নাসিরুদ্দিন চৌধুরী

প্রকাশ: শনিবার , ২৮ নভেম্বর, ২০২০

যেসব মহাজনের নাম আমি উপরে উল্লেখ করলাম ‘ওজু কালাম’ পড়ে যাঁদের নাম নিতে হয়, তাঁদের সমপংক্তিতে ইসহাক চৌধুরীর নাম নেওয়া বেয়াদপিরই সামিল হয়, তাঁদের চরণসেবা করতে পারলেও ইসহাক চৌধুরী ধন্য হতেন। তবে গবেষকের মানদণ্ড অনেক নিচুতে নামিয়ে আনতে পারলে ইসহাক চৌধুরীকে একজন ছোটোখাটো গবেষক হয়তো বলা যায়। ইসহাক চৌধুরী যে বিষয়টা নিয়ে গবেষণাকর্ম করেছেন, সেটা সাহিত্যের বাধা সড়ক নয়, তিনি সাহিত্যের একটি গলিপথ দিয়ে বিচরণ করেছেন, যেমন কৃষিজীবীকে গ্রামের আলপথ দিয়ে হাঁটতে হয়। পুঁথির খোঁজে ইসহাক চৌধুরীও সত্যিই আল দিয়ে হেঁটেছেন; দূর গাঁয়ের কোনো কৃষক হয়তো যক্ষের ধনের ন্যায় একটি পুঁথি আঁকড়ে ধরে বসে আছেন, সে খবর পেয়ে ইসহাক চৌধুরী বৃষ্টিতে ভিজে, রোদে পুড়ে ধূলিধূসরিত হয়ে ঘর্মাক্ত কলেবরে পৌঁছে গেছেন সেই কৃষকের পর্ণকুটিরে গুটি গুটি পায়ে। তারপর কত কাকুতি মিনতি, হাতে পায়ে ধরে সেই পুঁথি হস্তগত করে পটিয়া থানার দক্ষিণ হুলাইনে তাঁর বাড়িতে এসে পৌঁছেছেন। সাহিত্যের যে দিকটায় ইসহাক চৌধুরী হাঁটাহাঁটি করেছেন, সেখানে প্রথম পদধূলি দেন প্রাতঃস্মরণীয় মহাপুরুষ হরপ্রসাদ শাস্ত্রী, আবদুল করিম সাহিত্য বিশারদ, দীনেশ চন্দ্র সেন, নীহাররঞ্জন রায়, স্যার যদুনাথ সরদার, রাখাল দাশ বন্দ্যোপাধ্যায়। তার পর একে একে পায়ের ছাপ পড়ে নলিনী কান্ত ভট্টশালী, ড. আহমদ হাসান দানী, ড. মুহম্মদ শহীদুল্লা, আরসি মজুমদার, ‘হারামণি’র লেখক অধ্যাপক মুহাম্মদ মনসুর উদ্দিন, ড. মুহম্মদ এনামুল হক, অধ্যাপক সালাহউদ্দিন আহমদ, অধ্যাপক মমতাজুর রহমান তরফদার, ড. মোহর আলী, ড. আবদুল গফুর, ড. আবদুল করিম, আশুতোষ, চৌধুরী, ড. আহমদ শরীফ, আবদুল হক চৌধুরীর।

