স্কুল পর্যায়ে সারাদেশের একুশের প্রথম শহীদ মিনার কধুরখীল স্কুলে
নির্মানে বহিষ্কার হয়েছিলেন দু’জন ছাত্র
স্কুল পর্যায়ে সারা দেশের একুশের প্রথম শহীদ মিনার স্থাপিত হয় বোয়ালখালীর ঐতিহ্যবাহী কধুরখীল স্কুলে। যার জন্য দু’জন ছাত্র স্কুল থেকে বহিষ্কার হয়েছিলেন। এই শহীদ মিনারের ইতিবৃত্ত লিখেছেন বিশিষ্ট রাজনৈতিক নেতা সৈয়দুল আলম।
১৯৬৫ সাল। তৎকালীন পাকিস্তানে চলছে আইয়ুব- মোনায়েম শাহীর দৌরাত্ম।। কনভেনশন মুসলিম লীগের দুর্বৃত্তপনা। এমনি বিরাজমান পরিস্থিতিতে কধুরখীল উচ্চ বিদ্যালয়ের ছাত্রদের নেতৃত্বে সারা বোয়ালখালীর ছাত্রসমাজ ক্ষমতাসীন সরকারকে বিচলিত করে তুলেছিল। তারই ফলশ্রুতিতে স্থানীয় মুসলিম লীগ সমর্থবৃন্দ জোটপুকুর এলাকায় সৈয়দ জালালউদ্দীন সাহেবকে হত্যা করার প্রচেষ্টা চালায়। সাথে সাথে ছাত্রসমাজ জোড়ালো প্রতিবাদে মুখর করে তুলল সমগ্র বোয়ালখালী। ছাত্রদের জোরালো প্রতিরোধের মুখে তাদের প্রকাশ্য পদচারণা প্রায় বন্ধ হয়ে গিয়েছিল। এই অনুকুল পরিস্থিতির সুযোগ নিয়ে ছাত্র ইউনিয়ন বোয়ালখালী থানা শাখার সাধারণ সম্পাদকে দায়িত্বে নিয়োজিত ছিলাম আমি। তখন আইয়ুব মোনায়েম সরকারের দোর্দন্ড প্রতাপ চলছে। সারাদেশে আইয়ুুব শাহীর ঝান্ডা পথ পথ উড়ছে। তাদের কাছে শহীদ মিনার গড়া দেশদ্রোহীতার সামিল। ছাত্র ইউনিয়নের সভায় উপস্থাপিত প্রস্তাব সর্বসম্মতিক্রমে গৃহীত হলো। সেই সভায় উপস্থিত সবাই উৎপীড়ন, নির্যাতন, ভয়-ভীতিকে তুচ্ছ করে শহীদ মিনার গড়ার দীপ্ত শপথে উদ্দীপ্ত হলো। আমাদের সিদ্ধান্ত অনুযায়ী নিয়মতান্ত্রিক পথে প্রথমে বিদ্যালয় কর্তৃপক্ষের কাছে শহীদ মিনার নির্মাণের জন্য অনুমতি প্রার্থনা করেছিলাম। বিদ্যালয় কর্তৃপক্ষ অনুমতি দিলোনা বরং হুমকি প্রদর্শন করে বললেন কোন অবস্থায় আমাদের শহীদ মিনার করতে দেওয়া হবে না। কর্তৃপক্ষ আমাদের যুক্তি দিয়ে বিরত করতে চাইলেন। আমাদের বললেন বিদ্যালয়ে শহীদ মিনার করলে স্কুলের সরকারী অনুদান বন্ধ হয়ে যাবে। স্কুল সরকারের রোষানলে পড়বে। আবার আমরা বিবেচনায় বসলাম। কিন্তু সবাই সিদ্ধান্তে অটল, যে কোন ত্যাগের বিনিময়ে শহীদ মিনার করা হবে। আমাদের সম্ভাব্য প্রতিরোধ সমূহ আলোচনা করা হলো। উদ্ভাবিত সমস্যা সমূহের মোকাবিলা করার উপায় স্থির করা হলো। সকলের দৃষ্টিতে প্রাথমিক সমস্যা উত্তর আকুবদন্ডীর ইউ পি সদস্য কামাল উদ্দীন