অনলাইন ডেক্স: আগামী বাজেটে সামাজিক সুরক্ষা খাত অগ্রাধিকার পাবে। নতুন করে ১৩ লাখ দরিদ্র মানুষকে এই সামাজিক সুরক্ষার আওতায় আনা হবে। বর্তমান বাজেটে সামাজিক নিরাপত্তা বেস্টনির আওতায় সাড়ে ৭৩ লাখ মানুষ বিভিন্ন ভাতা পান। আগামী বাজেটে এ সংখ্যা হবে ৮৭ লাখ। বাজেট প্রণয়নের সঙ্গে সম্পৃক্ত নীতিনির্ধারক সূত্রে এসব তথ্য জানা গেছে।

সূত্র জানায়, সামাজিক সুরক্ষার আওতায় থাকা জনগণের মাসিক ভাতা এবারের বাজেটে তেমন বাড়ানো হবে না। তবে নতুন করে সুবিধাভোগীর সংখ্যা বাড়ানো হবে। সব বিষয়ে ভাতা না বাড়লেও কিছু ক্ষেত্রে অবশ্য ভাতা বৃদ্ধির প্রস্তাব থাকবে। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার নির্দেশ অনুযায়ী, এবারের বাজেটে যোগ্য সব প্রতিবন্ধীকে সামাজিক বেষ্টনীর আওতায় আনা হচ্ছে। একই সঙ্গে তাদের মাসিক ভাতা ও পরিবারের ছেলে-মেয়েদের শিক্ষাবৃত্তির টাকা বাড়ানো হচ্ছে। বাড়ছে মুক্তিযোদ্ধাদের সম্মানি ভাতা।

সূত্র জানায়, আসন্ন ২০১৯-২০ অর্থবছরের বাজেটে অতিরিক্ত ১৩ লাখের বেশি দরিদ্র জনগণ নতুন করে সামাজিক সুরক্ষার আওতায় আসছে। বর্তমানে বিভিন্ন মন্ত্রণালয়ের অধীনে বাস্তবায়নাধীন বয়স্ক ও বিধবা, প্রতিবন্ধী, মাতৃত্বকালীন ও মুক্তিযোদ্ধা সম্মানি ভাতাসহ বিভিন্ন জনকল্যাণমূলক সামাজিক কর্মসূচির আওতায় কমবেশি ৭৩ লাখ ৩৮ হাজার উপকারভোগী সরকারের কাছ থেকে নিয়মিত মাসিক ভাতা পাচ্ছেন। সূত্র জানায়, আগামী অর্থবছরের বাজেটে এই সংখ্যা ৮৭ লাখে উন্নীত করা হচ্ছে। গত ২৯ এপ্রিল অর্থমন্ত্রী আ হ ম মুস্তফা কামালের সভাপতিত্বে বাজেট নিয়ে এক বৈঠক হয়। ওই বৈঠকে আরও বেশি দরিদ্র জনগণকে সামাজিক নিরাপত্তাবলয়ের আওতায় আনার নীতিগত সিদ্ধান্ত হয়। সূত্র জানায়, বৈঠকে দুটি বিষয়ে গুরুত্ব দেন অর্থমন্ত্রী। প্রথমত, কর্মক্ষম ভাতাভোগীদের স্বাবলম্বী করা। দ্বিতীয়ত, সকল ভাতাভোগীকে দ্রুত অনলাইন ডাটাবেসের বা ডিজিটালাইজেশনের আওতায় নিয়ে আসা। অর্থমন্ত্রী বলেন, যে সব উপকারভোগী এখন ভাতা পাচ্ছেন, তাদের অনেকেই কর্মক্ষম। তাদের ভাতার আওতা থেকে ক্রমান্বয়ে বের করে আনতে হবে। এ জন্য আয় বৃদ্ধিমূলক কর্মকাণ্ডে প্রশিক্ষণের ব্যবস্থা করতে হবে। দরকার হলে আলাদা বরাদ্দ রাখা হবে বাজেটে। বিষয়টি পরীক্ষা-নিরীক্ষা করে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নিতে সংশ্নিষ্টদের নির্দেশ দেন অর্থমন্ত্রী। বর্তমানে বয়স্ক, বিধবাসহ কিছু ভাতার টাকা পরিশোধ পদ্ধতি ডিজিটালাইজ করা হয়েছে। এ ব্যবস্থায় মাসিক ভাতার টাকা সরকারি কোষাগার থেকে সরাসরি উপকারভোগীর ব্যাংক অ্যাকাউন্টে চলে যায়। বৈঠকে অর্থমন্ত্রী জানান, সকল উপকারভোগী যাতে এ ব্যবস্থায় ভাতা পেতে পারেন তা দ্রুত নিশ্চিত করতে হবে।

