একাত্তরে গঠন করেন ‘জয় বাংলা’ বাহিনী। সে সময় গ্রেফতার হন পাকিস্তানি সেনাদের হাতে। পরে পাগলের অভিনয় করে কারাগার থেকে ছাড়া পেয়ে পালিয়ে যান ভারতে। উত্তর প্রদেশের তান্ডুয়া সামরিক ক্যাম্পে প্রশিক্ষণরত মুক্তিযোদ্ধাদের একটি স্কোয়াডের কমান্ডার নিযুক্ত হন তিনি। পরে যোগ দেন মুক্তিযুদ্ধে।

তিনি চট্টলবীর এবিএম মহিউদ্দিন চৌধুরী। ছিলেন চট্টগ্রাম সিটি করপোরেশনের টানা তিনবারের মেয়র। রোববার (১৫ ডিসেম্বর) এই রাজনীতিবিদের ২য় মৃত্যুবার্ষিকী।

১৯৪৪ সালের ১ ডিসেম্বর রাউজানের গহিরা গ্রামের বক্স আলী চৌধুরী বাড়িতে জন্ম মহিউদ্দিন চৌধুরীর। বাবা হোসেন আহমদ চৌধুরী ছিলেন রেলওয়ে কর্মকর্তা, মা বেদুরা বেগম। ১৯৬২ সালে এসএসসি, ১৯৬৫ সালে এইচএসসি এবং ১৯৬৭ সালে তিনি ডিগ্রি পাস করেন। চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের ইসলামের ইতিহাস ও সংস্কৃতি বিভাগ এবং পরে আইন কলেজে ভর্তি হলেও ছাত্র আন্দোলনে জড়িয়ে পড়ায় পড়ালেখা শেষ করতে পারেননি। ১৯৬৮ ও ১৯৬৯ সালে তিনি নগর ছাত্রলীগের সাধারণ সম্পাদক নির্বাচিত হন।

এরপর শ্রমিক রাজনীতিতে যুক্ত হন মহিউদ্দিন চৌধুরী। যুবলীগের নগর কমিটির সাধারণ সম্পাদকের দায়িত্বও পালন করেন তিনি। পঁচাত্তরে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান সপরিবারে নিহত হলে প্রতিশোধ নিতে মৌলভী সৈয়দের নেতৃত্বে ‘মুজিব বাহিনী’ গঠন করেন। ওই সময় ‘চট্টগ্রাম ষড়যন্ত্র মামলা’র আসামি করা হলে তিনি কলকাতায় চলে যান। এরপর ১৯৭৮ সালে দেশে ফেরেন।

মহিউদ্দিন চৌধুরী চট্টগ্রামে স্বৈরাচারবিরোধী আন্দোলন, বন্দর রক্ষা আন্দোলন ও অসহযোগ আন্দোলনেও নেতৃত্ব দিয়েছেন। প্রায় দুই যুগ মহানগর আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক থাকার পর ২০০৬ সালের ২৭ জুন মহানগর আওয়ামী লীগের সভাপতি নির্বাচিত হন। মেয়র থাকাকালীন তার চশমা হিলের বাসা ছিল সবার জন্য উন্মুক্ত।

১৯৯১ সালের ঘূর্ণিঝড়ের পর বেওয়ারিশ মরদেহ নিজ কাঁধে বহন করে দাফন ও সৎকার করেছেন। অস্থায়ী হাসপাতাল বানিয়ে চিকিৎসকদের মাধ্যমে শত শত ডায়রিয়া আক্রান্ত রোগীর চিকিৎসার ব্যবস্থা করেছেন। কালুরঘাটে গার্মেন্টসে আগুনে পুড়ে অর্ধশতাধিক শ্রমিকের মৃত্যু ও বন্দরটিলায় সংঘর্ষে নিহত ব্যক্তিদের দাফন-সৎকারে সবার আগে এগিয়ে এসেছিলেন মহিউদ্দিন চৌধুরী।

এরশাদ সরকারের শাসনামলের শেষদিকে গ্রেফতার হয়েছিলেন মহিউদ্দিন চৌধুরী। এর প্রতিবাদে অচল হয়ে পড়েছিল পুরো চট্টগ্রাম। ১৯৯৬ সালেও তিনি গ্রেফতার হয়েছিলেন। মুহুর্তের মধ্যে প্রতিবাদে চট্টগ্রামের মানুষ নেমে পড়েছিল রাস্তায়।

মহিউদ্দিন চৌধুরী রাজনীতির পাশাপাশি মেয়র হিসেবেও সাফল্য দেখিয়েছেন। ১৯৯৪ সালে তিনি প্রথমবারের মতো চট্টগ্রাম সিটি করপোরেশনের মেয়র নির্বাচিত হন। পরিচ্ছন্নতাকর্মীদের তিনি ‘সেবক’ নাম দিয়েছিলেন। যখনই সাধারণ মানুষের অধিকার হরণ হয়েছে, চট্টলবীর গণমানুষের এই নেতা তাৎক্ষণিকভাবে তার প্রতিবাদ করেছেন।

১৯৯০ সাল থেকে প্রতিবছর বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের মৃত্যুবার্ষিকী উপলক্ষে গোপালগঞ্জের টুঙ্গিপাড়ায় মেজবানের আয়োজন করেন মহিউদ্দিন চৌধুরী। তার মৃত্যুর পর এবিএম মহিউদ্দিন চৌধুরী চ্যারিটেবল ফাউন্ডেশনের উদ্যোগে বর্তমানে এ আয়োজনে সমন্বয় করছেন তার বড় ছেলে আওয়ামী লীগের সাংগঠনিক সম্পাদক ও শিক্ষা উপমন্ত্রী ও সংসদ সদস্য ব্যারিস্টার মহিবুল হাসান চৌধুরী নওফেল। প্রতিবছর সেই মেজবানে খাওয়ানো হয় ৪০ হাজার মানুষকে।

মহিউদ্দিন চৌধুরী কখনও চট্টগ্রাম ছেড়ে থাকতে পারেননি। মন্ত্রী ও দলের প্রেসিডিয়াম সদস্য হওয়ার প্রস্তাব তিনি সানন্দে প্রত্যাখ্যান করেছেন। তিনি চট্টগ্রামবাসীকে নিজের আত্মীয়ের মতো ভালবাসতেন। ২০১৭ সালের ১৫ ডিসেম্বর হৃদযন্ত্র ও কিডনির জটিলতায় নগরের একটি হাসপাতালে তিনি শেষ নিঃশ্বাস ত্যাগ করেন। চট্টলদরদী এই মহান মানুষটিকে হারিয়ে সেদিন চট্টগ্রামবাসী কেঁদেছে, এখনও কাঁদছে তার গুণগ্রাহীরা।

Print Friendly, PDF & Email

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here