মুহাম্মদ নাজিম উদ্দিন

পরম করুণাময় আল্লাহতায়ালা মানুষকে সৃষ্টির সেরা জীব হিসেবে সৃষ্টি করেছেন এবং তারই উপকারের জন্য সৃষ্টি করেছেন এ সুন্দর ধরণী। মানুষের প্রতি আল্লাহতায়ালার এ অসীম অনুগ্রহের পেছনে তার নিশ্চয় উদ্দেশ্য রয়েছে। এ সম্পর্কে তিনি নিজেই বলেছেন-আমি জ্বীন ও মানব জাতিকে আমার ইবাদত বন্দেগী করা ব্যতীত অন্য কোন উদ্দেশ্যে সৃষ্টি করিনি। কিন্তু দুনিয়াতে পৌঁছে মানুষ সেই প্রতিশ্রুতি ভুলে যায়। সেই দিকভ্রান্ত জাতিকে হেদায়তের জন্যে তিনি প্রেরণ করেছেন নবী-রাসুল। আল্লাহর এ মনােনীত ধর্মকে সারা বিশ্ব প্রচার প্রসারের জন্যে যুগে যুগে প্রেরণ করেছেন নবী রাসুল (দ.) গুণ সমৃদ্ধ অলি, দরবেশ, সুফি, মনীষী, সাধক ও মহাসাধক। তেমনি এক অনির্বাণ জ্যোতিষ্ক আধ্যাত্মিক সাধক পুরুষ শাহসুফি মওলানা আবুল খায়ের নক্সবন্দি (রহ.)। সর্বত্যাগী এ সাধক পুরুষ তাঁর দার্শনিক চিন্তাশক্তি ও লেখনীর গুণে মানুষের কুপ্রবৃত্তি বিদূরিত করার প্রয়াস চালিয়ে গেছেন আজীবন।

