রমেন দাশগুপ্ত : সম্ভবত ২০০৫ সালের কথা। নিউমুরিং কনটেইনার টার্মিনাল (এনসিটি) পরিচালনা নিয়ে সভা হচ্ছিল চট্টগ্রাম বন্দরে। তৎকালীন নৌপরিবহন মন্ত্রী প্রয়াত বিএনপি নেতা আকবর হোসেন চৌধুরী ছিলেন সভায়। চট্টগ্রামের বিভিন্ন ট্রেডবডি, বন্দর ব্যবহারকারী সংগঠনের নেতারা ছিলেন। চট্টগ্রামের মেয়র হিসেবে এবিএম মহিউদ্দিন চৌধুরীও গিয়েছিলেন সেই সভায়। সেখানে ব্যবসায়ী নেতাদের সঙ্গে মহিউদ্দিনের মতদ্বৈততা হয় যা একপর্যায়ে বাকবিতণ্ডায় রূপ নেয়। মহিউদ্দিন প্রায় একাই, বিপরীতে বন্দর ব্যবহারকারীরা সবাই। বারবার টেবিল চাপড়ে হুংকার দিয়ে উঠছিলেন মহিউদ্দিন। হইচইয়ের মধ্যে মন্ত্রী বারবার হাত ধরে ‘মহিউদ্দিন ভাই, মহিউদ্দিন ভাই’ বলে তাঁকে শান্ত করার চেষ্টা করছিলেন। দমবার পাত্র নন তিনি। দাঁড়িয়ে গেলেন মন্ত্রীর সামনে। টেবিলে আঘাত করে বললেন, ‘মাননীয় মন্ত্রী, শুনে রাখুন। এটা চট্টগ্রাম বন্দরকে রক্ষার প্রশ্ন। চট্টগ্রামের স্বার্থের প্রশ্ন। আপনি যদি চট্টগ্রামের স্বার্থবিরোধী কোন সিদ্ধান্ত নেন, আমি মহিউদ্দিন চৌধুরী একাই আপনার বিরুদ্ধে রাস্তায় দাঁড়াব।’ এরপর তিনি একাই ‘মানি না, মানব না’ বলে স্লোগান দিতে দিতে সভাস্থল ছাড়েন।

আমি তখন একেবারে জুনিয়র একজন রিপোর্টার। কাজ করি দৈনিক সংবাদে। অবাক-বিস্ময়ে লক্ষ্য করলাম, একজন মানুষ একাই প্রতিবাদ করে কিভাবে পুরো সভাস্থলের সবার সামনে মাথা উঁচু করে বেরিয়ে যেতে পারেন? দেখলাম, একজন মানুষের হুঙ্কারে কিভাবে পুরো সভাস্থলে হঠাৎ পিনপতন নীরবতা নেমে আসতে পারে। সেসময় মহিউদ্দিন চৌধুরীর সেই প্রতিবাদ ভুল কি শুদ্ধ, সেটা বিবেচনা করা আমার মতো একজন জুনিয়র রিপোর্টারের পক্ষে সম্ভব ছিল না। কিন্তু দেখেছিলাম বিরোধীদলের একজন মেয়র হয়েও একজন বর্ষীয়ান রাজনীতিক ও সরকারের একজন প্রভাবশালী মন্ত্রীর সামনে টেবিল চাপড়ে কিভাবে বেরিয়ে আসা যায়!

আমার বেড়ে ওঠা গ্রামে। মহিউদ্দিন চৌধুরী যখন প্রথম মেয়র হন সেই ১৯৯৪ সালে, আমি তখন স্কুলছাত্র। গ্রামে বসেই উনার সাহস এবং সংগ্রামের গল্প শুনতাম। সেসময় আমাদের এলাকায় যারা রাজনীতিতে যুক্ত ছিলেন, তাদের মুখে শুনতাম কিভাবে মহিউদ্দিন চৌধুরী পুলিশের লাঠি, গুলি টিয়ার গ্যাসের সামনে বুক চিতিয়ে দিতেন। শুনতাম কিভাবে হাজার হাজার জনতা নিয়ে তিনি রাজপথ দখল করে ফেলতেন। শুনতাম তাঁর বজ্রকন্ঠের কথা। সেই কাহিনী যেন রূপকথার মতো! ৯৬ সালে অসহযোগ আন্দোলনের সময় মহিউদ্দিন চৌধুরী গ্রেফতার হলে পুরো চট্টগ্রাম দাবানলের মতো জ্বলে উঠেছিল। টেলিভিশন বলতে তো তখন শুধু ছিল বাংলাদেশ টেলিভিশন। বিটিভিতে অবশ্য সেই খবর ঠাঁই পেত না। স্কুলের পাশে বাজারের চায়ের দোকানে কিংবা সেলুনে পত্রিকা পেলে হুমড়ি খেয়ে পড়তাম।

