কালের স্বাক্ষী ডেক্স:
The Guru would never have any ready made answer to the earnest anxious inquiry of the Sishya, when made in the spirit of deep self surrender, wonder-faith and reverence. The answer must come from within and through intensive practice alone. The Guru could only open the eyes by pointing out the apparent contradictions that would cross the mind of the Sishya during the process. All doubts would disappear and proper solutions could be arrived at, only through deep and intense exercise of intellect. Thus, the Sishya would move to higher and higher stages, only through persistent endeavour.” – Benimadhab Das
দেশপ্রেমিক বাঙালি পন্ডিত এবং শিক্ষক বেণী মাধব দাস। দেশপ্রেম ও শিক্ষকতায় নিবেদিত প্রাণ বেণী মাধব ছিলেন একজন আদর্শ শিক্ষক। দর্শন ছাড়াও তিনি অর্থনীতি ও ইতিহাসে পন্ডিত ছিলেন। তিনি শরৎ চন্দ্র বোস সহ আরও অনেক প্রখ্যাত ব্যক্তির শিক্ষাগুরু ছিলেন। দর্শন শাস্ত্রে উচ্চ শিক্ষা লাভ করার পর তিনি চট্টগ্রাম কলেজে শিক্ষক হিসাবে যোগ দেন। তাঁর হাতে এটি একটি আদর্শ শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে পরিণত হয়। চট্টগ্রামের পর তিনি ঢাকা, কটক, কৃষ্ণ নগর, ও কলকাতার স্কুল ও কলেজে শিক্ষকতা করেছেন। তিনি চট্টগ্রাম জেলার বোয়ালখালী থানার সারোয়াতলী গ্রামে জন্মগ্রহণ করেন।
বেণী মাধব দাস ১৮৮৬ সালের ২২ নভেম্বর জন্মগ্রহণ করেন। তাঁর পিতার নাম কৃষ্ণ চন্দ্র দাস। বেণী মাধব দাস বেড়ে ওঠেন পরাধীন ভারতে। কর্মজীবনে তিনি একজন সৎ-নিষ্ঠবান শিক্ষক ছিলেন। দর্শন, অর্থনীতি ও ইতিহাসে হেড মাস্টার বেণী মাবধবের ছিল অগাধ পান্ডিত্য। কখনো স্কুলের প্রধান শিক্ষক, কখনো কলেজের প্রভাষক পদে তিনি চট্টগ্রাম, ঢাকা, কলকাতা, কটক, কৃষ্ণনগরের বিভিন্ন স্কুল কলেজে শিক্ষকতা করেন। নেতাজি সুভাষ চন্দ্র বোস স্কুল জীবনে তাঁর ছাত্র ছিলেন। বালক সুভাষের মনোজগতে গভীর রেখাপাত করেন বেণী মাধব। বলা যায় সুভাষ বসুর দেশপ্রেমের বীজ বোপন হয় বেণী মাধবের হাতে। সুভাষ তাঁর ভারত পথিক গ্রন্থে বেণী মাধব দাসের কথা উল্লেখ করেছেন। স্বাধীনতা সংগ্রামকে আরো জোরদার করতে দেশান্তরের পূর্বে সুভাষ বোস তাঁর প্রিয় শিক্ষকের কাছে আশীর্বাদ নিতে গিয়েছিলেন। কটক ও কৃষ্ণ নগরে বেণী মাধবের সংস্পর্শে আসা আরেকজন পন্ডিত, নিরঞ্জন নিয়োগী লিখেছেনঃ Here was no harshness in his administration, no pompous display surrounding it – His cool and charming behavior used to have a remarkable impact on his students. Even those who were turbulent calmed down, became respectful towards him and were endeared to his affections.
