বায়েজিদ বোস্তামী আমাদের দেশের ধর্মপ্রাণ মানুষের কাছে অলৌকিক এক ব্যক্তিত্ব, ঈশ্বর ভক্তের প্রতীক, অনুকরণীয় এক ইসলামী আদর্শ বলে স্মরিত। প্রচলিত আছে তাঁর হাত ধরে বাংলাদেশে ইসলাম প্রচারের কল্প কাহিনী, অভাব নেই শ্রদ্ধা ভক্তি মিশানো গাল গল্পের, আছে এক সুবিশাল কথিত মাজার বার আউলিয়ার দেশে বলে খ্যাত চট্টগ্রাম শহরের অদূরে। মোদ্দাকথায় তিনি এক ধ্রুব তারা বাংলার ইসলামী ধর্ম আকাশে। মরণোত্তর বায়েজিদের প্রতিভাসিত প্রচলিত কাহিনীর বাতায়নে স্বাভাবিকভাবে প্রশ্ন আসে তিনি কি সত্যি বাংলার মাটিতে কখনো পদ ধুলি দিয়েছিলেন? বাংলাদেশের ইসলাম প্রচারে সরাসরি তাঁর কি কোন ভূমিকা আছে? এর এক কথায় উত্তর- না। ধর্মীয় বিশ্বাসের উত্তপ্ত হাওয়া সাধারণ খেটে খাওয়া মানুষের বিচার বুদ্ধি কতখানি দূরীভূত করে, ধর্মের রঙিন বর্ণনা কি ভাবে তাদের নেশা গ্রস্থ করে রাখে, তারা যে সত্য অসত্য বিচারে তথ্য প্রমাণের খোজ রাখে না, ধর্মের অলৌকিকত্বে সহজে মুগ্ধ হয়ে তারা ছাইপাসেও পূর্ণ বিশ্বাস আনে- তার উজ্জ্বল দৃষ্টান্ত বায়েজিদ বোস্তামী সম্পর্কে প্রচলিত গল্পকথা।
ছোট বেলায় বাবার সাথে একবার গিয়েছিলাম সেই মাজার দেখতে। মাজারের কোন মর্মার্থ বুঝার বয়স তখনো হয়নি আমার, বায়েজিদ কে ছিলেন তাও জানতাম না। সেখানে গিয়ে ধাক্কা খেয়েছি কিছু মানুষের মাজার সন্মুখে উচ্চঃস্বরে ক্রন্দন দৃশ্য দেখে (সম্ভবত জীবণ যুদ্ধে পরাজয়ের প্রচন্ড হতাশা থেকে) এই দৃশ্য আমাকেও ব্যথিত করেছে, আবার মজা পেয়েছি মাজারের সামনের এক পুকুরে ইয়া বড় বড় কচ্ছপের বিচরণ দেখে, তাদের খাইয়ে।
কচ্ছপের কথা যখন উঠেই গেছে তখন এই ফাঁকে এই বিরল প্রজাতির কচ্ছপ নিয়ে দু-চার কথা বলে নিই। এর বৈজ্ঞানিক নাম হল অ্যাসপিডেরিটিস নাইগ্রিক্যান্স। প্রাণিবিজ্ঞানী অ্যান্ডারসন ১৮৭৫ সালে সর্বপ্রথম ভারতের জাদুঘরে রক্ষিত দুটি নমুনা থেকে বোস্তামীর কচ্ছপের প্রজাতিটির সন্ধান পান। রক্ষিত নমুনা দুটি ছিল চট্টগ্রামের বায়েজিদ বোস্তামী পুকুর থেকে সংগৃহীত। ১৯১২ সালে প্রাণিবিজ্ঞানী এন এনানডেলের মতে বোস্তামীর কচ্ছপ একসময় ব্রহ্মপুত্র নদের অববাহিকা থেকে মিয়ানমার পর্যন্ত বিশাল এলাকাজুড়ে বিচরণ করত। এই পুকুরে কচ্ছপ গুলো কিভাবে এল এতদিন পরে তা জানার কোন উপায় নেই আজ। তবে যেভাবে আসুক না কেন মাজারের এই