এরপর মহিউদ্দিন চৌধুরী যখন চট্টগ্রাম বন্দরকে মার্কিন একটি বেসরকারী প্রতিষ্ঠানের হাতে তুলে দেওয়ার বিরুদ্ধে নিজের দলের সরকারের বিরুদ্ধে দাঁড়ালেন, তখন আমি এই শহরে কলেজ পড়ুয়া তরুণ। জামালখানে রাস্তায় মঞ্চ বানিয়ে নিজ দলের সরকারের বিরুদ্ধে পালন করা এক কর্মসূচিতে আমি ঝুম বৃষ্টিতে দাঁড়িয়ে দেখেছিলাম মহিউদ্দিন চৌধুরীকে।

আমি যখন সাংবাদিকতায় যুক্ত হই, তখন বিএনপির নেতৃত্বাধীন চারদলীয় জোট ক্ষমতায়। শহীদ মিনারে-লালদিঘীতে আওয়ামী লীগের বিভিন্ন কর্মসূচি কাভার করতে যেতাম। সেই জনসভায়, সেই সমাবেশে আমি মহিউদ্দিন চৌধুরীর রণহুঙ্কার দেখেছি। যেটা বিশ্বাস করতেন, সেটা অকপটে বলার কী দৃঢ়তা! কখনও হুঙ্কার দিতেন, আবার কখনও হালকা মেজাজে দেওয়া বক্তব্য শুনে হাসির রোল পড়ে যেত সভাস্থলে। কখনও আক্রমণাত্মক হয়ে, আবার কখনও রসিকতার ছলে সরকার এবং সরকারী দলের নেতাদের সমালোচনা করতেন। তবে অবশ্যই রাজনীতির স্বাভাবিক শিষ্টাচার বজায় রেখে। আমার এখনও মনে পড়ে, এই শহরে বিভিন্ন বয়সী মানুষের অনেক আড্ডায় প্রধান অনুষঙ্গ থাকত সভা-সমাবেশে মহিউদ্দিন চৌধুরীর দেওয়া বক্তব্য কিংবা আওয়ামী লীগের বর্ষীয়ান নেতা অথবা মেয়র হিসেবে তাঁর কর্মকাণ্ডের কথা।