বেণী মাধব দাস তাঁর সারা জীবন ব্রাহ্ম সমাজের কল্যাণে নিবেদন করেন।বেণী মাধব বিয়ে করেন তৎকালীন কলকাতার সাধারণ ব্রাহ্ম সমাজের সাধারণ সম্পাদকের কন্যা সরলা দেবীকে। সরলা দেবীও সমাজসেবায় নিবেদিতপ্রাণ ছিলেন। তিনি অসহায় ও দুস্থ নারীদের সহায়তায় ‘সরলা পুন্যাশ্রম’ প্রতিষ্ঠা করেন। বেনী মাধব এবং সরলা দেবীর ঘরে জন্ম নেন অগ্নিযুগের দুই বিপ্লবী কল্যানী দাস (১৯০৭-৮৩) ও বীণা দাস (১৯১১-৮৬)। পরবর্তীকালে আমরা দুজনকেই ব্রিটিশ বিরোধী আন্দোলনে অগ্নিকন্যা রূপে পাই। কল্যাণী দাস সমাজ সেবা ও বিপ্লবী কর্মকান্ডে জড়িত ছিলেন এবং বীণা দাস ব্রিটিশ বিরোধী সশস্ত্র বিপ্লবে সক্রিয় ছিলেন।
তাঁর পিতা কৃষ্ণ চন্দ্র দাস পটিয়া কোর্টের নাজির ছিলেন। কিশোর বয়সে বেণী মাধব পিতার সঙ্গে পটিয়ায় চলে আসেন এবং ঐতিহ্যবাহী পটিয়া ইংরেজি উচ্চ বিদ্যালয়ে ভর্তি হন। ১৮৮২-৮৩ খ্রিস্টাব্দের দিকে তিনি পটিয়া উচ্চ বিদ্যালয় থেকে কৃতিত্বের সঙ্গে এন্ট্রাস পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হন। প্রায় এই সময়ে চট্টগ্রামের নববিধান’ ব্রাহ্ম সমাজের আচার্য ও চট্টগ্রাম নর্মাল স্কুলের প্রধান শিক্ষক রাজেশ^র গুপ্তের আহবানে ব্রহ্মানন্দ কেশবচন্দ্র সেন চট্টগ্রামে আসেন। ব্রহ্মানন্দ কেশবচন্দ্র সেনের বক্তৃতা, উপাসনা ও প্রেম ভারবাসনাপূর্ণ মানবহৃদয়ের অগ্নিস্পর্শ যুবক বেণী মাধবকে নবজীবন ও নবচেতনার পথে চালিত করে। যৌবনের প্রথম পাদে বেণী মাধবের ব্রাহ্মধর্ম গ্রহণ পিতা কৃষ্ণ চন্দ্রকে ব্যতিত ও শোকাগ্রস্থ করেছিল। ব্রহ্মানন্দ কেশবচন্দ্র সেনের জীবন বেদই বেণী মাধবের জীবনের একমাত্র আদর্শ হিসেবে প্রতিষ্ঠা পেয়েছিল।
বেনীমাধবের জীবন সম্পর্কে তাঁর অন্যতম সুযোগ্য ছাত্র ও প্রিয় শিষ্য নেতাজী সুভাষ চন্দ্র বোস ’ভারত পথিক’ গ্রন্থে লিখেছেন- His words seemed to pierce through my soul, then I ceased to listen, but continued to gaze at his impassioned countenance, which spoke volumes to me. There was an impression, a glow which I had seen in the portrait of Keshab Chandra. And no wonder-since he was Keshab’s ardent disciple and devotee?”
চট্টগ্রাম কলেজে অধ্যয়নরত অবস্থায় তিনি ’বেণী ব্রাহ্ম’ নামে চট্টগ্রামের হিন্দু সমাজে পরিচিতি লাভ করেন। ১৮৯৪ খ্রিস্টাব্দে কলকাতা বিশ^বিদ্যালয় থেকে দর্শন শাস্ত্রে এম এ পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হন এবং চট্টগ্রামে ফিরে আসেন। প্রথম অবস্থায় চট্টগ্রাম কলেজে সহকারি শিক্ষক এবং পরে চট্টগ্রাম কলেজিয়েট স্কুলের প্রধান শিক্ষক হিসেবে যোগদান করেন। চট্টগ্রাম কলেজিয়েট ইংরেজি উচ্চ বিদ্যালয়টি তাঁর আন্তরিক প্রচেষ্টা ও উদ্যোগে তৎকালিন ব্রিটিশ শিক্ষাক্রমের