সচিবালয়ের ভেতরে শিক্ষার্থীদের বিক্ষোভের মুখে এইচএসসি ও সমমানের স্থগিত পরীক্ষাগুলো বাতিল করে সরকার।ফাইল ছবি

করোনার কারণে ২০২০ সালে এইচএসসি ও সমমান পরীক্ষা অনুষ্ঠিত হয়নি। সেবার পরীক্ষার্থীদের ‘অটো পাস’ দেওয়া হয়। জেএসসি ও এসএসসি পরীক্ষার ফলাফলের ভিত্তিতে ফল তৈরি করা হয়েছিল। তখন জাতীয় সংসদে পরীক্ষা ছাড়াই ফল প্রকাশের ব্যাপারে আইন পাস করতে হয়েছে।

এ বছর ছাত্র-জনতার আন্দোলনের কারণে সাতটি বিষয়ে পরীক্ষার পর এইচএসসি পরীক্ষা এসে স্থগিত হয়ে যায়। অন্তর্বর্তী সরকার বাকি পরীক্ষাগুলোর নতুন তারিখ ঘোষণা করলেও কিছু শিক্ষার্থীর দাবির পরিপ্রেক্ষিতে সরকার পরীক্ষাগুলো বাতিল করে দেয়। এই সিদ্ধান্ত সংখ্যাগরিষ্ঠ পরীক্ষার্থীর মতের প্রতিফলন কি না, তার কোনো বিচার বা জরিপ করা হয়নি। চাইলে সেটা করা যেত।

২০২৪ সালে সব শিক্ষা বোর্ড মিলিয়ে পাসের হার ৭৭ দশমিক ৭৮ শতাংশ। আগের বছর ছিল ৭৮ দশমিক ৬৪ শতাংশ। আর ২০২২ ও ২০২১ সালে পাসের হার ছিল তুলনামূলকভাবে অনেক বেশি, যথাক্রমে প্রায় ৮৬ শতাংশ ও ৯৭ শতাংশের বেশি। তার মানে ২০২০ সালের শতকরা ১০০ ভাগ ‘অটো পাসে’র পর এবারই সবচেয়ে কম পরীক্ষার্থী পাস করেছে।

যেসব শিক্ষার্থী স্থগিত পরীক্ষাগুলো বাতিলের দাবিতে আন্দোলন করেছিল, তারা এই ফলাফলে কতটুকু সন্তুষ্ট হতে পেরেছে, সেটি তারাই ভালো বলতে পারবে। তবে বিপুলসংখ্যক পরীক্ষার্থী অকৃতকার্য হওয়ায় তাদের একটি বড় অংশ নম্বর ও ফল চ্যালেঞ্জ করে বোর্ড কর্তৃপক্ষের কাছে আবেদন করতে পারবে। এসএসসি বা পূর্ববর্তী পরীক্ষায় যারা ভালো নম্বর পেয়েছিল, ‘সাবজেক্ট ম্যাপিং’ বা বিষয় সমন্বয়ের কারণে এবারও তারা ভালো নম্বর পেয়েছে। এর ফলে গতবারের চেয়ে এবার ৫০ হাজারের বেশি শিক্ষার্থী জিপিএ–৫ পেয়েছে।

পাসের হার বা জিপিএ-৫ দিয়ে কি আদৌ শিক্ষার মানের প্রকৃত অবস্থা বোঝা সম্ভব? আমাদের পরীক্ষাপদ্ধতি এখনো যথেষ্ট উৎকৃষ্ট মানে পৌঁছাতে পারেনি। এখন পর্যন্ত আমাদের পরীক্ষাগুলোয় গতানুগতিক ধারায় প্রশ্ন করা হয়। শিক্ষার্থীর প্রকৃত জ্ঞান ও দক্ষতা এভাবে পুরোপুরি যাচাই করা সম্ভব নয়। দেখা যাচ্ছে, স্কুল-কলেজ ও সরকারের কাছে ফলাফল মানে হলো পাসের হার। আর অভিভাবক ও শিক্ষার্থীদের কাছে ফলাফল মানে জিপিএর মান। পরীক্ষা কেন নেওয়া হয় কিংবা এর উদ্দেশ্য কী, সেটি মোটেও বিবেচনায় নেওয়া হয় না।