২০০৫ সালে এবিএম মহিউদ্দিন চৌধুরী যখন আওয়ামী লীগের কঠিন সময়ে মেয়র পদে ভূমিধ্বস বিজয় পেয়েছিলেন, তখনও আমি ছিলাম দৈনিক সংবাদে। আমার উপর দায়িত্ব ছিল বিএনপির প্রার্থী মীর মোহাম্মদ নাছিরউদ্দিনের কর্মসূচি ফলো করা। সুতরাং মহিউদ্দিনের সামনে যাবার সুযোগ তখন হয়নি। তবে নির্বাচনের ফলাফল ঘোষণার রাতে জিমনেশিয়ামের সামনে শুনেছিলাম মহিউদ্দিনের বজ্রকন্ঠ। আমি ছিলাম ফলাফল ঘোষণাকেন্দ্রের ভেতরে। বক্তব্য রাখার সময় মহিউদ্দিন মাঝে মাঝে রিটার্নিং অফিসার গোলাম কুদ্দুসের নাম উল্লেখ করে ‘এই কুদ্দুস’ বলে চীৎকার করে উঠছিলেন, যেন বাঘের হুঙ্কার। ভোটের ফল ম্যাকানিজমের চিন্তা কারও ছিল কি না জানি না, তবে মহিউদ্দিনের চিৎকার শুনে নির্বাচন কর্মকর্তাদের অসহায় সেই মুখভঙ্গি এখনও মনে পড়ে। তবে চট্টগ্রামে আলোচনা ছিল, মহিউদ্দিন চৌধুরী সেদিন জিমনেশিয়াম ঘেরাও না করলে ফল উল্টে যেত।
তো, আমি তখন এতই কনিষ্ঠ গণমাধ্যম কর্মী যে, এবিএম মহিউদ্দিন চৌধুরীর পর্বতসম ব্যক্তিত্বের কারণে সাংবাদিকতা করেও তার কাছে দাঁড়ানোটা দুঃসাহস মনে করতাম।
২০০৬ সালে একদিন নগরীর এ কে খান মোড় এলাকায় চলছিল ১৪ দলের গণমিছিল কর্মসূচি। তোফায়েল আহমেদ, আব্দুল জলিল, রাশেদ খান মেনন, হাসানুল হক ইনুর মতো জাতীয় নেতারা ছিলেন সেই মিছিলে। কিন্তু সবাইকে ছাপিয়ে স্বমহিমায় উজ্জ্বল চট্টগ্রামের মহিউদ্দিন। গণমিছিল শুরুর পর একটি ট্রাকে উঠলেন জাতীয় নেতারা। আরেকটি ট্রাকে মাইক্রোফোন হাতে নিয়ে মহিউদ্দিন। প্রখর রোদের মধ্যে হাতে প্যাড আর কলম নিয়ে আমিসহ কয়েকজন সংবাদকর্মী ট্রাকের পেছনে গণমিছিলের আগে আগে হাঁটছিলাম। হঠাৎ ট্রাক থামালেন মহিউদ্দিন। মাইকে বললেন, ‘সাংবাদিক ভাইয়েরা ট্রাকে আসুন।’
আমরা ট্রাকে উঠলাম। একেবারে মহিউদ্দিন চৌধুরীর পাশের চেয়ারে আমি বসলাম। সেই প্রথম আমি মহিউদ্দিন চৌধুরীর মুখোমুখি। শুরুতেই বললেন, ‘ফ্যাক্টরি হননোয়াত আছ? বেতন-টেতন পও নি ?’ আমি ভ্যাবাচ্যাকা খেয়ে গেলাম। অর্থাৎ তিনি জানতে চাইলেন, ‘আমি কোন প্রতিষ্ঠানে কাজ করি ? বেতন ঠিকমতো দেয় কি না ?’ সাথের সিনিয়র সাংবাদিকরা মুখ টিপে হাসছিলেন। আমি উনার এই ধরনের আচরণের কথা আগে শুনলেও এই প্রথম সরাসরি নিজে প্রত্যক্ষ করলাম। নিচু স্বরে বললাম, ‘দৈনিক সংবাদে’। তিনি বললেন, ‘তুঁই কমিউনিস্ট না ?’ আমি হেসে বললাম, ‘না, রাজনীতি করি না।’ বললেন, ‘জারগোয়াই ন গইরজ্য, ইতারা কমিউনিস্ট ছাড়া ক্যঅরে চরি ন দে। কমিউনিস্ট পালিবু আর বেতন ন দিবু।’ (দুষ্টামি করো না। এরা (দৈনিক সংবাদ) কমিউনিস্ট ছাড়া কাউকে চাকরি দেয় না। কমিউনিস্ট পুষবে আর বেতন দেবে না।) আমার সঙ্গে কথা সেরে অন্য সাংবাদিকদের সঙ্গে হাসি-ঠাট্টায় মেতে উঠলেন। এরপর আবার কানের পাশে মুখ এনে বললেন, ‘বাসাত আইসসু। আঁত্তে ডায়বেটিস। আঁর বৌয়ে এত্তলাই আঁরে ভাত ন দে। ন হাবাই, ন হাবাই মারি ফালার। ইন এক্কানা লেখিত পারিবা না ?’ (বাসায় এসো। আমি ডায়াবেটিসে ভুগছি। সেজন্য আমার স্ত্রী আমাকে ভাত দেয় না। না খাইয়ে মেরে ফেলছে। এগুলো কি একটু লিখতে পারবে?) আমি হাসলাম।

