সংসদ রিপোর্টার ॥
অকাল প্রয়াত জাসদ নেতা মইন উদ্দীন খান বাদলের মৃত্যুতে গভীর শোক প্রকাশ করে প্রধানমন্ত্রী ও সংসদ নেতা শেখ হাসিনা বলেছেন, চলার পথে অনেক আপনজনকে হারিয়েছি, অনেকে হারিয়ে যাচ্ছেন। অবশ্য একদিন সবাইকেই চলে যেতে হবে। মইন উদ্দীন খান বাদলের অকাল মৃত্যুতে রাজনৈতিক অঙ্গনে বিরাট শূন্যতা সৃষ্টি করেছে। আমাদের দুর্ভাগ্য, তার সেই বলিষ্ঠ কণ্ঠস্বর আর শুনব না।
স্পীকার ড. শিরীন শারমিন চৌধুরীর সভাপতিত্বে বৃহস্পতিবার শোক প্রস্তাবের ওপর আলোচনায় অংশ নিয়ে প্রধানমন্ত্রী আরও বলেন, ছাত্রলীগ কর্মী হিসেবে ছাত্র রাজনীতিতে তিনি সক্রিয় অংশগ্রহণ করেছেন। মহান মুক্তিযুদ্ধেও তার বলিষ্ঠ অবদান রয়েছে। তিনি সব সময় অসাম্প্রদায়িক চেতনা ও শান্তি-সমৃদ্ধিতে বিশ্বাসী ছিলেন। সংসদে তিনি যখন বক্তব্য রাখতেন প্রত্যেকটা ভাষণই মনে দাগ কেটে যেত। তিনি অত্যন্ত বলিষ্ঠভাবেই কথা বলতেন। এলাকার উন্নয়নের জন্য সব সময় সক্রিয় ছিলেন। তার মৃত্যুতে তার এলাকাবাসীর যেমন ক্ষতি হয়েছে, তেমনি রাজনীতিরও।
প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ছাড়াও শোক প্রস্তাবের ওপর আলোচনায় অংশ নেন বিরোধী দলের নেতা রওশন এরশাদ, আওয়ামী লীগের প্রবীণ নেতা আমীর হোসেন হোসেন আমু, তোফায়েল আহমেদ, সাবেক স্বাস্থ্যমন্ত্রী মোহাম্মদ নাসিম, সাবেক মন্ত্রী শাজাহান খান, সাবেক মন্ত্রী ড. মহীউদ্দীন খান আলমগীর, সাবেক মন্ত্রী আবুল কালাম আজাদ, সাবেক চীফ হুইপ আ স ম ফিরোজ, ওয়ার্কার্স পার্টির সভাপতি রাশেদ খান মেনন, জাসদ সভাপতি হাসানুল হক ইনু, জাতীয় পার্টির ব্যারিস্টার আনিসুল ইসলাম মাহমুদ ও বিরোধীদলীয় চীফ হুইপ মশিউর রহমান রাঙ্গা। স্পীকার পরে সংসদে শোক প্রস্তাবটি গ্রহণের প্রস্তাব দিলে সর্বসম্মতিক্রমে তা গৃহীত হয়।
পরে প্রয়াতদের রুহের মাগফিরাত কামনা করে এক মিনিট দাঁড়িয়ে নীরবতা পালন শেষে মোনাজাত করা হয়। মোনাজাত পরিচালনা করেন সরকারী দলের এমপি বি এইচ হারুন। চলমান সংসদের কোন সদস্যের মৃত্যু হলে রেওয়াজ অনুযায়ী স্পীকার অধিবেশনের অবশিষ্ট কার্যক্রম স্থগিত রেখে সংসদ অধিবেশন সোমবার বিকেল সোয়া চারটা পর্যন্ত মুলতবি ঘোষণা করেন।