প্রতিটি শ্রেণির বা স্তরের শিক্ষাক্রমে কিছু যোগ্যতা বা দক্ষতা নির্ধারণ করা থাকে। একে শিখনফলও বলা হয়। উচ্চমাধ্যমিক স্তরে শিক্ষার্থী একেকটি বিষয়ে কতটুকু দক্ষতা অর্জন করবে, তা ওই স্তরের বিস্তারিত শিক্ষাক্রমে নির্ধারিত আছে। স্কুল-কলেজের পরীক্ষা বা বোর্ডের চূড়ান্ত পরীক্ষার মাধ্যমে যাচাই করা হয় শিক্ষার্থী সেই যোগ্যতার কতটুকু অর্জন করল। কোনো বিষয়ে পরীক্ষা না নেওয়া হলে বোঝা সম্ভব নয় ওই বিষয়ে শিক্ষার্থী কাঙ্ক্ষিত দক্ষতার কতটুকু অর্জন করেছেন। পূর্বের ফলাফল দিয়ে এটি মোটেও বোঝা যাবে না।

উদাহরণ হিসেবে ধরা যাক, ২০২২ সালের এসএসসি পরীক্ষায় কোনো শিক্ষার্থী হয়তো রসায়নে ৮২ নম্বর পেল। এ বছর এইচএসসি পরীক্ষায় ওই শিক্ষার্থী বিজ্ঞান শাখায় থাকলে রসায়নে ১৬৪ নম্বর পেয়েছে। আবার ওই শিক্ষার্থী বিজ্ঞান শাখা পরিবর্তন করে উচ্চমাধ্যমিকে ব্যবসায় শিক্ষা বা মানবিক শাখায় পড়তে পারে। এ ক্ষেত্রে সে বর্তমান শাখার নৈর্বাচনিক বিষয়ের একটিতে ১৬৪ পাবে। এসএসসির ১০০ নম্বরের ফলকে স্রেফ দ্বিগুণ করে এইচএসসির ২০০ নম্বরের ফল হিসেবে প্রকাশ করা হয়েছে।

ফল তৈরির এই ‘অটো’ প্রক্রিয়া অটো পাসের মতোই বিভ্রান্তির। কারণ, উচ্চমাধ্যমিকের কোনো বিষয়ে শিক্ষার্থীর অবস্থান কী, তা কেবল পরীক্ষা নিয়েই বোঝা সম্ভব। এই ফলাফল উচ্চশিক্ষা ও ভর্তি পরীক্ষার ক্ষেত্রেও সমস্যা তৈরি করতে পারে। যেসব বিষয়ে পরীক্ষা ছাড়াই নম্বর দেওয়া হয়েছে, সেসব বিষয়ে শিক্ষার্থীর প্রকৃত অবস্থা উচ্চশিক্ষা প্রতিষ্ঠানের পক্ষে নির্ধারণ করা সম্ভব নয়। আবার উচ্চমাধ্যমিকে বিজ্ঞান শাখায় থাকা অনেক শিক্ষার্থী বিশ্ববিদ্যালয় পর্যায়ে এসেও শাখা পরিবর্তন করে ফেলে। এর প্রধান কারণ এইচএসসিতে বিজ্ঞানের বিষয়গুলোতে ভালো নম্বর না পাওয়া। এখন এসএসসির অনুরূপ নম্বর থাকায় শিক্ষার্থী নিজেও হয়তো বুঝতে পারবে না তার বিভাগ পরিবর্তন করা ঠিক হবে কি না।

একেকটি শ্রেণিতে বা স্তরে অর্জিত দক্ষতার ওপর ভিত্তি করেই পরবর্তী শ্রেণি বা স্তরে ভর্তির সুযোগ দেওয়া হয়। সংগত কারণেই উচ্চমাধ্যমিকের ফলাফল ভর্তি পরীক্ষা এবং উচ্চশিক্ষায় প্রভাব ফেলে। এবার এইচএসসির নম্বরপত্রে দেখানো সব নম্বর উচ্চমাধ্যমিকের জ্ঞানের বা দক্ষতার প্রকৃত প্রতিফলন ঘটাবে না। ফলে বিশ্ববিদ্যালয় পর্যায়ে পড়াশোনার সময়ে অনেক শিক্ষার্থী বাড়তি চ্যালেঞ্জের মুখোমুখি হতে পারে। ভর্তি পরীক্ষা গ্রহণের ক্ষেত্রেও বুয়েট, মেডিকেল বা বিশ্ববিদ্যালয়কে ন্যূনতম জিপিএ বা নম্বর নির্ধারণ করতে খানিক দ্বিধায় ফেলবে।

ভবিষ্যতে পরীক্ষা ছাড়া নম্বর দেওয়ার ব্যাপারে মন্ত্রণালয় ও শিক্ষা বোর্ড কর্তৃপক্ষকে আরও বিচক্ষণতার পরিচয় দেওয়া দরকার। এ ধরনের দাবি করার ক্ষেত্রে শিক্ষার্থীদেরও ভাবা দরকার।

 তারিক মনজুর ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের বাংলা বিভাগের অধ্যাপক

Print Friendly, PDF & Email

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here