তারপর তো চট্টগ্রামের রাজনীতিতে অনেক উত্থান-পতন। তৃতীয়বার মেয়রের চেয়ারে বসা মহিউদ্দিনের অনেক কর্মকাণ্ড তার অনেক ঘনিষ্ঠজন মেনে নিতে পারেননি। গণমাধ্যমের তীব্র সমালোচনার তীরেও বিদ্ধ হতে লাগলেন তিনি। এসময় মহিউদ্দিনের বিরুদ্ধে অনেক কর্মসূচি নিজেও কাভার করেছি। কিন্তু আমি বরাবর আন্দোলন-সংগ্রামের নায়ক মহিউদ্দিনকে তাঁর সেই জায়গাতেই রেখেছি। দেখেছি, অনেক সমালোচনার মধ্যেও মহিউদ্দিন যেমন ভাঙবার পাত্র নন, তেমনি চট্টগ্রামের রাজনীতি তাঁকে ঘিরেই আবর্তিত। সেসময় শাহ আমানত সেতু নির্মাণের বিরোধিতা করে ঝুলন্ত সেতুর দাবি করেছিলেন মহিউদ্দিন। সাথে সাথে তীব্র সমালোচনার মুখে পড়েছিলেন। এখন তো বলা হচ্ছে, এই সেতুর জন্যই কর্ণফুলী ভরাট হয়ে যাচ্ছে। তাহলে মহিউদ্দিনের অবস্থানই সঠিক ছিল। তবে আমার সেসময় মনে হত, শেষ মেয়াদে এসে উনি জনগণের ভাষা হয়তো বুঝতেন, কিন্তু জনগণকে নিজের ভাষাটা বোঝাতে সক্ষম হচ্ছিলেন না। তাই এতো সমালোচনা।

এরপর ওয়ান-ইলেভেন এলো। মহিউদ্দিন চৌধুরী জেলে গেলেন। দৈনিক আজাদী লিখল, ‘একটি নক্ষত্রের পতন।’ এর আগেই অবশ্য আমি যোগ দিয়েছিলাম রেডিও টুডেতে। মহিউদ্দিন চৌধুরী যখন জেলে ছিলেন, বিভিন্ন সময় উনার স্ত্রীর ইন্টারভিউ নিতাম। রেডিও টুডেতে প্রচার হত। একবার আদালতে হাজিরা দিতে আনা হল মহিউদ্দিনকে। কাঠগড়ার নিচে চেয়ারে উনাকে বসানো হল। উনার মেয়ে টুম্পা (প্রয়াত) এবং আমি একটি টুলে পাশাপাশি বসেছিলাম। আমার হাতে ছিল রেডিও টুডে’র ‍লোগোসহ বুম। কিছুটা অন্যমনস্ক ছিলাম। টুম্পা বললেন, ‘আপনাকে আব্বু ডাকছে।’ দেখি হাতের ইশারায় মহিউদ্দিন চৌধুরী আমাকে ডাকছেন। কাছে গেলাম। মহিউদ্দিন বললেন, ‘তুঁই হডে আছ ? হাতত (বুম দেখিয়ে) ইবা কি?’ (তুমি কোথায় আছ ? হাতে এটা কি ?) আমি বললাম, ‘রেডিও টুডেতে আছি। আগে দৈনিক সংবাদে ছিলাম।’ নাম জানতে চাইলেন। বললাম।

নাম শুনে চোখ কপালে তুলে বললেন, ‘আঁই ত তোঁয়ার নাম পইত্যোদিন আযইন্যা ফুনি। তুঁই ত রানাইয়্যার (অ্যাডভোকেট রানা দাশগুপ্ত) আত্মীয় ফাঁনলার।’ (আমি তো তোমার নাম প্রতিদিন সন্ধ্যায় শুনি। তুমি তো মনে হয় রানা দাশগুপ্তের আত্মীয়।) রেডিও টুডেতে প্রতিদিন সন্ধ্যা পৌনে ৭টায় খবর প্রচার হত। হয়ত জেলে বসে সেই খবর তিনি শুনতে পারতেন। অথবা হাসপাতালের বেডে শুয়ে শুনতেন। প্যাকেজ নিউজ হলে আমার নাম শোনা যেত। জেলে বসেই আমার নামটি তিনি মনে রেখেছিলেন। তবে কোনদিনই চেহারা মনে রাখতে পারেননি।

