প্রয়াত সাংসদ বীর মুক্তিযোদ্ধা মঈনুদ্দিন খান বাদলের প্রথম ম‍ৃত‍্যু বার্ষিকী স্মরণে


‌‌‌‌♦মনজুর আলম

‘তোমার সমাধি ফুলে ফুলে ঢাকা
কে বলে আজ তুমি নাই
তুমি আছো মন বলে তাই।।’

গৌরি প্রসন্ন মজুমদারের লেখা, শিল্পী শ্যামল মিত্রের সুর ও কন্ঠে গাওয়া এ গানটির মতো কারোই বিশ্বাস হয় না যে দেশের প্রখ‍্যাত পার্লামেন্টেরিয়ান প্রয়াত চট্টগ্রাম-৮ আসনের জননন্দিত সাংসদ বীর মুক্তিযোদ্ধা মঈনুদ্দিন খান বাদল আজ বেঁচে নেই।

জাগতিক অর্থে তিনি শারীরিকভাবে বেঁচে না থাকলেও তাঁর কৃতকর্মে তিনি মানুষের হৃদয়ে বেঁচে রয়েছেন, থাকবেন।


সাংসদ মঈনুদ্দিন খান বাদলের জীবদ্দশায় আলাপচারিতায় লেখক


সাংসদ হিসেবে তাঁর সময়ের গৃহীত উন্নয়ন প্রকল্পগুলোর কথা আসলেই মানুষ আজো শ্রদ্ধার সাথে স্মরণ করেন তাঁকে। যখন আরাকান সড়কের মিলিটারি ব্রীজ-কানুনগোপাড়া সড়ক উন্নয়নের প্রসঙ্গ আসে সেখানে মানুষ খুঁজে নেয় বাদলকে, বোয়ালখালীতে শতভাগ বিদ‍্যুতায়নেও আছেন তিনি, ফায়ার সার্ভিসের গাড়িগুলো যখন হুইসেল বাজিয়ে আগুন নেভাতে যায় তখন মানুষ বলে আ-হা এ ফায়ার সার্ভিসের জন‍্য বাদলের কতোই না অবদান, ভান্ডালজুড়ি ওয়াটার ট্রিটমেন্ট প্ল্যান্টের মতো এতো বড় একটি প্রকল্পের কাজ দেখে এলাকাবাসী গর্ভে বুক ফুলায়।

নদী তীরবর্তী এলাকায় এক সময় নির্ঘুম রাত কাটানো পরিবারগুলো এখনো আশীর্বাদ মনে করেন তাঁকে । কারণ তাঁর উদ‍্যোগে ভাঙ্গনরোধ হয়েছে, নির্মিত বাঁধে গড়ে উঠেছে মুক্তিযোদ্ধা রিভার ভিউ’র মত বিনোদন স্পট। যাতে প্রতিদিন দূরের-কাছের শতশত মানুষ স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেলতে ছুটে আসেন এখানে।

দেশ প্রেমিক বীর মুক্তিযোদ্ধাদের জন‍্য বোয়ালখালীতে গড়ে তোলা হয়েছে মুক্তিযোদ্ধা কমপ্লেক্সে। যার সু-উচ্চ ভবনটির পরতে পরতে লেগে আছে তাঁর অনেক স্মৃতি।

শাকপুরার জেলে পাড়ার বাদল কৈর্বত‍্য-পূর্ব গোমদণ্ডীর নিঃসন্তান বৃদ্ধা সখিনাদের মত হাজারো অসহায় এলাকাবাসি তাঁদের বুকফাটা আহাজারিতে বেঁচে আছেন প্রয়াত সাংসদ বাদল।

এছাড়া তাঁর নির্বাচনী এলাকার শহর অংশে, আশেকানে আউলিয়া ডিগ্রী কলেজ সরকারিকরণ, ষোলশহরে টেক্সটাইল এন্ড জুট ইনস্টিটিউট, মোহরায় বঙ্গবন্ধু মেরিটাইম ইউনিভার্সিটি, চান্দগাঁও এলাকায় এক হাজার কর্মজীবী নারীর বাসস্থান নির্মাণ, কর্ণফুলীর তীরে অত্যাধুনিক সরকারি গুদাম স্থাপনের কথা আসলেই সর্বাগ্রে উঠে আসে বাদলের কথা।