ইসহাক চৌধুরীর পিতা আবদুস সাত্তার চৌধুরী ছিলেন শিক্ষক। পটিয়া থানার দক্ষিণ হুলাইন গ্রামে ছিলো তাঁর বাড়ি; সাহিত্যবিশারদের বাড়ি থেকে মাত্র মাইল তিনেক দূরত্ব। সাহিত্য বিশারদ একদিন তাঁকে ডেকে পুঁথি সংগ্রহের কাজ দেন। সেই যে পুঁথির প্রেমে পড়লেন তিনি, সারা জীবনেও আর তার মায়া কাটাতে পারলেন না। ছেলে অর্থাৎ ইসহাক যখন চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের বাংলা বিভাগে ভর্তি হলো, তখন তাকেও পুঁথি সংগ্রহের কাজে নিয়োজিত করলেন। পুঁথির প্রেমে মজে কোথায় না গেছেন সাত্তার মাস্টার; সমগ্র চট্টগ্রাম জেলা, যার মধ্যে বর্তমান কঙবাজারও অন্তর্ভুক্ত ছিলো, সম্ভবত নোয়াখালী, কুমিল্লা, রাজশাহী, সিলেটের দিকেও তিনি খোঁজাখুঁজি শুরু করেছিলেন। শুধু যে পুঁথি তার অনুসন্ধানের বিষয় ছিলো তা নয়, তিনি প্রাচীন দলিল-দস্তবেজ, পাণ্ডুলিপি, পুস্তকও উদ্ধার করেছিলেন। তাঁর মুর্শিদ সাহিত্যবিশারদের প্রয়োজন মিটিয়েও তাঁর হাতে এত পুঁথি থেকে গেলে যে, সেগুলি তিনি বাংলা একাডেমি, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়, রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়, বরেন্দ্র রিসার্চ মিউজিয়াম, চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়কে দান করেন। তারপরেও অন্তত হাজার দুয়েক পুঁথি তার হাতে উদ্বুত্ত থেকে যায়। তিনি সেগুলি পুত্রকে দান করেন। অদ্ভুত উত্তরাধিকার ! ধন নয়, মান নয়, দিলেন কিছু পুঁথি আর পুঁথির প্রতি অজস্র ভালোবাসা। সাত্তার সাহেবকে সৈয়দ আলী আহসান সাহেব চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ে চাকরি দিয়েছিলেন, তিনি বসতেন লাইব্রেরিতে। বেশ কয়েকবার আমি সেখানে গিয়েছি তাঁর সঙ্গে দেখা করতে। আমি অর্থাৎ তাঁর বন্ধু হুলাইনের আবদুস সালাম মাস্টারের ভ্রাতুষ্পুত্র ও কবি নূর মুহম্মদ চৌধুরী সাহিত্যরত্নের পুত্র বাঙলা সাহিত্য পড়তে বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি হয়েছে সেটা জেনে তিনি খুব খুশি হয়েছিলেন।

পিতার কাছে হাতেখড়ি হয়েছিলো পুঁথি পাঠে; পিতার দেহত্যাগের পর ইসহাক নিজেও পুঁথির জগতে ডুব দেন; তারপর কত যে মনি মুক্তা কুড়িয়ে তুললেন, যেগুলি তিনি সারস্বতজনের সেবায় দান করে যান। বাংলাদেশে এমন ক’টি পরিবার আছে আমি জানি না, যে পরিবারে পুরুষানুক্রমে পুঁথি সাহিত্যের চর্চা হয়েছে। কিন্তু আবদুস সাত্তার চৌধুরীর পরিবারে দুই পুরুষ ধরে পুথি সাহিত্যের চর্চা হতে আমরা দেখলাম। মৃত্যুতে তাঁর পুথি গবেষণা নিঃশেষিত হয়ে যায় নি। তাঁর পিতার সংগৃহীত পুঁথি এবং তিনি নিজে যা সংগ্রহ করেছিলেন, সেসব সুবিন্যস্ত করে তিনি তাঁর পিতার নামে একটি সংগ্রহশালা প্রতিষ্ঠা করে গেছেন। তিনি চেয়েছিলেন দেশী-বিদেশি গবেষকের এক তীর্থস্থান হয়ে উঠুক আবদুস সাত্তার চৌধুরী পুঁথি সংগ্রহশালা।

ইসহাক যেক্ষেত্রে অনন্য, সেটা হলো পুঁথির পাঠোদ্ধার; বাংলাদেশে এখন মিউজিয়াম, আর্কাইভস্‌ এবং কিছু লাইব্রেরি হয়েছে। বাংলা একাডেমি, এশিয়াটিক সোসাইটি তো রয়েছেই। সব বিশ্ববিদ্যালয়ের বাংলা বিভাগ ও লাইব্রেরি এবং মিউজিয়ামগুলি থেকে পুঁথি সাহিত্যের ওপর ক’জন বিশেষজ্ঞ সৃষ্টি হয়েছে আমি জানি না। কিন্তু আমার কেমন জানি মনে হচ্ছে, ইসহাক চৌধুরীর মৃত্যুতে এক্ষেত্রে একটি শূন্যতা সৃষ্টি হয়েছে। পুঁথি সাহিত্যে প্রচুর রস আছে, কিন্তু সে রস আস্বাদনের জন্য মধ্যযুগ, অষ্টাদশ ও ঊনিশ শতকের ভাষার জটিল অরণ্যে প্রবেশের অধিকার অর্জন করতে হবে। পুঁথি-পাণ্ডুলিপি ও প্রাচীন দলিল-দস্তাবেজ পাঠ একটি টেকনিক্যাল সাবজেক্ট, ইসহাক চৌধুরী সেক্ষেত্রে এমন একটি এঙপার্টাইজ অর্জন করেছিলেন যে, বাংলা সাহিত্যের শিক্ষকদেরকেও পুঁথি সংশ্লিষ্ট কোন কোন বিষয়ে ইসহাক চৌধুরীর স্মরণাপন্ন হতে আমি দেখেছি। চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ে আমি সর্বশেষ অধ্যাপক সুলতান আহমদ ভূঁইয়াকে এ বিষয়ে একজন পণ্ডিত ব্যক্তি হিসেবে দেখেছি। তাঁর স্থলাভিষিক্ত কে হয়েছেন আমি জানি না।

