নিজস্ব প্রতিবেদক

গ্রামের স্কুল-কলেজে মানসম্মত শিক্ষক খুবই কম। এ ছাড়া শিক্ষক সংকট তো রয়েছেই। এমন বাস্তবতায় শহরের নামকরা শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের সেরা শিক্ষকদের কিছুদিনের জন্য ‘অতিথি শিক্ষক’ করে গ্রামে পাঠানোর প্রস্তাব এসেছে আসন্ন জেলা প্রশাসক (ডিসি) সম্মেলনে।

আগামী ১৪ জুলাই ডিসি সম্মেলন শুরু হবে। মন্ত্রিপরিষদ বিভাগ ও শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের সূত্র দৈনিক শিক্ষাকে জানায়, ‘সেরা শিক্ষকদের কিছু সময়ের জন্য গ্রামে পাঠালে গ্রামের স্কুলগুলোর শিক্ষার মান বৃদ্ধি পাবে। শিক্ষার্থীদেরও পড়াশোনায় আগ্রহ বৃদ্ধি পাবে।’ এমনটাই মনে করছেন ডিসিরা।

সূত্র জানায়, জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয়ের অধীনে সঠিক যাচাই-বাছাই ছাড়া চালুকৃত বেসরকারি টিচার্স ট্রেনিং কলেজ (টিটিসি) এবং বিএড কলেজ বন্ধ করার প্রস্তাব দিয়েছেন ঝিনাইদহের ডিসি।

তিনি বলেছেন, অধিকাংশ প্রতিষ্ঠান নামসর্বস্ব। শিক্ষকরা সরকারি টিটিসি থেকে যেভাবে প্রশিক্ষণ পান তা বেসরকারি টিটিসি থেকে ন্যূনতমও দেয়া হয় না। এতে সরকারি অর্থের অপচয় হচ্ছে। এরই মধ্যে অনুমতিপ্রাপ্ত প্রতিষ্ঠানের সক্ষমতা যাচাইয়ে জেলাপর্যায়ে কমিটি গঠন করার সুপারিশ করেছেন তিনি। শহরাঞ্চলের সেরা শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের শিক্ষকদের গ্রামাঞ্চলের শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে কিছু সময়ের জন্য পাঠানোর প্রস্তাব দিয়েছেন রংপুরের ডিসি। শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের সামনে দেয়াল ঘেঁষে মার্কেট তৈরি নিষিদ্ধ করার কথা বলেছেন ঢাকার ডিসি।

তিনি বলেছেন, মার্কেটের কারণে বিদ্যালয়ের পরিবেশ নষ্ট হয়। প্রধান শিক্ষক ও ম্যানেজিং কমিটির সদস্যরা এ মার্কেটের আয়-ব্যয় নিয়ে অনেক সময় ব্যয় করেন।

উপজেলা শিক্ষা কমিটি পুনর্গঠন করে উপজেলা পরিষদ চেয়ারম্যানকে উপদেষ্টা এবং ইউএনওকে সভাপতি করার প্রস্তাব দিয়েছেন ঝালকাঠির ডিসি। সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের শিক্ষকদের বদলির ক্ষেত্রে উপজেলা শিক্ষা কমিটির দায়িত্ব পুনর্বহালের জন্য সুপারিশ করেছেন কুমিল্লার ডিসি। এসব শিক্ষকের বদলি ইতোপূর্বে উপজেলা শিক্ষা কমিটির প্রস্তাবের পরিপ্রেক্ষিতে অনুমোদন করা হতো। বর্তমান বদলিতে উপজেলা শিক্ষা কমিটির কোনো সংশ্লিষ্টতা নেই।

আগামী রোববার থেকে শুরু হওয়া জেলা প্রশাসক (ডিসি) সম্মেলনে এ সব উপস্থাপন করা হবে বলে জানা গেছে। প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয়ে অনুষ্ঠেয় এই সম্মেলনের উদ্বোধন করবেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা।