পুকুরে শত শত বছর ধরে বাস করা কাচ্ছপগুলো বিশ্বে প্রায় বিলুপ্ত হয়ে যাওয়া প্রজাতির তা নিয়ে সন্দেহের কোন অবকাশ নেই। এই প্রজাতির কচ্ছপ এতই দূর্লভ ১৯১৪ সালে প্রাণিবিজ্ঞানী এন এনানডেলের ও অন্য প্রাণিবিজ্ঞানী এম শাস্ত্রী এক গবেষণায় উল্লেখ করেন বোস্তামীর কচ্ছপ বর্তমানে শুধু চট্টগ্রামের বায়েজিদ বোস্তামী মাজার সংলগ্ন পুকুরেই টিকে আছে। পৃথিবীর কোথাও এই প্রজাতির কচ্ছপ আর দেখা যায় না। ২০০২ সালে পরিবেশ ও প্রকৃতি সংরক্ষণে আন্তর্জাতিক সংস্থা, আন্তর্জাতিক প্রকৃতি ও প্রাকৃতিক সম্পদ সংরক্ষণ সংঘ (IUCN) কর্তৃক বোস্তামী কচ্ছপ কে চরমভাবে বিলুপ্তপ্রায় প্রজাতি হিসাবে তালিকাভুক্ত করা হয়। তাই এই কচ্ছপেরর ওপর ২০০৭ সালে ন্যাশনাল জিওগ্রাফি চ্যানেল এক ডকুমেন্টারি তৈরি করে নিয়ে যায়। এগুলোর অন্যতম বৈশিষ্ট্য- আকারে এই কচ্ছপ অনেক বড় হয় এবং ওজনও নাকি বেশি হয়। কালের সাক্ষ্যি হয়ে শত শত বছর এদের বেঁচে থাকার অপূর্ব ক্ষমতা আছে। মিথ প্রচলিত আছে বায়েজিদ বোস্তামী নিজে এসব কচ্ছপ চট্টগ্রামে নিয়ে এসেছিলেন।আবার কেউ কেউ বিশ্বাস করেন বায়েজিদ দুষ্ট জ্বীনদের কচ্ছপ বানিয়ে বন্ধী করে রেখেছেন।
দুঃখজনক খবর জীব বৈচিত্রের নিদর্শন নিরীহ এই কচ্ছপগুলোকে ২০০৪ সালের মে মাসে একবার পুকুরে বিষ ঢেলে এদের বংশ র্নিবংশ করার চেষ্টা করা হয়েছিল কিন্তু জাতীয় বন্যপ্রাণী ব্যবস্থাপনা ও প্রকৃতি সংরক্ষণ বিভাগ চট্টগ্রামের ত্বরিত পদক্ষেপে কোনমতে রক্ষা পেয়ে যায় কচ্ছপ গুলো।
বায়েজিদ বোস্তামী ৮০৪ খ্রীষ্টাব্দে ইরানের বোস্তাম শহরে জন্ম গ্রহণ করেন এক ধর্মাশ্রিত পরিবারে। আগেকার দিনে কিছু কিছু দেশে নামের শেষে জন্ম গ্রহণকারী অঞ্চলের নাম জুড়ে দেওয়ার রীতি বেশ প্রচলিত ছিল। তারি ধারাবাহিকতায় তাঁর নামের শেষে বসে যায় বোস্তামী শব্দটি। বোস্তামী মানে- বোস্তাম শহরের বাসিন্দা। পিতা মাতার দেওয়া তাঁর নাম ছিল আবু ইয়াজিদ বিস্তামী। তাঁর পিতার নাম ছিল তয়ফুর। বাবার নামানুসারে আবার কেউ কেউ তাঁকে ডাকেন তায়ফুর আবু ইয়াজিদ আল্ বোস্তামী নামে। তখন পৃথিবী জুড়েই ঝাঁকিয়ে বসেছিল ধর্মীয় উন্মাদনার গণজোয়ার। একে অন্যের সাথে প্রতিযোগিতা করে মানত ধর্মীয় অনুশাসন। সবার মনের গহীনে কম বেশি উঁকি দিত ধর্মীয় ব্যক্তিত্ব হওয়ার স্বপ্ন।
