স্বপ্না রেজা:

অবশেষে পেঁয়াজ হালিতে বিক্রি হওয়া শুরু হয়েছে। পত্রিকার পাতায় সংবাদ ছাপা হয়েছে। কল্পনা করা না গেলেও এটা সত্য ঘটনা। আজব আজব লাগলেও সত্য। দুঃস্বপ্ন হলেও সত্য। পেঁয়াজের আকাল এখন দেশে। পেঁয়াজের অস্বাভাবিক মূল্য বৃদ্ধি পেয়েছে এখন দেশে। অতীতে এমন নজির নেই যে, পেঁয়াজ হালিতে বিক্রি হয়েছে। সহজলভ্য থেকে পেঁয়াজ এখন দুর্লভ বস্তুতে পরিণত হয়ে হালিতে ঠেকেছে। অদূর ভবিষ্যতে পেঁয়াজ বিলুপ্ত ফসল হয়ে না যায় আবার। জনগণের ক্রয় সীমার বাইরে চলে গেলে পেঁয়াজ খাবার ইচ্ছে তো আর বেঁচে থাকবে না কারোর। এভাবে একদিন পেঁয়াজ খেতে ভুলে যাবে এদেশের মানুষ। কেউ কেউ আবার বলতে শুরু করেছেন এমন কথা, পেঁয়াজ দিয়ে রান্না করতেই বা হবে কেন? পেঁয়াজ ছাড়া রান্না হোক। রান্না করাও যায়।

স্বপ্না রেজা – ফাইল ছবি।

তাদের দাবি, তারা পেঁয়াজ ছাড়া তরকারি খেতে শুরু করেছেন। তাদের ঘরে পেঁয়াজের অস্তিত্ব নেই। এটা হতে পারে পেঁয়াজ চাহিদা অনুযায়ী না পাওয়ার ফলে জনগণের হাহাকার থেকে সৃষ্ট ক্ষতের ওপর সংশ্লিষ্টদের মলম দেয়ার একটা কৌশল মাত্র। মানুষকে শান্ত রাখার প্রচেষ্টা হতে পারে। বিশ্বাস করি তারাও বোঝেন যে, পেঁয়াজের ঘাটতির সমাধান কেবল পেঁয়াজ না খেয়ে থাকা নয়। এসব আবেগের কথা কিন্তু এমন আবেগ কতটা জনগণের চাহিদার পাশে বন্ধু হয়ে দাঁড়ায় ভাবা দরকার। প্রয়োজন বোধ এক কঠিন বাস্তবতা। যাকে আশ্বস্ত করতে হয় প্রয়োজন মিটিয়েই, কথায় নয়।

যাই হোক, পেঁয়াজ ছাড়া তরকারি রান্না, এমনটি বাংলাদেশের রাঁধুনিরা, খাদকেরা ভাবতেই পারেন না। ভাবা যায় না। অভ্যাসও নেই পেঁয়াজ ছাড়া তরকারি রান্নার, খাবারের। রুচি তো নেই-ই। অবস্থাদৃষ্টে মনে হচ্ছে, পেঁয়াজ নিয়ে গবেষণা ও কর্মশালা এবার শুরু হতেও পারে। গবেষক ও চিন্তাবিদরা কাজ করার বিষয় পেয়ে যেতে পারেন। একদিন এসব গবেষণা ও ধারণা পাঠ করে উত্তরসূরিরা জানবে যে, সহজলভ্য পেঁয়াজ কীভাবে একদিন দুর্লভ হয়ে পড়েছিল। আর রাজনৈতিক দল বিএনপি তো আন্দোলন করার একটা সুযোগ পেয়েই গেলেন। খালেদা জিয়ার মুক্তি ছাড়া তো তারা কোনোই ইস্যু পাচ্ছিলেন না রাজনৈতিক কাজকর্মে। হয়তো এই দল আরো কদিন সভা, সমাবেশ আর বক্তৃতা দেয়ার সুযোগ পাবেন, যদি না অতিসত্বর পেঁয়াজকে নিয়ন্ত্রণে আনা সম্ভব হয়।