পাঁচ দিনের এই সম্মেলনে বিভিন্ন মন্ত্রণালয় ও বিভাগের দায়িত্বপ্রাপ্ত উপদেষ্টা, মন্ত্রী, প্রতিমন্ত্রী, উপমন্ত্রী, সিনিয়র সচিব, সচিব এবং ভারপ্রাপ্ত সচিবদের কাছ থেকে প্রয়োজনীয় দিক নির্দেশনা নেবেন মাঠ প্রশাসনের কর্মকর্তারা। এছাড়া রাষ্ট্রপতির সঙ্গে বরাবরের মতই সৌজন্য সাক্ষাৎ এবং প্রয়োজনীয় নির্দেশনা নেবেন ডিসিরা। নতুন করে প্রধান বিচারপতির কাছ থেকে নির্দেশনা নেবেন ডিসিরা। এছাড়া তিন বাহিনীর প্রধানদের সঙ্গেও বৈঠক হবে ডিসিদের।

সংশ্লিষ্ট সূত্র জানায়, নির্বাহী ম্যাজিস্ট্রেটদের ক্ষমতা প্রদানের ফৌজদারি কার্যবিধির ৯৮,১০৮,১১০,১৪৪,১৪৫ ও ১৪৭ ধারা সংশোধন করা হবে। বর্তমানে এই ক্ষমতা সরকার ম্যাজিস্ট্রেটদের দিয়ে থাকেন। কোনো কর্মকর্তা বদলী হলে ক্ষমতা প্রদানে অনাকাঙ্ক্ষিত বিলম্ব ঘটে। কার্যবিধিতে সংশোধন করে তা সরকারের পাশাপাশি ডিসিও যাতে দিতে পারেন সেই ধারাযুক্ত করা হবে।

ডিসি অফিসের সার্বিক নিরাপত্তা, মোবাইল কোর্ট পরিচালনা এবং সার্কিট হাউসের নিরাপত্তার জন্য ডিসির অধীনে একটি বিশেষায়িত সার্বক্ষণিক পুলিশ ফোর্স দাবি করেছেন ডিসিরা। ডিসিদের যুক্তি হলো জেলার উন্নয়ন সমন্বয় সভা, আইন শৃঙ্খলা সভাসহ বিভিন্ন গুরুত্বপূর্ণ সভা অনুষ্ঠিত হয় ডিসি অফিসে। প্রতিদিন দেশি-বিদেশি উর্ধ্বতন কর্মকর্তা এবং বিদেশি প্রতিনিধিরা ডিসিদের সঙ্গে সাক্ষাতে আসেন। তাদের নিরাপত্তা জোরদার করা জরুরি। মোবাইল কোর্ট পরিচালনায় সব সময় পুলিশ ফোর্স পাওয়া যায় না। কারণ পুলিশ ফোর্সের সদস্যগণ আইন শৃঙ্খলা রক্ষায় ব্যস্ত থাকেন। ডিসির অধীনে পুলিশ ফোর্স থাকলে যে কোনো সময় নির্বাহী ম্যাজিস্ট্রেটরা যে কোনো অপরাধ দমণে ভ্রাম্যমান আদালত পরিচালনা করতে পারবেন।

এছাড়া ডিসিরা লিখেছেন, জেলা প্রশাসক কার্যালয়ে অবস্থিত বিচারিক আদালত সমূহের সার্বিক নিরাপত্তা রক্ষাসহ আইন শৃঙ্খলা রক্ষার স্বার্থে ডিসির অধীনে একটি বিশেষায়িত পুলিশ ফোর্স রাখা জরুরি।