বায়েজীদের বাবা চাচা সবাই বেশ কঠোর ধর্ম চর্চা করতেন। শোনা যায় তাঁরা তপস্বী ছিলেন। তাঁর পিতামহও ছিলেন বেশ ধার্মিক প্রকৃতির লোক। তিনি কোন এক সময়ের প্রতাপশালী এক ঈশ্বরবাদের সূচনাকারী ধর্ম জরোষ্টার ত্যাগ করে গ্রহণ করেছিলেন ইসলাম। অর্থাৎ ঈশ্বরের উপর বিশ্বাস ও আস্থা ঠিক রেখেই বদলিয়েছেন শুধু লেবেলটা। এই লেবেল বদলানোর পিছনে কাজ করেছে নিঃসন্দেহে ইরানের রাজনৈতিক ক্ষমতা ও পারিপার্শ্বিক পট পরিবর্তনের সামাজিক ও রাষ্ট্রীয় প্রভাব। ইসলাম প্রতিষ্ঠার বাঁশিতে ফু দিয়ে নবিজী নিজে যে যুদ্ধ শুরু করেছিলেন সেই যুদ্ধকে আরো বিস্তৃত রূপ দেন তাঁর মৃত্যু পরবর্তী ইসলামী শাসকেরা। ইসলাম প্রচারের চেয়েও এই যুদ্ধে তাদের নগদ লাভ হত পররাজ্য, ক্ষমতা, প্রাচুর্য্য, বিত্ত বৈভব, প্রচুর দাস ও গনিমতের মাল হিসাবে অবস্থাপন্ন পরিবারের অসংখ্য সুন্দরী মেয়ে। এই সব নগদ প্রাপ্তির লোভ তাদের যুদ্ধে প্রলুব্ধ করত সব সময়। তাছাড়া ক্রমাগত যুদ্ধ জয়ে তাদের মানসিক শক্তি হয়ে পড়েছিল বেশ দৃঢ়, আত্মবিশ্বাস ছিল তুঙ্গে, যুদ্ধবিদ্যা ও রণকৌশলে হয়ে গিয়েছিল অত্যন্ত পারদর্শী, তাদের কাছে মূহুর্তে যে কাউকে হত্যা করা ছিল মামুলি কাজ।
শুধু ২য় খলিফা ওমরের শাসনামলের যুদ্ধের বছর গুলো হিসাব করলে প্রতিটি মানবতা সম্পন্ন বিবেকবান মানুষ বুঝতে পারবে আরব জাহান জুড়ে কি ত্রাসের রাজত্ব তিনি কায়েম করেছিলেন(অমুসলিমদের জন্য), কত হাজারো নিরীহ মানুষের জীবণ নিয়েছেন, কত মানুষকে বানিয়েছেন দাস-দাসী, কত প্রাচীণ সভ্যতা ও সংস্কৃতি তিনি ধ্বংস করে সেখানে বুনেছেন শান্তির বীজ! সেই বীজ আজ মহীরুহ ধারণ করে আছে সমগ্র আরব অঞ্চল জুড়ে।
During the reign of Omar Ibne Khattab, another father in law, 2nd Caliph (r 634-644)
For expanding the domain of Islam:
1) Battle of bridge in Iraq (Muslims defeated by Persian) – 634 CE
2) Battle of Fihl, Damascus (Syria) – 635 CE
3) Battle of Yermuk (decisive battle against Byzantine) – 636 CE
4) Battle of Qadisiya in Iraq and Madain – 636 CE
5) Battle of Jalula – 637 CE
6) Battle of Yarmuk (conquest of Jerusalem and Jazirah) – 638 CE
7) Conquest of Khujistan and movement into Egypt – 639 CE. Conquest of Egypt, lead by Amr bin al-‘As – 640 -641CE