এতদিন হাঁস আর মুরগির ডিম হালিতে কিনে খেতো মানুষ। এখন পেঁয়াজ সেই লাইনে দাঁড়িয়ে গেছে। কেজি, মণ ছেড়ে হালির খাতায় পেঁয়াজ জায়গা পেয়েছে। মানুষ এখন হালিতে পেঁয়াজ কিনে খাচ্ছে, খাবার কথা ভাবছে। এসব কারণে পত্রিকার পাতায় প্রতিদিন সংবাদ হচ্ছে পেঁয়াজ। সেলিব্রেটি রীতিমতো। এটা সত্য যে, মানুষের মতো পেঁয়াজের দু’পা নেই যে, সে হেঁটে গিয়ে ডিমের লাইনে দাঁড়িয়ে গেছে। পেঁয়াজ হলো ডিমের মতোই বহন করে নেয়ার জড়বস্তু। যা সরবরাহের মাধ্যমে মানুষের নাগালে পৌঁছায়। একটা শ্রেণি এসব সরবরাহ করেন। যারা ব্যবসায়ী, মজুদদার হিসেবে প্রতিষ্ঠিত। এসব সরবরাহ হয় বিভিন্ন বাহনে যেমন- ট্রাক, ভ্যান, নৌকা, কার্গোশিপ ইত্যাদিতে।

যদিও সরকার ঘোষণা দিয়েছেন, উড়োজাহাজ করে এবার পেঁয়াজ দেশে আসছে ঘাটতি পূরণে, জনগণের চাহিদা মেটাতে। উড়োজাহাজের কথা শুনে সাধারণ মানুষ কি খুশি হলো? মোটেও না। পেঁয়াজের তীব্র ঘাটতিতে জনগণের ভেতর যে ক্ষোভ, অসন্তোষ, সেটা প্রশমনে উড়োজাহাজ এক কৌশল হতে পারে বলে অনেকেই মনে করেন। অনেকেই কিন্তু তেমনটাই ভাবছেন। কারণ, উড়োজাহাজ তো সাধারণ মানুষের কল্পনার জগতের এক বাহন। পেঁয়াজ সেই সাধারণ মানুষের কল্পনার বাহন উড়োজাহাজ চড়ে এসে বাস্তব হয়ে দেখা দেবে, সেও বা কম কী, এমনটি ভাবা কিন্তু রীতিমতো ফ্যান্টাসি। মানুষ কিন্তু বেশ সচেতন। নিজের প্রয়োজন সে নিজেই মেটায় এবং তা অর্থমূল্যে। যাই হোক, হালিতে বিক্রি হওয়ায় নিঃসন্দেহে পেঁয়াজের স্ট্যাটাস বেড়েছে। মানে দাম (মর্যাদা) বেড়েছে।

পাঠক ভাববেন না যে, এখন হোটেলে খেতে গিয়েই চাক চাক করে কাটা পেঁয়াজ প্লেটে সাজানো অবস্থায় পেয়ে যাবেন। সহজেই টেবিলে পরিবেশন করার সাহস দেখাবেন না ওয়েটার। মালিকের বারণ থাকবে বরং ওরকম সালাদের দাম নির্ঘাত মাছ, মাংসের তরকারির চাইতে বেশি হাঁকবে। হয়তো মেন্যুতে লেখা থাকবে বিভিন্ন দেশের পেঁয়াজ অনুযায়ী সালাদের দাম। যেমন, মিসরের পেঁয়াজের সালাদ, মিয়ানমারের পেঁয়াজের সালাদ, পাকিস্তানের পেঁয়াজের সালাদ, চীনের পেঁয়াজের সালাদ ইত্যাদির ওপর দাম নির্ধারণ করা হবে। শুধু সালাদ কেন, হয়তো বিভিন্ন দেশের পেঁয়াজ দিয়ে রান্নার আইটেমগুলোও ভিন্ন দামে বিক্রির সুযোগ ঘটবে ব্যবসায়ীদের।