বার আউলিয়ার স্মৃতিধন্য পুণ্যভূমি এ চট্টগ্রাম। চট্টগ্রাম শহরের অতি সন্নিকটে অসংখ্য পীর, আউলিয়া, পাহাড় ঘেরা, নদী বিধৌত, প্রাকৃতিক সৌন্দর্যের লীলা নিকেতন আনােয়ারা থানা। এ থানার অন্তর্গত পাখি ডাকা ছায়াঘেরা শান্ত-স্নিগ্ধ জনপদ পূর্ববরিয়া গ্রাম। এগ্রামে ১৯০৮ সালে হযরত শাহসুফি মৌলানা আবুল খায়ের নক্সবন্দি (রহ.) দেহ লাভ করেন। তাঁর পিতা নেয়ামত আলী শাহ (রহ.) ও একজন ধর্মপরায়ন কামেল ব্যক্তি ছিলেন এবং মাতা ছুরত জামান ছিলেন বড়ােই ধর্মশীলা। মাতা-পিতার চারিত্রিক গুণাবলী তাঁর বাল্যজীবনে বিশেষভাবে প্রতিফলিত হয়। তিনি স্থানীয় প্রাইমারী মক্তবের পাঠ শেষ করে আনােয়ারা হাই স্কুলে এন্ট্রান্স শ্রেণীতে অধ্যয়নকালে তাঁর পিতা পরলােকগমন করেন। এরপর আর্থিক অনটনের দরুন ইংরেজি শিক্ষা ত্যাগ করে চট্টগ্রাম দারুল উলুম মাদ্রাসায় ভর্তি হন। সেখানে পাঁচ বছর শিক্ষা লাভের পর ১৯২৯ সালে কলিকাতা মাদরাসায় ভর্তি হন। এখান থেকে ফাইনাল মাদরাসা বা ইউনিভারসিটি পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হন। ১৯৩০ সালে হিন্দুস্থান মুরাদাবাদ মাদ্রাসা হতে হাদীসে দাওয়া উত্তীর্ণ হয়ে ভারত ভ্রমণে বহির্গত হন। এই ভারত ভ্রমণের অন্যতম উদ্দেশ্য ছিল ফকির, দরবেশ, সাধু-সন্ন্যাসীর সঙ্গ লাভ করা। এর ফলে তার মনে আধ্যাত্মিক জগতে প্রবেশেরস্পৃহা জাগে এবংআধ্যাত্মিকতার বীজ রােপিত হয়। এই সুপ্ত আকাংখা অন্তরে লালন করে ১৯৩২ সালে মাতৃভূমিতে ফিরে আসেন। এই সময় এসে অন্তর জগতের সন্ধান লাভের জন্য তার মন ব্যাকুল হয়ে ওঠে। এই ব্যাকুলতার প্রভাবে আরম্ভ করলেন কঠোর সাধনা এবং নিরবচ্ছিন্ন জ্ঞান আহরণ। সাধনা বা আধ্যাত্মিক জগতের গুপ্ত রহস্য আবিষ্কারের সাথে সাথে তার মানসিক অবস্থাও ধীরে ধীরে পরিবর্তন লক্ষ্য করা হয়। ফলে মাতার আদেশ এই মাতৃভক্ত মহাপুরুষ উপেক্ষা করতে না পেরে ১৯৩৩ সালে বিবাহ বন্ধনে আবদ্ধ হন এবং জীবীকা অর্জনে শিক্ষকতা পেশা গ্রহণ করেন। চট্টগ্রামের প্রাণ প্রবাহিনীনদী কর্ণফুলীর বুকে পতিত পূর্বাঞ্চলীয় পাহাড়ী অঞ্চল থেকে নেমে আসা এক স্রোতস্বিনী যার নাম বােয়াখালী। অসংখ্য পীর-আউলিয়া, জ্ঞানী-গুণী, ঋষি-মনীষী, কবি-সাত্যিক, সাংবাদিক বুদ্ধিজীবীদের জন্মস্থান এ পুণ্যভূমি শহরতলী বােয়ালখালী। কোন এক শুভ মুহূর্তে এই মহাপুরুষ জন্মস্থান ত্যাগ করে কাকতালীয়ভাবে এ থানার অন্তর্গত পুণ্যভূমি গোমদন্ডী গ্রামে ইসমত আলী মুন্সির মসজিদ সংলগ্ন ফোরকানিয়া মাদ্রাসায় শিক্ষকতা শুরু করেন। পরবর্তীতে গোমদন্ডী বহদ্দার পাড়ার মিয়াজীর বাড়িতে গৃহ শিক্ষক থেকে পশ্চিম গোমদন্ডী বহদ্দারপাড়া প্রাইমারী স্কুল প্রতিষ্ঠা করেন। স্বাধীনতা যুদ্ধের সময় এ স্কুলে মুক্তি বাহিনীর ঘাঁটি করা হয় এবং এখান থেকে গােলা, বারুদ ও যুদ্ধের রসদ সামগ্রী সংগ্রহ এবং যুদ্ধ পরিচালনা করা হয়। মহান শিক্ষকতা পেশাকে তিনি সমাজসেবা ও জাতি গঠনের হাতিয়ার রুপে গ্রহণ করেছিলেন। তিনি জীবনের শেষ মুহূর্ত পর্যন্ত নিজেকে এ মহৎ পেশা ও ধর্ম দেশনায় নিয়ােজিত রেখেছিলেন। ফলশ্রুতিতে তাঁরই উৎসাহ উদ্দীপনা ও অনুপ্রেরণায় প্রতিষ্ঠিত হয় গোমদণ্ডী পাইলট উচ্চ বিদ্যালয়, বােয়ালখালী কলেজ। বিংশ শতাব্দীর পঞ্চাশ দশকের মাঝামাঝিতে গোমদন্ডী বহদ্দারপাড়ায় এক খণ্ড জমি ক্রয় করে তাঁর হুজরা স্থাপন করেন।

এই মহানুভব ব্যক্তি জাতিভেদ বা ধর্মভেদের গণ্ডি অতিক্রম করে এক বিশাল মানব ধর্মের অস্তিত্ব সাগরে বিহার করেন। যা তিনি নিজেই লিখে গেছেন-“সর্ব জাতি ও সর্ব জীবকে মিত্র ভাবনায় বিশ্বপ্রেম সৃষ্টি হয়। সেই প্রেমই নিষ্কাম প্রেম।” তাই তিনি সাধকাগ্রণী মাইজভাণ্ডারী তরিকার প্রাণপুরুষ গাউসুল আজম মাইজভাণ্ডারী হযরত মাওলানা সৈয়দ আহমদ উল্লাহ (ক.), খুলনার সাধক প্রবর মৌলানা খুল নবী (রহ.), মহাসাধক শ্রী জগদানন্দ, মুক্তাত্মা শ্রী শ্রী গিরিজানন্দ (বালক সাধু), স্বামী অদ্বৈতানন্দ, স্বামী শ্ৰদ্ধানন্দ ইত্যাদি মুসলিম ও হিন্দু সমাজের বহু মহা মানবের সাথে মিলিত হয়ে আধ্যাত্মিক জগতের রস আস্বাদন করতে প্রয়াসী ছিলেন। মানুষ প্রধানত ইন্দ্রিয় প্রত্যক্ষণ, প্রজ্ঞা এবং অতিন্দ্রীয় বা সজ্ঞা-এই তিন পথে জ্ঞান অর্জন করে থাকেন। পরম সত্ত্বা বা স্রষ্টাকে জানার ক্ষেত্রে সুফি সাধকেরা অতিন্দ্রীয় অনুভূতি তথা সজ্ঞার উপর সমধিক গুরুত্ব আরােপ করে থাকেন। সুফিরা পরম সত্ত্বা বা স্রষ্টার মধ্যে আত্মবিলােপন। করতে চান। প্রেম এবং ভক্তির বলে প্রেমময় খােদার সান্নিধ্য। লাভই তাদের প্রধান লক্ষ্য। তিনি নিজেই লিখেছেন, “ধ্যান ছাড়া জ্ঞান হয় না।” “জ্ঞান ছাড়া মুক্তি নাই।”

