মহানগর নিউজ

থার্টি ফার্স্ট নাইটে বিশ্বের দীর্ঘ সমুদ্র সৈকত কক্সবাজারে লাখো পর্যটকের ভিড় থাকা স্বাভাবিক। তবে এবারের চিত্র ভিন্ন। অন্যান্য সময়ে যত পর্যটক থাকে এ সময়েও তাও নেই। ফলে রীতিমত হতাশ হয়ে পড়েছেন পর্যটন সংশ্লিষ্ট ব্যবসায়ীরা। প্রতি বছর পুরোনো বছরকে বিদায় ও নতুন বছরকে স্বাগত জানাতে লাখো পর্যটকের ঢল নামে সৈকতে। কিন্তু এবার এসেছে মাত্র ৬০ হাজার পর্যটক।

শুক্রবার (৩১ ডিসেম্বর) বিকেলে মহানগর প্রতিবেদককে এ তথ্য জানিয়েছেন কক্সবাজার হোটেল ওনার্স এণ্ড অফিসার্স সমিতির সাধারণ সম্পাদক কলিম উল্লাহ।

এর কারণ হিসেবে তিনি উল্লেখ করেন, থার্টি ফাস্ট উপলক্ষে সমুদ্র সৈকতে কোন অনুষ্ঠান না থাকা। কিছুদিন যাবৎ কক্সবাজার নিয়ে নানা প্রপাগান্ডা ও অপপ্রচার এবং এক নারীকে সংঘবদ্ধ ধর্ষণের অভিযোগের কারণে এবার কক্সবাজার বিমুখ হয়েছেন পর্যটকরা।

কক্সবাজার জেলা প্রশাসন, পুলিশ ও পর্যটন সূত্র জানায়, মূলত ২৭ সেপ্টেম্বর বিশ্ব পর্যটন দিবসের পর থেকে কক্সবাজারে পর্যটকদের আনাগোনা শুরু হয়। ডিসেম্বর থেকে মার্চ পর্যন্ত কক্সবাজারে সর্বোচ্চ সংখ্যক পর্যটকের আগমন ঘটে। কিন্তু এবার পর্যটন দিবসের সপ্তাহখানেক পর থেকে পর্যটন জোনে ঘটতে থাকে নানা অঘটন।

এরমধ্যে সুগন্ধা পয়েন্টের শুটকি মার্কেটে কক্সবাজার সদর উপজেলা ছাত্রলীগ সভাপতি কাজী তামজীদ পাশার ওপর হামলা করে একদল দুর্বৃত্ত। এই পয়েন্ট দিয়েই সর্বোচ্চ সংখ্যক পর্যটক সমুদ্র সৈকতে আনাগোনা করে। এ ঘটনার কয়েকদিন পরই একই এলাকায় কক্সবাজার জেলা ছাত্রলীগের সাবেক সহসভাপতি মোনাফ সিকদারসহ দুজনকে গুলি করে পালিয়ে যান দুর্বৃত্তরা। খবরটি ছড়িয়ে পড়ায় পর্যটকদের মধ্যে আতঙ্ক সৃষ্টি হয়। অনেকেই ছাড়েন কক্সবাজার। বিপদে পড়েন হোটেল-মালিকেরা। তার ৪ দিন পর আবার পর্যটন জোনে নৈরাজ্য চলে। ৩১ অক্টোবর মোনাফকে গুলির ঘটনায় পৌর মেয়র ও জেলা আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক মুজিবুর রহমানকে হত্যাচেষ্টা মামলার প্রধান আসামি করায় তার হাজারো অনুসারী রাস্তায় নেমে আসেন। তারা শহরের প্রধান সড়কে টায়ার জ্বালিয়ে বিক্ষোভ করেন। এ সময় সড়কের দুই পাশের কয়েক হাজার দোকানপাট বন্ধ হয়ে যায়। শতাধিক বাস আটকে দেওয়া হয়। হোটেল-রেস্তোরাঁ বন্ধ হয়ে যাওয়ায় সৈকতে ভ্রমণে আসা ৫০ হাজারের বেশি পর্যটক বিপাকে পড়েন। তাতে বড় রকমের ক্ষতির মুখে পড়েন এখানকার ব্যবসায়ীরা।

ঘটনার এখানেই শেষ নয়, ৫ নভেম্বর রাতে কক্সবাজার শহরের লিংক রোডে গুলি চালিয়ে দুবৃর্ত্তরা হত্যা করেন জেলা শ্রমিক লীগের সভাপতি জহিরুল ইসলাম সিকদারকে। সবশেষ গত ২২ ডিসেম্বর স্বামী-সন্তানকে জিম্মি করে এক গৃহবধূকে তুলে নিয়ে সংঘবদ্ধ ধর্ষণের ঘটনা ঘটে। আন্তর্জাতিক গণমাধ্যমেও এ খবর প্রকাশিত হয়। এর আগে পর্যটকদের ৪৫০ টাকায় ডাল ভাত বিক্রির ভুয়া খবর ছাপায় কিছু গণমাধ্যম। এসব ঘটনায় কক্সবাজার নিয়ে পর্যটকদের মধ্যে বিরূপ প্রতিক্রিয়া তৈরি হয়েছে। শহরটা তারা নিরাপদ মনে করছেন না।