প্রধানমন্ত্রী বলেন, নিয়তির কী নির্মম পরিহাস, আজ (বৃহস্পতিবার) সকালেই মইন উদ্দীন খান বাদল চলে গেলেন। তার লাশ আনার জন্য ইতোমধ্যে ব্যবস্থা নেয়া হয়েছে। আমাদের হাইকমিশনের এক কর্মকর্তাকে পাঠিয়েছি। মরদেহ আজ (বৃহস্পতিবার) সন্ধ্যার মধ্যে পৌঁছানোর কথা, হয়ত আগামীকাল (শুক্রবার) সকালের মধ্যে পৌঁছবে।
তিনি বলেন, মইন উদ্দীন খান বাদল ২০০৮, ’১৪ ’১৮ তিনটা নির্বাচনে এমপি নির্বাচিত হন। ছাত্র রাজনীতিতে তিনি সক্রিয় অংশগ্রহণ করেছেন। রাজনৈতিক অঙ্গনে আমরা যারা স্বৈরাচারবিরোধী আন্দোলন করেছি, যারা গণতন্ত্রের জন্য সংগ্রাম করেছি, এমনকি আইয়ুববিরোধী আন্দোলন থেকে নিয়ে ৬ দফা আন্দোলন, আগরতলা ষড়যন্ত্র মামলা প্রত্যাহার আন্দোলন, মুক্তিযুদ্ধ প্রতিটি ক্ষেত্রেই বাদলের সক্রিয় ভূমিকা ছিল। ছাত্রজীবন থেকেই তিনি ছাত্রলীগ কর্মী ছিলেন। স্বাধীনতার পর তিনি জাসদে যোগ দেন। আমরা যখন ঐক্যজোট গঠন করি আমাদের ঐক্যজোটের সঙ্গেও তিনি সক্রিয় ছিলেন। কাজেই আন্দোলন সংগ্রামের রাজপথে এবং সংসদে একসঙ্গে কাজ করার আমার সুযোগ হয়েছে।
সংসদ নেতা বলেন, রাজনৈতিক চিন্তাচেতনা ও প্রজ্ঞায় মইন উদ্দীন খান বাদল যথেষ্ট শক্তিশালী ভূমিকা রেখেছেন। তার মৃত্যুতে রাজনৈতিক অঙ্গনে একটা বিরাট শূন্যতা সৃষ্টি হলো। তিনি বলেন, আমি সবসময় তার শরীর স্বাস্থ্যের খোঁজ নিতাম। তিনি অসুস্থ ছিলেন। তার স্ত্রী মেসেজ পাঠিয়ে খবর দিতেন তিনি কি অবস্থায় আছেন। সকালে যখন খবর পেলাম তখন বিরাট একটা ধাক্কা খেলাম। কারণ এটা আমি ভাবতেও পারিনি যে তিনি এভাবে অকালে চলে যাবেন। পার্লামেন্ট শুরু হবে তিনি পার্লামেন্টে আসবেন এবং দ্রুত সুস্থ হতে হবে এটাই মনে মনে পোষণ করতেন তিনি। আমাদের দুর্ভাগ্য যে তার সেই বলিষ্ঠ কণ্ঠস্বর আর শুনতে পাব না। চলার পথে অনেক আপনজনকে হারিয়েছি, অনেকে হারিয়ে যাচ্ছে। অবশ্য একদিন সবাইকে চলে যেতে হবে।
আওয়ামী লীগ সভাপতি শেখ হাসিনা বলেন, মইন উদ্দীন খান বাদল তিনটি সংসদ নির্বাচনে সংসদ সদস্য নির্বাচিত হন। অসাম্প্রদায়িক চেতনায় বিশ্বাসী ছিলেন তিনি। অত্যন্ত বলিষ্ঠ কথা বলতেন। এলাকার উন্নয়নে ছিলেন সবসময় সচেষ্ট। তার মৃত্যুতে রাজনৈতিক অঙ্গনে বিরাট শূন্যতার সৃষ্টি হলো। তিনি সেই আইয়ুববিরোধী আন্দোলন থেকে শুরু করে আগরতলা ষড়যন্ত্র মামলা, মহান মুক্তিযুদ্ধ, পরবর্তীতে স্বৈরাচারবিরোধী আন্দোলনসহ দেশের সব গণতান্ত্রিক আন্দোলনে, সংগ্রামে তার ভূমিকা ছিল। সত্য মেনে নেয়া কঠিন, কিন্তু আমাদের তা মেনে নিতেই হয়। আমি তার শোকসন্তপ্ত পরিবারের প্রতি গভীর সমবেদনা জানাই।
