সাতকানিয়া উপজেলার কেওচিয়া এলাকার মো. জহির। এলাকায় তার ১০ কানি (১ দশমিক ৬ হেক্টর) জমির মধ্যে মাত্র ৩ কানিতে চাষাবাদ করতে পারেন। তাও আমন মৌসুমে। বাকিগুলো নানা কারণে তিনি পতিত রেখেছেন। ৭ কানি বা প্রায় ১ দশমিক ১ হেক্টর আবাদযোগ্য জমি তিনি ফেলে রেখেছেন। এসব জমিতে কোনো ফসল উৎপাদন করতে পারেন না। কারণ ইটভাটাগুলো এসব জমির টপ সয়েল কেটে নেয়াতে মাটি উর্বরতা হারিয়েছে। শুধু ইটভাটা নয়, নিচু এলাকায় পানি নিষ্কাশন ব্যবস্থা না থাকাসহ নানা কারণ উল্লেখ করেন জহির।
এদিকে বৈশ্বিক খাদ্য সংকট থেকে বাংলাদেশকে মুক্ত রাখতে আবাদযোগ্য প্রতি ইঞ্চি জমিতে
ফসল ফলাতে দেশবাসীর প্রতি আহবান জানিয়েছেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। এ নিয়ে প্রশাসনের পক্ষ থেকে জমিগুলো আবাদযোগ্য করার জন্য গণ-বিজ্ঞপ্তি জারি করে। এতে বলা হয়-‘কোনো কৃষি জমি পরপর ৩ বছর অনাবাদি থাকলে বিদ্যমান আইন অনুযায়ী সরকারের নিয়ন্ত্রণে নেয়ার বিধান রয়েছে। কোন ব্যক্তি তার জমি কৃষি কাজে ব্যবহার না করে পতিত রাখলে উক্ত জমি রাষ্ট্রীয় অধিগ্রহণ ও প্রজস্বত্ব আইন ১৯৫০ এর ৯২ (১) এর (গ) ধারা মোতাবেক খাস করা হবে। এমতাবস্থায়, আবাদযোগ্য জমি পতিত না রেখে আবাদ করার জন্য সর্বসাধারণকে অনুরোধ করা হয়েছে। অন্যথায় বিদ্যমান আইন অনুযায়ী অনাবাদি জমি খাস করা হবে।’

কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তর সূত্রে জানা গেছে, চট্টগ্রাম জেলায় আবাদযোগ্য জমির পরিমাণ ২ লক্ষ ২৮ হাজার ৯৬৬ হেক্টর। এরমধ্যে আবাদ হচ্ছে ২ লক্ষ ১৪ হাজার ৮১০ হেক্টরে। পতিত রয়েছে ১৪ হাজার ১৫৬ হেক্টর জমি। এর মধ্যে লোহাগাড়া উপজেলায় ৫১০ হেক্টর, সাতকানিয়ায় ৫৫০ হেক্টর, চন্দনাইশে ৪০০ হেক্টর, আনোয়ারায় ৩৫০ হেক্টর, বাঁশখালীতে ৬৫০ হেক্টর, বোয়ালখালীতে ৫৫০ হেক্টর, কর্ণফুলীতে ২০০ হেক্টর, পটিয়ায় ৭৫০ হেক্টর, মিরসরাইয়ে ২০০০ হেক্টর, সন্দ্বীপে ৩০০০ হেক্টর, সীতকুন্ডে ৩৫০ হেক্টর, হাটহাজারীতে ৬৫০ হেক্টর, রাউজানে ১১০০ হেক্টর, ফটিকছড়িতে ২৫৪৬ হেক্টর এবং রাঙ্গুনিয়ায় ৫৫০ হেক্টর আবাদযোগ্য পতিত জমি রয়েছে। আবাদ না হওয়ার কারণ হিসেবে নিচু এলাকার কিছু জমিতে পানিতে তলিয়ে গেছে, আবার কিছু জমি কচুরিপানা ও ঘাসে ভরে গেছে। অর্থাৎ, চাষাবাদের অনুপযোগী হয়ে পড়েছে এসব জমি। যার কারণ হিসেবে বলা হচ্ছে- সেচ সুবিধার অভাব, খাল ভরাট হয়ে যাওয়া, নিচু এলাকায় পানি নিষ্কাশন ব্যবস্থা না থাকা, ¯øুইস গেট নির্মাণ ও ব্যবস্থাপনার অভাব, চরের জমি বন্দোবস্ত না হওয়া, দুর্গম এলাকা, পাহাড়ের পাদদেশের জমিতে বন্যহাতির আক্রমণ, জলাবদ্ধ এলাকায় জোঁকের উপদ্রব, ভূমি মালিকদের অনাগ্রহ ও ইটভাটার জন্য টপ সয়েল কেটে নেয়া।