জেলা প্রশাসকদের গাড়ির জ্বালানি তেলের সিলিং তুলে দেয়ার প্রস্তাব করেছেন ডিসিরা। সময়ের সঙ্গে পাল্লা দিয়ে ডিসিদের দায়িত্ব বেড়েছে। এছাড়া ভিভিআইপি কিংবা ভিআইপিদের যাতায়াতে অনেক বেশি প্রোটেকশনের দরকার হয় এবং জ্বালানি খরচও বাড়ে। অতএব ডিসিদের জ্বালারিন তেলের সিলিং বাড়াতে হবে। জেলা প্রশাসকের কার্যালয়ে বাবুর্চির পদ সৃষ্টির প্রস্তাব করা হয়েছে। কারণ ডিসিদের অনেক সময় আপ্যয়নের আয়োজন করতে হয়। ডিসির বাসভবনে কোনো বাবুর্চি না থাকায় সমস্যা হয়। আগ্নেয়াস্ত্র লাইসেন্স বই যুগোপযোগী করার প্রস্তাব করেছেন ডিসিরা। ব্রিটিশ আমলে যে ধরনের বইয়ের প্রচলন ছিলো এখনো তা বহাল আছে। পুরাতন পদ্ধতির বই ৪/৫ বছরের মধ্যে নষ্ট হয়ে যায়।

ডিসিরা লিখেছেন, পাসপোর্ট আকারের বই হলে বই নষ্ট হবে না। নতুন করে বই করা হলে এক পৃষ্ঠায় নবায়ন এবং অপর পৃষ্ঠায় পুলিশি প্রতিবেদন, গুলি ক্রয় ও খরচের হিসেবে লেখা থাকবে। এছাড়া প্রতিটি বইয়ে এবং পাতায় নিরাপত্তা প্রতীকসহ ক্রমিক নম্বার লেখা থাকলে লাইসেন্স জাল হওয়ার সুযোগ থাকবে না।

বিসিএস প্রশাসন একাডেমির পাঁচ মাসব্যাপী চলা আইন ও প্রশাসন বিষয়ক প্রশিক্ষণের সময় তিন মাস বাড়িয়ে আটমাস করে প্রশিক্ষণ শেষে একটি ডিপ্লোমা ডিগ্রি প্রদানের প্রস্তাব করেছেন ডিসিরা। এতে কর্মকর্তাদের কর্মদক্ষতা বাড়বে বলে মনে করছেন তারা।

মোবাইল কোর্টের জব্দকরা মালামাল রাখা, সংরক্ষণ, পরিবহণের জন্য অর্থ বরাদ্দ দরকার। এছাড়া জব্দকৃত মালামাল আনা নেয়ার জন্য শ্রমিকের মজুরি বরাদ্দ দেয়ার প্রস্তাব করেছেন। ক্যাডার কর্মকর্তাদের অন্যান্য প্রশিক্ষণের সঙ্গে প্রকল্প ব্যবস্থাপনা প্রশিক্ষণ অন্তর্ভুক্ত করার প্রস্তাব করা হয়েছে। নির্বাহী ম্যাজিস্ট্রেটদের মোবাইল কোর্ট পরিচালনার সুবিধার্থে স্থায়ী বেঞ্চ সহকারির পদ সৃষ্টির প্রস্তাব করা হয়েছে। এতে মোবাইল কোর্ট সংক্রান্ত সাংগঠনিক কাঠামো শক্তিশালী হবে।

মাদকবিরোধী অভিযান পরিচালনার সুবিধার্থে নতুন করে প্রণীত মাদক নিয়ন্ত্রণ আইন ২০১৮ মোবাইল কোর্ট আইনে তফসিলভুক্ত করার প্রস্তাব করেছেন তারা। মাদকাসক্ত গরিব জনগোষ্ঠিকে স্বাভাবিক জীবনে ফিরিয়ে আনতে এই সংক্রান্ত চিকিৎসা সহজ করার প্রস্তাব করেছেন ডিসিরা। উপজেলা পর্যায়ে ভূমি অফিসের ডিজিটাল রেকর্ড রুম নেই। ফলে গুরুত্বপূর্ণ সরকারি দলিল-দস্তাবেজ নষ্ট হচ্ছে। জনগণের ভোগান্তি বাড়ছে। দেওয়ানি মামলা সৃষ্টি হচ্ছে। বিশেষ সুবিধাভোগী শ্রেণী তৈরি হচ্ছে। এ অবস্থার উন্নয়নে ডিসিরা উপজেলা পর্যায়ে ডিজিটাল রেকর্ডরুম এবং রেকর্ড কিপারের পদ সৃষ্টির প্রস্তাব করেছেন। ই নামজারির জন্য সহকারি প্রোগ্রামারের পদ সৃজনের জন্য লিখেছেন ডিসিরা।