বিরোধী দলের নেতা রওশন এরশাদ বলেন, অত্যন্ত বিনয়ী, বিচক্ষণ ও অনলবর্ষী বক্তা মইন উদ্দীন খান বাদলের মৃত্যুতে আমরা মর্মাহত, গভীরভাবে শোকাহত। একাত্তরে সোয়াত জাহাজ থেকে পাক হানাদাররা অস্ত্র খালাস করছিলেন, তখন বীর মুক্তিযোদ্ধা বাদল আক্রমণ চালিয়ে সেই অস্ত্র লুটে নিয়ে মুক্তিযোদ্ধাদের হাতে দিয়ে যুদ্ধ করেছিলেন। সংসদেও তার সপ্রতিভ ক্ষুরধার বক্তব্য, শব্দ চয়ন ছিল চমৎকার। দেশের প্রাসঙ্গিক বিষয়গুলো সংসদে জোরালোভাবে তুলে ধরতেন। তার মৃত্যুতে যে শূন্যতা হলো, তা কোনদিন পূরণ হবে না।
আওয়ামী লীগের প্রবীণ নেতা ও সাবেক শিল্পমন্ত্রী আমীর হোসেন আমু বলেন, স্বৈরশাসনের বিরুদ্ধে গণতান্ত্রিক আন্দোলনে মইন উদ্দীন খান বাদল অত্যন্ত সাহসী ভূমিকা রেখে গেছেন। অসাম্প্রদায়িক-গণতান্ত্রিক রাজনীতিতে বিশ্বাসী বীর মুক্তিযোদ্ধা বাদল সংসদের ভেতর-বাইরে একজন বলিষ্ঠ সুবক্তা ছিলেন। তার মৃত্যুতে রাজনীতির জন্য বিরাট একটা ক্ষতি হলে গেল।
সাবেক বাণিজ্যমন্ত্রী তোফায়েল আহমেদ বলেন, একদিন আমাদের সবাইকে চলে যেতে হবে। স্কুল-কলেজ জীবনে ছাত্রলীগের নেতা ছিলেন মইন উদ্দীন খান বাদল। পরে জাসদে যোগ দিলেও অসাম্প্রদায়িক-গণতান্ত্রিক রাজনীতিতে বিশ্বাসী ছিলেন। সাম্প্রদায়িক রাজনীতির ঘোরবিরোধী ছিলেন তিনি। তার বক্তৃতায় আলাদা বৈশিষ্ট্য ছিল। মুক্তিযুদ্ধে মুজিববাহিনীর সদস্য হিসেবে অত্যন্ত সাহসী ভূমিকা রেখেছেন। কিন্তু এত তাড়াতাড়ি তিনি চলে যাবেন ভাবতেও পারিনি।
সাবেক স্বাস্থ্যমন্ত্রী মোহাম্মদ নাসিম বলেন, বীর মুক্তিযোদ্ধা মইন উদ্দীন খান বাদল একজন সুবক্তা, প্রখর চিন্তাবিদ ও অভিজ্ঞ রাজনীতিক ছিলেন। বিএনপি-জামায়াত জোটের দুঃশাসনের বিরুদ্ধে ১৪ দল গঠনে অন্যতম ভূমিকা পালন করে গেছেন। অসুস্থ অবস্থাতেও সংসদে প্রাণবন্ত বক্তব্য রেখেছেন। দেশপ্রেমিক এই রাজনীতিবিদের চলে যাওয়া দেশের জন্য অপূরণীয় ক্ষতি।
শোক প্রস্তাবের ওপর আলোচনায় অংশ নিয়ে ওয়ার্কার্স পার্টির সভাপতি রাশেদ খান মেনন বলেন, বাংলাদেশ পরবর্তীকালে সামরিক শাসনসহ প্রতিটি গণতান্ত্রিক আন্দোলনে তার সাহস ও বিচক্ষণতা সত্যিই প্রশংসনীয়। মহান মুক্তিযুদ্ধের সময় পাক হানাদারদের আতঙ্কের নাম ছিল মইন উদ্দীন খান বাদল। তার অকাল মৃত্যু পূরণ হওয়ার নয়।
