ভারতের পশ্চিমবঙ্গ উপকূলে আঘাত হেনে কিছুটা দুর্বল হয়ে অতি প্রবল থেকে প্রবল ঘূর্ণিঝড়ে রূপ নিয়েছে ‘বুলবুল’। ঘণ্টায় ১১৫ কিলোমিটার থেকে ১২৫ কিলোমিটার বাতাসের গতি নিয়ে বাংলাদেশ সময় শনিবার রাত ৯টায় পশ্চিমবঙ্গের সাগর দ্বীপ উপকূলে আঘাত হানে এই ঘূর্ণিঝড়।
ভারতের আবহাওয়া বিভাগ গতরাত সাড়ে ১০টায় জানায়, ঘূর্ণিঝড়ের কেন্দ্র উপকূলের কাছাকাছি পৌঁছে গেছে। বুলবুল পুরোপুরি স্থলভাগে উঠে আসতে আরও ঘণ্টা দুয়েক সময় লাগতে পারে। বুলবুলের প্রভাবে ভারতের ওড়িশা ও কলকাতায় ভারী বৃষ্টি ও দমকা হাওয়ায় বহু গাছ উপড়ে গেছে, মৃত্যু হয়েছে অন্তত দুজনের।
ঘূর্ণিঝড়টির ব্যাসার্ধ ২০০ থেকে ২৫০ কিলোমিটার। ঝড়টি ঘণ্টায় ১২ কিলোমিটার গতিতে উত্তরপূর্ব দিকে এগোচ্ছিল। মধ্যরাত নাগাদ ঝড়টি বাংলাদেশে ঢুকবে বলে আবহাওয়াবিদরা তাদের ধারণার কথা জানিয়েছিলেন।
গতরাত ১১টায় আবহাওয়া অধিদপ্তরের উপ-পরিচালক আয়েশা খাতুন বলেন, “ঘূর্ণিঝড়টি বর্তমানে বঙ্গোপসাগরের পশ্চিমবঙ্গ ও বাংলাদেশের দক্ষিণপশ্চিম এলাকায় অবস্থান করছে। ঘূর্ণিঝড়টি উত্তরপূর্ব দিকে অগ্রসর হয়ে ক্রমশ দুর্বল হয়ে পড়বে। মধ্যরাত নাগাদ সুন্দরবনের নিকট দিয়ে উপকূল অতিক্রম করবে।”
তিনি বলেন, ঘূর্ণিঝড়টির কেন্দ্রের ৭৪ কিলোমিটারের মধ্যে বাতাসের একটানা গতিবেগ ঘণ্টায় সর্বোচ্চ ১০০ কিলোমিটার, যা দমকা অথবা ঝড়ো হাওয়ার আকারে ১২০ কিলোমিটার পর্যন্ত বৃদ্ধি পাচ্ছে। ঘূর্ণিঝড় কেন্দ্রের কাছে সাগর খুবই উত্তাল রয়েছে।
ঘূর্ণিঝড় বুলবুলের প্রভাবে শনিবার সারাদিনই দেশের বিভিন্ন স্থানে থেমে থেমে বৃষ্টি হয়। গতরাত ৮টার পর প্রায় ঘণ্টা দুয়েক মংলায় ঝড়ো হাওয়ার সঙ্গে ভারি বৃষ্টি হয়।
মংলা উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা রাহাত মান্নান বলেন, সর্বশেষ তথ্য অনুযায়ী সুন্দবনের দুবলার চরে সন্ধ্যার দিকে প্রচন্ড বাতাস শুরু হয়। তবে এখনও ক্ষয়ক্ষতির বা প্রাণহানির খবর পাওয়া যায়নি। মোংলার সুন্দরবন সংলগ্ন গ্রামগুলো থেকে বাসিন্দাদের আশ্রয়কেন্দ্রে নিয়ে আসা হয়েছে।
ঘূর্ণিঝড়টি যখন বাংলাদেশের উপর দিয়ে বয়ে যাবে, তখন জোয়ার থাকবে বলে আবহাওয়া অধিদপ্তর জানিয়েছে। এতে ৫ থেকে ৭ ফুট উচ্চতার জলোচ্ছ্বাসে উপকূলীয় এলাকা প্লাবিত হতে পারে বলে আশঙ্কার কথা বলেন আয়েশা খাতুন। মংলার মাঝিরাও এই শঙ্কা করেন।