আহম্মদ ও দক্ষিণ আকুবদন্ডীর ইউপি সদস্য সৈয়দ জামাল উদ্দীন আহম্মদ। তাঁদের ঠেকিয়ে রাখতে পারলেই সব হয়ে যাবে। স্কুল কর্তৃপক্ষ আমাদের কিছুই করতে পারবেন না। কারণ তারা দুইজন ছিলেন সমাজের প্রভাবশালী ব্যক্তিত্ব। জনাব কামাল উদ্দীন আমার পিতা। তাই সঙ্গত কারণেই আমার বড় ভাই মাহাবুব ও আমার উপরই কামাল সাহেবকে ঠেকানোর দায়িত্ব পড়লো। আবুল হাসান সৈয়দ জামাল এর আদুরে ভাগনে। তাই তার উপর জামাল সাহেবকে ঠেকানোর দায়িত্ব ন্যস্ত হলো। সিদ্ধান্ত হলো ২০ শে ফেব্রুয়ারী রাতে, তোরণের প্রবেশের পর-পরই বরাবর কিছু বামে শহীদ মিনার করা হবে। কামাল সাহেবকে আমরা দুই ভাই কিছুটা ম্যানেজ করলাম। তাঁকে বুঝিয়ে দিলাম-তাঁর উপস্থিতিতে পিতা পুত্রের সংঘর্ষ অনিবার্য। তাছাড়া শান্ত ভাষায় বুঝাতে সক্ষম হয়েছিলাম। শহীদ মিনার করা কোন রাষ্ট্রদ্রোহিতা নয় বা ইসলাম বিরোধী কাজও নয়। অবশেষে মান্যবর পিতা কিছুটা নমনীয় হলেন। কিন্তু সম্মানীয় জামাল সাহেব? তাঁর ব্যাপারে আমাদের প্রচেষ্টাই ব্যর্থ হলো। অবশেষে সিদ্ধান্ত হলো- জামাল সাহেবকে ঠেকানোর শেষ উপায় হিসেবে রাত্রে রাস্তায় দিগম্বর স্ট্যাচু হয়ে দাঁড়িয়ে থাকতে হবে। সেই দায়িত্ব পালনকারী হলো আবুল হাসান। যথাযথ নির্দেশ পালনকারী আবুল হাসান রাত দশটা থেকেই কর্তব্য পালনের জন্য নির্দেশিত স্থানে হাজির হয়ে তার কর্তব্য পরায়ণতার পরিচয় দিয়েছিল। রাত প্রায় দশটা. জামাল সাহেব যথারীতি স্কুলের দিকে আসছিলেন, সাথে আরও দুইজন লোক ছিলেন যারা এ ঘটনার স্বাক্ষী হিসেবে এখনও বেঁচে আছেন। স্কুলের কাছাকাছি এলাকায় জামাল সাহেব। টর্চের আলো সামনের দিকে প্রসারিত করা মাত্রই দিগম্বর তবে মুখাবয়ব আবৃত মূর্তি দেখেই দলবল সহ এবাউট টার্ণ করলেন। সাকসেসফুল আবুল হাসান। অশেষ ধন্যবাদসহ হাস্যরসে মুখরিত হলো আমাদের সেই আপাততঃ বিজয় মুহুর্ত।
রাত ক্রমশই গভীরতর হচ্ছে। আমাদের অবস্থান মাঠে আর স্কুল কর্তৃপক্ষ ও শিক্ষকবৃন্দের অবস্থান স্কুলের সামনের বারান্দায়। তবে তৎকালীন প্রধান শিক্ষক কাজী… ছাবেরী সাহেব ঐ দিনের শহীদ মিনার গড়ার প্রতিরোধে উপস্থিত ছিলেন না। প্রতিরোধকারীরা মওলানা ইসমাইল সাহেবের নেতৃত্বে হ্যাজাক লাইট জ্বালিয়ে সামনের অফিসে বসে আছেন। তখন প্রধান শিক্ষক ছিলেন প্রয়াত বাবু ধীরেন্দ্র লাল মজুমদার মহাশয়। মাঝে মাঝে রাস্তায় আসেন। আমরা তখন মাঠের প্রান্তে কিছুটা