একজন বলছিলেন মজা করে, মিসর বা তুরস্কে যাওয়ার আর্থিক ক্ষমতা কোনোদিন তার হবে না কিন্তু সেই দেশের পেঁয়াজ নিজ দেশে বসে খাবার ক্ষমতা সরকার তাকে করে দিচ্ছে, কম কী। পেঁয়াজের আকাল না হলে তো তার মিসরের পেঁয়াজ খাবার সৌভাগ্য হতো না। এমন কথায় কি কর্তৃপক্ষ আনন্দে উদ্বেলিত হবেন? হওয়া উচিত নয়। পেঁয়াজের মতন ফসল আমদানি করে খাওয়া, অন্যকে খাওয়ানোর ভেতর কৃতিত্ব নেই। আমাদের দেশের এত সুন্দর আবাদি মাটি থাকতে, পরিশ্রমী কৃষক থাকতে, বাংলাদেশ তো কৃষিনির্ভর একটা দেশ, ভুলে গেলে চলবে কী করে !

সাধারণত দেখা যায় যে, যখনই দেশে কোনো নিত্যপ্রয়োজনীয় দ্রব্যের ঘাটতি দেখা দেয়, তখন তার ঘাটতির কারণ অনুসন্ধান না করে এবং অভ্যন্তরীণভাবে উৎপাদনের চাইতে বিদেশ হতে আমদানি করে ঘাটতি মেটানোর জোর পাঁয়তারা চলে। আমদানির প্রবণতা বেড়ে যায়। চাহিদার তীব্রতায় সরকার জনগণকে আশ্বস্ত করেন, অতি শিগগিরই ঘাটতি পূরণ করার এবং তা আমদানির মাধ্যমে। এতে বারবার আমদানিকারক শ্রেণি স্বস্তি, শক্তি পান। পান হৃষ্টপুষ্ট হয়ে ওঠার সুযোগ। প্রাকৃতিক দুর্যোগে আশানুরূপভাবে আবাদি ফসল না হওয়া, অস্বাভাবিক কিছু নয়।

জনগণকে সেই ঘাটতি বা ক্ষতি বা অভাব মেনে নিতেই হয়। মেনে নেন কিন্তু কোনো ব্যক্তি বা গোষ্ঠী দ্বারা সৃষ্ট সঙ্কট তো মেনে নেয়া যায় না। কেন মানবেন জনগণ। কথাটা বলছি এ কারণে যে, সম্প্রতি আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক এবং সড়ক পরিবহন ও সেতুমন্ত্রী বলেছেন, যাদের কারণে পেঁয়াজের দাম বেড়েছে, তাদের চিহ্নিত করার চেষ্টা চলছে। তার কথায় স্পষ্ট যে, এই ঘাটতি এক শ্রেণির মানুষ কর্তৃক সৃষ্ট, এটা প্রাকৃতিক দুর্যোগে সৃষ্ট কোন ঘটনা নয়। যেটা সরকার ইতোমধ্যে টের পেয়ে গেছে। নিশ্চিত তাদের হাতে তথ্য আছে। প্রশ্ন জাগে, কারা এতটা দুঃসাহসিকতার পরিচয় দিচ্ছেন তাহলে?