9) Battle of Nihawand (final defeat of Persians) – 641-642 CE
10) Battle of Ray in Persia – 642 CE
11) Conquest of Azerbaijan – 643 CE
12) Conquest of Fars – 644 CE
৬৩৪-৬৪৪ সাল এই দশটা বছর তাঁর শাসনামল কেটেছে ১২টা রক্তক্ষয়ী যুদ্ধ করে। যুদ্ধ মানেই প্রচুর ক্ষয়ক্ষতি, ধ্বংস, রক্তারক্তি, সম্পদহানি, অন্যের জান তুলে নিয়ে নিজের জান বাঁচানোর মর্মান্তিক খেলা। কিন্তু ইসলামের ক্ষেত্রে বিষয়টা হয়েছিল উল্টো। যুদ্ধে প্রচুর নগদ কড় কড়ে লাভ বয়ে আনত ইসলামীদের। সেজন্য অস্ত্র হাতে নিয়ে নতুন দেশ আক্রমণে তারা মোটেই কুন্ঠিত হতো না।
শান্তিপূর্ণ ভাবে ইসলাম প্রচারই যদি তাদের মূখ্য উদ্দেশ্য হত তাহলে মক্কা মদীনা ছেড়ে দূরবর্তী আরবের অনান্য দেশ যেমন- ইরাক, সিরিয়া, মিশর, কাজাকিস্তান, ইরান, জেরুজামেন ইত্যাদি খ্রীষ্টান, ইহুদি, প্যাগান, জরোষ্টার অধ্যুষিত অঞ্চলে ক্ষুধার্ত হায়েনার মত ঝাঁপিয়ে পড়ার যৌক্তিক প্রযোজন ছিল বলে জোরালো কোন প্রমাণ পাওয়া যায় না। এও প্রমাণ মেলেনা এই সব দেশে কোরান, পীর, দরবেশ ও ইসলামী বিশ্বাসীদের দিয়ে ইসলাম প্রচারের চেষ্টা করতে। স্মর্তব্য এই সমস্ত দেশগুলোর শাসক ও জন সাধারণ স্বেচ্ছায় ইসলামকে মেনে না নিলেও কখনোই ইসলামীদের আক্রমণের লক্ষ্যবস্তু করেনি। মুসলমানেরাই বরং তাদের আক্রমণ করে তাদের রাজ্য দখল করে সর্বত্র ইসলামীকরণ করেছিল বিজিত দেশেগুলোতে। ইরানো তার ব্যতিক্রম নয়। যা আমরা উপরে ওমরের শাসনামলে আক্রমণের তালিকায় দেখেছি। ফলে বায়েজিদের পিতামহ স্বেচ্ছায় ইসলাম গ্রহণ করেছিলেন সেই দাবি উদ্ভুত পরিস্থিতির পারিপার্শ্বিকতার বিচারে প্রশ্নবিদ্ধ থেকেই যায়। পারস্য অর্থাৎ ইরানীদেরও যে দাস হতে হয়েছিল ইসলামের শাসকদের তা সন্দেহাতীত ভাবে প্রমাণ হয় ইসলামের ২য় খলিফা ওমরের খুনি হিসাবে আবু লুলু ফিরোজ নামের এক পার্সীয়ান দাসের নাম উঠে আসায়।
পারস্য তথা ইরানের লোকেরা এক সময় ইসলাম গ্রহণ করলেও এখানে ধীরে ধীরে জনপ্রিয়তা লাভ করেছিল শিয়া ও সুফি মতবাদ। ইরানের জনসংখ্যার প্রায় ৯০ ভাগ লোক শিয়া মতবাদ অনুসারী। যাকে আবার সংখ্যা গরিষ্ট সুন্নিরা প্রকৃত ইসলাম বলে স্বীকার করতে নারাজ। প্রকৃত ইসলামের সাথে চর্চিত হয়ে আসা স্থানীয় ধর্মীয় আচার-আচরণ ও বিশ্বাসের ধীরে ধীরে সমন্বয়ের ফলে এখানে সুফিবাদের