কিউআর কোডের মাধ্যমে কবর ব্যবস্থাপনার আওতায় কুড়িগ্রামের এক ভাষা সৈনিকের কবরস্থান।

প্রযুক্তির উৎকর্ষতায় ডিজিটালের সুফল এরইমধ্যে ছড়িয়ে পড়েছে শহর, নগর এমনকি গ্রামীণ জনপদেও। পোশাক থেকে শুরু করে খাদ্যদ্রব্যের কেনাকাটা। এমনকি ব্যবসা বাণিজ্যে বেড়েছে অনলাইন নির্ভরতা।

প্রবাসীদের রেমিট্যান্স আর ঘরে বসে ইন্টারনেটে পড়াশোনা, চিকিৎসকের পরামর্শ সঙ্গে জরুরি ওষুধপত্রও এখন ঘরে বসে এক ক্লিকে হাতের নাগালে। সবকিছুতেই যখন ডিজিটালের অভূতপূর্ব ছোঁয়া, তখন আর মৃত ব্যক্তিদের আলাদা করে রাখা নিষ্প্রয়োজন।

মৃত মানুষ তা সম্প্রতি কিংবা শত বছরের পুরনো, তাদের তথ্যও এখন হালনাগাদ হচ্ছে ডিজিটাল মাধ্যমে। আর হ্যাঁ, এমনই এক উদ্ভাবন নিয়ে এসেছে কুড়িগ্রামের তরুণ উদ্যোক্তা চৌধুরী তানভীর ইসলাম অন্তু ও তার সংগঠন ‘অপ্রতিরোধ্য কুড়িগ্রাম’। যারা দেশে প্রথমবারের মতো কবরস্থানে কিউআরকোড ব্যবহার করে কবর ব্যবস্থাপনাকে নিয়ে এসেছে ডিজিটাল সেবার আওতায়।

বীর মুক্তিযোদ্ধাদের সমাধি ও কবরস্থানের ব্যবস্থাপনার উদ্যোগ নেয়ায় ডিজিটাল বাংলাদেশ দিবস-২০২২ এ ডিজিটাল বাংলাদেশ পুরস্কার-২০২২ পেয়েছেন কুড়িগ্রামের তরুণ উদ্যোক্তা চৌধুরী তানভীর ইসলাম অন্তু ও তার সংগঠন। সোমবার (১২ ডিসেম্বর) সকাল ১০টায় বঙ্গবন্ধু আন্তর্জাতিক সম্মেলন কেন্দ্রে (বিআইসিসি) প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা কুড়িগ্রামের এ তরুণ উদ্যোক্তার হাতে পুরস্কার তুলে দেন।

মূলত বীর মুক্তিযোদ্ধাদের সমাধি ও কবরস্থানের ডিজিটাল ব্যবস্থাপনার মাধ্যমে কিউআর কোডের মাধ্যমে কবর সনাক্তকরণের জন্য এ পুরস্কার দেয়া হয়। পুরস্কার হিসেবে তাকে ক্রেস্ট, সার্টিফিকেট ও ৪৫ হাজার টাকা দেয়া হয়েছে।চৌধুরী তানভীর ইসলাম অন্তু দীর্ঘদিন ধরে নতুন নতুন চিন্তাধারা নিয়ে কুড়িগ্রাম জেলায় বিভিন্ন সামাজিক কাজ করে আসছেন। ‘অপ্রতিরোধ্য কুড়িগ্রাম’ নামক সামাজিক সংগঠনের প্রতিষ্ঠাতা ও বর্তমান সভাপতি তিনি।

তরুণ উদ্যোক্তা চৌধুরী তানভীর ইসলামের উদ্যোগে ২০২২ সালের ২১ আগস্ট বীর মুক্তিযোদ্ধাদের সমাধি ও কবরস্থানের ডিজিটাল ব্যবস্থাপনা কার্যক্রমের উদ্বোধন করা হয়। কুড়িগ্রাম জেলা প্রশাসকের সম্মেলন কক্ষে সে সময় ওই কার্যক্রমের উদ্বোধন করেন সদ্যবিদায়ী জেলা প্রশাসক মোহাম্মদ রেজাউল করিম।

সার্বিক বিষয় নিয়ে সময় সংবাদের মুখোমুখি তরুণ উদ্যোক্তা চৌধুরী তানভীর ইসলাম অন্তু। জানান এই দীর্ঘ পথচলায় সমস্যা আর সম্ভাবনার নানান কথা।

