নাসির উদ্দিন হায়দার
অধ্যাপক আবদুল মান্নান গত ৩০ জানুয়ারি চট্টগ্রামে এসেছিলেন জেলা প্রশাসন ও হাটখোলার উদ্যোগে গুণীজন সম্মাননা অনুষ্ঠানে অংশ নিতে। সেখানে গুীণজন হিসেবে সংবর্ধিত করা হয় অধ্যাপক আবদুল মান্নান, সংগীতজ্ঞ আবদুল গফুর হালী ও নারীনেত্রী নুরজাহান খানকে।
অধ্যাপক মান্নান চট্টগ্রামের জন্য অতিথি নন, তিনি তো চট্টগ্রামেরই কৃতী সন্তান। কাজের সূত্রে দীর্ঘদিন ঢাকায় থাকেন বলে চট্টগ্রামের অতিথি বলায় তার বেশ আপত্তি। অনুষ্ঠানের আগে শিল্পকলা একাডেমির অফিসকক্ষে ঘরোয়া আড্ডায় কথা হয় সমকালের সাথে।
প্রসঙ্গত, অধ্যাপক আবদুল মান্নান ১৯৭২ সালে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ব্যবস্থাপনা বিভাগ থেকে সম্মানসহ স্নাতকোত্তর ডিগ্রি লাভ করেন। ১৯৭৩ সালে চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের ব্যবস্থাপনা বিভাগে প্রভাষক পদে যোগ দেন। তার জন্ম চট্টগ্রামের হাটহাজারী এলাকায়।
আলাপচারিতার শুরুতেই উঠল চট্টগ্রামের ভাষা প্রসঙ্গ। আবদুল মান্নান বললেন, ‘আমি তো চট্টগ্রামের মানুষ পেলে চট্টগ্রামের ভাষায়ই কথা বলি। আমার খুব ইচ্ছে কোনো অনুষ্ঠানে আঞ্চলিক ভাষায় বক্তব্য দিতে।’ চট্টগ্রামের ভাষার কথা যেহেতু উঠেছে অবধারিতভাবে এলো চট্টগ্রামের গান তথা আঞ্চলিক গান প্রসঙ্গ। সেখানে তখন ছিলেন চাটগাঁইয়া গানের কিংবদন্তি শিল্পী আবদুল গফর হালীও। প্রসঙ্গটা তুললেন অধ্যাপক মান্নানই। বললেন, ‘ছোটবেলায় আঞ্চলিক গান শুনে আমরা কত আনন্দ করেছি। মোহাম্মদ নাসির, মলয় ঘোষ দস্তিদার, অচিন্ত্যকুমার চক্রবর্তীর গান তো এখনও কানে বাজে। গানে গানে শেফালী ঘোষ-শ্যামসুন্দর বৈষ্ণবের হাস্যরস-কী মজার ছিল!’
অধ্যাপক মান্নান যোগ করলেন, চট্টগ্রামের একজন শিল্পীর কথা কিন্তু আলাদা করে বলতে হবে। তিনি হলেন মোহাম্মদ নাসির। কারণ এই নাসিরই চট্টগ্রামের গানকে নিয়ে গেছেন উপমাহদেশীয় গণ্ডিতে। মোহাম্মদ নাসিরের কণ্ঠেই প্রথম হিন্দুস্থান রেকর্ড থেকে চট্টগ্রামের গানের রেকর্ড বের হয়েছে।
আমি যোগ করলাম, ‘স্যার মোহাম্মদ নাসিরের প্রথম রেকর্ড বের হয়েছে এইচএমভি থেকে, ১৯৩২ সালে। রেকর্ডে দুটো মাইজভাণ্ডারী গান ছিল। এটা ঠিক মোহাম্মদ নাসিরের কণ্ঠেই প্রথম চাটগাঁইয়া গানের বিশ্বায়ন হয়েছে।’ শিক্ষা ও সঙ্গীতের দুই দিকপাল আবদুল মান্নান ও আবদুল গফুর হালী তাতে সম্মতি জানালেন।
এবার স্যার স্মরণ করলেন ফটিকছড়ির নানুপুরের কৃতী সন্তান কাওয়ালী
গানের সম্রাট আবু কাওয়ালকে। আবু কাওয়ালের কথা উঠতেই স্মৃতির ঝাঁপি খুলে দিলেন আবদুল গফুর হালী। আবু কাওয়ালের সাথে তার অনেক স্মৃতি, একসাথে গান করার, ঘোরাঘুরি করার।
অধ্যাপক মান্নান বললেন, ‘যৌবন বয়সেও আমরা আবু কাওয়ালের গান শুনতে ব্যাকুল ছিলাম। তিনি কাওয়ালী গান গেয়ে বিপুল খ্যাতি পেয়েছিলেন। তার খ্যাতি ছিল সারাদেশে। আবু কাওয়ালের ফার্সি শের শুনে মানুষ কাঁদত।’
আবদুল গফুর হালী জানালেন, আবু কাওয়াল ছিলেন উপমহাদেশের প্রখ্যাত কাওয়াল কালু কাওয়ালের শিষ্য।
‘আবু কাওয়ালের ছেলে সৈয়দ আমিনুল ইসলামের কাওয়ালিও আমার বেশ পছন্দ।’ বললেন অধ্যাপক মান্নান।
হাটখোলা সেদিন পিঠ উৎসব করেছিল। কথা হলো সেটা নিয়েও। ‘পিঠাপুলি এখন উৎসবের বিষয় হয়ে গেছে। নগরায়ন আর আকাশ-সংস্কৃতির কারণে আবহমান বাংলার অনেক ঐতিহ্য জাদুঘরে ঠাঁই নিচ্ছে। আগে মা-নানিদের অফুরন্ত সময় ছিল। তারা সারা বছর হরেক রকম পিঠা বানাত। এখন তো গ্রামেও নগরায়নের প্রভাব পড়ছে। সেখানে বিদ্যুৎ গেছে, গেছে দেশ-বিদেশের চ্যানেল। মেয়েরা এখন পিঠা তৈরির চেয়ে হিন্দি সিরিয়ালে বেশি মগ্ন। ফলে আবহমান বাংলার পিঠা সংস্কৃতিতে আকাশসংস্কৃতির নেতিবাচক প্রভাব পড়ছে। শহরে তো অবস্থা আরও খারাপ। এখানকার ছেলেমেয়েরা পিঠাই চেনে না। তারা তো পিৎজা আর বার্গারে মত্ত।’
জেলা প্রশাসন ও হাটখোলা যে পিঠা উৎসবের আয়োজন করেছে সেটা বাংলার চিরায়ত সংস্কৃতির জাগরণে ভূমিকা রাখবে বলে আশাপ্রকাশ করলেন এই বরেণ্য শিক্ষাবিদ।
কথা কথায় বেলা বাড়ে। ডাক পড়ে অনুষ্ঠানে যাওয়ার। যাওয়ার আগে বরেণ্য এই শিক্ষাবিদ বলে গেলেন-আশাহত হওয়ার কারণ নেই। বাঙালি বীরের জাতি। তারা মূল হারায় না। তাই বাঙালিত্বের চেতনা কখনও বাসি হয় না।