জাসদ সভাপতি হাসানুল হক ইনু বলেন, মইন উদ্দীন খান বাদল আমার দীর্ঘদিনের রাজনৈতিক সহযোদ্ধা ছিলেন। ষাটের দশকে পূর্ব বাংলা ছাত্রলীগের সদস্য হিসেবে রাজনীতি শুরু করেন। চট্টগ্রামে মহান মুক্তিযুদ্ধে বিশেষ ভূমিকা রেখে গেছেন। জড়িত ছিলেন জাসদের জন্মলগ্ন থেকেই। বঙ্গবন্ধু হত্যার পর জেনারেল জিয়া ও এরশাদের সামরিক শাসনবিরোধী আন্দোলনে সাহসী ভূমিকা রাখেন। সাম্প্রদায়িকতাবিরোধী গণতান্ত্রিক প্রতিটি আন্দোলনে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রেখেছেন।
ড. মহীউদ্দীন খান আলমগীর এই বীর মুক্তিযোদ্ধার প্রতি গভীর শ্রদ্ধা নিবেদন করে বলেন, ব্রিটিশ ও কানাডিয়ান পার্লামেন্টে সংরক্ষিত হিসাব কমিটির প্রতিনিধি হিসেবে ফলপ্রসূ ভূমিকা পালন করে দেশের নাম উজ্জ্বল করেছেন। মঈন উদ্দীন খান বাদল অত্যন্ত দেশপ্রেমিক ও দেশের উন্নয়নে সবসময় কাজ করতেন। তার অকাল মৃত্যুতে আমরা দেশের প্রথম সারির একজন রাজনীতিককে হারালাম।
সাবেক মন্ত্রী শাজাহান খান বলেন, মহান মুক্তিযুদ্ধের সময় নৌকমান্ডোরা একসঙ্গে চারটি সমুদ্রবন্দরে অসংখ্য পাকবাহিনীর জাহাজ ডুবিয়ে দিয়েছিল। প্রয়াত মইন উদ্দীন খান বাদল এই ঘটনার সঙ্গে জড়িত ছিলেন। অত্যন্ত সুবক্তা, প্রাজ্ঞ ও ইতিহাসের ওপর সুনিপুণ দখল ছিল তার।
ছাত্রজীবন থেকে মইন উদ্দীন খান বাদলের রাজনীতির সঙ্গে জড়িত থাকার স্মৃতিচারণ করতে গিয়ে জাতীয় পার্টির ব্যারিস্টার আনিসুল ইসলাম মাহমুদ বলেন, মহান মুক্তিযুদ্ধ থেকে পরবর্তী প্রতিটি গণতান্ত্রিক আন্দোলনের সঙ্গে জড়িত ছিলেন। পরিবারের চেয়েও এলাকার লোকজন সবসময় তার কাছে প্রাধান্য পেয়েছেন। তার স্ত্রীও দুরারোগ্য ক্যান্সার রোগে আক্রান্ত।
বিরোধীদলীয় চীফ হুইপ রাঙ্গা বলেন, আমরা একজন অত্যন্ত সুবক্তা, গুণী, বিচক্ষণ ও মহান মুক্তিযোদ্ধাকে হারালাম। অত্যন্ত পড়াশোনা করে সংসদে বক্তব্য রাখতেন। তার অভাব সত্যিই আমাদের ব্যথিত করেছে।
আ স ম ফিরোজ বলেন, অত্যন্ত সুবক্তা ও বিচক্ষণ নেতা ছিলেন মইন উদ্দীন খান বাদল। শুধু সংসদে নয়, আন্তর্জাতিক বিভিন্ন সেমিনারে তার বক্তব্য দেশকে অনেক উচ্চতায় নিয়ে গেছেন। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার অত্যন্ত আস্থাভাজন নেতা ছিলেন তিনি। মানুষ হিসেবেও অত্যন্ত চমৎকার মানুষ ছিলেন।