সেসব জমিকে চাষের আওতায় আনতে কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তর ও স্থানীয় প্রশাসন কাজ করে যাচ্ছে। গতকাল বৃহস্পতিবার কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তর চট্টগ্রামের উপ-পরিচালকের কার্যালয়ে গেলে এসব তথ্য উঠে আসে।
স্থানীয়রা জানান, প্রায় দুই দশক থেকে গ্রামাঞ্চলে শিল্প-কারখানার দ্রæত প্রসার ঘটেছে। নদী-খাল ও বড় সড়কের আশপাশের আবাদি জমির ওপর গড়ে ওঠেছে এসব কারখানা। এছাড়াও ক্রমবর্ধমান জনসংখ্যার চাপে কৃষি জমির ওপর নির্মাণ করা হচ্ছে বাড়ি-ঘর। শিল্পায়ন ও বাড়িঘর নির্মাণে খাল-বিল হারিয়ে যাচ্ছে। পানি নিষ্কাশনের ব্যবস্থা বন্ধ হয়ে যাওয়ায় জমিতে জলাবদ্ধতা সৃষ্টি হচ্ছে। পরে এসব জমি চাষের অনুপযোগী হয়ে যাচ্ছে। এছাড়াও শিল্প-কারখানার দূষিত বর্জ্য ফেলা হয় নদী ও খাল-বিলে। এতে আশপাশের জমির উর্বরাশক্তি হ্রাস পায়। ফসল উৎপাদন কমে যায়। অপর দিকে চাষাবাদের খরচ বেড়ে যাচ্ছে। এরফলে চাষাবাদে আগ্রহ হারিয়ে ফেলছেন কৃষকেরা।
চট্টগ্রাম জেলায় আবাদযোগ্য পতিত কৃষি জমির বিষয়ে নানা সমস্যার কথা তুলে ধরেন কৃষকরা। তাদের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, সেচের সংকট, সেচ-চাষাবাদের খরচ বেড়ে যাওয়া, বর্ষায় জলাবদ্ধতা সৃষ্টি, কৃষিজীবী মানুষের জীবিকার সন্ধানে শহরমুখী হয়ে পড়া, শ্রমিক সংকট, কৃষিকাজে নতুন প্রজন্মদের অনাগ্রহ ও একান্নবর্তী পরিবার ভেঙে যাওয়ায় চাষাবাদ দিন দিন কমে যাচ্ছে। এছাড়াও গ্রামাঞ্চলে শিল্পায়নের ছোঁয়ার বড় প্রভাব পড়েছে কৃষিজমিতে। পতিত ও অনাবাদি জমিসহ বিপুল পরিমাণ জমি কমে যাচ্ছে শিল্প-কারখানা স্থাপনে।
চন্দনাইশের দোহাজারী এলাকার মো. কামাল উদ্দিনও একসময় বিভিন্ন সবজির চাষ করলেও এখন বীজ ও সেচের দাম বাড়ার কারণে তিনিও সবজি চাষ বন্ধ করে এখন গাড়ির হেলপার হিসেবে কাজ করছেন। তিনি বলেন, ‘কৃষি যন্ত্রপাতি, সেচ-কীটনাশক ও শ্রমিক খরচ অনেক বেড়ে গেছে। খরচ পোষায় না। ক্রমবর্ধমান জনসংখ্যার চাপে কৃষিজীবী মানুষ জীবন-জীবিকার খোঁজে শহরমুখী হয়ে পড়েছেন। এছাড়াও শিক্ষিত ও নতুন প্রজন্মের মধ্যে কৃষিকাজে অনাগ্রহ রয়েছে। এসব কারণে কৃষিজমি অনাবাদি পড়ে থাকছে’।
কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তরের কর্মকর্তারা বলছেন, সেচ সুবিধার সম্প্রসারণ, বিশেষ করে এলএলপি, ফিতা পাইপ, বারিড পাইপ ব্যবহার করে সেচের এলাকা বৃদ্ধি করা, খাল খনন, স্লুইচ গেট নির্মাণ এবং নির্মাণ পরবর্তী সময়ে দক্ষ ব্যবস্থাপনা, চরের জমি বন্দোবস্ত প্রদান, বিশেষ প্রণোদনার মাধ্যমে পাহাড়ি এলাকা ও পাহাড়ের পাদদেশের পতিত জমিতে ফলবাগান স্থাপন ও নিচু এলাকায় কচু জাতীয় সবজির চাষ করা গেলে অনাবাদি জমি আর থাকবে না। এতে ফসল, সবজি ও ফলের চাহিদার সংকট কমে আসবে।
কর্মকতাদের হিসাবমতে, প্রতিবছর ১ শতাংশ হারে আবাদি জমি কমে যাচ্ছে। ইটভাটা, কলকারখানা, ঘরবাড়ি, স্কুল-কলেজ স্থাপন ও রাস্তাঘাট নির্মাণের কারণে কৃষি জমি অকৃষি খাতে চলে যাচ্ছে।
জেলা কৃষি স¤প্রসারণ অধিদপ্তরের উপপরিচালক মো, আক্তারুজ্জামান পূর্বদেশকে বলেন, আমরা প্রণোদনা কর্মসূচির মাধ্যমে ফসল উৎপাদনে উৎসাহিত করছি। চাষযোগ্য পতিত জমিগুলো আমরা চিহ্নিত করা শুরু করছি। এসব জমিতে কি কারণে চাষ করা যাচ্ছে না তা কৃষকদের থেকে জেনে তা সমাধান করা হবে। সুতরাং, পতিত জমিগুলো চাষাবাদের আওতায় আনার জন্য আমরা সর্বোচ্চ চেষ্টা করছি।
এদিকে চট্টগ্রামে সরকারি-বেসকারি প্রতিষ্ঠানের পতিত জমিতে সবজি বাগান করার নির্দেশ দিয়েছেন চট্টগ্রামের জেলা প্রশাসক মো. মমিনুর রহমান। পাশাপাশি পতিত জমিতে সবজি চাষের মাধ্যমে যারা অগ্রগতি দেখাবেন তাদের পুরস্কার দেওয়ার ঘোষণা দেওয়া হয়েছে। জেলা শিক্ষা অফিসার, প্রাথমিক শিক্ষা অফিসার, বন বিভাগ, সিভিল সার্জনসহ সরকারি ও স্বায়ত্তশাসিত প্রতিষ্ঠানকে তাদের চত্বরের পতিত জমিতে সবজি চাষের জন্য নির্ধারিত টার্গেট দেওয়া হয়েছে। সেক্ষেত্রে আজ (শুক্রবার) ও আগামীকাল শনিবার সব প্রতিষ্ঠানকে তাদের চত্বরের পতিত জমি চাষাবাদ উপযোগী করে গড়ে তোলার নির্দেশনা দেওয়া হয়েছে। একই সঙ্গে পরের সপ্তাহে তাতে সবজি বাগান করার জন্য নির্দেশনা দেওয়া হয়েছে। এই কার্যক্রমকে ফলপ্রসু করতে একটি সুন্দর প্রতিযোগিতার মাধ্যমে সব প্রতিষ্ঠান তাদের চত্বরের পতিত জমিতে সবজি চাষের মাধ্যমে যারা উল্লেখযোগ্য অগ্রগতি দেখাবেন তাদের প্রথম, দ্বিতীয়, তৃতীয় স্থান নির্ধারণ করে পুরস্কার দেওয়া হবে।
সকল উপজেলা নির্বাহী অফিসারকে উপজেলায় পতিত জমি নির্ধারণ করে তা চাষাবাদের আওতায় আনতে কার্যকর ভূমিকা রাখতে নির্দেশা দেওয়ার পাশাপাশি আশ্রয়ণ প্রকল্পের প্রতিটি উপকারভোগী যেন তাদের বসবাসের স্থানের পতিত জায়গা ফেলে না রাখে এবং সবজি চাষ করেন সে বিষয়ে কার্যকরী ব্যবস্থা নিতে বলা হয়।

Print Friendly, PDF & Email

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here