ইসমাইল জসীম

একজন প্রবাসীর মৃত্যু মানে একটি সভ্যতার পতন, একটি প্রজন্মের পতন। একটি নক্ষত্রের পতন। যাকে আমরা কথায় কথায় রেমিট্যান্স যোদ্ধা বলে অভিহিত করি। আমরা রেমিট্যান্স যোদ্ধা বলি সেই ব্যক্তিকে নয়, সেই ফরেন কারেন্সি উপার্জনের মেশিনটাকে। আমাদের সরকার এ মেশিনটাকে বাহবা দেয়, যোদ্ধা বলে সম্মান দেয়। কিন্তু এ মেশিন নামক ব্যক্তিটির মূল্য একজন কামলার সমতুল্যও নয়, তার কোন ইচ্ছা অনিচ্ছার গুরুত্ব থাকে না। তাকে বুঝার কেউ নেই, তার আবেগের কোন গুরুত্ব নেই, তার দেশাত্মবোধের কোন মূল্যায়ন নেই। একজন প্রবাসী মানে তার সুখ, সাধ, ইচ্ছা, আকাঙ্ক্ষা, আবেগ, জীবন যৌবন সবকিছু বিসর্জন দেয়। একটি সুন্দর সুখী সমৃদ্ধ পরিবারের জন্য, একটি দেশের জন্য। এ একটি মাত্র স্বপ্নের জন্য সে বঞ্চিত হয়, মা বাবার স্নেহ থেকে, স্ত্রীর ভালবাসা থেকে, সন্তানদের শৈশব থেকে। যে সময়ে তাকে স্ত্রীর পাশে থাকার কথা, যে সময়ে ছোট ছোট সন্তানদের নিয়ে খেলা করার কথা, কিম্বা মা বাবার সেবা করা বা তাদের শেষ যাত্রায় কাধে করে লাশ বহন করার কথা, সে সময় এ প্রবাসী নামক টাকা আয়ের মেশিন যন্ত্রদানব প্রবাসে মুখ লুকিয়ে বুক ফাটা কান্না করছে, তার কান্না কেউ শুনতে পায় না। শুনতে পেলেও সে কান্নার কোন মূল্যায়ন হয় না। পরিবার ও সরকার চায় কেবল টাকা আর টাকা। আজ করোনা মহামারীর কবলে পুরো বিশ্ব। সবাই এ করোনা নামক অদৃশ্য শক্তির কাছে অসহায়। আল্লাহ উপর ভরসা রেখেই যতটুকু বেঁচে থাকা। আমরা যারা প্রবাসে আছি। তারা আজ বড়ই অসহায়। আমাদের শোনার কেউ নেই, আমাদেরকে বুঝার কেউ নেই, আমাদের আবেগকে প্রকাশ করার কোন অবকাশ নেই। বিশেষকরে আমরা যারা আজ মধ্যপ্রাচ্য প্রবাসী। তারাতো কোন মানুষের কাতারেই নেই। তারা কেবল এক একটি যন্ত্রদানব মাত্র। প্রবাসীদের মধ্যে আজ সিংহভাগ প্রবাসী মধ্যপ্রাচ্যে। স্বাভাবিক ভাবে দেশের রেমিট্যান্সের সিংহভাগ আসে মধ্যপ্রাচ্য থেকেই। কিন্তু তাদের নিয়ে চিন্তা করার কেউ নেই। আজকের এ সংকটময় পরিস্থিতিতে রাষ্ট্র কিম্বা সরকার কেউও চিন্তা করে না তারা কেমন আছে, কোন অবস্থায় আছে? বলতে গেলে আজ এক তৃতীয়াংশ প্রবাসী মানবেতর জীবন যাপন করছে। তারা চাকরি হারা। যারা ব্যবসায়ী তারা আজ পথের ভিখারি। কেউ কি কখনো এসবের খবর রাখে? যাদের রেমিট্যান্সের বিনিময়ে আজ রিজার্ভ সন্তোষজনক, সরকারি কর্মকর্তারা গাড়ি বাড়ি করছেন, তারা তো ঘরে বসে বসে বিনা কর্মে বেতন নিয়ে দিব্যি আরাম আয়েশে আছেন। একবারও কি চিন্তা করেছেন সে সব প্রবাসীদের কথা যারা আজ চাকরিচ্যুত? দেশে চাকরি হারালে চাকরি পাওয়া যায়, না হয় ব্যবসাবাণিজ্য করা যায় নয়তো ভিক্ষা করা যায় কিন্তু এই প্রবাসে? এখানে প্রতিটি দেশে রয়েছে তাদের নিজস্ব সরকারি