ঘূর্ণিঝড় আঘাতের আশঙ্কায় মোংলা, চট্টগ্রামসহ সব সমুদ্রবন্দরে কাজ বন্ধ রাখা হয়েছে। সারা দেশে সব ধরনের নৌযান চলাচল পরবর্তী নির্দেশ না দেওয়া পর্যন্ত বন্ধ রাখতে বলেছে অভ্যন্তরীণ নৌপরিবহন কর্তৃপক্ষ।
ঘূর্ণিঝড়ের ক্ষয়ক্ষতি এড়াতে ঝুঁকিপূর্ণ এলাকাগুলো থেকে ২৫ লাখ মানুষকে নিরাপদ আশ্রয়ে সরিয়ে নেওয়া হয়েছে বলে দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা অধিদপ্তরের মহাপরিচালক মো. শাহাদাৎ হোসেন জানিয়েছেন।
গত শুক্রবার রাত থেকে এ কার্যক্রম চলছে জানিয়ে তিনি বলেন, “আমাদের টার্গেট ছিল ১৮ লাখ লোক সরাতে হবে। স্থানীয় প্রশাসনের ব্যাপক তৎপরতায় লোকজন নিরাপদে এসেছে, কাউকে জোর করা হচ্ছে না। প্রায় ২৫ লাখ লোককে আশ্রওয় কেন্দ্র, শিক্ষা প্রতিষ্ঠান ও নানা স্থাপনায় নিরাপদ আশ্রয়ে আনা হয়েছে।” খুলনা, সাতক্ষীরা, বাগেরহাট, বরগুনা, পটুয়াখালী, পিরোজপুর ও ভোলা জেলাকে ঝুঁকিপূর্ণ এলাকা বিবেচনা করে প্রস্তুতি সাজানো হয়েছে।
বলার পরও যারা আশ্রয় কেন্দ্রে যাচ্ছেন না, তাদের নিতে বাধ্য করতে পুলিশ নামানো হয়েছে বলে জানান পটুয়াখালীর কলাপাড়া উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা মুনিবুর রহমান।
ঘূর্ণিঝড় প্রস্তুতি কর্মসূচির (সিপিপি) ৫৬ হাজার স্বেচ্ছাসেবীকে প্রস্তুত রাখা হয়েছে উদ্ধার ও জরুরি ত্রাণ তৎপরতার জন্য। পাশাপাশি উপকূলীয় সেনা ক্যাম্পগুলোকে সতর্ক রাখা হয়েছে। প্রতিটি জেলায় খোলা হয়েছে নিয়ন্ত্রণ কক্ষ। আশ্রয় কেন্দ্রগুলোতে ২০০০ প্যাকেট করে শুকনো খাবার পৌঁছে দেওয়া হয়েছে। সচেতনতা সৃষ্টির জন্য স্বেচ্ছাসেবকরা মাইকে এবং ২২টি কমিউনিটি রেডিওর মাধ্যমে সতর্কবার্তা প্রচার করছে।
উপকূলীয় ১৩ জেলার কর্মকর্তা-কর্মচারীদের ছুটি বাতিল করে তাদের কর্মস্থলে উপস্থিত থাকতে নির্দেশ দেওয়া হয়। এসব জেলার সব কর্মীদের ছুটি বাতিল করেছে স্বাস্থ্য বিভাগ। তারা গঠন করেছে ১ হাজার ৫৭৭টি মেডিকেল টিম।
ঝড় এগিয়ে আসায় পিছিয়ে দেওয়া হয়েছিল শনিবারের জুনিয়র স্কুল সার্টিফিকেট (জেএসসি) ও জুনিয়র দাখিল সার্টিফিকেট (জেডিসি) পরীক্ষা। শনিবার আরেক ঘোষণায় সোমবারের পরীক্ষাও স্থগিত করা হয়েছে। ঘূর্ণিঝড়ের কারণে জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয়ের শনিবারের সব পরীক্ষাও স্থগিত করা হয়। এ পরীক্ষা কবে নেওয়া হবে তা পরে জানানো হবে।