বছরে তিনটি ফসল উৎপাদন হয় এমন জমি রক্ষার প্রস্তাব করেছেন ডিসিরা। বিষয়টির ওপর একটি নতুন আইন প্রণয়নের প্রস্তাবও করেছেন তারা। উপজেলা পর্যায়ের ভূমি অফিস পাহারা দেয়ার জন্য দুইজন নৈশ প্রহরী নিয়োগের প্রস্তাব করেছেন ডিসিরা। ইউনিয়ন ভূমি সহকারি কর্মকর্তার জন্য মোটরসাইকেলের প্রস্তাব করা হয়েছে। তারা ভূমি রাজস্ব আদায়ে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেন।

দেশের প্রতিটি ইউনিয়নের প্রতিটি ওয়ার্ডে দুই করে গ্রাম পুলিশের পদ সৃষ্টির প্রস্তাব করেছেন ডিসিরা। তার মধ্যে একজন মহিলা গ্রাম পুলিশ থাকবে। ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যানরা মেয়াদ শেষ হওয়ার ৬ মাস কিংবা ১ বছর আগে উচ্চ আদালতে পাতানো মামলা দিয়ে দীর্ঘকাল দায়িত্বপালন করেন। এই অবস্থা থেকে বেরিয়ে আসতে মেয়াদ শেষ হওয়ার সঙ্গে সঙ্গে ইউনিয়ন পরিষদে প্রশাসক বসানোর প্রস্তাব করেছেন ডিসিরা।

সনাতন দলিল রেজিস্ট্রেশন পদ্ধতি তুলে দিয়ে ডিজিটাল দলিল রেজিস্ট্রেশন পদ্ধতি চালুর প্রস্তাব করেছেন ডিসিরা। এর ফলে মোহরারগণের অতিরিক্ত অর্থ আদায় বন্ধ হবে। দালালের দৌরাত্ম্য কমবে। দলিল রেজিস্ট্রেশন করতে গিয়ে সাধারণ মানুষ হয়রানি শিকার হচ্ছেন। হাইকোর্ট থেকে রিট পিটিশনের নোটিশ ও আর্জির কপি সংগ্রহ করা সময় সাপেক্ষ, শ্রম ও ব্যয়সাধ্য বিষয়। অনেক সময় এই নোটিশ যথা সময়ে না পাওয়ায় আপিল কিংবা জবাব যথাসময়ে দেয়া সম্ভব হয় না। এতে রাষ্ট্রীয় স্বার্থ বিঘ্ন হয়।

উচ্চ আদালতে সরকারি স্বার্থ সংশ্লিষ্ট মামলার সংখ্যা দিন দিন বড়ছে। সেই ক্ষেত্রে সর্বোচ্চ আদালতে দায়ের করা সরকারি স্বার্থ সংশ্লিষ্ট মামলা পরিচালনায় আন্তঃমন্ত্রণালয় সমন্বয় কমিটি করে পরিচালনা করার প্রস্তাবও করেছেন ডিসিরা। অ্যাটর্নি সার্ভিসে কর্মরত জিপি এবং এজিপিগণের চাকরি স্থায়ী না হওয়ায় তাদের জবাবদিহিতাও নাই। আইন কর্মকর্তা পরিবর্তনের ফলে অনেক সময় সরকারি স্বার্থ বিঘ্ন হয়। সেই ক্ষেত্রে স্থায়ী অ্যাটর্নী সার্ভিস চালুর সুপারিশ করা হয়েছে।

Print Friendly, PDF & Email

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here