চৌধুরী তানভীর ইসলাম অন্তু: জাতির শ্রেষ্ঠ সন্তান বীর মুক্তিযোদ্ধাদের সমাধি ও তাদের বীরত্বের কাহিনীগুলো আগামী প্রজন্মের কাছে তুলে ধরতে ডিজিটাল প্রক্রিয়ায় তাদের কবর ব্যবস্থাপনার উদ্যোগ নেয় অপ্রতিরোধ্য কুড়িগ্রাম। এই কার্যক্রমে শুধু মুক্তিযোদ্ধা নন, সাধারণ মানুষের কবরও অন্তর্ভুক্ত করা হয়েছে। এতে করে স্বজনরা সহজেই তাদের পরিবারের মৃত সদস্যদের কবর খুঁজে পাবেন। জায়গা সংকুলান না হওয়ায় অনেক কবরস্থানে এক কবরের ওপরে আরেক কবর দিলে আগের কবর খুঁজে পাওয়া যায় না। এমনকি সেখানে কার কবর ছিল সেটাও জানা থাকে না। কিন্তু এই কবর ব্যবস্থাপনায় ডিজিটাল পদ্ধতি ব্যবহারের ফলে এ সমস্যার সমাধান হবে।

ডিজিটাল কবর ব্যবস্থাপনায় কিউআর কোড:
তরুণ উদ্যোক্তা চৌধুরী তানভীর: আমরা জিআইএস ম্যাপ করেছি। এরপর ওই ম্যাপের আওতায় প্রত্যেকটা কবর প্লট ভিত্তিক করেছি। ওই প্লটগুলোকে আমরা কিউআর কোডের আওতায় এনেছি। যখন কোনো একটা কবরে গিয়ে কিউআর কোডে স্ক্যান করবেন তখন আপনি ওই কবরের তথ্য আপনার মোবাইলে পেয়ে যাচ্ছেন।

কিউআর কোডে যে সব তথ্য পাওয়া যাবে:
চৌধুরী তানভীর ইসলাম: ওই কিউআর কোডে কবরবাসীর তথ্য নির্ভর করবে তার আত্মীয় স্বজন আমাদের কতটা তথ্য দিয়ে সহযোগিতা করছে তার ওপর। তারা যতটুকু তথ্য দেয় সেগুলোই থাকে। এর বাইরে মৃত ব্যক্তির বাবার নাম, তার কতজন সন্তান আছে বা তার এই কবরে আর কেউ আছেন কিনা। এ ছাড়া পরিচয়, ঠিকানা, জন্ম-মৃত্যুর তারিখ এমনকি কি কারণে মারা গেছেন, কোন সময়ে মারা গেছেন, কবর কখন হয়েছে এসব সংরক্ষণ করছি। যদি কেউ জাতীয় পরিচয়পত্রের নম্বর দেন সেটাও এখানে শো করবে। তবে এটা বাধ্যতামূলক নয়। এর বাইরে মৃত ব্যক্তির আত্মীয়স্বজন ও যিনি তথ্য দিচ্ছেন তার ব্যক্তিগত কিছু তথ্য আমরা রাখছি।

ডিজিটাল কবর ব্যবস্থাপনার সুফল:
তরুণ উদ্যোক্তা: ডিজিটাল কবর ব্যবস্থাপনার মাধ্যমে আমরা মূলত যেটা করছি বিশেষ করে ফ্যামিলি ট্রি বা পরিবার বৃক্ষ। ‍যদি ভিন্ন ভিন্ন ব্লকে ব্লাড রিলেটেড স্বজনরা থাকেন তাহলে পরবর্তী প্রজন্ম সাধারণত তাদের খুঁজে পাবে না। সেখানে এই কিউআর কোডের মাধ্যমে যদি কেউ তার দাদা বা নানার নামের ওপর ক্লিক করেন তিনি ওই মৃত ব্যক্তির পুরো পরিবার বৃক্ষটি চলে আসবে। এখানে মূলত আর্টিফিশিয়াল ইন্টেলিজেন্স (এআই) প্রযুক্তি ব্যবহার করা হচ্ছে।

