শায়খ মুহাম্মদ মুহি উদ্দীন আযহারী
বিশ্বসমাজ আজ এক ক্রান্তিলগ্ন অতিক্রম করছে। একদিকে নানা ধর্মের অনুসারীদের মাঝে ক্রমবর্ধমান হানাহানি, অন্যদিকে এর সুযোগে অনৈতিকতার বেসাতি নিয়ে ধর্মহীনতা আর নাস্তিক্যতাবাদের বিস্তার-এই দুয়ের মাঝে পড়ে বিশ্ব-মানবতা আজ সত্যের মশালের বাহকের সন্ধান করছে। বিশ্ব-মানবতার মুক্তিদূত হযরত মুহাম্মদ (স.) এর প্রচারিত ইসলামের মৌলিক শিক্ষাকে আত্মস্থ করে বিকাশ লাভ করা সুফিবাদ এই সংকট নিরসনের প্রকৃষ্ট সমাধান।
ইসলাম ধর্মে ঐশী সাধনা ও প্রভুর নৈকট্য লাভের পথ পরিক্রমার এক অবশ্যম্ভাবী অধ্যায় সুফিবাদ। সুফিবাদ চর্চার দীর্ঘ পথ পরিক্রমায় বহু ত্বরিকা বিকাশ লাভ করে, যেমন : কাদেরিয়া, চিশতিয়া, সোহরাওয়ার্দিয়া, নকশ্বন্দিয়, মুজাদ্দেদিয়া ইত্যাদি। মাইজভাণ্ডারী ত্বরিকা সুফি সাধনারই এক বিশেষ ধারা। বেলায়তে ওজমার অধিকারী গাউসুল আজম সৈয়দ আহমদ উল্লাহ মাইজভাণ্ডারী (ক.) এই ত্বরিকা প্রতিষ্ঠা করেন।
এই ত্বরিকার উৎসমূল বর্ণনায় শাহ সুফি সৈয়দ দেলাওর হোসাইন মাইজভাণ্ডারী (রহ.) বেলায়তে মোতলাকা গ্রন্থে বলেন, ‘ত্রিবিধ বেলায়তি ধারা, নবুয়তি ধারার সমন্বয়ে অর্থাৎ জাহের বাতেন তালিমে এরশাদিসহ শরীয়ত, ত্বরিকত, হাকিকত ও মারফত প্রভাবে ও সংমিশ্রণে মাইজভাণ্ডারী ত্বরিকারূপী মহাসাগরের উৎপত্তি।’
এই ত্বরিকা আচার ধর্ম পালনের সাথে সাথে নৈতিক পরিশুদ্ধির ওপর প্রাধান্য দেয়। ইসলাম ধর্মের চিরন্তন শান্তির বাণীকে ধারণ করে, ধর্মের শাশ্বত মানবতার আদর্শকে যুগোপযোগী করে উপস্থাপন করা হয়েছে এই ত্বরিকার প্রতিটি কর্মকাণ্ডে।
ইতিহাস পর্যালোচনায় আমরা দেখতে পাই পৃথিবীর বুকে সংঘটিত রক্তক্ষয়ী সংঘর্ষগুলোর অন্যতম প্রধান কারণ বিশ্বাসজনিত সংঘাত। মানব সভ্যতার ইতিহাসে গোষ্ঠীগত ধর্ম-বিশ্বাসের দ্বন্দ্বে কত রক্ত ঝরেছে তার কোনো সংখ্যা-পরিসংখ্যান নেই। সমসাময়িককালের চলমান দ্বন্দ্ব-সংঘাতের পিছনেও প্রত্যক্ষ বা পরোক্ষভাবে ধর্ম-বিশ্বাসের ভিন্নতাই মুখ্য।
ধর্ম-বিশ্বাস সম্ভুত সংঘাতের মৌলিক রূপ দু’ধরনের হতে পারে। এক. একই ধর্মের মধ্যে উপদলীয় কোন্দল ও সংঘাত। খ্রিস্টান ধর্মের ক্যাথলিক-প্রোটেস্ট্যান্ট দ্বন্দ্ব, ইসলাম ধর্মের শিয়া-সুন্নি দ্বন্দ্ব, হিন্দু ধর্মের মাঝে বিদ্যমান জাত প্রথা এই ধর্মীয় কোন্দলের উদাহরণ। দুই. নিজ ধর্মের প্রাধান্য বজায় রাখা ও অন্যধর্মের প্রতি বিদ্বেষ প্রকাশের চেষ্টায় সৃষ্ট সংঘাত।
ধর্মীয় পরিমণ্ডলই মানুষের নৈতিকতার শিক্ষা অর্জনের প্রদান ক্ষেত্র। পাশাপাশি মানুষকে তার পারিবারিক ও সামাজিক বন্ধনের প্রতি দায়বদ্ধ থাকতে ও অনুগত রাখার ক্ষেত্রে ধর্মীয় বিশ্বাসই অনেকাংশে কার্যকর ভূমিকা পালন করে। তাই আমরা দেখি যে, ধর্মহীন পরিবেশে পারিবারিক ও সামাজিক বন্ধন অনেকটা শিথিল।