আওতায় একটি আদর্শ শিক্ষা প্রতিষ্টানে পরিণত হয়। কিছু সময় পরে তিনি ঢাকায় চলে যান। ঢাকা ত্যাগের পরে তিনি উড়িস্যার কটক শহরের ঐতিহ্যবাহী র্যাভেন’ শ কলেজে দর্শন শাস্ত্রের অধ্যাপক পদে যোগদান করেন। ১৮৯৭-৯৮ খ্রিস্টাব্দের দিকে র্যাভেন’শ কলেজের অধ্যক্ষ বিপিন বিহারী গুপ্ত মহাময়ের অনুরোধে শিক্ষাব্রতী বেণী মাধব কটক সরকারি কলেজিয়েট স্কুলের সুনাম ফিরিয়ে আনার লক্ষ্যে প্রধান শিক্ষকের পদে ব্রতী হন।
প্রসঙ্গত উল্লেখ্য যে, তৎকালীন কটক র্যাভে’শ কলেজে টেকজন খ্যাতিমান দর্শন শাস্ত্রের অধ্যাপক হিসেবে পরিচিতি সত্ত্বেও তিনি কটক সরকারি কলেজিয়েট বিদ্যালয়টির মান উন্নয়নে প্রধান শিক্ষকের পদটিতে অনীহা প্রকাশ করেননি।
কটক র্যাভেন’শ কলেজে তাঁর ছাত্র ছিলেন নেতাজী সুভাষ বোসের অগ্রজ শতীশ চন্দ্র বোস, শরৎ চন্দ্র বোস এবং পরবর্তী সময়ে অন্যান্য শিক্ষায়তনে দর্শন শাস্ত্রের খ্যাতিমান অধ্যাপক ড. শিশির কুমার মৈত্র, কলকাতা সুপ্রীম কোর্টের বিচারপতি সুধীর কুমার দাস, খ্যাতনামা চিকিৎসক ডা. রামকৃষ্ণ অধিকারী ও অধ্যাপক বীরেন্দ্র আচার্য প্রমুখ। কটক সরকারি কলেজিয়েট স্কুলেই কিশোর সুভাষ চন্দ্র বেণী মাধবের আন্তরিক স্নেহ সান্নিধ্য লাভ করেন। নেতাজীর আলোকিত জীবন সম্পর্কে বেণী মাধব দাসের সুযোগ্য কন্যা, কলকাতার ডায়োসেশনের (কলেজ) কৃতী ছাত্রী বিপ্লবী বীণা দাশ বলেছেন, “দেশের কাজে বাবার জীবনের একটি মহান অবদান-নেতাজী সুভাষ চন্দ্র। সুভাষ চন্দ্র তো শুধু বাবার ছাত্রই ছিলেন না, বাবার জীবনের শ্রেষ্ট গৌরব যে তিনিই। বাবার চরিত্রে আলোক সম্পাতে যে কিশোরটি একদিন প্রথম শতদল মেলে ফুটে উঠেছিল, একদিন সেই মহৎ জীবনেরই সৌরভে, সৌন্দর্যে, দীপ্তিতে সমস্ত দেশটাই পরিপ্লাবিত হয়ে গিয়েছিল।”
নেতাজী সুভাষ চন্দ্র বোস তাঁর আত্মজীবনীতে লিখেছেন,“মাস্টারমশাইর সংস্পর্শে না গেলে আমার জীবনের ধারা অন্য খাতে প্রবাহিত হয়ে যেত।” দেশ ত্যাগের আগের দিনেও (১৭ জানুয়ারি ১৯৪১ খ্রি.) তাঁর গুরু বেণী মাধবকে এলগিন রোডের বাসায় এনে গুরুপদধুলি এবং আশির্বাদ কামনা করেছিলেন। কটকে সরকারি কলেজিয়েট বিদ্যালয়ে প্রধান শিক্ষক থাকাকালীন বাঙলার বিপ্লবীদের সঙ্গে তাঁর যোগাযোগ ছিল। বৈপ্লবিক কর্মকান্ডের সঙ্গেও তিনি যুক্ত হয়ে যান। তাঁর বাসায় বিপ্লবী উল্লাস কর দত্তের পিতা দ্বিজদাস দত্ত, উল্লাসকর দত্ত, বারীন্দ্র কুমার ঘোষ (ঋষি অরবিন্দ এর অনুজ) ও তাঁর ভগ্নী সরোজিনীর যাওয়া-আসা ছিল।
দেশব্রতী ও শিক্ষানুরাগী বেণী মাধব উড়িষ্যার প্রথম ’উৎকল ইয়ংমেনস এসোসিয়েশন’ প্রতিষ্টা করেন। উড়িষ্যার সামাজিক, সাংস্কৃতিক আন্দোলনের সঙ্গেও তিনি জড়িত ছিলেন।