প্রসার ঘটে। ইতিহাসবিদেরা আরো দাবি করেন ভারতবর্ষের সীমানা পেরিয়ে আফগানিস্তানের উপর দিয়ে পারস্যের সাথে দীর্ঘ দিনের যোগাযোগের ফলে ভারতীয় ধর্ম দর্শনের কিছুটা আঁচ চালান হয়ে ঢুকে যায় পারস্যের সুফিবাদে। সুফি দর্শন মতে সুফি ঈশ্বরের সাথে আধ্যাত্মিক সম্পর্ক তৈরী করে বিশেষ শক্তি প্রাপ্ত হন। তখন সুফির অন্তরে সার্বক্ষণিক শান্তি ও আনন্দ বিরাজ করে। এই দর্শন মূল ইসলামী বিশ্বাসের সাথে ঠিক খাপ খায় না বরং কিছুটা প্রচ্ছন্ন ছাপ দেখা যায় বুদ্ধের নির্বান তত্ত্বের সাথে। বুদ্ধ কঠোর ধ্যান সাধনার মাধ্যমে মনের চাঞ্চল্য দূর করে মনকে এমন এক স্তরে নিয়ে যাওয়া্র কথা বলেছেন যেখানে সুখে দুঃখে মন থাকে অবিচল। মনে প্রশান্তি বিরাজ করে সবসময়, ছিন্ন হয় দুঃখ কষ্টের বন্ধন। এই জন্যই পারস্যের সুফিবাদী ইসলাম আর অনান্য আরব দেশের ইসলামের সাথে দেখা যায় বিশাল ফাঁক। প্রকৃত ইসলামে আল্লাহ্ প্রভু, তিনিই মালিক, তিনিই পরিচালক তিনিই সব। মানুষ তাঁর গোলাম বা দাস বা সেবক। এখানে মানুষ শুধু বিনা প্রশ্নে আল্লাহ্র আদেশ নির্দেশ মানতে বাধ্য থাকবে। এখানে প্রেমের সম্পর্ক মূখ্য নয়। সম্পর্ক আদেশ পালনের, সম্পর্ক প্রভু ভৃত্যের। অপরদিকে সুফিবাদের দর্শন মতে নিরাকার স্রষ্টা বিরাজমান থাকেন তাঁর সকল সৃষ্টির মাঝেই। তাই আল্লাহ্র সাথে বান্দার সম্পর্ক কখনো প্রভু ভৃত্যের নয় বরং তা স্নেহ-মমতার, প্রেম- ভালোবাসার।
বায়েজিদের জীবনী সম্পর্কে তেমন বিস্তারিত বিশেষ কিছু জানা যায় না। তিনি থেকে গেছেন অনেকটা আলোআধারি খেলার মত। তাঁর বাবা ছিলেন এক জন সুফি সাধক, মাও ছিলেন ধর্মপ্রাণ মহিলা। তাই এই কথা আমরা নির্দ্বিধায় বলতে পারি শুরু থেকাই তিনি বেড়ে উঠেছেন ভীষণ বিশ্বাসী ধর্মীয় পরিমন্ডলে। ঈশ্বর চিন্তায় সদামগ্ন পরিবেশে। শোনা যায় ছোটবেলায় তাঁর বেশিরভাগ সময় নাকি কাটত ঘর থেকে মসজিদ আর মসজিদ থেকে ঘরে যাওয়া আসা করেই। তাঁর জ্ঞান বুদ্ধি তাতে কতটুকু বিকশিত হয়েছিল তা নিয়ে ঘোর সংশয় সৃষ্টি হয় কবি কালিদাস রায়ের ‘মাতৃভক্তি’ কবিতাটি পড়লেই। কবিতায় বায়েজিদ বোস্তামীর বালক বয়সের মাতৃভক্তির যে কাহিনী ফুটে উঠেছে তা এরূপ- একদিন বায়েজিদ বোস্তামীর মা গভীর রাতে হঠাৎ ঘুম থেকে জেগে পানি খেতে চাইলেন। বালক বায়েজিদ পানি আনতে গিয়ে দেখলেন কলসিতে পানি