একসময় জেল থেকে বের হলেন। এরপর থেকেই অবশ্য উনার বাসায় আমার নিত্য যাতায়াত। গেলেই স্বভাবসুলভ প্রথমে গর্জে উঠতেন, ‘আঁই হন হথা হইতাম ন। সম্বাদিকতা দেহাইতা আইসসুযে না। ইন আঁই গরি আসসি। কাবিলতি ন মারি বই থাহ।’ (আমি কোন কথা বলব না। সাংবাদিকতা দেখাতে এসেছো নাকি। এগুলো আমি করে এসেছি। বসে থাক।) তবে আমি যখন নিজের নাম বলতাম, তাঁর গলার স্বর নরম হয়ে যেত। পাশে ডেকে বসাতেন। এরপর নিজের শয়নকক্ষে। পরম মমতায় পাশে বসিয়ে ভাত খাওয়াতেন। বলতে পারি, আমার অনেক নিউজের সোর্সও ছিলেন তিনি।

২০১০ সালে সিটি করপোরেশন নির্বাচনের আগে পেশাগত কাজে আমি এবং সহকর্মী বন্ধু মিন্টু চৌধুরী গেলাম মহিউদ্দিন চৌধুরীর বাসায়। আমি তখন বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কমে। কেউ নাম বলিনি। প্রতিষ্ঠানের পরিচয় দিতেই তীব্র প্রতিক্রিয়া জানালেন তিনি। চট্টগ্রামের ছেলে পরিচয় পেয়ে কেন আঞ্চলিক ভাষায় কথা বলছি না, এটাতে উনার চরম আপত্তি। উনি এমনভাবে রেগে গেলেন যে, আমাদের উঠে আসা উচিত ছিল। কিন্তু আমরা বসে ছিলাম। তিনি একটু শান্ত হলে কথা শুরু করলাম। একফাঁকে আমি নিজের নাম বললাম। পরে আমাদের সব প্রশ্নের উত্তর দিলেন এবং দুজনকে দুইদিকে বগলদাবা করে ভাত খাওয়াতে নিয়ে গেলেন।

মৃত্যুর মাসখানেক আগে ফৌজিয়া সুলতানা টুম্পার মৃত্যুবার্ষিকীতে উনার বাসায় দাওয়াত ছিল। মহিউদ্দিন চৌধুরীকে সামনে পাওয়া মানেই সংবাদকর্মীদের কাছে উনার মুখ থেকে কিছু বের করা এবং আলোচিত একটি নিউজ আইটেম নিয়ে অফিসে ফেরা। দৈনিক প্রথম আলোর সিনিয়র রিপোর্টার অগ্রজ প্রণব বল আর আমি গিয়েছিলাম একসাথে। একটি নিউজ আইটেম নিয়ে অফিসে ফেরার তাগিদে উনাকে বারবার বিরক্ত করতে লাগলাম কিছু বলার জন্য। বারবার তিনি নাকচ করছিলেন আর আমি অনুরোধ করেই যাচ্ছিলাম। শেষতক তিনি রেগে অগ্নিশর্মা হয়ে উঠলেন। বললেন, ‘তোঁয়ারে যদি আঁই উগ্গা চোয়ার মারিত ফাইরতাম।’ (তোমাকে যদি আমি একটি চড় মারতে পারতাম।) আমরাও আর কথা বাড়াইনি। তিনিও আর কিছু বলেননি। শেষ দেখা, শেষ আলাপ।

এখনও অবাক-বিস্ময়ে ভাবি, সেই উদ্যোম তারুণ্যের সময় থেকে একজন রাজনীতিকের তুচ্ছতাচ্ছিল্যভরা এসব বাক্যবাণ কিভাবে সহ্য করতাম! সেই কথার কাঁটার মধ্যেও কি অন্যরকম মমত্ববোধ ছিল না? হাতেগোণা দু’য়েকজন সাংবাদিক ছাড়া প্রায় সবার সঙ্গেই এমন করতেন। অনেকেই তো নীরবে সহ্য করতেন। কারণ, উনার পর্বতসম ব্যক্তিত্বের কাছে সবার মাথা নুয়ে আসত।

