গেছে এক পরিবারে সাত সদস্যের মধ্যে পাঁচজন উহানে ভ্রমণ করেছেন। যেখান থেকে করোনা ভাইরাস ছড়াচ্ছে বলে ধারণা করা হচ্ছে। তাদের থেকে ওই পরিবারের বাকি দুই সদস্যও করোনা ভাইরাসে আক্রান্ত হন।

ভ্রমণ নিষেধাজ্ঞা: হুবেই প্রদেশের প্রায় সাড়ে ৫ কোর্টি মানুষের মধ্যে যাতে করোনা ভাইরাস ছড়িয়ে পড়তে না পারে সেজন্য সেখানকার ১৬টি শহরের ভ্রমণ নিষেধাজ্ঞা আরোপ করা হয়েছে।

এছাড়া আজ শনিবার (২৫ জানুয়ারি) চীনের নতুন চন্দ্রবর্ষ শুরু হচ্ছে। তবে করোনা ভাইরাসের কারণে বাতিল করা হয়েছে উদযাপনের অনেক অনুষ্ঠান।

উহানের হাসপাতালগুলোতে রোগির সংখ্যা বাড়তে থাকায় খাদ্য ও ওষুধ সরবরাহে সমস্যা দেখা দিয়েছে।

ভাইরাস প্রতিহত করার ঘোষণা শি জিনপিংসহ চীনের জাতীয় নেতাদের: করোনা ভাইরাসের বিস্তার চীনে কী ধরনের প্রভাব ফেলছে সে বিষয়ে কমিউনিস্ট পার্টির নেতাদের সঙ্গে শনিবার এক বৈঠক করেছেন দেশটির শীর্ষ নেতা শি জিনপিং। সেখানে করোনা ভাইরাসের বিস্তার, প্রতিরোধ ও চিকিৎসা বিষয়ে আলোচনা করেন।

পরে সাংবাদিকদের জানান, ‘আমরা এই মহামারিকে অবশ্যই প্রতিরোধ ও প্রতিকার করতে সক্ষম হবো।’ যদিও এই বিষয়ে খুব কমই মুখ খুলছেন এই শীর্ষ নেতা।

১০ দিনে নতুন হাসপাতাল: করোনা ভাইরাস মোকাবিলায় ১০ দিনে ১ হাজার শয্যার নতুন হাসপাতাল নির্মাণের ঘোষণা দিয়েছে উহান কর্তৃপক্ষ। আগামী ৩ ফেব্রুয়ারি হাসপাতালটির নির্মাণ কাজ শেষ হবে।

তবে করোনা ভাইরাস প্রতিরোধে চীনের এই কর্মকাণ্ড নিয়েও উঠছে নানা প্রশ্ন। বিষয়টা এখনো পরিষ্কার না ভাইরাসটি কি পরিমাণ প্রাণঘাতী হতে পারে অথবা আদৌ প্রাণঘাতী কি না।

উৎসব মৌসুমে পর্যটন শিল্পে বিপর্যয়: গণজমায়েত করোনা ভাইরাস বিস্তারে সহায়ক হতে পারে বলে বেইজিং ও সাংহাইয়ের গুরুত্বপূর্ণ পর্যটন এলাকাগুলো বন্ধ ঘোষণা করা হয়েছে।

এছাড়া স্থগিত করা হয়েছে নতুন বছর বরণের অধিকাংশ উৎসব। এ সময়ে চীনের অধিকাংশ পরিবারের সদস্যরা একত্রিত হয়, বিভিন্ন স্থানে ভ্রমণ করে।

হংকংয়ে জরুরি অবস্থা জারি, বন্ধ ঘোষণা করা হয়েছে স্কুল: চীনের আধা স্বায়ত্তশাসিত প্রদেশ হংকংয়ের নেতা ক্যারি লাম সেখানে স্বস্থ্যবিষয়ক জরুরি অবস্থা ঘোষণা করেছেন। পাশাপাশি বন্ধ ঘোষণা করা হয়েছে সবগুলো স্কুল। আগামী ফ্রেব্রুয়ারি মাসের মাঝামাঝি পর্যন্ত সেগুলো বন্ধ থাকবে।

অস্ট্রেলিয়াতে ৪ জন শনাক্ত: শনিবার অষ্ট্রেলিয়াতে চারজনকে শনাক্ত করা হয়েছে যারা করোনা ভাইরাসে আক্রান্ত। রোগীর সংখ্যা আরও বাড়তে পারে বলে মনে করছেন বিশেষজ্ঞরা। চীনের পর্যটকদের অন্যতম ভ্রমণস্থান অস্ট্রেলিয়া হওয়ায় চীনা পর্যটকদের মাধ্যমে সেখানে করোনা ভাইরাস ছড়াচ্ছে বলে জানিয়েছেন দেশটির কর্তৃপক্ষ।

 ইউনিভার্সিটি অব কুইনসল্যান্ড জানিয়েছে করোনা ভাইরাসের বিস্তার রোধে তাদের ভ্যাকসিন আবিষ্কার করতে বলা হয়েছে।

আক্রান্ত হয়েছে অন্যান্য দেশের নাগরিকরাও: চীন-অস্ট্রেলিয়া ছাড়াও ভাইরাস ছড়িয়েছে বেশ কয়েকটি দেশে। ইতোমধ্যে তাইওয়ানে এক জন, মোনাকোতে দুই জন, হংকংয়ে দুই জন, ভিয়েতনামে দুই জন, থাইল্যান্ডে তিন জন, জাপানে একজন ও দক্ষিণ কোরিয়া, সিঙ্গাপুর ও যুক্তরাষ্ট্রে একজন করে করোনা ভাইরাসে আক্রান্ত হয়েছেন।

Print Friendly, PDF & Email

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here