করোনাভাইরাস মোকাবেলায় চীন এক হাজার শয্যার একটি হাসপাতাল নির্মাণ করছে মাত্র ছয়দিনে। এতো দ্রুত সময়ে হাসপাতাল নির্মাণের কাজ পুরো বিশ্বে হৈচৈ ফেলে দিয়েছে। অথচ পৃথিবীর অনেক দেশ আছে যেখানে প্রকল্প শেষ করতে বছরের পর বছর সময় লাগে। বাংলাদেশ তার মধ্যে অন্যতম।
বাংলাদেশে কেন এতো সময় লাগে?
অনুমোদনের দীর্ঘসূত্রিতা
যে কোন প্রকল্প প্রস্তাব দিয়ে সেটির অনুমোদন নিতে দীর্ঘ সময় লেগে যায়। এর সাথে বিভিন্ন মন্ত্রণালয় জড়িত থাকে। সবার মতামত নিয়ে প্রকল্প চূড়ান্ত করতে হয়। এ কাজ করতে কয়েক ডজন মিটিং করতে হয়।
সাবেক অর্থমন্ত্রী আবুল মাল আব্দুল মুহিত একবার আক্ষেপ করে বলেছিলেন, উন্নয়ন প্রকল্প অনুমোদন করতেই প্রকল্প বাস্তবায়নের সময় শেষ হয়ে যায়। অনেক সময় ঠিক মতো সমীক্ষা না করেই প্রকল্প গ্রহণ করা হয়।
প্রকল্প অনুমোদনের পর যখন কাজ শুরু হয় তখন দেখা বিভিন্ন সংস্থার সাথে সমন্বয় করতে হয়। রাস্তা নির্মাণ করতে গিয়ে দেখা যাচ্ছে মাঝখানে বিদ্যুতের খুঁটি পড়েছে কিংবা সুয়ারেজ লাইন পরিবর্তন করতে হবে। সেক্ষেত্রে অন্যান্য সংস্থার অনুমোদন নিতে হয়। এক্ষেত্রে দীর্ঘ সময় লাগে। একের পর এক মিটিং করতে হয়।
ঢাকা ট্রান্সপোর্ট সমন্বয় বোর্ডের সাবেক নির্বাহী পরিচালক সালেহ উদ্দিন আহমেদ বিবিসি বাংলাকে বলেন, বিভিন্ন সংস্থার মধ্যে সমন্বয়ের কাজটি বেশ জটিল এবং সময়সাপেক্ষ।
পর্যাপ্ত অর্থের অভাব
বাংলাদেশে উন্নয়ন প্রকল্প বাস্তবায়নের জন্য প্রতিবছর বাজেটের বার্ষিক উন্নয়ন কর্মসূচিতে অর্থ বরাদ্দ দেয়া হয়। কিন্তু অনেক প্রকল্পে নিরবচ্ছিন্ন অর্থ বরাদ্দ দেয়া সম্ভব হয়না। দেখা যায়, দুই-তিন বছর মিলিয়ে পুরো অর্থ ছাড় করা হয়। ফলে কাজের অগ্রগতি আটকে থাকে।
ভূমি জটিলতা
জমি অধিগ্রহণ একটি বড় সমস্যা। ঢাকা-চট্টগ্রাম এবং ঢাকা-ময়মনসিংহ চার লেন বাস্তবায়ন করতে এ সমস্যায় পড়ে হয়েছিল। ভূমি জটিলতার কারণে মহাসড়কের প্রকৃতিও পরিবর্তন করতে হয়েছে। এনিয়ে সরকারের বিভিন্ন সংস্থা দীর্ঘসময় যাবত চিঠি চালাচালি করে।
সরকারের আওতাধীন বাস্তবায়ন, পরিবীক্ষণ ও মূল্যায়ন বিভাগের (আইএমইডি) বিভিন্ন প্রতিবেদনে প্রকল্প বাস্তবায়নের ক্ষেত্রে ভূমি জটিলতার বিষয়টি তুলে ধরা হয়েছে।
পরামর্শক নিয়োগে জটিলতা
যেসব প্রকল্পে বিদেশী অর্থায়ন আছে সেখানে পরামর্শ দেবার জন্য বিভিন্ন পরামর্শক প্রতিষ্ঠান বা ব্যক্তি নিয়োগ করা হয়। অনেক সময় পরামর্শক নিয়োগ করতে করতে মাসের পর মাস সময় লাগে। সেজন্য প্রকল্প বাস্তবায়নও পিছিয়ে যায়।