আড়াল হয়ে যাই। এভাবে সারারাত ধরে ইঁদুর বিড়াল খেলা চললো। আমরা কোদাল নিয়ে এগিয়ে আসলে তারা এগিয়ে আসেন। আবার পেছনে সরে যাই। এমনিতেই রাত প্রায় শেষ হওয়ার – পথে। পূর্ব সিদ্ধান্ত মোতাবেক জালাল সাহেবের সরবরাহকৃত ইট ও আবদুল্লাহ আল-নোমান (তৎকালীন ছাত্র ইউনিয়ন জেলা কমিটির সভাপতি) এর দেওয়া শহীদ মিনারের পরিচিতি পাথর সবই আমাদের সাথেই আছে। আর সাথে সাথে আছে রাজমিস্ত্রী মরহুম বসির আহমদ।
পূর্ব দিগন্তে ঈষৎ আভা পরিলক্ষিত হচ্ছে। আমাদের প্রাণে হঠাৎ প্রতিরোধ ভাঙ্গণের প্রবল জোয়ার এসে পড়লো। আমাদেরই সাথী শাহজাদা সৈয়দ রেজাউল্লা আকবরী কোমরে লুঙ্গির গোছা দিয়ে কোদাল নিয়ে দীপ্ত তেজে এগিয়ে চললো। যথাস্থানে কোদাল চালানো। হৈ হৈ করে উচ্চসিত কণ্ঠে আমরাও সবাই তার সাথে কাজে লেগে গেলাম। ছাত্রদের রুদ্র ও বিপ্লবী মূর্তি দেখে সকল কর্তৃপক্ষ অবশেষে স্কুল এলাকা থেকে প্রস্থান করলেন। বিজয় উল্লাসের ভিতর দিয়ে তৈরী হলো বোয়ালখালী তথা স্কুল পর্যায়ে সারা দেশের একুশের প্রথম শহীদ মিনার। এই শহীদ মিনারের প্রাথমিক আকৃতি ছিল অনেকটা পিরামিডের মত। সকালের রৌদ্রের আলোয ঝলমল ছিল সেই দিনের সকাল। তার চেয়ে আরও উচ্ছাসে উল্লাসিত আমাদের কয়টি কিশোর প্রাণ। সকাল ধীরে ধীরে দুপুরে এগিয়ে যাচ্ছে। ক্রমে, ক্রমে লোকজন এসে জমা হতে লাগলো। লোক আসছে শহীদ মিনার দেখতে এবং শহীদদের প্রতি শ্রদ্ধা নিবেদন করতে। সন্ধ্যা প্রায় সমাগত। জনস্রোত জনসভায় রূপন্তরিত হলো। শুরু হলো বক্তৃতা, আবৃত্তি, গান। শহীদদের প্রতি নিবেদিত শ্রদ্ধায় সেই দিন হতেই সূচিত হয়েছিল কধুরখীল উচ্চ বিদ্যালয় তথা সমগ্র বোয়ালখালীর শহীদ মিনারে। এর পরে ১৯৬৮ সাল অবধি প্রতি বছরই স্কুলের সামনে এই মাঠে কেন্দ্রীয়ভাবে একুশ উদযাপন করা হয়েছে। এই একুশ মেলা সেই দিনের চেতনায় উদ্দীপ্ত হোক এ আমাদের পরম প্রত্যাশা। ২০শে ফেব্রুয়ারী সেই রাতে আমাদের সাথে যারা ছিলেন তারা হলো মরহুম আবুল হাসান, সৈয়দ নুরুল হুদা, (এই দুইজনকে শহীদ মিনার নির্মাণ কাজে নিয়োজিত থাকার জন্য স্কুল থেকে বহিষ্কার করা হয়)। মাহাবুব উল আলম, ফরিদ উদ্দীন জালাল, পিযুষ চৌধুরী, মিলন নাথ, যোগব্রত বিশ্বাস, আবদুছ সত্তার, দুলাল মজুদার, মোহাম্মদ আলী, আবুল কালাম আজাদ, ওসমান, এস.এম ইউছুফ, তসলিম উদ্দিন, জাকির হোসেন প্রমুখ।
তথ্য সূত্র- কধুরখীল স্কুলের প্রকাশনা- প্রাক্তসর