আবদুল হক চৌধুরীও একটা দিকে দক্ষতার পরিচয় দিয়েছেন। সেটা হচ্ছে ভূমির দলিল, খতিয়ান, পাট্টা ইত্যাদি পাঠ তিনি আয়ত্ত করেছিলেন এবং তার ভিত্তিতে এমন এক ঐতিহাসিক কীর্তি স্থাপন করেছেন যে, তাঁকে কুর্ণিশ করতে হয়। তাঁর রচিত বই ইতিহাসের গণ্ডি অতিক্রম করে সমাজ-ইতিহাসে পরিণত হয়েছে। শ্রদ্ধেয় ড. আবদুল করিম যেমন শিলালিপি ও মুদ্রা পাঠে অথরিটি হয়ে উঠেছিলেন। ড. আলমগীর সিরাজুদ্দীন সাহেবও কোম্পানি আমলে চট্টগ্রামের ভূমি রাজস্ব বিষয়ে একটি উৎকৃষ্ট অভিসন্দর্ভ রচনা উপহার দিয়েছেন।

ইসহাক চৌধুরী আমার সহপাঠী, বন্ধু, সহোদরপ্রতিম এবং আত্মার আত্মীয় ছিলেন। আমার লেখার তিনি একজন উৎসাহী পাঠক ছিলেন। লেখালেখির ব্যাপারে আমার আলস্য এবং গা ছাড়া ভাব লক্ষ করে তিনি খুব বিচলিত হয়ে পড়তেন এবং আমার অফিস ও বাসায় এসে আমাকে ভর্ৎসনা করেছেন, উৎসাহ যুগিয়েছেন।
চট্টগ্রামের সাহিত্য, সংস্কৃতি ও ইতিহাস চর্চার অনেক বিষয়ে ইসহাক চৌধুরী বিশেষজ্ঞ ছিলেন। সংবাদপত্রের ফিচার সম্পাদক ও সাহিত্য সম্পাদকরা তাঁকে বেশ কদর করতেন। চট্টগ্রামের সংবাদপত্র, বলীখেলা, মধ্যযুগের কবি এবং সংস্কৃতিক অনুষ্ঠানের জন্য ইসহাক চৌধুরীর দ্বারস্থ হওয়া ছাড়া তাদের কোন উপায় ছিলো না। ১৯৯৯ সালে আমরা যখন চট্টগ্রামের তৎকালীন ভারপ্রাপ্ত জেলা প্রশাসক নজরুল ইসলাম সাহেবের অনুপ্রেরণায় নজরুল জন্মশতবার্ষিকী উদযাপনের উদ্যোগে নিয়েছিলাম, তখন ইসহাক চৌধুরীই ছিলেন আমাদের রিসোর্স পারসন।

ইসহাক চৌধুরী রাজনীতি করতেন না। কিন্তু আমার সঙ্গে বন্ধুত্বের কারণে স্বাধীনতার পর ১৯৭৩ সালে দেশের প্রথম সাধারণ নির্বাচনে তিনি পটিয়া থেকে জাসদের প্রার্থী অ্যাডভোকেট বদিউল আলম সাহেবের নির্বাচনী এজেন্ট হয়েছিলেন হুলাইন ছালেহ-নূর কলেজ কেন্দ্রে। কিন্তু সন্ত্রাসীরা তাঁকে মেরে ধরে কেন্দ্র থেকে বের করে দেয়। তাঁর পিতাকে নিয়েও এমন একটি নির্বাচনী ঘটনা আছে। আইয়ুবের আমলে সম্ভবত ১৯৬২ সালে বিডি নির্বাচনে আবদুল সাত্তার চৌধুরী বিডি মেম্বার নির্বাচন হয়েছিলেন। একজন চেয়ারম্যান প্রার্থী তাঁর আনুগত্য সম্পর্কে নিশ্চিত হতে না পেরে তাঁকে হাইজ্যাক করেছিলেন। নির্বাচনী ফলাফল ঘোষণার পর তাঁকে ছেড়ে দেয়া হয়।

Print Friendly, PDF & Email

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here