সূত্র জানায়, বর্তমানে দশ লাখ অসচ্ছল প্রতিবন্ধী মাসিক ৭০০ টাকা করে ভাতা পান। এ ছাড়া অসচ্ছল প্রতিবন্ধী পরিবারের সদস্যরা শিক্ষার বিভিন্ন স্তরে নির্দিষ্ট অঙ্কের ভাতা পান। আগামী বাজেটে অসচ্ছল প্রতিবন্ধীদের আওতা বাড়িয়ে সাড়ে পনেরো লাখে উন্নীত করা হচ্ছে। ভাতা দেওয়া হবে ৭৫০ টাকা। এখন ৯০ হাজার অসচ্ছল প্রতিবন্ধী পরিবারের ছেলেমেয়ে শিক্ষার বিভিন্ন স্তরে (প্রাইমারি থেকে উচ্চতর) সর্বনিম্ন মাসিক ৭০০ টাকা এবং সর্বোচ্চ ১২০০ টাকা করে বৃত্তি পায়। আসন্ন বাজেটে বৃত্তির টাকা আরও ৫০ টাকা বাড়ানো হচ্ছে। সব মিলে সাড়ে ১৬ লাখ প্রতিবন্ধী ও তাদের পরিবারের শিক্ষিত ছেলেমেয়েকে সামাজিক নিরাপত্তা বেষ্টনীর আওতায় নিয়ে আসা হচ্ছে, যা এখন আছে প্রায় এগারো লাখ। অর্থাৎ নতুন করে আরও অতিরিক্ত পাঁচ লাখ পঞ্চাশ হাজার আর্থিক সহায়তা পাবেন। জানা যায়, গত মাসে আন্তর্জাতিক অটিজম দিবস অনুষ্ঠানে জরিপভুক্ত সকল প্রতিবন্ধী যাতে মাসিক ভাতা পান সে বিষয়ে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নেওয়ার নিদের্শ দেন প্রধানমন্ত্রী। সমাজকল্যাণ মন্ত্রণালয় সূত্রে জানা যায়, জরিপে ১৫ লাখ ৫০ হাজার প্রতিবন্ধী চিহ্নিত করা হয়। এর মধ্যে দশ লাখকে ইতিমধ্যে সামাজিক সুরক্ষার আওতায় আনা হয়েছে। প্রধানমন্ত্রীর নির্দেশ অনুসারে বাকিদের আগামী বাজেটে আওতায় আনা হবে।

মুক্তিযোদ্ধাদের জন্য এবারও সুখবর থাকছে বাজেটে। বর্তমানে প্রায় দুই লাখ মুক্তিযোদ্ধা নগদ দশ হাজার টাকা করে মাসিক ভাতা পান। ২০১৯-২০ বাজেটে তাদের শুধু ভাতা বাড়িয়ে ১২ হাজার টাকা করা হচ্ছে। অর্থাৎ তাদের মাসিক ভাতা আরও দুই হাজার টাকা বাড়ছে। এর বাইরে মুক্তিযোদ্ধারা বর্তমানে দুই ঈদে সমপরিমাণ দুটি বোনাস, স্বাধীনতা ও বিজয় দিবস ভাতা ও বৈশাখী ভাতা ভোগ করছেন। এসব সুবিধা আগের মতোই অব্যাহত থাকছে।