পশ্চিমবঙ্গে আঘাত : পশ্চিমবঙ্গের স্থলভাগে আঘাত হেনেছে ঘূর্ণিঝড় বুলবুল। গতরাত নয়টার দিকে দক্ষিণ ২৪ পরগনার ফ্রেজারগঞ্জ ও সাগরদ্বীপ হয়ে স্থলভাগে ঢুকে পড়ে এই ঘূর্ণিঝড়। এরপর সুন্দরবন বদ্বীপ অঞ্চলের দিকে এগিয়ে যায় বুলবুল। ওই সময় রাজ্যের আলিপুর আবহাওয়া দফতর জানিয়েছিল, তিন-চার ঘণ্টার মধ্যে স্থলভাগে আছড়ে পড়ার গোটা প্রক্রিয়াটি শেষ হবে।
এদিকে বাংলাদেশ আবহাওয়া অধিদফতরের বুলেটিনে বলা হয়েছে, শনিবার সন্ধ্যা ৬টায় চট্টগ্রাম সমুদ্রবন্দর থেকে ৪২৫ কিমি. পশ্চিম-দক্ষিণপশ্চিমে, কক্সবাজার সমুদ্রবন্দর থেকে ৪৩০ কিমি. পশ্চিম-দক্ষিণপশ্চিমে, মোংলা সমুদ্রবন্দর থেকে ২১০ কিমি. দক্ষিণপশ্চিমে এবং পায়রা সমুদ্রবন্দর থেকে ২৫৫ কিমি. দক্ষিণপশ্চিমে অবস্থান করছিল।
ঘূর্ণিঝড়টি আরও উত্তর/উত্তরপূর্ব দিকে অগ্রসর হয়ে শনিবার মধ্যরাত নাগাদ পশ্চিমবঙ্গ-খুলনা উপকূল (সুন্দরবনের কাছ দিয়ে) অতিক্রম করতে পারে। উত্তরপশ্চিম বঙ্গোপসাগর ও তৎসংলগ্ন এলাকায় অবস্থানরত অতি প্রবল ঘূর্ণিঝড় ‘বুলবুল’ আরও উত্তর-উত্তরপূর্ব দিকে প্রায় ১২ কিমি/ঘণ্টা বেগে অগ্রসর হয়ে একই এলাকায় অবস্থান করছে।
অতি প্রবল ঘূর্ণিঝড় বুলবুল কেন্দ্রের ৭৪ কিলোমিটারের মধ্যে বাতাসের একটানা সর্বোচ্চ গতিবেগ ঘণ্টায় ১১০ কিলোমিটার। যা দমকা অথবা ঝড়ো হাওয়ার আকারে ১৩০ কিলোমিটার পর্যন্ত বৃদ্ধি পাচ্ছে। অতি প্রবল ঘূর্ণিঝড় কেন্দ্রের কাছে সাগর খুবই বিক্ষুব্ধ রয়েছে।
এর আগে ঘূর্ণিঝড়ের জন্য মোংলা ও পায়রা সমুদ্রবন্দরকে ১০ নম্বর মহাবিপদ সংকেত দেখিয়ে যেতে বলা হয়। উপকূলীয় জেলা ভোলা, বরগুনা, পটুয়াখালী, বরিশাল, পিরোজপুর, ঝালকাঠি, বাগেরহাট, খুলনা, সাতক্ষীরা এবং তাদের অদূরবর্তী দ্বীপ ও চরগুলো ১০ নম্বর মহাবিপদ সংকেতের আওতায় থাকবে।
চট্টগ্রাম সমুদ্রবন্দরকে নয় নম্বর মহাবিপদ সংকেত দেখিয়ে যেতে বলা হয়। উপকূলীয় জেলা চট্টগ্রাম, নোয়াখালী, ল²ীপুর, ফেনী, চাঁদপুর এবং তাদের অদূরবর্তী দ্বীপ ও চরগুলো নয় নম্বর মহবিপদ সংকেতের আওতায় থাকবে। এছাড়া কক্সবাজার সমুদ্রবন্দরকে চার নম্বর স্থানীয় হুঁশিয়ারি সংকেত দেখিয়ে যেতে বলা হয়েছে।