অনেক সাধ ছিল তাঁর, মৃত‍্যুর আগে স্বপ্নের কালুরঘাট সেতুটি স্বচক্ষে দেখে যাবেন, এ নিয়ে কতোই না আকুতি ছিল তাঁর, এ জন্য জাতীয় সংসদ হতে পদত‍্যাগেরও হুমকি দিয়েছিলেন তিনি, শেষ পর্যন্ত তা করে যেতে পারলেন না। তবে কালুরঘাট সেতুর কথা উঠেলেই লোকমুখে অনায়াসে চলে আসে তাঁর কথা। এলাকাবাসী বলেন শেষ পর্যন্ত কোন এক অশুভ শক্তির কাছে হেরে গেলেও আমুচিয়া-কড়লডেঙ্গা পাহাড়ি এলাকায় মুসলমানদের বু-আলী কালন্দর শাহ(রহ.) মাজার, সনাতন ধর্মাবলম্বীদের মেধস আশ্রম ও বৌদ্ধদের বোধিদ্রুম বিহারকে কেন্দ্র করে ত্রি-ধর্মের সন্নিবেশ ঘটিয়ে একটি আন্তর্জাতিক পর্যটন কেন্দ্র, অবহেলিত পাহাড়ি ভুমিতে পুলিশ ট্রেনিং সেন্টার ও আইটি ইনস্টিটিউট স্হাপন করতে আপ্রাণ চেষ্টায় করেছেন তিনি। এগিয়েও ছিলেন অনেকখানি। কিন্তু আজকের এ অশুভ দিন আর এগোতে দিলো না তাঁকে। গত বছরের এইদিন ৭ নভেম্বর ভারতের ব্যাঙ্গলোর নারায়ণা হাসপাতালে চিকিৎসাধীন অবস্থায় শেষ নিঃশ্বাস ত‍্যাগ করেন তিনি।

পিতা আহমদ উল্লাহ্ খান ও মা যতুমা খাতুন দম্পতির ঘরে বায়ান্নের ভাষা আন্দোলনের সূচনালগ্ন ২১ ফেব্রুয়ারিতে জন্ম নেয়া এ কৃতিপুরুষের শৈশব কাটে চট্টগ্রামের বোয়ালখালী উপজেলার সারোয়াতলী গ্রামে। পরে ছাত্রলীগের রাজনীতির সাথে জড়িত হয়ে ১৯৭১ সালে মুক্তিযুদ্ধে সক্রিয়ভাবে অংশ নেন। কথিত আছে, বাঙালিদের ওপর আক্রমণের জন্য পাকিস্তান থেকে আনা অস্ত্র চট্টগ্রাম বন্দরে সোয়াত জাহাজ থেকে খালাসের সময় প্রতিরোধের অন্যতম নেতৃত্বদাতা ছিলেন তিনি।

মুক্তিযুদ্ধ পরবর্তী সময়ে সমাজতান্ত্রিক রাজনীতির প্রতি আকৃষ্ট হয়ে পড়েন বাদল। জাসদ, বাসদ হয়ে পুনরায় জাসদে ফিরে এ দলের একাংশের কার্যকরী সভাপতি হন তিনি।

স্বৈরাচার বিরোধী আন্দোলনের সময় আওয়ামী লীগের নেতৃত্বে ১৪ দল গঠনেও বাদলের উল্লেখযোগ্য ভূমিকার প্রতিদান স্বরূপ ২০০৮ সালের জাতীয় সংসদ নির্বাচনে সব কিছুকে ছাপিয়ে চট্টগ্রাম-৭( বোয়ালখালী,চাঁন্দগাও – পাঁচলাইশ) আসনের নৌকা প্রতীক তুলে দেন শেখ হাসিনা তাঁর হাতে। সেই নির্বাচনে জয়ী হয়ে সংসদে বিচক্ষণতার পরিচয় দিয়ে সবার দৃষ্টি কাড়েন তিনি। এ সময় সংসদে অনলবর্ষী বক্তা ও দক্ষ পার্লামেন্টারিয়ান হিসেবে খ্যাতি লাভ করেন। এর পরবর্তিতে একই আসন থেকে নৌকা প্রতীকে পরপর আরো দু’বার সংসদ সদস্য নির্বাচিত হয়ে মৃত্যুকালীন সময় পর্যন্ত দায়িত্ব পালন করে এলাকাবাসির হৃদয়ের মনিকোঠায় ঠাঁই করে নিয়েছেন তিনি। যারা এখনো ভুলতে পারছেন না তাঁকে।

পরিশেষে বলি যেখানে -যে অবস্থায় আছেন ভালো থাকবেন বাদল ভাই।


লেখক – সাংবাদিক , শিক্ষক, বোয়ালখালী।

Print Friendly, PDF & Email

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here