এই মহান পুরুষ তার আধ্যাত্মিক সাধনালব্ধ জ্ঞান সমাজে প্রতিফলন করার জন্য রচনা করেছিলেন সহস্রাধিক গান। তাঁর মহামূল্যবান গ্রন্থাবলী ও সঙ্গীতাবলী বর্তমান নৈতিক অবক্ষয়ের যুগে আলােকবর্তিকা বললেও অত্যুক্তি হবে না। গবেষণা ও আধ্যাত্মিকধর্মী তার মূল্যবান গ্রন্থগুলিতে তিনি ঐশীপ্রেমের মাধ্যমে মানবমুক্তির দিক নির্দেশনা দিয়েছেন। ১৯৬১ সালে তাঁর প্রথম সঙ্গীতের বই “অগ্নিশিখা” প্রকাশিত হয়। পরবর্তীতে তাঁর রচিত “ভাবের বাশী”, “ প্রেম লহরী”,“জীবন সখা”, “ভক্তিমালা”, “শান্তি বীণা” ও “নূর লহরী” প্রভৃতি সঙ্গীতের পুস্তকাবলী প্রকাশিত ও অপ্রকাশিত পাণ্ডুলিপি সুধীসমাজ ও শিক্ষিতমহলে তার কদর বাড়িয়ে দেয়। ১৯৭৬ সালে “ফানা ফিল্লার পথে (মুক্তির পথে) এই মহামূল্যবান আধ্যাত্মিক গ্রন্থটি প্রকাশিত হলে দেশের সুধীজনরা এ গ্রন্থ পাঠ করে আধ্যাত্মিক জগতের এক আশার আলাের দ্বার উন্মােচন করেন। তাঁর লিখনীর মাধ্যমে তিনি যে শুধু আধ্যাত্মিক মহাপুরুষই নন, তিনি যে একজন দার্শনিক, কবি ও গবেষক অতি সহজেই এই চিত্র পরিস্ফুটিত হয়ে ওঠে। তাঁর লিখা থেকে পরিষ্কার বুঝা যায়, “মেদীনি, পক্ষী, মেঘ, চন্দ্র, সূৰ্য্য, নক্ষত্র, শূন্যমণ্ডল। এই মণ্ডলাদি মহাশূন্যে বিরাজমান। রাসুলের শবে মেরাজ সম্বন্ধে বলতে গেলে তিনি এই মণ্ডলের কথা উল্লেখ করেন।” বা “বৈজ্ঞানিক সাধন বলে চালােকে মানব সন্তান যাওয়া যেমন সহজ সাধ্য। আধ্যাত্মিক সাধন বলে সাকার স্বরূপ মানব দেহ নিরাকার হওয়া সহজ সাধ্য।” অথবা “সূর্য ছাড়া জগত নয়, প্রেম ছাড়া জীবন নয়।” অমানিশার এ ঘাের অন্ধকারে এসব রচনাবলী বড়ই দুর্লভ।

তিনি ১৯৭২ সালে ফি (৫২)/৭২-৪০৫৯ নং চুক্তিমালামূলে বাংলাদেশ বেতারের তালিকাভুক্ত গীতিকার হন। পরবর্তীকালে সুধী সমাজের কাছে পরিচিতি হন সুফি ও কবি আবুল খায়ের রূপে। যারা সত্যিকারের প্রেমিক, ভাবুক ও সঙ্গীতপ্রিয় তাদেরকে সেই সঙ্গীতাবলী ও গ্রন্থাবলী নিঃসন্দেহে দোলা দেবে। তাঁর গান, বাণী মানুষের নৈতিক চরিত্র গঠনে বড়ই সহায়ক। তাই তাঁর অপ্রকাশিত গ্রন্থাবলী প্রকাশ করা ও প্রকাশিত দুর্লভ গ্রন্থগুলি পুনঃমুদ্রণ এখন সময়ের দাবি। কারণ এসব দুর্লভ গ্রন্থাবলী আমাদের নৈতিক অধঃপতনের দুর্দিনে আলাের দিশারী হিসেবে পাথেয় হয়ে থাকবে। এতে কোন সন্দেহ নেই।