নেই। অতগ্য তিনি রাত দুপুরে বহু দুরের ঝর্ণা হতে পানি নিয়ে এসে দেখলেন মা আবারো ঘুমিয়ে পড়েছেন। কিন্তু তিনি মায়ের ঘুম না ভাঙ্গিয়ে সারারাত পানির গ্লাস হাতে মায়ের শিয়রের কাছে দাঁড়িয়ে প্রতিক্ষায় রইলেন মায়ের ঘুম ভাঙ্গার? এক সময় রাত কেটে সকাল হল। মা জেগে দেখলেন বায়েজিদ তখনো দাঁড়িয়ে আছে গ্লাসে পানি নিয়ে। মায়ের প্রতি এই ভক্তি দেখে মা আবেগ তাড়িত হয়ে কেঁদে বলেন-
কহিল মা, মরি মরি!
বাছারে আমার পানি হাতে করে সারা রাত্রটি ধরি
দাঁড়াইয়া আছো? ঘুমাওনি আজ? চোখে এলো জল ভরি।
কালিদাস বাঙ্গালী কবি ছিলেন তাই আমরা ধরে নিতে পারি লোক মুখে প্রচলিত বায়েজিদের মাতৃভক্তির কাহিনী শুনেই তিনি কবিতাটি রচনা করেন। এতে অবশ্য কাব্যিক প্রয়োজনে কিছুটা বাহুল্য থাকা বিচিত্র কিছু নয়। বাহুল্য যদি থেকে থাকে তাহলে আমার বলার কিছু নেই। আর যদি ঘটনা সত্যি হয়ে থাকে তবে তা বালক বায়েজিদের মাতৃভক্তির চেয়ে কান্ড জ্ঞানহীন বোকামি প্রকাশ করে ঢের বেশি। কারণ কোন বুদ্ধিমান বালক পিপাসার্ত মাকে পানি না খাইয়ে সকাল পর্যন্ত পানি নিয়ে অপেক্ষায় থাকবেনা। বায়েজিদ ঠিক কত বছর বয়সে এই কাজটি করেছিলেন বালক শব্দ ব্যবহার করায় তাও অস্পষ্ট। তবে বয়স যে অল্প ছিল না তা আমরা ধারণা করতে পারি রাতের আঁধারে দূরের ঝর্ণা থেকে পানি নিয়ে আসায়। অল্প বয়সী কোন ছেলের পক্ষে রাতের আঁধারে ঘর থেকে একা বের হওয়ার কথা বিশ্বাস যোগ্য নয় মোটেই।
বায়েজিদের জন্মের পূর্বে থেকেই ইসলামে সুফিবাদের বিক্ষিপ্ত কিছু প্রভাব দেখা যায়। তবে সুফিরা দাবী করেন বায়েজিদ সুফিবাদকে জনপ্রিয় করে সুফিবাদকে একটা দৃঢ় ভিত্তির উপর প্রতিষ্ঠিত করে যান। জীবনের সুদীর্ঘ ত্রিশটি বছর তিনি সুফিবাদ প্রচারে ব্যয় করলেও তাঁর জীবনের উল্লেখযোগ্য ঘটনাবলি নিয়ে সত্যিকার বিশ্বাসযোগ্য কোন লিখিত প্রমাণিক ইতিহাস পাওয়া যায় না। তাতে সন্দেহ আরো বদ্ধমূল হয় তিনি সত্যি কি এমন অবিস্মরণীয় কাজ করে গেছেন অথচ তা কালের সাক্ষ্য দিচ্ছেনা? তবে তাঁকে নিয়ে প্রচুর মিথ ও গালগল্প ছড়িয়ে আছে সুফি সাহিত্যে। যা এ কান ও কান হয়ে ফুলে ফেঁপে তাঁকে পরিচিতি দিয়েছে এক অলৌকিক চরিত্রে।