২০০৮ সালে আওয়ামী লীগ ক্ষমতায় আসার পর দলের অনেক নেতা মন্ত্রী-এমপি উনার তীব্র বিরোধিতায় নেমেছিলেন। মহিউদ্দিন চৌধুরী কখনও সেগুলো আমলে নিতেন, কখনও নিতেন না। কখনও বাসায় গেলে উনার বিরোধিতায় মুখর নেতাদের কথা তুলতাম। অধিকাংশ সময়ই তিনি সেগুলোকে পাত্তা না দেওয়ার মতো করে এড়িয়ে যেতেন। একবার, দু’বার উনার চেহারায় বিষন্নতার ছাপ দেখেছি। একবার আমার হাত ধরে বললেন, অমুককে খাতুনগঞ্জ থেকে ধরে এনে নেতা বানিয়েছেন। তমুককে দলের কেউ পাত্তা দিত না। তিনি পাশে রেখে দলের পদ-পদবি পাইয়ে দিয়েছেন, এমপি বানিয়েছেন। একজনকে মন্ত্রী করার জন্য দলের শীর্ষপর্যায়ের সঙ্গে উনার দেনদরবারের কথাও একদিন বলেছিলেন।

শেষবার মেয়র হওয়ার পর থেকে শুরু হওয়া গণমাধ্যমের অব্যাহত সমালোচনা ২০০৮ সালের জাতীয় নির্বাচনের পর আরও তীব্র রূপ পায়। একজন সংবাদকর্মী হিসেবে আমার কাছে এই সমালোচনা কখনো যৌক্তিক, কখনও মনে হয়েছে মহিউদ্দিন চৌধুরীর প্রতি অবিচার হচ্ছে। নিয়ত সমালোচনার কাঁটায় বিদ্ধ হলেও কখনো গণমাধ্যমে এক লাইনের প্রতিবাদ পাঠিয়েছেন, এরকম অন্তত শুনিনি।

২০১০ সালে সিটি করপোরেশন নির্বাচনে নিজের শিষ্য এম মনজুর আলমের কাছে হারলেন। ভোটের তিন-চারদিন পর একদিন উনার বাসায় গেলাম। বললেন, ‘তোঁয়ারার বিপ্লবী বিনোদ ব আর রানা ব আঁরে হারাই দিইয়ে।’ (তোমাদের বিপ্লবী বিনোদ বাবু এবং রানা বাবু আমাকে হারিয়ে দিয়েছেন।) নগরীর গোলপাহাড়ে পশুশালার একটি জায়গা নিয়ে বৃটিশ বিরোধী বিপ্লবী বিনোদ বিহারী চৌধুরী এবং আইনজীবী রানা দাশগুপ্তের সঙ্গে উনার বিরোধ তৈরি হয়েছিল। সেই প্রসঙ্গেই তিনি এমন কথা বলেছিলেন।

নিজ দলের নেতাদের বিরোধিতার প্রসঙ্গ তুললাম আমি। বিষন্ন সুরে বললেন, ‘রাজনীতিতে যাদের জনভিত্তি নেই, তাদের সম্বল হচ্ছে পতাকা, পদ-পদবি। আমি মহিউদ্দিন চৌধুরী। কেউ আমার বিরোধিতা করুক কিংবা আমার বিরুদ্ধে ষড়যন্ত্র করুক, আমার দরজা সবার জন্য খোলা। আমার পিছে পিছে থাকার জন্য তো কাউকে আমি নেতা বানাইনি।’

কত বিশাল হৃদয়ের রাজনীতিক হলে তিনি এই ধরনের কথা বলতে পারেন, সেটা এই সেলফি রাজনীতির যুগের নেতাকর্মীদের বোঝার কথা নয়। ক্ষমতা, লুটপাট আর দুর্বৃত্তায়নের রাজনীতিতে এই ধরনের মানসিকতা সম্পূর্ণ বেমানান। মাঝে মাঝে ভাবি, এই সেলফি যুগের রাজনীতিতে নিজেকে খাপ খাওয়াতে না পেরেই কি অভিমান করে চলে গেলেন মহিউদ্দিন চৌধুরী?