সূত্র জানায়, সমাজকল্যাণ মন্ত্রণালয়ের অধীনে বাস্তবায়নাধীন সামাজিক নিরাপত্তাবলয়ের আওতায় বর্তমানে বয়স্কভাতা হচ্ছে সবচেয়ে বড় কর্মসূচি। বর্তমানে ৬৫ বছরের বয়স্ক ব্যক্তি মাসিক নগদ ৫০০ টাকা করে ভাতা পান। সারাদেশে মোট ৪০ লাখ গরিব বয়স্ক ব্যক্তি এই ভাতা পান। আসন্ন বাজেটে ভাতা অপরিবর্তিত রেখে তাদের সংখ্যা বর্তমানের চেয়ে বাড়িয়ে ৪৪ লাখে উন্নীত করা হচ্ছে। অর্থাৎ বাড়তি আরও চার লাখ বয়স্কভাতা পাবেন। সামাজিক নিরাপত্তা বেষ্টনীর আওতায় আরেকটি বড় কর্মসূচি হচ্ছে বিধবা ভাতা। বর্তমানে ১৪ লাখ বিধবা মাসে ৫০০ টাকা করে ভাতা পান। নতুন বাজেটে তাদের সংখ্যা আরও তিন লাখ বাড়িয়ে ১৭ লাখে উন্নীত করা হচ্ছে। এ ছাড়া ভাতা একই রাখা হচ্ছে। জানা যায়, বর্তমানে মহিলা ও শিশুবিষয়ক মন্ত্রণালয়ের অধীনে বাস্তবায়নাধীন মাতৃত্বকালীন ভাতা পাচ্ছেন ৭ লাখ নারী। ভাতার অঙ্ক মাসিক ৮০০ টাকা। আসন্ন বাজেটে আরও ৭০ হাজার দরিদ্র মাকে নতুন করে এর আওতায় আনা হচ্ছে। তবে ভাতা অপরিবর্তিত রাখা হচ্ছে।

সূত্র জানায়, বর্তমানে সমাজকল্যাণ মন্ত্রণালয়ের অধীনে সবচেয়ে বেশি সামাজিক সুরক্ষা কর্মসূচি বাস্তবায়নাধীন আছে। এর মধ্যে বয়স্ক, বিধবা, অসচ্ছল প্রতিবন্ধী, প্রতিবন্ধী শিক্ষা উপবৃত্তি, ক্যান্সার, কিডনিসহ বিভিন্ন দুরারোগ্য ব্যাধিতে আক্রান্ত ব্যক্তি, পিছিয়ে পড়া জনগোষ্ঠী তথা বেদে সম্প্রদায় ও তাদের ছেলেমেয়েদের জন্য শিক্ষাবৃত্তি, হিজড়া জনগোষ্ঠী ও চাবাগানের শ্রমিকদের জীবনমান উন্নয়নে গৃহীত কর্মসূচির আওতায় বিভিন্ন অঙ্কের মাসিক ভাতা দেওয়া হয়। এর বাইরে ত্রাণ-দুর্যোগ,শিক্ষা, স্বাস্থ্যসহ ২২ মন্ত্রণালয় ও সংস্থা সামাজিক নিরাপত্তা বেষ্টনীর আওতায় ১৩০টি কর্মসূচি বাস্তবায়নাধীন রয়েছে। যেমন- পেনশন সুবিধা এক ধরনের সামাজিক কর্মসূচি। এতে বছরে সরকারের ব্যয় হয় ২০ হাজার কোটি টাকার বেশি। আবার কম দামে গরিবদের চাল দেওয়া, ভিজিডি, ভিজিএফ, ঘরে ঘরে চাকরি দেওয়ার লক্ষ্যে বাস্তবায়নাধীন ন্যাশনাল সার্ভিসের মতো কর্মসূচির মাধ্যমে দারিদ্র্য বিমোচন করা হয়। এরকম ১৩০টি কর্মসূচি আছে, যা বিভিন্ন মন্ত্রণালয়ের মাধ্যমে বাস্তবায়ন করা হচ্ছে। তবে জনপ্রিয় এবং বড় কর্মসূচিগুলো বাস্তবায়ন করছে সমাজকল্যাণ মন্ত্রণালয়ের অধীন সমাজসেবা অধিদপ্তর। অর্থ মন্ত্রণালয় সূত্রে জানা গেছে, বর্তমানে মোট বাজেটের ১৩ শতাংশ অর্থ এই সামাজিক সুরক্ষা খাতে বরাদ্দ দেওয়া হয়। চলতি অর্থবছরে এ খাতে মোট বরাদ্দ দেওয়া হয় ৬৪ হাজার কোটি টাকা, যা মোট জিডিপির আড়াই শতাংশ। আগামী বাজেটে এ খাতে মোট ৭২ হাজার কোটি টাকা বরাদ্দের প্রস্তাব করা হতে পারে।