এ বিষয়ে হোটেল ও রেস্তোরাঁ মালিকদের সমিতির সমন্বিত মোর্চা ‘ফেডারেশন অব ট্যুরিজম ওনার্স অ্যাসোসিয়েশন অব বাংলাদেশ’–এর সাধারণ সম্পাদক আবুল কাশেম সিকদার বলেন, ‘এই সময়ে আমাদের হোটেল-মোটেলগুলোতে শতভাগ বুকিং থাকে। কিন্তু এখন ৫০ শতাংশের মত বুকিং আছে। এই মৌসুমে একের পর এক অপ্রীতিকর পরিস্থিতির সৃষ্টি হয়েছে। এটার প্রভাব পড়েছে।’

তিনি আরও জানান, বছরের শেষ সূর্যাস্ত ও নতুন বছরের সূর্যোদয় দেখার জন্য বছরের এই সময়টাতে দেশ-বিদেশের পর্যটকেরা ভিড় করেন কক্সবাজার শহরে। সৈকত এলাকার ৪৬৯টি হোটেল, মোটেল, গেস্টহাউস (নিবন্ধিত ৪২৬টি ও অনিবন্ধিত ৪৩টি) আছে। এসব হোটেল-মোটেলে ১ লাখ ৬০ হাজার মানুষের ধারণ ক্ষমতা থাকলেও টানা কয়েকদিনের ছুটিতে এবং বছরের শেষ ও নতুন বছরের শুরুর দিনের সময়টাতে সেই ভিড় বাড়ে। তখন প্রতিদিন অন্তত দুই থেকে তিন লাখ পর্যটক অবস্থান করেন কক্সবাজারে। কিন্তু আজকের চিত্র উল্টো।

সরেজমিনে দেখা যায়, কক্সবাজার শহরের লাবণী পয়েন্ট থেকে কলাতলী বীচ পর্যন্ত হাজার পনের পর্যটক ঘুরে বেড়াচ্ছেন। অথচ এই সময়ে লাখো পর্যটক সমুদ্র সৈকতে অবস্থান করেন।

তৃতীয়বারের মত কক্সবাজারে বেড়াতে আসা শরীয়তপুরের বিল্লাল হোসেন বলেন, স্ত্রীকে নিয়ে তৃতীয়বারের মত থার্টি ফাস্ট নাইট পালন করতে কক্সবাজার এসেছি। কিন্তু এত কম পর্যটক কখনো দেখিনি। তবে এবারের রুম ভাড়া এবং খাবারের দাম অন্যান্য বারের চেয়ে একটু বেশি। এদিকে প্রশাসনের নজর দরকার।

এ বিষয়ে কক্সবাজার হোটেল মোটেল মালিক সমিতির সভাপতি ওমর ফারুক বলেন, পর্যটন ব্যবসায় তিনটি মৌসুম রয়েছে। পিক, অফপিক ও সুপার পিক আওয়ার বলে থাকি আমরা। ডিসেম্বর থেকে মার্চ হচ্ছে সুপার পিক আওয়ার অর্থাৎ পর্যটনের ভরা মৌসুম। ওই সময়টাতে আমরা কক্ষ ভাড়ায় কোন ধরনের ছাড় দিতে পারিনা। অন্য সময়টাতে ছাড় থাকে।

কক্সবাজার চেম্বার অব কমার্স অ্যান্ড ইন্ডাস্ট্রিজের সভাপতি আবু মোর্শেদ চৌধুরী বলেন, ‘স্বাভাবিক সময়ে ছুটির দিনগুলোতে অন্তত ৪০০ কোটি টাকা ব্যবসা হয়। করোনার কারণে গত দুই মৌসুমে সেভাবে ব্যবসা হয়নি। এবার করোনা পরিস্থিতি অনেকটা স্বাভাবিক হলেও নানা অপ্রীতিকর ঘটনার প্রভাবে ব্যবসা হচ্ছে না।’

কক্সবাজারের অতিরিক্ত জেলা ম্যাজিস্ট্রেট (এডিএম) আবু সুফিয়ান বলেন, স্বরাষ্ট্রমন্ত্রণালয়ে কঠোর নির্দশনা রয়েছে উন্মুক্তস্থানে কোন অনুষ্ঠান না করার। এছাড়া কিছু কিছু মিডিয়ায় এবং সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম ফেসবুকে কক্সবাজার নিয়ে নানা ধরনের নেতিবাচক সংবাদ পরিবেশিত হয়েছে। সেই কারণে হয়তো এবার একটু পর্যটক কম।

তিনি আরও বলেন, ১৮ ডিসেম্বরের পর থেকে কক্সবাজারে তেমন পর্যটক নেই। এ থেকে উত্তোরণের জন্য আমরা নানা পদক্ষেপ নিয়েছি। যেমন হোটেল মোটেলের খালি কক্ষ, ভাড়া তালিকা ও খাবারের দাম টাঙ্গানোর নির্দেশনা দিয়েছি। পাশপাশি নিরাপদ ভ্রমণ নিশ্চিত করতে নানা উদ্যোগ নিয়েছি।

Print Friendly, PDF & Email

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here