২০১৪ সালের ১ ডিসেম্বর মহিউদ্দিনের জন্মদিনে সাবেক ছাত্রনেতা ও কাউন্সিলর মামুনুর রশীদ মামুন তাঁর গলায় ফুলের মালা দিতে গিয়েছিলেন। বিভিন্ন বিতর্কিত ঘটনার পর মামুনকে দীর্ঘদিন সহজভাবে নেননি মহিউদ্দিন। মামুন মহিউদ্দিনের কাছে যাচ্ছেন শুনেই আমি এবং বাংলানিউজের ফটোসাংবাদিক সোহেল সরওয়ার প্রিমিয়ার বিশ্ববিদ্যালয়ের ক্যাম্পাসে উনার অফিসে যাই। ছবিসহ বিশদভাবে নিউজ করি, যেটা বেশ সমালোচনার মুখে ফেলে দিয়েছিল মহিউদ্দিনকে। উনার ঘনিষ্ঠ কয়েকজন আওয়ামী লীগ নেতা আমাকে ফোন করে বলেছিলেন, ‘তুমি মহিউদ্দিন ভাইয়ের সঙ্গে দেখা করো। উনি মনে কষ্ট পেয়েছেন। ক্ষুব্ধ হয়েছেন।’ ভয়ে ভয়ে আমি পরদিন সকালে চশমাহিলের বাসায় যাই। বাক্যবাণে জর্জরিত হবার প্রস্তুতি নিয়েই যাই। বসার ঘরভর্তি নেতাকর্মী। দরজা খুলে ঢোকার সাথে সাথে বললেন, ‘ইবা হন ?’ (এটা কে?) যুবলীগ নেতা ফরিদ মাহমুদ বললেন, ‘রমেন এসেছে। সাংবাদিক।’ মহিউদ্দিন চৌধুরী বললেন, ‘আসতক হাক্কু। আঁর ডাহদ্দি আসতক।’ (আসেন কাকা, আমার পাশে আসেন।) আমি পাশে গিয়ে বসলাম। বাসার ভেতরে নিজস্ব কর্মচারীদের দৃষ্টি আকর্ষণ করে বললেন, ‘অয় পোয়াঅল, মিষ্টি দে। কাক্কু কালিয়া আঁরে … দিইয়্যে।’ (এই ছেলেরা, মিষ্টি দাও। কাকা গতকাল আমার বিরুদ্ধে নিউজ করেছেন।) ঘরভর্তি নেতাকর্মীরা হেসে উঠলেন। আমিও হাসলাম। মহিউদ্দিন চৌধুরী হেসে বললেন, ‘আঁরে ছোড গইরত্যা যাইয়রে আরেকজনর উফার গরি ফালাইয়্যূ। দোয়া গরির, তুঁই যেন আরও বেশি লেহিত পার।’ (আমাকে ছোট করতে গিয়ে আরেকজনের উপকার করেছ। দোয়া করছি, তুমি যেন আরও বেশি লিখতে পার।)

২০১৫ সালের আগস্টে সিদ্ধান্ত নিলাম, বঙ্গবন্ধু হত্যার প্রতিবাদে মহিউদ্দিন চৌধুরীর অস্ত্র হাতে তুলে নেওয়ার সেই বীরত্বগাঁথা তুলে এনে একটি বিশদ রিপোর্ট করবো। বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কমের এডিটর ইন চীফ শ্রদ্ধেয় আলমগীর হোসেনের সঙ্গে পরামর্শ করলাম। শুনেই তিনি খুশি হলেন। উৎসাহ দিলেন, দিকনির্দেশনাও দিলেন। এক দুপুরে গেলাম মহিউদ্দিন চৌধুরীর বাসায়। সরাসরি বিষয়টা বললাম। যথারীতি তিনি রেগেমেগে আমাকে ভাত খাইয়ে বিদায় দিলেন। হতাশ হলাম। এডিটরকে বলে ফেলেছি। এখন যদি রিপোর্ট করতে না পারি, নিজেই লজ্জায় পড়ে যাব! তবে আমি হাল ছেড়ে দিইনি। মহিউদ্দিন চৌধুরীর ছেলে মহিবুল হাসান চৌধুরী নওফেলকে ফোন করলাম। তিনি বললেন, ‘আমার মার সঙ্গে কথা বলে আমি আব্বাকে রাজি করানোর চেষ্টা করব।’ দুই-তিনদিন পর নওফেল নিজেই ফোন করলেন। মহিউদ্দিন চৌধুরী রাজি হয়েছেন। রাত ১০টায় সময় ঠিক হল। আমি যথাসময়ে গেলাম। যাবার আগে নওফেলের পরামর্শে উনার আম্মা হাসিনা মহিউদ্দিনকে ফোন করলাম। আমি আর সোহেল সরওয়ার বসার ঘরে ঢুকলাম। একাই বসেছিলেন মহিউদ্দিন। পরিচয় দেওয়ার পর বললেন, ‘তোঁয়ার অঙ্গে তো দেইজ্জ্যি আঁর বৌঅর লয় ডাইরেক্ট লাইন। ইবারে পডাই ফেলাইয়্যূ।’ (তোমার সঙ্গে তো দেখি আমার স্ত্রীর ভালো সম্পর্ক। তাকে রাজি করিয়ে ফেলেছ।)