আইন কানুন। আপনার যা ইচ্ছে করতে পারেন না। চাকরি হারালে আপনার ইচ্ছেমত আরেকটি চাকরি নিতে পারেন না, ইচ্ছেমত ব্যবসা করতে পারেন না। অনেকাংশেই হাত পা বাধা। আমরা প্রবাসে হাত পা বাধা অবস্থায় প্রবাস নামক সাগরে সাঁতার কাটছি। এতো কিছু বলার পেছনে আমার একটিই উদ্দেশ্য। যা আমাকে আজ খুব ভাবিয়েছে। তা হলো এ পরিস্থিতি তে আমরা প্রতিনিয়তই হারাচ্ছি সেই সব রেমিট্যান্স যোদ্ধা নামক যন্ত্রদানবদের। সৌদি আরব প্রেক্ষিত যদি চিন্তা করি দেখা যায়। ছয়শতের কাছাকাছি নক্ষত্রের পতন হয়েছে এ ক’মাসে। সবাই কি করোনায় আক্রান্ত? না। অধিকাংশই দুশ্চিন্তা ও অনিশ্চিত ভবিষ্যতের চিন্তায় স্ট্রোক করে মারা যাচ্ছেন। অনেকেই আছেন লক্ষ লক্ষ রিয়াল লোকসান দিয়ে নিঃস্ব হয়ে, অনেকে চাকরি হারিয়ে আবার অনেকে আইনি জটিলতায়। আমরা যারা আজ চাকরি হারিয়ে দেশে ফেরার অপেক্ষায় আছি তারা ফিরতে পারছি না। এমন অনেকেই আছেন এ দীর্ঘ সময় চাকরি হারা হয়ে না খেয়ে আছেন, অসুখে ভোগছেন। অন্যদিকে তাদের পরিবার পরিজন আছেন চরম দুর্ভোগে। এদের সংখ্যা কিন্তু তেমন নগণ্য নয় যে, যা কিনা মাসে দুএকটি বিশেষ বিমান দিয়ে সমাধান করা যাবে। দেশ আমাদের আমরা দেশে যেতে চাই। আমরা দেশের মাটিতে মাথা রেখে মরতে চাই। বিদেশের মাটিতে নয়। আমরা বাঁচতে চাই পরিবার পরিজন নিয়ে। আমাদের বাঁচান। এ পর্যন্ত আমরা কত আপনজনকে হারালাম। প্রতিদিনই সকাল হতেই শুনতে পাই কারো না কারো মৃত্যু সংবাদ। আমরা শুনতে চাই না প্রবাসের মাটিতে কারো মৃত্যু। আজ সকালে এমন একজনের মৃত্যু আমাকে এসব লিখতে আমাকে বাধ্য করলো সে আর কেউ নয়, আমারই গ্রামের একজন, আমারই পাড়াত ভাই। আহমদ কবির। সৌদি আরবের দাম্মাম প্রবাসী। কত স্বপ্ন নিয়ে এসেছিল সে এ দেশে। একটু সুখের আশায়, একটু সমৃদ্ধির আশায়, নতুন প্রজন্মের উন্নত জীবনের আশায়। যে কি ছিলো তার পরিবারের প্রতিটি সদস্যের জন্য রিয়েল হিরো। একটি নক্ষত্র। আজ সব ধুলোয় মিশিয়ে দিয়ে সে আজ অন্যলোকের বাসিন্দা। তার মা কখনো সে ছেলের মুখ দেখতে পারবে না, স্ত্রী কখনো তার বুকের ভেতর একান্ত না বলা কথাগুলো বলতে পারবে না। কলিজার টুকরা সন্তানেরা কখনো বাবা বলে ডাকতে পারবে না। হয়তো ছোট সন্তানটা তার বাবা দেখতে কেমন সে স্মৃতিটুকু ধরে রাখতে না। বাবা আর আনবে না কোন খেলনাপাতি। বাবা ছুটিতে আর আসবে না, কাধের উপর উঠে ঘুরতে পারবে না, কিম্বা ঘোড়া বানিয়ে বাবার পিঠে আর চড়তে পারবে না।
আহমদ কবির এসব কিছুই আমরা কিম্বা সরকার কেউ ফিরিয়ে দিতে পারবো না। আল্লাহর কাছে প্রার্থনা করতে পারি। যেন তোমার পরিবার ধর্য্যশীল হয়, তোমাকে যেন জান্নাতবাসী করেন। আমিন।

Print Friendly, PDF & Email

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here