জাহাজশূন্য চট্টগ্রাম বন্দর জেটি : ঘূর্ণিঝড় বুলবুলের প্রভাবে সাগর উত্তাল ও আবহাওয়া অধিদফতরের ৯ নম্বর মহাবিপদ সংকেতের কারণে চট্টগ্রাম বন্দর জেটি জাহাজশূন্য করা হয়। বন্ধ করে দেওয়া হয়েছে কনটেইনার ও কার্গো হ্যান্ডলিং। গতকাল সকাল থেকে বন্দরের মূল জেটির জাহাজগুলো একে একে বহির্নোঙরে পাঠিয়ে দেওয়া হয়।
বন্দর সচিব মো. ওমর ফারুক বলেন, চট্টগ্রাম বন্দর কর্তৃপক্ষ আবহাওয়া অধিদফতরের সতর্ক সংকেতকে সর্বোচ্চ গুরুত্ব দিয়ে বন্দর চ্যানেল নিরাপদ রাখতে প্রয়োজনীয় পদক্ষেপ নিয়েছে।
তিনি বলেন, কর্ণফুলী নদীর বন্দর চ্যানেলে অবস্থানরত অভ্যন্তরীণ জাহাজ ও ছোট ছোট নৌযানগুলো শাহ আমানত সেতুর উজানে পাঠিয়ে দিচ্ছে। বহির্নোঙরে (সাগরে) অবস্থানরত বড় জাহাজগুলো ক্রমান্বয়ে কুতুবদিয়া ও কক্সবাজার উপকূলে সরিয়ে নেওয়া হচ্ছে। এসব বড় জাহাজের ইঞ্জিন সার্বক্ষণিক চালু রাখতে নির্দেশনা দেওয়া হয়েছে।
বন্দরের সব কি গ্যান্ট্রি ক্রেন, রাবার টায়ার গ্যান্ট্রি ক্রেনসহ অন্যান্য হ্যান্ডলিং ইক্যুইপমেন্ট প্যাকিং করা হচ্ছে। ঝড়ো হাওয়ায় যাতে কনটেইনার পড়ে পণ্যের ক্ষয়ক্ষতি না হয় সে লক্ষ্যে একটির ওপর কয়েকটি রাখা কনটেইনার নামিয়ে রাখা হচ্ছে। বন্দরের অপারেশনাল কার্যক্রম বন্ধ ঘোষণা করা হয়েছে।
বন্দর সচিব মো. ওমর ফারুক জানান, বন্দর কর্তৃপক্ষের ‘সাইক্লোন ডিজেস্টার প্রিপার্ডনেস অ্যান্ড পোর্ট সাইক্লোন রিহ্যাবিলেটেশন প্ল্যান ১৯৯২ অনুযায়ী বন্দর চেয়ারম্যান নিজস্ব অ্যালার্ট জারি করেছেন। বন্দরের বহির্নোঙরে অবস্থানরত দেশি-বিদেশি জাহাজ, মূল জেটি ও টার্মিনালের কার্গো, কনটেইনার, হ্যান্ডলিং ইক্যুইপমেন্ট রক্ষায় বন্দর কর্তৃপক্ষ সচেষ্ট রয়েছে। বন্দর কর্তৃপক্ষের নৌ বিভাগের নিয়ন্ত্রণ কক্ষের নম্বর ০৩১-৭২৬৯১৬।
এনসিটি ও সিসিটির দায়িত্বে থাকা বন্দরের শীর্ষ টার্মিনাল অপারেটর মেসার্স সাইফ পাওয়ারটেকের ক্যাপ্টেন তানভির জানান, সকাল ৭টায় সিসিটি এনসিটির অপারেশন বন্ধ রাখা হয়েছে। এরপর একে একে সব জাহাজ বন্দরের অভিজ্ঞ পাইলটরা বহির্নোঙরে নিয়ে যান।

Print Friendly, PDF & Email

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here