নৈতিকতার শিক্ষা ও মানবতা আর পারিবারিক-সামাজিক বন্ধনের উৎস ধর্ম-বিশ্বাস যখন অশান্তি আর সংঘাতের কারণ হয়ে দাঁড়ায় তখন তা বিশ্ব-মানবতার জন্য এক বিপর্যয়কর অবস্থার সৃষ্টি করে। ধর্মীয় পরিমণ্ডলের এই অন্তর্কলহ, ভিন্ন ধর্মানুসারীদের মধ্যকার পারস্পরিক প্রাধান্য বিস্তারের দ্বন্দ্ব মানব সমাজের এক বিরাটাংশের মনে ধর্মের প্রয়োজনীয়তা ও উপযোগিতা সম্পর্কে এক বিরাট প্রশ্নবোধক চিহ্ন এঁকে দিয়েছে। ফলে পাশ্চাত্য সমাজতো বটেই ধর্মপ্রাণ হিসেবে পরিচিত এশীয় সমাজেও নাস্তিকতা মহামারীর আকারে ছড়িয়ে পড়ছে, যা মানব সমাজের জন্য আরও ক্ষতিকর। এ যেন বিপন্ন মানবতার উত্তপ্ত কড়াই থেকে জ্বলন্ত উনুনে পতন। আল্লাহতায়ালা পবিত্র কোরআনে এরশাদ করেন, ‘ধর্মের ক্ষেত্রে কোনো বাড়াবাড়ি বা জবরদস্তি নেই।’ (সুরা বাকারা)
আন্ত-ধর্মীয় প্রতিযোগিতা ও ধর্মের আভরণে অমানবিক কর্মকাণ্ডের অবসানে, ইসলাম ধর্মের উদারতা ও শান্তির বাণীকে আত্মস্থ করে, সকল ধর্মের অনুসারীদের মাঝে সাম্য, সম্প্রীতি ও শান্তিপূর্ণ সহাবস্থানের আবেদন নিয়ে মাইজভাণ্ডারী ত্বরিকার আগমন।
ধর্মগত বিভাজন ও জাত-পাতের শ্রেণিকরণের মাধ্যমে মানবতার অপমান নয়, জাতি-ধর্ম-বর্ণ নির্বিশেষে সকল মানুষকে একটি বৃহত্তর সমাজের সদস্য বিবেচনা করে সকলের মাঝে ভালোবাসা ও সম্প্রীতিবোধের উন্মেষ ঘটানোই মাইজভাণ্ডারী ত্বরিকার বিশেষ বৈশিষ্ট্য। সৃষ্টিকর্তার অস্তিত্বে অবিশ্বাসী নাস্তিক্যতাবাদের বিরুদ্ধে এই ত্বরিকা এক কার্যকর শান্তিপূর্ণ মাধ্যম। বিশ্ব মানবতার জন্য হযরত সৈয়দ আহমদ উল্লাহ (ক.) এর এই দুর্লভ অবদান আবহমান কাল পর্যন্ত স্থায়ী ও অবিকৃত থাকবে।
মাইজভাণ্ডারী ত্বরিকার এই ধর্মসাম্য মানে অবশ্যই ধর্মহীনতা নয়। মাইজভাণ্ডারী ত্বরিকার এই উদারতা ও ধর্মসাম্যের বাণী মূলত পবিত্র ইসলাম ধর্মের মৌলিক বিশ্বাস থেকেই গৃহীত। এই ত্বরিকা ইসলাম ধর্মের আদর্শকে পরিপূর্ণভাবে মেনে চলায় উৎসাহ ও দিকনির্দেশনা দেয়। সাথে সাথে অন্য ধর্মের অনুসারীদেরও ইসলাম প্রদত্ত প্রাপ্য অধিকার ও সম্মানের স্বীকৃতি দেয়। এতে করে সমাজে ধর্ম-বিশ্বাসজনিত সংঘাত অনেকাংশে লোপ পায়।
তাইতো আমরা দেখি মাইজভাণ্ডার দরবার শরীফ সকল ধর্মের অনুসারীদের জন্য উন্মুক্ত। আন্তরিকতা, অভ্যর্থনা আর আপ্যায়নের ক্ষেত্রে ধর্ম, বর্ণ বা শ্রেণিগত কোনো বৈষম্য নেই। নেই কোনো ঠুনকো আভিজাত্যের অহম বা গোঁড়াবাদের জৌলুশ। অন্যদিকে এই ত্বরিকার সকল কর্মকাণ্ডই পরিচালিত হয় একমাত্র ইসলাম ধর্মের দিকনির্দেশনা অনুযায়ী। যেমন, মাইজভাণ্ডার দরবার শরিফে এই ছিলছিলার ধারাবাহিকতায় একমাত্র খেলাফতপ্রাপ্ত সাজ্জাদানশীন শাহসুফি সৈয়দ এমদাদুল হক মাইজভাণ্ডারী (ম.) তার মুরিদদের প্রথম যে ছবক দেন তা হচ্ছে প্রতিদিন নামাজ আদায়ের পর ‘লা ইলাহা ইল্লাল্লাহ’ জিকির করা। আর তাই মাইজভাণ্ডারী ত্বরিকার অনুসরণে মানুষ একদিকে যেমন সহজে আল্লাহর নৈকট্য লাভ করতে পারে তেমনি অন্যদিকে বৃহত্তর সমাজে শান্তিপূর্ণ সহাবস্থানের পরিবেশ সৃষ্টি হয়। যা আল্লাহর এক অতুলনীয় নেয়ামত।
শায়খ মুহাম্মদ মুহি উদ্দীন আযহারী
প্রধান, পোর্টস মাউথ ইসলামিক সেন্টার, ইউ কে
খতিব, পোর্টস মাউথ জামে মসজিদ, ইউ কে