তাঁর কর্মসঙ্গীও বন্ধু ছিলেন, উড়িষ্যার নবযুগ স্রষ্টা গোপবন্ধু দাস, নীলকন্ঠ দাস, গোদাবরী মিশ্র প্রমুখ। এই দলটিকে Makers of Modern Orissa নামে আখ্যায়িত করা হয়। বেণী মাধব উড়িষ্যায় প্রথম বালিকা বিদ্যালয়ের অন্যতম প্রতিষ্টাতা। এই সময়ে স্বদেশী কাজকর্ম এবং বিপ্লবীদের সঙ্গে যোগাযোগের জন্য ইংরেজ শিক্ষা প্রশাসন তাকে নদীয়া কৃষ্ণ নগর সরকারি উচ্চ বিদ্যালয়ে স্থানান্তরিত করে। কৃষ্ণ নগর উচ্চ বিদ্যালয়ের কৃতীছাত্র, বিচারপতি সুধাংশু কুমার দাসের মন্থব্য বেণী মাধবকে প্রাচীন ভারতের একজন বৈদিক আচার্য, আদর্শ গুরুর অবয়বই আমাদের সম্মুখে এনে দেয়।
তিনি বলেছেন, His relation with students was not merely the relation of the teacher and the taught in the matter of book learning only, it was that of a preceptor who guides the faulting steps of a young aspirant for a full and rich life. To him disciples were not mere pupils but young men committed to his loving care and he took the responsibilities of developing the complete man in them. It is not often that an abstract idea takes the embodiment of a physical from. Such however, was the personality of achariya Benimadhab that one felt in his presence that the ideal which he was preaching was present before one’s eyes in his own life.”
আচার্য বেণী মাধব দাসের দেশপ্রেম ও দেশমাতৃকার মুক্তি সংগ্রামে অবদান সম্পর্কে অবিভক্ত বঙ্গের বিপ্লব প্রচেষ্টা, ব্রিটিশ বিরোধী আন্দোলনের অন্যতম সংগঠক ও উদ্যোগ পর্বের নেতা ড. যদু গোপাল মুখোপাধ্যায় তাঁর (বেণী মাধব দাসের) ছেলেকে এক চিঠিতে লিখেছিলেন, “বহুদিনাবধি দূর থেকে আপনার পরমারাধ্য পিতৃদেবকে জানতাম ও আন্তরিক শ্রদ্ধা করতাম। জাতিকে গড়ে তোলার কাজে যাঁরা ব্রতী ছিলেন তাঁদের মধ্যে তিনি ছিলেন অন্যতম- শুধু অন্যতম নয়, একেবারে অগ্রণী।”
কবিগুরু রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর শান্তিনিকেতনে তাঁর কৃতীছাত্র প্রখ্যাত চিকিৎসক ডা. রামচন্দ্র অধিকারীর সঙ্গে আলাপচারিতার ফাঁকে আচার্য বেণী মাধব দাস সম্পর্কে বলেছিলেন-‘বেণীবাবুকে আমি জানি-আদর্শ চরিত্র, আদর্শ গুরু। তাঁকে বড়ো শ্রদ্ধা করি।’
আচার্য বেণী মাধব দাস ২ সেপ্টেম্বর ১৯৫২ খ্রিস্টাব্দে কলকাতায় শেষ নিঃশ্বাস ত্যাগ করেন।
প্রসঙ্গত উল্লেকযোগ্য যে, জীবিতাবস্তায় বেণী মাধব জ্যেষ্ট সন্তান ডা. বিমল দাসকে নিয়ে ও একা বৎসরান্তে একবার সারোয়াতলী গ্রামে আসতেন। বৃদ্ধা মায়ের সঙ্গে সাক্ষাৎ ও পদধুলি নিয়ে যেতেন।
এই গুণীর প্রতি আলোকিত বোয়ালখালী পরিবার বিনম্র শ্রদ্ধা জ্ঞাপন করছে।
প্রতীক্ষার প্রহর গুণছে পরিবার : স্বাধীনতার ৫০বছরেও মিলেনি শহীদ মুক্তিযোদ্ধার স্বীকৃতি
স্বামী বিদ্যারণ্য বিভূতিভূষণ দত্ত একজন গাণিতিক ইতিহাসবেত্তা ও সন্ন্যাসী