বায়েজিদের সারা জীবন কেটেছে ঈশ্বর সাধনায়। ছোট বেলা থেকেই ঈশ্বর চিন্তায় আচ্ছন্ন ছিলেন তিনি। সম্ভবত নবী মুসা বা নবী মুহাম্মদের আদর্শে অনুপ্রাণিত হয়ে ঈশ্বর মগ্নতায় বুদ হয়ে ভেবেছিলেন তাঁরা যদি ঈশ্বরের সাথে দেখা করে কথা বলতে পারে আমিও নিশ্চইয় পারব। মনের আকাঙ্খা বাস্তবায়নে প্রবল বিশ্বাস নিয়ে তিনি তিন তিনবার ঈশ্বরের ঘর মক্কা ভ্রমণ করেন সরাসরি ঈশ্বরের সাক্ষাৎ পেতে।
উপরে আমরা কালীদাস রায় থেকে বালক বায়েজিদের মাতৃভক্তির গল্প শুনেছিলাম। এবার প্রাচীন সুফিবাদের গবেষক হুজুইরি কাস্ফ আল মাহজাব থেকে শুনি পরিণত বয়সে তাঁর ঈশ্বরের সাথে দেখা করতে মক্কা যাওয়ার কাহিনী।
Adapted from Hujwiri 1976, p. 108
Bayazid said: “I went to Mecca and saw a House standing apart. I said, ‘My pilgrimage is not accepted, for I have seen many stones of this sort.’ I went again, and saw the House and also the Lord of the House. I said, ‘This is not yet real unity.’ I went a third time, and saw only the Lord of the House. A voice in my heart whispered, ‘O Bayazid, if you did not see yourself, you would not have been an idol-worshipper even though you saw the whole universe, but since you see yourself, you are an idol-worshipper blind to the whole universe. ‘Thereupon I repented, and once more I repented of my repentance, and yet once more I repented of seeing my own existence’.
হুজুইরির বর্ণনা বিশ্লেষণ করে পাই, বায়েজিদ ১ম বার মক্কা গিয়ে শুন্য ঘর ও কিছু পাথর ছাড়া কিছুই দেখতে পেলেন না। ভাবলেন হয়তো ঈশ্বর তাঁর তীর্থভ্রমণ গ্রহণ করেন নি। তাই দেখা দেন নি। ২য় বার আবার গেলেন সেখানে, ঐ ঘর আবার দেখতে পেলেন এবং সেই সাথে ঐ ঘরের প্রভুকে দেখতে পাওয়ার দাবি জানালেন। তবে এই ঘরের প্রভুটি কে? তিনই মানুষ নাকি দেবতা বা ঈশ্বর? উনি দেখতে কেমন? কি তার আকার আকৃতি, বেশভূষা? কিছুই তিনি ব্যখ্যা করেন নি। বোধকরি মক্কায় তখন আরো অনেক লোক ছিল, তারা কেউ বায়েজিদের এই দাবীর পক্ষে সাক্ষ্য দেয়নি। তবে তিনি কি ঈশ্বর? সেই দ্বন্দ্ব তিনি নিজেই ঘোলাটা করেছেন -‘This is not yet real unity.’ বলে। তাঁর কাছে মনে হল গড়বড় আছে কিছু, কোথায় যেন ঠিক মিলছে না। ঈশ্বরকে দেখেছেন অথচ কিছু মেলাতে পারছেন না, তাতো হতে পারে না। অত্যধিক ঈশ্বর চিন্তায় মানসিক বিকারগ্রস্থ হয়ে দৃষ্টিভ্রম হওয়া অস্বাভাবিক কিছু নয়। দিনের আলোতে যে ঈশ্বরকে তিনি দেখতে পেলেন না অথচ সেই ঈশ্বরকে তিনি ঘুমিয়ে ঘুমিয়ে স্বপ্ন দেখলেন এবং ঘুমের ঘোরে ঈশ্বরের সাথে নাকি কথা বলল্লেন। আট্টারের সূত্র থেকে আমরা জানতে পারি বায়েজিদ দাবী করেছেন -“I saw God in a dream and asked Him what is the path towards You? He replied, Abandon yourself and you are already there.” (Attar 1976). আবার মূল প্রসঙ্গে আসি, ঈশ্বরের সাক্ষাত পেতেই হবে এই সংকল্প নিয়ে ৩য় বারের মত তিনি আবার মক্কা গেলেন এইবার শুধু ঘরের প্রভুটিকে দেখতে পেলেন। তখন বিড়বিড় করে আত্মউপলব্ধি করলেন-“ও বায়েজিদ, তুমি নিজেকে না জেনে গোটা পৃথিবী জানলেও তুমি সত্যিকারের ঈশ্বর-ভক্ত হতে পারবেনা, যখনি তুমি নিজেকে জানবে তখনি চিনতে পারবে পুরো বিশ্বব্রহ্মান্ড হবে প্রকৃত ঈশ্বর ভক্ত”, তাঁর বোধদয় হল মানুষের নিজের মনের মাঝেই ঈশ্বর বিরাজমান শুধু তাঁকে দেখার মত অন্তঃদৃষ্টি চাই, আরো উপলব্ধি জন্মাল মানুষের কল্পনার ঈশ্বর আর প্রকৃত ঈশ্বরের মধ্যে বিস্তর ব্যবধান।
মক্কাকে ঈশ্বরের ঘর মেনে নিলেও ঈশ্বর দেখার ইচ্ছা নিয়ে কোন মুসলমান মক্কা যায় না কারণ তারা ভাল করেই জানে এখানে ঈশ্বর বাস করেন না। অথচ বায়েজিদ এই কথা জেনেও বারবার মক্কায় গেলেন ঈশ্বরকে দেখতে! তাঁর এই অবোধ শিশু সুলভ চিন্তা ভাবনার জন্য তাঁকে সুস্থ মানসিকতা সম্পন্ন ব্যক্তি পর্যায়ে বিবেচনা করতে কেন জানি বারবার সংশয়াচ্ছন্ন হতে হয়। এছাড়া তাঁর এই দর্শন প্রকৃত ইসলামের পরিপন্থি, ইসলামের মূল আদর্শ ঈশ্বরকে খুজে বের করে ঈশ্বরের সাথে সাক্ষাৎ করা নয়, ঈশ্বর ও নবীর প্রতি বিশ্বাস আনাই ইসলামের মূল কথা।
বায়েজিদের জীবদ্দশায় তাঁর এই ঈশ্বর দর্শন নিয়ে প্রচুর মতবিরোধের জন্ম দিয়েছিল। অবশেষে বায়েজিদ ৮৭৪ সালে ৭০ ঊর্ধ বছর বয়সে মারা যান। তাঁকে সমাহিত করা হয় বোস্তাম শহরেই।
মৃত্যু পূর্বে কেউ একজন তাঁর বয়স জিজ্ঞেস করলে তাঁর জবাব ছিল বেশ চমকপ্রদ-
“I am four years old. For seventy years I was veiled. I got rid of my veils only four years ago.”
অর্থাৎ মৃত্যুর পূর্বে তাঁকে নিয়ে সকল সংশয় দূর করতে তিনি নিজেই যেন স্বীকার করে গেলেন শেষ চার বছর বাদ দিলে বাকি জীবনটায় তিনি কাটিয়েছেন এক ঘোরের মধ্যে।