বর্তমান সরকার ১৯৯৬-৯৭ অর্থবছরে সামাজিক নিরাপত্তা কর্মসূচি চালু করেছিল। পরবর্তী সময়ে সব সরকার এসব কর্মসূচি অব্যাহত রাখে। কিন্তু পদ্ধতিগত দুর্বলতা ও দুর্নীতির কারণে এর সুফল আশানুরূপভাবে মিলছে না বলে অভিযোগ উঠেছে। তত্ত্বাবধায়ক সরকারের সাবেক অর্থ উপদেষ্টা ড. এবি মির্জ্জা আজিজুল ইসলাম বলেন, সামাজিক নিরাপত্তা খাতে বিভিন্ন ভাতা প্রদানের ক্ষেত্রে ব্যাপক দুর্নীতি হচ্ছে। প্রতিবছর এ খাতে বিপুল পরিমাণ অর্থ ব্যয় করা হলেও এর সুফল উপকারভোগী বা টার্গেট গ্রুপের কাছে তেমন একটা পৌঁছায় না।

বিআইডিএসের গবেষণা পরিচালক ড. জায়েদ বখত বিদ্যমান কর্মসূচিগুলো পর্যালোচনা করে যোগ্যদের কাছে তার সুবিধা নিশ্চিত করার পরামর্শ দেন। সমাজকল্যাণ মন্ত্রণালয় সূত্রে জানা যায়, ভাতা প্রদান প্রক্রিয়া স্বচ্ছ ও দ্রুত পেতে অটোমেশনের পরিকল্পনা নেওয়া হয়। এরমধ্যে বয়স্ক, বিধবার মতো বড় তিন ধরনের ভাতা প্রদান পদ্ধতি আংিশক ডিজিটালাইজ করা হয়েছে। সরকারের লক্ষ্য হচ্ছে ২০২০ সালের মধ্যে সব ধরনের ভাতা প্রদান কর্মসূচি ডিজিটালাইজেশনের আওতায় আনা। এ পরিকল্পনা বাস্তবায়নে কাজ চলছে বলে তিনি জানালেন।

ক্যান্সার, কিডনি, লিভার সিরোসিস, স্ট্রোক ও প্যারালাইসিসে আক্রান্ত গরিব রোগীদের এককালীন নগদ সহায়তা দেয় সরকার। এর পরিমাণ রোগীপ্রতি ৫০ হাজার টাকা। বর্তমানে ১৫ হাজার রোগী আর্থিক সুবিধা পাচ্ছেন। আসন্ন বাজেটে এই সংখ্যা দ্বিগুণ করা হচ্ছে। বেদে ও অনগ্রসর জনগোষ্ঠী এবং তাদের ছেলেমেয়েরা মাসিক ভাতাসহ নানা সুবিধা পাচ্ছে। বর্তমানে ৬৪ হাজার এই সুবিধা ভোগ করছে। নতুন বাজেটে এই সংখ্যা ৮১ হাজারে উন্নীত করা হচ্ছে। একই সঙ্গে সুবিধাভোগী ছেলেমেয়েদের বৃত্তির টাকা অব্যাহত থাকছে। এ ছাড়া চা শ্রমিকদের জীবনমান উন্নয়নে সহায়তা করছে সরকার। বর্তমানে ৪০ হাজার চা শ্রমিক এককালীন ৫ হাজার টাকা করে নগদ সহায়তা পাচ্ছেন। নতুন বাজেটে আরও দশ হাজার চা শ্রমিককে সহায়তা দেওয়া হবে। তবে টাকার অঙ্ক একই থাকছে। সব মিলিয়ে বাড়তি ১৩ লাখ ৬২ হাজার গরিব মানুষকে সামাজিক সুরক্ষার আওতায় আনা হচ্ছে।

এবি/সবুজ

Print Friendly, PDF & Email

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here