দুষ্টচক্র পেঁয়াজের বাজারকে অস্থিতিশীল করার সুযোগ কী করে পেল, যদি সত্যিই বাণিজ্য মন্ত্রণালয়ের সুষ্ঠু ব্যবস্থাপনা নিয়ন্ত্রণ থাকে এবং আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী সংস্থা অপরাধ দমনে সক্রিয় থাকে? বিষয়টি কি পুরনো গল্পের মতন শোনায় না যে, থানার সামনেই ক্যাসিনোর জমজমাট ব্যবসা চলেছে বহুদিন ধরে অথচ থানার কাছে কোনো তথ্য ছিল না কিংবা বিভিন্ন ক্লাবের সঙ্গে সক্রিয় থেকেও প্রভাবশালীরা জানতেন না যে, তার ক্লাবে ক্যাসিনো চলে? হাস্যকর। চালাকরা যখন অন্যকে বোকা ভাবেন, তখন তারা কোনোভাবেই বুঝতে পারেন না যে, তাদের চালাকি বোকারা অনায়াসে বুঝে যায়। এভাবে বোকারা একদিন তাদের চাইতে বেশি চালাক হয়ে ওঠেন।
আকাল আর হাহাকারে মনে হচ্ছে, পেঁয়াজ দিয়ে রান্না মাছ, মাংস, ডিম ভুনাসহ বিভিন্ন তরকারির রেসিপি উঠে যাবে রন্ধন শিল্পের ঐতিহ্য থেকে। প্রচার মাধ্যমে অনেক সাধারণ মানুষ এমন দুঃখ নিয়ে সেই ইঙ্গিত দিচ্ছেন। কোনো কোনো প্রচার মাধ্যম আবার বসে নেই। ব্যবসায়িক দৌড়ে রন্ধন বিষয় নিয়ে প্রচারণা শুরু করেছেন।

রন্ধনশিল্পী দ্বারা প্রচারিত হচ্ছে পেঁয়াজ ছাড়া রান্নার কৌশল ও স্বাদের বয়ান অথচ বাঙালির আহার সংস্কৃতিতে সুস্বাদু বিষয়টি অন্যসব মসলার পাশাপাশি পেঁয়াজের ওপর অনেকটা নির্ভরশীল। তাই সবাই পেঁয়াজের আকাল, অস্বাভাবিক মূল্যবৃদ্ধি মেনে নিতে পারছেন না। বড় সত্য দরিদ্র মানুষদের অনেকেই এখনো কাঁচা মরিচ, পেঁয়াজ, লবণ দিয়ে ভাত খান। পহেলা বৈশাখে বাঙালিদের পান্তা খাবার হিড়িককে কেউ কেউ ফ্যাশন বা কৃত্রিমতা বলে উল্লেখ করলেও মূলত বাঙালি সংস্কৃতির একটা বৈশিষ্ট্য কিন্তু এতে নিহিত থাকে। কৃষকের ঘরে প্রায় প্রতিদিন কাঁচা মরিচ, পেঁয়াজ, লবণ দিয়ে পান্তা খাবার রেওয়াজটা কিন্তু মিথ্যে নয়। সময়ের পরিবর্তনে আচার-আচরণ, অভ্যাসের পরিবর্তন ঘটলেও পান্তা খাবার রেওয়াজ মুছে যায়নি। এসব ক্ষেত্রে আধুনিক রন্ধন প্রণালির কোনো স্থান নেই, চাহিদা নই।

পরিশেষে বলব, পেঁয়াজ সঙ্কট দূর করার জন্য কেবল উড়োজাহাজে চড়িয়ে দেশে আনা নয় বরং পেঁয়াজ উৎপাদনে যত্নবান হওয়া, কৃষককে সহায়তা করা, বাণিজ্য ব্যবস্থাপনায় মেধা-দক্ষতার দৃশ্যমান উপস্থিতি, অসাধু ব্যবসায়ীদের চূড়ান্ত শাস্তির আওতায় আনা জরুরি হয়ে পড়েছে। বাংলাদেশ কৃষিনির্ভর একটি দেশ- এমন বোধ কাগজ, কলমে এবং কাজে থাকলে, ফসলের সঙ্কট হওয়ার কথা নয়।

লেখক -স্বপ্না রেজা : কথাসাহিত্যিক ও কলামিস্ট।

Print Friendly, PDF & Email

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here