ডিজিটাল কবর ব্যবস্থাপনায় প্রতিবন্ধকতা:
অপ্রতিরোধ্য কুড়িগ্রাম এর সভাপতি চৌধুরী তানভীর ইসলাম অন্তু: তথ্যগত সমস্যাটা প্রকট। যত বেশি আমরা তথ্য পাবো তত বেশি আমরা কাজ করতে পারবো। ডাটা অ্যানালাইসিস সহজ হবে। বিগ ডাটা অ্যানালাইসিসের ক্ষেত্রে। যেমন অনেকেই আমাদের তথ্য দেয় না যে ওই ব্যক্তি কিভাবে মারা গেছেন। এটা পেলে হয় কি যে, আমরা একটা জিনিস বুঝতে পারি যে এই এলাকায় এই রোগে বেশি মানুষ মারা যাচ্ছে। এটার কারণ কি? তখন এটা নিয়ে পরবর্তীতে গবেষণা হতে পারে। আমরা তথ্য উপাত্ত কম পাচ্ছি, যদি এটা বেশি পেতাম তাহলে এটা সরকারের একটা সম্পদ হয়ে যেতো।

আমরা সবশেষ যে তথ্য পেয়েছি সেটা হচ্ছে ১৯৬৮ সালে মারা যাওয়া ব্যক্তির। অনেকেই এটা জানে আবার অনেকেই জানেন না। প্রথমে অনেকেই তথ্য দিতো না। এখন অনেকে স্বতঃস্ফূর্তভাবে এসে তথ্য দিচ্ছেন। একটা প্রজন্ম চলে গেছে, তাদের পেলে আমরা আরও বেশি তথ্য পেতাম। তবে এখন যে তথ্য রাখা হচ্ছে তা তো হাজার হাজার বছর থেকে যাবে। আমরা তথ্যের জন্য বাসায় বাসায় গেছি, আবার বিভিন্ন মাধ্যমে খোঁজ নিই। যাতে কবরগুলো শনাক্ত করে দেন এবং মৃত ব্যক্তির তথ্যগুলো দেন। এইভাবেও কিছু তথ্য সংগ্রহ করেছি। আবার অনেকের তথ্য পাওয়া যায় না।

ডিজিটাল কবর ব্যবস্থাপনায় অন্তর্ভুক্তি খরচ:
এমন প্রশ্নের জবাবে চৌধুরী তানভীর ইসলাম অন্তু বলেন, এখানে কোনো খরচ নেই। এটা সম্পূর্ণ বিনামূল্যে করা হচ্ছে। এটা আমরা সামাজিক কাজ করি। এখানে এ টু জেড সম্পূর্ণ বিনামূল্যে। কারো একটি টাকাও খরচ হবে না। আমাদের টিম মেম্বাররা সবাই স্বেচ্ছাসেবী হিসেবে কাজ করছেন।

কুড়িগ্রামপরবর্তী যে জেলা ডিজিটাল কবর ব্যবস্থাপনায়:
আমরা পঞ্চগড়ে খুব সম্ভবত ডিজিটাল কবর ব্যবস্থাপনার কাজ করতে যাবো এই ডিসেম্বরেই। এছাড়া তথ্য মন্ত্রণালয়ের সচিব আমাদের আশ্বাস দিয়েছেন যে, তারা এই জিনিসটা নিয়ে কাজ করবে। আমরা পর্যায়ক্রমে সারাদেশের কবরগুলোকে ডিজিটাল কবর ব্যবস্থাপনার আওতায় আনবো।

যাদের তথ্য মিলছে কিউআর কোডে:
জানা গেছে, কার্যক্রম শুরুর পর থেকে ফুলবাড়ী উপজেলার ৮৬ জন বীর মুক্তিযোদ্ধার কবর এবং জেলা শহরের কেন্দ্রীয় কবরস্থানের প্রায় দেড় হাজার কবরবাসীর তথ্য ডিজিটালাইজড করা হয়েছে। কবরগুলোতে কিউআর কোড বসানো হয়েছে। কিউআর কোড স্ক্যানের মাধ্যমে কবরের মরহুম বা মরহুমার সব তথ্যাদি পাওয়া যাবে।