দরপত্র প্রক্রিয়া
যে কোন সরকারি প্রকল্প বাস্তবায়নের ক্ষেত্রে দরপত্র প্রক্রিয়া অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। সাধারণত যে প্রতিষ্ঠান সবচেয়ে কম খরচে প্রকল্প বাস্তবায়ন করবে তাদের কাজ দেয়া হয়। এক্ষেত্রে পুরো প্রক্রিয়া বেশ সময় লাগে।
অভিযোগ রয়েছে, ক্ষমতাসীনরা সবসময় তাদের পছন্দের ব্যক্তি কিংবা প্রতিষ্ঠানকে কাজ দিতে তৎপর থাকে। ফলে দরপত্রের শর্ত শিথিল করা কিংবা নানা কারসাজির অভিযোগ উঠে। এতে সময় নষ্ট হয় অনেক।
নকশা পরিবর্তন
বড় সেতু, ফ্লাইওভার, মেট্রোরেল কিংবা এক্সপ্রেসওয়ে নির্মাণের ক্ষেত্রে নকাশা অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। নকশা চূড়ান্ত করার ক্ষেত্রে দীর্ঘ সময় লাগে। এর একটি বড় কারণ হচ্ছে বিভিন্ন সংস্থার আপত্তি। উদাহরণস্বরূপ, এলিভেটেড এক্সপ্রেসওয়ে প্রকল্প।
ঢাকা শহরের উপর দিয়ে প্রায় ২০ কিলোমিটার দীর্ঘ যে এক্সপ্রেসওয়ে নির্মাণের কাজ চলছে সেখানে পাঁচবার নকশায় পরিবর্তন আনা হয়েছে। মেট্রোরেল নির্মাণের ক্ষেত্রে রুট নির্ধারণের ক্ষেত্রে নানা জটিলতা তৈরি হয়েছিল। বিভিন্ন সংস্থার আপত্তির কারণে মেট্রোরেলের রুট চূড়ান্ত করতে অনেক সময় লেগেছে।
প্রকল্প কর্মকর্তার বদলী
বাংলাদেশে যে কোন প্রকল্প বাস্তবায়নের ক্ষেত্রে প্রকল্প সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তাদের ভূমিকা অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। অনেক সময় দেখা যায় প্রকল্প বাস্তবায়নের সময় কর্মকর্তারা বদলি হয়ে যায়।
ফলে নতুন আরেকজন এসে কাজ বুঝে নিতে সময় লাগে। ফলে প্রকল্প বাস্তবায়ন ধীরগতির হয়ে যায়। ড. সালেহ উদ্দিন আহমেদ বলেন, “একজন বদলী হয়ে যাবার ফলে আরেকজন আসলে কাজ বুঝে নিতে সময় লাগে। ফলে প্রকল্প বাস্তবায়ন হতে দেরি হয়।”
দুর্নীতি
সময়মতো প্রকল্পের কাজ শেষ না হবার পেছনে দুর্নীতি একটি বড় কারণ। অভিযোগ রয়েছে, প্রকল্পের সাথে সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিরা ইচ্ছে করেই ধীর গতিতে কাজ করেন যাতে সময় বেশি লাগে। সময় বেশি প্রয়োজন হলে ব্যয়ও বাড়ে। ফলে অতিরিক্ত টাকা বরাদ্দ দিতে হয়।
দক্ষতার অভাব
যে কোন প্রকল্প ভালোভাবে বাস্তবায়ন করতে হলে প্রকল্পের সাথে সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিদের সে সম্পর্কে পর্যাপ্ত জ্ঞান থাকা জরুরী। অভিযোগ রয়েছে, অনেকে সময় রাজনৈতিক বিবেচনায় নিয়োগের কারণে এ ধরণের পরিস্থিতির সৃষ্টি হয়।