সেদিন রাত ১২টা পর্যন্ত কথা বললেন। তবে সব কথা মনে করতে পারলেন না। টানা আরও দুইদিন মুক্তিযোদ্ধা অমল মিত্রকে পাশে নিয়ে স্মৃতিচারণ করলেন সেই সংগ্রামমুখর দিনগুলোর। শেষদিন ইন্টারভিউ যখন শেষ করে আনছিলাম, বলতে বলতে হঠাৎ আবেগপ্রবণ হয়ে পড়লেন মহিউদ্দিন। সাধারণত কোন বাক্য তিনি সুন্দরভাবে গুছিয়ে বলতেন না। সেদিন গুছিয়ে বললেন, ‘বিপ্লবের পর প্রতিবিপ্লব হবে আমরা জানতাম। প্রতিবিপ্লব দমনের প্রস্তুতিও কিছুটা আমাদের ছিল। কিন্তু প্রতিবিপ্লবটা এতো তাড়াতাড়ি হয়ে যাবে আমরা বুঝতে পারিনি। আমরা বঙ্গবন্ধুকে বাঁচাতে পারিনি। আমাদের রাজনৈতিক জীবনের ব্যর্থতা সেটাই।’

এরপর তিনি দুই হাত দিয়ে চোখ ঢেকে ফেললেন। পুরো কক্ষে তখন পিনপতন নীরবতা। অমল মিত্রও চোখ মুছছিলেন। মেয়ে ফৌজিয়া সুলতানা টুম্পার মৃত্যুর পর মহিউদ্দিন চৌধুরীকে কাঁদতে দেখেছি। এবার দেখলাম বঙ্গবন্ধুর জন্য মহিউদ্দিনের কান্না। যে সিংহপুরুষের হুংকার শুনে আন্দোলিত হতেন লালদিঘীর মাঠের লক্ষ জনতা, মঞ্চের বাইরে তাঁর হৃদয় কতটা কোমল, কতটা মমতায় ভরা, আরেকবার প্রমাণ পেলাম।

শেষ করছি কয়েকটি বাক্য দিয়ে। মহিউদ্দিন চৌধুরী ফেরেশতা নন, দোষে-গুণে একজন মানুষ। সব যদি তাঁর গুণই থাকত, তাহলে তিনি মানুষ হতেন না, নাটক-সিনেমার কল্পিত চরিত্র হয়ে যেতেন। তিনি আজ নেই। এখন তিনি সকল আলোচনা-সমালোচনা, তর্ক-বিতর্কের উর্দ্ধে। মহিউদ্দিন চৌধুরীকে যখন ক্লিনিকে মৃত ঘোষণা করা হল, উনার দলেরই একজন সাবেক ছাত্রনেতা আমাকে ফোন করলেন। মহিউদ্দিন চৌধুরীর বিরোধীপক্ষে থাকা সাবেক এই ছাত্রনেতা ছিলেন তাঁর কট্টর সমালোচক। তিনি হাউমাউ করে কেঁদে বললেন, ‘মহিউদ্দিন ভাই নাই, মহিউদ্দিন ভাই নাই।’

ব্যক্তিবিশেষের চাহিদা বাস্তবায়ন করতে গিয়ে এই মানুষটির প্রতি অবিচার করতে অনেকেই দ্বিধাবোধ করেননি। মৃত্যুর পর সেই মানুষগুলোর অনেকের চোখেও আমি জল দেখেছি। একদিন আগেও যারা তার ধ্বংস কামনা করতে দ্বিধাবোধ করেননি, পৃথিবী থেকে বিদায় নেওয়ার পর তাদেরকেও চোখের জল ফেলতে বাধ্য করেছেন মহিউদ্দিন।
আপাদমস্তক একজন রাজনীতিবিদ আবুল বশর মোহাম্মদ মহিউদ্দিন চৌধুরীর জীবনের সবচেয়ে বড় সাফল্য এটাই।

(লেখক: সাংবাদিক রমেন দাশগুপ্ত)
Print Friendly, PDF & Email

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here