এই আধ্যাত্মিক সাধকের ২কার্তিক ১৩৮০ বাংলা, ২১ রমজান ১৩৯০ হিজরী, ১৯ অক্টোবর ১৯৭৩ ইংরেজি শুক্রবার মহাপ্রয়াণ ঘটে। বহদ্দার পাড়ায় তাঁর স্বীয় আস্তানায় দাফন করা হয়। জীবন যেখানে আছে, সেখানে আছে মৃত্যু। এই অমােঘ নিয়মের ব্যতিক্রম ঘটিয়ে যে জীবন মৃত্যুহীন হয়ে থাকে তা নিশ্চয়ই মহৎ, মহাজীবন। কিন্তু এমহাজীবন বড়ই দুর্লভ। যে স্থানে, যে বংশে, যে যুগে তাঁর জন্ম সেই স্থান-কাল-পাত্র ধন্য হয়ে যায়। কবির ভাষায় বলা চলে…..।

সেই ধন্য নরকূলে, লােকে যারে নাহি ভুলে

মনের মন্দিরে নিত্য সেবে সর্বজন।

ওফাতের পূর্বে তিনি ১৯৬২ সালে বােয়ালখালী সাব রেজিস্ট্রার অফিসে তাঁর যাবতীয় সম্পত্তি ফি-সাবেলিল্লাহ ওয়াকফা দলিল নং ৭০৭৬ এবং ১৫ এপ্রিল ১৯৭৩সালে তাঁর লিখিত অছিয়তনামা সম্পাদন করেন। তাঁর অছিয়তনামা অনুসারে ভক্ত, শিষ্য ও মুরীদানগণ তকালীন পটিয়া মহকুমা প্রশাসকের অনুমােদনক্রমে ১৯৭৪ সালে পাঁচ বছর মেয়াদী কমিটি গঠন করা হয়। পরবর্তী পর্যায়ক্রমে পরিচালনা কমিটির মাধ্যমে খায়ের মনজিল দরবার শরীফ ও খায়েরিয়া মাদ্রাসা প্রতিষ্ঠানিক রূপলাভ করেন। উক্ত প্রতিষ্ঠান ওয়াকফ প্রশাসকের অনুমােদিত বিধিমালা ইসি ১৬০৭৬ অনুসারে পরিচালনা কমিটি দ্বারা পরিচালিত হয়ে আসছে। বর্তমানে কমিটির গুরু দায়িত্ব পালন করছেন বিশিষ্ট সমাজসেবক, শিক্ষানুরাগী জনাব এস. এম. আবু তাহের। ১৯৮৬ সালে বাংলাদেশ টেলিভিশন পাশা/বিবিধ/৩০০/০১/৮৬ চুক্তিমূলে মৌলভী আবুল খায়ের (রহ.)’র নাম গীতিকার রূপে নিবন্ধকরণ করা হয় এবং ১৯৮৬ সালে ডি.টি.ভি/নং-৮১/৩৯০ নং চুক্তিমূলে খায়ের মনজিল দরবার শরীফ বাংলাদেশ। টেলিভিশনের শিল্প গােষ্ঠী হিসেবে অনুমােদন লাভ করেন।

প্রতি বছর ১ ফালয়ুন, ২ কার্তিক তাঁর পবিত্র খােশরােজ শরীফ ও ওফাত দিবস অনুষ্ঠিত হয়। দরবার শরীফে নক্সবন্দি তরিকানুসারে আধ্যাত্মিক গবেষনা, সেমিনার, ধর্মীয় আলােচনা, রেয়াজত বা সংযম সাধনা এবং তাঁরই রচিত আধ্যাত্মিক সঙ্গীত প্রতিযােগিতাসহ সুফিবাদ কার্যক্রম অনুষ্ঠিত হয়ে আসছে। এই মহান সুফিসাধক সুফিবাদ সাধনায় তাঁর লিখনীতে সাহিত্য, সূর ও ছন্দের সাহায্যে আধ্যাত্মিক জ্ঞান অকাতরে বিলিয়ে দিয়েছেন এবং মানব কল্যাণে ব্রতী হয়ে জ্ঞানী, গুণির এক উজ্জ্বল দৃষ্টান্ত রেখে গেছেন। আল্লাহ্পাক আমাদেরকে যেন এ পথে চলার তৌফিক দিন। আমিন! বেহুরমতে সৈয়্যেদিল মুরসালিন।

সহায়কগ্রন্থ : ফানা ফিল্লার পথে (মুক্তির পথে)।

আরো পড়ুন :

আত্মশুদ্ধি ছাড়া সিদ্ধি লাভ অসম্ভব

Print Friendly, PDF & Email

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here