ডাক-টেলিযোগাযোগ ও তথ্য প্রযুক্তি মন্ত্রণালয়ের তথ্য ও যোগাযোগ প্রযুক্তি অধিদফতরের মহাপরিচালক মো. মোস্তফা কামাল (অতিরিক্ত সচিব) স্বাক্ষরিত পত্রে জেলা পর্যায়ে ডিজিটাল বাংলাদেশ পুরস্কার-২০২২ এর সাধারণ বেসরকারি ক্যাটাগরিতে বীর মুক্তিযোদ্ধাদের সমাধি ও কবরস্থানের ডিজিটাল ব্যবস্থাপনা উদ্যোগটি চূড়ান্তভাবে নির্বাচিত হওয়ার বিষয়টি জানতে পারে এ তরুণ উদ্যোক্তা। আমন্ত্রণপত্র পাওয়ার পর আনুষ্ঠানিকভাবে প্রধানমন্ত্রীর কাছ থেকে এ পুরস্কার গ্রহণ করেন চৌধুরী তানভীর ইসলাম অন্তু।

দেশের প্রথম ডিজিটাল কবর ব্যবস্থাপনার উদ্বোধন

দেশের প্রথম ডিজিটাল কবর ব্যবস্থাপনার উদ্বোধন

কুড়িগ্রামে দেশের প্রথম ডিজিটাল কবর ব্যবস্থাপনা কার্যক্রমের উদ্বোধন করা হয়েছে। বীর মুক্তিযোদ্ধাদের জন্য কবর ব্যবস্থাপনায় ডিজিটাল পদ্ধতির ব্যবহারের উদ্যোগ গ্রহণ করেছে অপ্রতিরোধ্য কুড়িগ্রাম নামক সামাজিক সংগঠন।

রোববার (২১ আগস্ট) বিকেলে কুড়িগ্রাম জেলা প্রশাসকের সম্মেলন কক্ষে কবর ব্যবস্থাপনায় ডিজিটাল পদ্ধতি উদ্বোধন করেন জেলা প্রশাসক মোহাম্মদ রেজাউল করিম।

উদ্বোধনী অনুষ্ঠানে আরও উপস্থিত ছিলেন কুড়িগ্রামের সিভিল সার্জন ডা. মঞ্জুর-এ-মুর্শেদ, কুড়িগ্রাম সরকারি কলেজের অধ্যক্ষ মির্জা নাসির উদ্দিন, পাবলিক প্রসিকিউটর আব্রাহাম লিংকন, কুড়িগ্রাম পৌর মেয়র কাজিউল ইসলাম, অতিরিক্ত পুলিশ সুপার রুহুল আমিন, জেলা শিক্ষা অফিসার শামসুল ইসলাম প্রমুখ।

আয়োজকরা জানান, আইসিটি খাতে উন্নয়ন ত্বরান্বিত করার লক্ষ্যে এবং প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ঘোষিত রূপকল্প ২০৪১ বাস্তবায়নে এ উদ্যোগ নেয়া হয়েছে। জাতির সর্বকালের শ্রেষ্ঠ সন্তান বীর মুক্তিযোদ্ধাদের সমাধি ও তাদের বীরত্বের কাহিনীগুলো আগামী প্রজন্মের কাছে তুলে ধরার উদ্দেশে ডিজিটাল কবর ব্যবস্থাপনার উদ্যোগ নিয়েছে অপ্রতিরোধ্য কুড়িগ্রাম।

শুধু মুক্তিযোদ্ধা নন, সাধারণ মানুষের কবরগুলোকেও এই প্রকল্পের আওতায় হবে বলে জানান আয়োজকরা। এতে করে মৃত ব্যক্তির নিকটাত্মীয়রা সহজেই তাদের পরিবারের মৃত সদস্যদের কবর খুঁজে পাবেন।

অনেক সময় কবরস্থানগুলোতে এক কবরের ওপরে আরেকটি কবর দেয়া হয়। এতে আগের কবর খুঁজে পাওয়া যায় না। এমনকি সেখানে কার কবর ছিল সে চিহ্নও থাকে না। কিন্তু কবর ব্যবস্থাপনায় ডিজিটাল পদ্ধতি ব্যবহারের ফলে এই সমস্যা থেকে পরিত্রাণ মিলবে।

অপ্রতিরোধ্য কুড়িগ্রামের প্রতিষ্ঠাতা ও সংগঠনটির সভাপতি অন্তু চৌধুরী জানান, প্রাথমিকভাবে জেলা শহরের কেন্দ্রীয় কবরস্থানের ১ হাজার ৩৯৬টি কবর ও জেলার ফুলবাড়ী উপজেলার ৮৬টি কবরের তথ্য ডিজিটাল করা হয়েছে।

Print Friendly, PDF & Email

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here